গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ৬ অক্টোবর, ২০১২

সরদার ফারুক



প্রত্যাবর্তনের দিন

          
        রেল লাইনের পাশের খালটাকে সবাই বলতো ফিটকিরির খাল । ফিটকিরি, খালটির ইজারাদার । শক্তপোক্ত চেহারা , চুল দাড়ি মায় ভুরুগুলো পর্যন্ত পাকা । কালো রঙের বিপরীতে ফটফটে সাদা চুল, দাড়ি, গোঁফ , ভুরু -মনে হতো স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে অল্টু স্যারের চকখড়ির আঁকিবুকি । ছেলেছোকরারা স্কুল পালিয়ে চুরি করে মাছ ধরতে আসতো খালে । ফিটকিরি টের পেলেই প্রাণ নিয়ে দৌড় । কতো বাহারী চিকন চিকন ছিপ , বাঁশ কেটে যত্ন করে বানানো , সাথে জোড়া বড়শি । মেথি আর রসগোল্লার রস মিশিয়ে তৈরী হতো চার । চারের গন্ধে ছুটে আসতো জামাই ভাজা পুঁটিমাছ - পেটের কাছে লম্বা লাল দাগ । খালের পশ্চিম পাড়ে ঘন জঙ্গল । জিগনি , বাবলা গাছের ফাঁকে ফাঁকে আশশ্যাওড়া , কুকুর শুকা ,ভাট আর আকন্দের ঝোপ । হঠাৎ কোথা থেকে বেরিয়ে আসতো নির্বিষ ঢোড়া অথবা হলদে কালোয় মেশানো সরু সরু হেলে সাপ । খুব বড়ো কালো প্রজাপতি আর হেলিকপ্টারের মতো দেখতে অজস্র ফড়িং, দুপুরের ঝিমধরা রোদে উড়াউড়ি করতো ।
         খালপাড়েই লালুদের বাড়ি । তারপর কোরবান মিয়ার জমি ছাড়ালেই পানি উন্নয়ন বোর্ডের পাচিল, তখন নাম ছিলো ওয়াপদা । অ্যাসবেস্টসের তৈরী চমৎকার বাড়িগুলোকে খেলনা বাড়ির মতো দেখতে । শীতের বিকেলে এক্সিকউটিভ ইঞ্জিনিয়ারের বাসার সামনে ব্যাডমিন্টন খেলা হতো । ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের শালী শিখা নাচের ছন্দে কর্ক ছুড়ে দিতো । তার খিলখিল হাসিতে তরুণদের বুক ভেঙে যেতো । হাভাতে ঘরের ছেলেপেলে - এরকম সাদা , নরম পরীর মতো মেয়ে কখনো দেখেনি ! শিখা একবার মুখে কুমকুম,চন্দন কিসব মেখে স্কুলের ফাংশনে নেচেছিল - ওগো বধু সুন্দরী , তুমি মধু মঞ্জরী । এতো গুণ আর এতো রূপ একসাথে ! দূর থেকে দেখাও কম কথা নয় । অর্ধভূক্ত কখনো অভূক্ত পেটে সারাদিন ফ্যা ফ্যা করে ঘোরা , বাড়ি ফিরলেই মা বাবার গালাগালি ; এর মধ্যেও শিখাকে দেখলে অনেকেই ক্ষুধা-তৃষ্ণার কথা ভুলে কেমন একটা ঘোরের মধ্যে দিন কাটাতো । যুদ্ধশেষে অজিতরা ফিরে এলো শরণার্থী শিবির থেকে । সাথে নিয়ে এলো জয়বাংলা রোগ আর হিন্দি ছবির গান । শিবিরের অস্বাস্হ্যকর পরিবেশে প্রায় সবারই চোখ ওঠা আর খোসপাচড়া রোগ হতো -লোকে ঠাট্টা করে বলতো জয়বাংলা রোগ । পুড়িয়ে দেয়া ঘরদোর কোনরকমে মেরামত করে অজিতদের পরিবার নতুন করে সবকিছু শুরু করলো । বড়দা নেপাল বিএ পাশ । চাকরি টাকরি না পেয়ে পানের দোকান দিলো স্টেশন রোডে । লজ্জা করলেতো পেট চলবেনা । তো এইসব অভাব- কষ্টের মধ্যেই অজিত সদ্য দেখা হিন্দি ছবির গান ধরতো -রেখা ও রেখা , জিসকো তুম দেখা ।অথবা - চল চল চল মেরা সাথী , ও মেরা হাতি। মোফাজ্জেল মিয়ার বাসার সামনে এলে অজিতের গলার স্বর একটু উঁচুতে । লক্ষ্য -মোফাজ্জেল সাহেবের ছোট মেয়ে মিলি । কখনো কখনো জানালাটা খুলে যেতো । পানপাতার মতো কিশোরী একটা মুখ সহসা উঁকি দিয়েই সরে যেতো । মুক্তিযোদ্ধারাও ফিরে আসছিলো দলে দলে । কাঁধে এস.এল.আর , এস.এম.জি ,ব্যাটাগান আর সাবেকী থ্রি নট থ্রি । কেউ কেউ সাথে করে নিয়ে এসেছিলো টু ইঞ্চ অথবা থ্রি ইঞ্চ মর্টারের তাজা শেল , মাইন , পিকে জেল । মাইনগুলো দেখতে অনেকটা কেরোসিন স্টোভের মতো ; হলদে মাখনের মতো দেখতে পিকে জেল । ডেটোনেটরের সাথে লম্বা তার লাগিয়ে বিস্ফোরণ ঘটানো হতো । লোকজনের মুখে মুখে তখন যুদ্ধের গল্প । থানা দখলের আগে কিভাবে রেলব্রীজ উড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো , কিভাবে অকুতোভয় পান্নাভাই গুলি করতে করতে এগিয়ে গিয়েছিলো ,আর পাকবাহিনীর বুলেটে তার মাথার খুলি উড়ে গিয়েছিলো -সারাদিন এইসব গল্প । যারা যুদ্ধে যায়নি তারাও কল্পনায় একেকজন বীর হয়ে উঠতো , “আমার এট্টু শ্বাসের দোষ  তা নাহলি আমুও শালাগের দ্যাকায় দিতাম বাঙালির সাতে লাগতি গেলি কি হয়’ !
         অজিতদের বাড়ির সামনের রাস্তার নাম রাখা হলো শহীদ স্মৃতি সড়ক ,সবখানে বাংলা নাম । নানা জায়গায় প্যান্ডেল বানিয়ে , হ্যাজাগ জ্বালিয়ে অনুষ্ঠান । শোনা যেতো -সালাম সালাম , হাজার সালাম , সকল শহীদ স্মরণে । দিনগুলো যেন খুব দ্রুত কেটে যেতে লাগলো । যতো দিন যাচ্ছিলো -মনে হচ্ছিলো লোকজন আস্তে আস্তে ম্রিয়মাণ হয়ে যাচ্ছে ।অভাবের তাড়নায় কউ আর আগের মতো উৎসাহ নিয়ে যুদ্ধদিনের গল্প শুনতে চাইতো না ।মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই আবার পুরনো দিনের মতো বেকার ।অস্ত্র জমা দেয়ার পর তারা যেন আগের চেয়েও সাধারণ হয়ে পড়েছে । গালে খোচা খোচা দাড়ি , চোখের কোণে কালি - আগের সেই স্বপ্নহীন , হতভাগ্য চেহারা ! যাত্রাপালার শেষে রাজার পোষাক খুলে নিলে যেভাবে নিতাইকে সেই নিতাই ময়রাই মনে হতো - ঠিক সেরকম । পরিবারের লোক ,প্রতিবেশী , যে কেউ তখন উপদেষ্টা - ‘থোও দিনি তুমার যুদ্ধির কতা , খাবানে কি , পরবানে কি , ভাইবে দেইকোছো’ ? বাজারে হঠাৎ করে চাল ডাল ,তেল নুনের অভাব । কি এক ভোজবাজীতে সবকিছু যেন উধাও । আর অনেক কষ্টে কিছু পাওয়া গেলেও দাম নাগালের বাইরে ।  ন্যায্যমূল্যের দোকানের সামনে বিরাট লাইন । সেখানে যে চাল দেয় তাতে বিকট দুর্গন্ধ আর কাঁকরে ভরা ।নিম্নমানের শাড়ি লুঙ্গি এতোই স্বচ্ছ -লোকে নাম দিয়েছে ল্যাংটাসুন্দর লুঙ্গি আর উলঙ্গবাহার শাড়ি । শান্তি কমিটির লোক আর রাজাকাররা কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে ছিলো । পরিস্হিতি বুঝে আস্তে আস্তে ফিরে আসছে । মানুষজন নিস্পৃহ দৃষ্টিতে ওদের দেখে । চোখের ক্রোধ ক্রমশ যেন নিভে এসেছে । এতো দ্রুত সব নিভে যেতে পারে , ভাবাই যায়নি ! এরিমধ্যে রাজাকারদের কেউ কেউ নেতাদের ছেলেমেয়েদের সাথে নিজেদের ছেলেমেয়ের বিয়ে দিয়ে আত্মীয় হয়ে বসেছে । পাশাপাশি গজিয়ে উঠেছে সিক্সটিনথ ডিভিশন । এরা যুদ্ধ করেনি । ১৬ ডিসেম্বরের পর রাজাকারদের অস্ত্র নিয়ে জমা দিয়েছে মিলিশিয়া ক্যাম্পে । অস্ত্র জমা দিয়েই প্রত্যেকে পেয়ে গেছে স্লিপ ।এরাই এখন শুরু করেছে ডাকাতি,লুটপাট ।মাড়োয়াড়িদের বিশাল বিশাল বাড়ি দখল করে মচ্ছব করছে । বদনাম হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের দালালেরা সুযোগ পেয়ে বলা শুরু করেছে - ‘কিসির স্বাধীনতা ? পাকিস্তানই ভালো ছেলো’ ।  দাদের মলম বিক্রেতা অথবা ট্রেনের কামরায় হাতকাটা মহাশংকর তেলের ক্যানভাসার গোপনে দুদশ টাকা পাচ্ছে । মজমার আগে হেড়ে গলায় ইন্দিরা গান্ধিকে নিয়ে জুড়ে দিচ্ছে আদিরসাত্মক গান । এদিকে অজিতদের তখন দুবেলা খাওয়াই জুটছেনা ঠিকমতো । একবেলা ছোলার ধাপড়া তো আরেক বেলা মিষ্টি আলু সেদ্ধ । ভাত যেন স্বর্গীয় সাদা সারস ! অজিতের মা মাঝে মাঝেই বলে ওঠেন -ওরে , তুরা আমারে ইন্ডিয়ারতে নিয়ে আসলি ক্যান ? ক্যাম্পেতো এরচে খারাপ ছেলাম না’ ! অজিতের বড়দার মুখ খুব খারাপ । পানের দোকানে বসে সারাদিন একে তাকে গালাগাল করে মনের ঝাল মেটায় । নেতাদের কাজকর্মে লোকজনের মতো সেও বিরক্ত । শোনা যায় নতুন এক দল তৈরী হয়েছে । তারা নাকি সমাজতন্ত্র কায়েম করবে । নেপাল লোকজনকে বোঝায় -বুইঝলে , সেকেনে সবাই সুমান । কেউ একলা একলা মজা মারবে , আর আমরা খাইটে মরবো- সেসব চুদুরবুদুর ওকেনে চলবেনানে’ । অনেকেই গোপনে গোপনে দলের খোঁজ নিচ্ছে । এদিকে পরিস্হিতি সামলাতে গঠন করা হয়েছে বিশেষ বাহিনী । মোসলেম ডাক্তারের বাড়ির সামনে ক্যাম্প বসলো । সেখান থেকে প্রায়ই মানুষের চিৎকারের আওয়াজ পাওয়া যেতে থাকে । যুদ্ধের দিনের মতো আবারো এখানে সেখানে ফুটফাট গোলাগুলির আওয়াজ । অনেকেই আবার আগের মতো আত্মগোপনে চলে গেলো । সাধারণ লোকজন কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলো না –‘একি খিজালত বোলো দিনি , দেশে হচ্চেডা কি ? যুইধ্য কি আর শেষ হবেনানে’ ?

          এইসব অশান্তির মধ্যেই সৈয়দপুর আর খুলনা থেকে আসে বিহারী মুন্না কাওয়াল আর পিয়ারু কাওয়াল । কয়েকদিন লোকজন ওদের নিয়ে মেতে ওঠে ।গলায় দুজনেরই খুব কালোয়াতি । ওস্তাদী গলায় মুন্না কাওয়াল রুপোর রাংতায় মোড়া হারমোনিয়াম বাজাতে বাজাতে গেয়ে ওঠে –‘শোনো চান্দা শোনো তারা , আ রাহা হ্যায় রবকা পেয়ারা - আজ খুশিয়া মানাও ……’। কয়েকজন শীর্ণকায় যুবক বেলবটম পরে কাওয়ালির সাথে টুইস্ট নাচ নাচে । কেউ কেউ ধেনো মদ অথবা গানের নেশায় কেয়া বাত ,কেয়া বাত বলতে বলতে টাকার মালা নিয়ে মুন্না কাওয়ালের গলায় পরায় পিয়ারুর গলা আরো মিষ্টি । ভাঙা ভাঙা গলায় অদ্ভুত মাদকতা । পানের পিক ফেলে শুরু করে - দমাদম মাস্ত কলন্দর । শ্রোতারা সামূদ্রিক ঝড়ের মতো -অভিশপ্ত বন্যার মতো উন্মত্ত হয়ে ওঠে । আবারো টাকার মালা আর হিজড়ে নাচ । মাঝে মাঝে স্কুলের মাঠে ফুটবল টুর্নামেন্ট হয় । পাবনার গোলকীপারকে হায়ার করে আনে সবুজ সংঘ । মার্কামারা দাঙ্গাবাজ জার্মান, বল্টু আর আক্কাসরা কাঠের শক্ত বাটওয়ালা ছাতা নিয়ে রেডি হয় । কি কারনে কখন যে গন্ডগোল শুরু হয় কেউ স্পষ্ট করে বলতে পারেনা । শুধু দেখা যায় হঠাৎ করে লোকজনের পিঠে গোটানো ছাতার বাট আঘাত পড়ছে । কে কার প্রতিপক্ষ ভালো করে বোঝার আগেই লোকজন ছত্রভঙ্গ্ হয়ে প্রাণপণে ছুটতে থাকে দিন যায় । অভাবের মধ্যে নানা ঘটনাবহুল দিন । এর মধ্যে একদিন শোনা যায় , ফিটকিরির খালে কার যেন লাশ ভেসে উঠেছে । সারা শহরের লোক ভেঙ্গে পড়ে খালের পাড়ে ,কিন্তু ভয়ে কেউ কাছে যেতে সাহস পায়না ।কার লাশ - নিজেদের কারো নয়তো ? রবি ডোম এসে লাশটাকে ডাঙায় তুললে স্পষ্ট চেনা যায় নেপালের মুখ । ঠোঁটের একপাশে পরিচিত কাটাদাগ ।নেপাল , অজিতের মা খবর পেয়ে ছুটে আসে ।বুক চাপড়ে বিলাপ করতে করতে বলে- কিসির জন্যি ফিইরে আলাম ,ও বাপ ,কিসির জন্যি ? ”