গঙ্গা-ভ্রমণ ও
ইলিশ-উৎসব
আজ সকালে আমাকে আর ঈশাণ চন্দ্রকে নিয়ে আমার পালিকা নৌ-ভ্রমণে গেছিলেন। সঙ্গে ছিল আমার বড় মেয়ে-জামাই, দেবশ্রী ও রাজীব।
আর ছিল কাজল,যে আমার দুই মেয়ে দেবশ্রী ও রাজশ্রীকে শিশুকাল থেকে পালন করেছে
এবং এখন আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। আর ছিল মৌসুমী নামে এক বালিকা,যে এখন ঈশান-পালিকা
! শুধু ছোট মেয়ে-জামাই, রাজশ্রী-প্রণব ছিল না বলে আমাদের বৃত্ত
অসম্পূর্ণ থাকার এক দুঃখ খুব কষ্ট দিয়েছে আমাদের ! সেই গঙ্গা ভ্রমণ শেষ করে একটু আগে ফিরলুম।
ফেয়ারলি প্লেসের ঘাট থেকে ছাড়ল লঞ্চ বেলা দশটা নাগাদ। প্রায় আশিজন আমরা একসঙ্গে। যে সংস্থাটি আমাদের নিয়ে এই ভ্রমনের আয়োজন করেছে, Travel Plus Howrah, তার ব্যবস্থাপকেরা প্রথমে শুরু করলেন আমাদের পারস্পরিক পরিচিতি জানাতে। এই অনুষ্ঠানের অন্যতম অজুহাত ছিল ইলিশ। তাই তাঁরা এর নাম দিয়েছিলেন 'ইলিশ-উৎসব' ! লঞ্চের পিছনে রান্নার আয়োজন, আর সামনে দু'পাশে আমরা বসে শুনছি গান,মাইক্রোফোনে। সে গান ছড়িয়ে যাচ্ছিল লঞ্চের বাইরেও, হয়তোপৌঁছে যাচ্ছিলো গঙ্গার দু পাড়ে ! লঞ্চ চলেছে, চলছে গান, quiz,নানা প্রতিযোগিতা। আমি সেই quiz এ প্রেমেন্দ্র মিত্রর ঘনাদার প্রথম গল্পের নাম 'মশা' বলে দিয়ে, ফাঁকতালে একটি প্রাইজ পেয়ে গেলুম ! আসলে দীপায়ন নামে প্রশ্নকারী যখন প্রশ্নটি করেছিলো, সেই সময়ে আমার পায়ে একটি মশা কামড়াচ্ছিলো, তাই খুব আস্তে বলেছিলুম , 'কি মশা' ! ব্যস, সেই মূহূর্তেই দীপায়ন,'সঠিক উত্তর' বলে আমার হাতে প্রাইজের পেনটি তুলে দিলে, আর সব লোক মহা হাততালি দিতে লাগলে, আর আমার কিছু বলাই হল না ! পরে আমি যখন দীপায়নকে আলাদা করে ব্যাপারটি বোঝাতে গেলুম যে ওই প্রাইজ আসলে আমাকে কামড়ানো সেই মশাটিরই পাওয়া উচিত, সে শুধু হাসতে লাগল, আর আমার ফোন নম্বর, ইমেল আইডি এইসব নিলে। মনে হল সে বোধহয় আমাকে একটু 'cultivate' করতে চায় ! কিন্তু ঈশানচন্দ্রের বোধহয় এইসব খুব একটা পছন্দ নয়,তাই সে 'নীচে জলে...নীচে জলে' বলে ,তাকে নিয়ে জলে নামতে আমাকে প্ররোচিত করেই চলল ! তখন সেই হাঙ্গামায় বাধ্য হয়ে, নীচের বদলে তাকে নিয়ে ওপরে হুইল-হাউসে উঠলুম লোহার সিঁড়ি বেয়ে। এইখানে কাঁচের ঘরে যে ভদ্রলোক হুইল চালাচ্ছিলেন, তাঁর সঙ্গে কিছুক্ষণের মধ্যেই সখ্য পাতিয়ে সে একটু হুইলও ঘুরিয়ে নিলে মহাখুসী হয়ে !
এদিকে দু'সপ্তাহ আগে ঈশাণ চন্দ্র পুরীতে তার আড়াই
বছরের দীর্ঘ জীবনে প্রথম একসঙ্গে এত জল দেখে এসেছে ,আর সাগর চিনেছে। স্বাভাবিক ভাবেই সে আজ
নদীকে সমুদ্র বলতে শুরু করেছিল। যখন তাকে বললুম,এ হল গঙ্গা, তখন প্রথমে তার একটু আপত্তির ভাব ছিল। পরে
অবিশ্যি সে আপত্তি আর খুব একটি ছিল না তার। আজ সে নৌকো চিনল, মাঝি, মাঝধরার জাল, আরো অনেক কিছু
জানলে। আর তার হাতের একটি
খেলনা টিয়াপাখি, যেটি তার মা বেলুড় মঠে নেমে এনে দিয়েছিল সবে, সেটিকে, যেমন করে সে তার
মা-বাবার বই দশতলার থেকে নীচে ফেলে দেয়, সেই ভাবেই গঙ্গায় বিসর্জন দিয়ে খুব আমোদ
পেয়েছে !আর তার এই কীর্তিতে যেই তার মা রেগে গেছে, সঙ্গে সঙ্গে যথারীতি, সে তার সুরেলা গলায়
আমায় বকতে শুরু করেছে,' দাদা, তুমি পাখি জলে ফেলে দিইইইলেএএএ ক্যায়ায়ানোওওওও...। লঞ্চ চলেছে গঙ্গার
বুকের মাঝখান দিয়ে। ডানদিকে পড়ল নানা সব ঘাট। নিমতলা ঘাট দেখে আমার জীবনের একমাত্র
ঠাকুরের স্মৃতি মনে এল। এটিই ছিল তাঁর জীবনের শেষ ষ্টেশন। বাঁদিকে উত্তরপাড়া, ভদ্রেশ্বর, নানা ঘাট, কত দুরে সব গাছপালা
ছবি যেন, ল্যান্ডস্কেপ।
এবার এসে পৌছলুম বেলুড় মঠের ঘাটে। নোঙ্গর পড়লো জলে। আরেকটি ঘটনা চোখে পড়ল আজ এই নৌ-ভ্রমনের সুবাদে। লঞ্চ যখন চলেছে
মাঝখান দিয়ে দু' পাড়কে বড়ো সুন্দর দেখিয়েছে ছবির মতই। শুধু যখনি কোন পাড়ের কাছে
গেছে, সেই পাড়কে দেখিয়েছে বড় কুশ্রী, আর উল্টোদিক বড়োই মনোময় সবুজ ! অথচ কত বড়
এক মিথ্যে এটি ! আমাদের জীবন-নদীতেও যখন বয়ে যাই আমরা, তখনো এই ঘটনাই ঘটে
বোধহয় ! এবার ইলিশ-উৎসব শুরু। ইলিশের মাথা দিয়ে কচুর শাক, তেলের সঙ্গে
ইলিশ-ভাজা, শর্ষে-ইলিশ,দই-ইলিশ,ইত্যাদি ইত্যাদি,ইলিশের পরাকাষ্ঠা !
আমার সেই সব রূপোলী-সুন্দরীদের জন্য এত মন খারাপ হল, আমি তাদের স্মৃতিতে শর্ষে-ইলিশ খেলুমই না, মনের দু;খে ! সবাই তাই শুনে
আমাকে খুব বাহা বাহা করতে লাগল। আমি ভাবছিলুম, এই সুযোগে যদি সবাইকে দিয়ে
ইলিশ-সুন্দরীদের আত্মার প্রতি দু' মিনিটের নীরবতা পালন করানো যায়, তা'হলে দু'শো মজা হবে !
কিন্তু আমার পালিকা ,যিনি আমায় নিয়ে সর্বদাই সন্দিহান থাকেন যে আমি কখন কি করে বসি, তিনি বোধহয় কিছু
আঁচ করে ,তাড়াতাড়ি খেয়ে ওঠার আদেশ জারী করলেন। আমার এই সৎ উদ্যোগ
একেবারেই মাঠে মারা গেল ! আর মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে আমার মেয়ে , কানে কানে চুপিচুপি
এসে বলে গেল ,'তোমার শর্ষেতে Allergy বলে তুমি শর্ষে-ইলিশ খেলে না, আর তাই নিয়ে সবাইকে
এমন নাচালে' ! সেই 'ঘরের শত্রু বিভীষন' বলে ইংরিজিতে একটা কথা আছে না, তার মানে এখন আবার
বুঝতে পারলুম নতুন করে।
এদিকে ঈশানচন্দ্র আবার হুইল-হাউসে যাবার বায়না
শুরু করেছে। আবার তাকে নিয়ে চললুম ওপরে। সেখানে চালক-ভদ্রলোক ছিলেন না, নীচে খেতে নেমেছেন
বোধহয়। তবে তাঁর দুটি ছোটো ছেলে-মেয়ে মহানন্দে হুইলটি ঘোরাচ্ছিল ! আমি দেখে আঁৎকে
উঠে তাদের এই প্রয়াস থেকে বিরত করতে চাইলুম, যাতে তাঁরা কিছু অঘটন না ঘটায়। তাতে তাঁরা
নির্বিকার ভাবে জানিয়ে দিলে যে আমার জলযান সম্পর্কে নাকি আদৌ বিন্দুমাত্র ধারনা
নেই, তাঁরা এই কর্ম প্রায়ই করে থাকে, এবং তাতে আজ পর্যন্ত কোন মহাভারত অশুদ্ধ
হয় নি ! তাদের কথার প্রত্যয় দেখে আমার আত্মবিশ্বাস আজ টলে গেল। কেন জানি না, মনে হতে লাগল, সত্যিই আমি বোধহয়
বিজ্ঞান ও ইঞ্জিনীয়ারিং বিষয়গুলি সত্যিই কিছু জানি না ! এই ব্যপারে অবিশ্যি আমার
নিজেরই বরাবর একটি সন্দেহ ছিল, আজ এই শিশুরা আমার সেই সন্দেহ যে সঠিক তা
প্রমান করে আমাকে একেবারে চিন্তামুক্ত করে খুব খুসি করে দিলে ! এই শিশুদুটি তার পরে মহা উৎসাহে আমাকে নৌ-বিজ্ঞান সম্পর্কে এমন
চিত্তাকর্ষক বহুকিছু শেখালে ,যা সারা জীবনে কোন ইঞ্জিনীয়ারিং বইতে পাওয়া যাবে
না। তাঁরা এও জানালে, এগুলি তাঁরা জন্মগত সূত্রেই জেনেছে ! তাদের সঙ্গে আমার আর
ঈশানচন্দ্রের এমন বন্ধুত্ব হয়ে গেল, তাঁরা আর আমাদের ছাড়তে চাইলে না, তারাও আমাদের সঙ্গে
নীচে নামলে !
এরপর সূর্যদেব তাঁর সাত-ঘোড়ার রথে শুরু করলেন
দিগন্তের দিকে যাত্রা। আমাদেরও শুরু হল ফেরা। ঊঠল নোঙ্গর, বন্দরের কাল হল শেষ
!
ফেরার পথে ঈশানচন্দ্র তেমন কিছু আর করে নি। শুধু ,আমরা যখন কোল্ড-ড্রিঙ্কস খাচ্ছিলুম, তখন 'আমাল গোলা বেথা,আমায় কোল-ডিঙ্কস দাও ' বলে সামান্য হামলা করে ঠিক আমার কাছ থেকে তা' আদায় করে খেয়ে, আমাকে একটু বকুনি খাইয়েছে !
এরপরে এসে নামলুম আবার ফেয়ারলির ঘাটে, তারপরে বাড়িতে ফেরৎ
। ঈশানচকাল আবার তার স্কুল আছে তো, তাই ! আমি এখন সেই মেঘ-পিওন, যার ব্যাগে মন-খারাপ থাকে দিস্তা দিস্তা, বিকেলে ঈশানচন্দ্র
চলে যাবার পরে যার মন খারাপ হয়ে কুয়াশা হয়েছিল, তা' এখন ব্যাকুল হয়ে তিস্তার মত বইছে তার মনে !
প্রার্থনা
গত কয়েকদিন জয়ার কাজে কেবলই ভুল হচ্ছে । এই যেমন গতকাল
অনিমেষের চায়ের কাপে ভুল করে চিনি দিয়ে দেওয়া , নুন ছাড়া উচ্ছেভাতে , তারপর পুকলুর টিফিনে সবজি দিতে ভুলে
যাওয়া এই সব । আহা ! কি কষ্ট করেই না
বেচারা শুধু শুকনো
পরোটা চিবিয়েছে । তাও আবার পরীক্ষার সময় ! হুম , আসল কথা এই পরীক্ষা । পুকলুর পরীক্ষাই জয়ার এইসব
ভুল কাজ কর্মের জন্যে দায়ী । পুকলু তার ক্লাসের সেরা ছাত্র , স্কুলের নাম অভিলাষ । টিচাররা প্রত্যেকেই তার প্রশংসায়
পঞ্চমুখ । পাঁচ বছর আগে জয়ারা যখন দক্ষিণ ভারতের এই ইষ্পাত কলোনিতে আসে তখন পুকলুর ক্লাস ফোর , শিশুটি, পুকলুর সেই
বয়েসের চেহারা জয়ার চোখে লেগে আছে এখনো । নতুন স্কুলে এসে পুরনো স্কুলের
বন্ধুদের জন্য তার কি কান্না ! সব , সব মনে আছে জয়ার ...। চায়ের জল
বসাতে বসাতে জয়া নিজের অজান্তেই হেসে ফেলে । সেই ছেলে এখন ক্লাস নাইন । বাধ্য , পড়াশুনোয় অত্যন্ত সিরিয়াস পুকলু আজ অবধি কখনো
সেকেন্ড হয়নি । এই যেমন আজ পুকলুর ফার্স্ট সামিটিভের শেষ পরীক্ষা, ম্যাথ্স
।
ঠিক রাত তিনটের সময় উঠে অঙ্ক করতে বসে গেছে পুকলু , সাথে জয়াও । দু কাপ চা বানিয়ে পুকলুর ঘরে এলো । ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো একবার । চায়ের কাপ হাতে নিলো পুকলু, চোখ লাল , হবেই তো । গত সাতদিন ছেলের নাওয়া , খাওয়া , ঘুম কোনো কিছুরই ঠিক নেই । জয়া জানে পুকলু নিজেই এবার খুব টেনশনে আছে পরীক্ষা নিয়ে । সেশনের শুরুতেই একটি মেয়ে জয়েন করেছে পুকলুদের ক্লাসে । দেবস্মিতা , দেবস্মিতা দত্তগুপ্ত । মেয়েটি অসাধারণ মেধাবী স্মার্ট তুখোড় । বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশনের পিকনিকে মিসেস দত্তগুপ্তর সাথে আলাপও হয়েছে জয়ার । ব্লান্ট চুল, স্মার্ট জিন্স টপে মুখর মহিলা । বাড়িতে ফিরে জয়া অনিমেষকে বলেছিল ওরা মা মেয়ে দুজনেই ভালো করে জানে কিভাবে লাইম লাইটে আসতে হয় । এখনো মনে আছে, অনিমেষ মৃদু স্বরে বলেছিল , আহা! তুমি তো মিঃ দত্তগুপ্তের চেয়ারটার কথা মনে রাখবে । জয়া থমকে গিয়েছিল । সত্যিইতো । তারা দুজনেই যাদবপুরের কৃতি ছাত্রছাত্রী । স্রেফ ভাগ্যের পরিহাসে অনিমেষ এখনো সিনিয়র ম্যানেজার আর জয়া তো কখনো চাকরিই করেনি । এখন নিজেই ভাবে কেমন ডাকসাইটে লিডার ছিলো জয়া রায় ... কতোটা অপরিহার্য ! “আমায় চা দেবে না”? সুদীপ উঠে পড়েছে । গ্যাসের একদিকে চা আর অন্যদিকে আলু ভাজা । দেবস্মিতা মেয়েটিকে নিয়ে পুকলু খুব চিন্তায় আছে । প্রতিটা ক্লাস টেস্টে পুকলু আর ও, পুকলুকে পেছনেও ফেলে দিয়েছে দেবস্মিতা । পুকলুর কপালের ভাঁজগুলো স্পষ্ট গুনতে পারছে জয়া । পুকলু – জয়ার একমাত্র অহংকার,আর এই কলোনিগুলোতে নানা রকম কম্পিটিশন ... চেহারা , স্বামীর পদমর্যাদা , গাড়ীর ব্র্যান্ড এমনকি বাড়িতে কজন কাজের লোক তা নিয়েও ।
ঠিক রাত তিনটের সময় উঠে অঙ্ক করতে বসে গেছে পুকলু , সাথে জয়াও । দু কাপ চা বানিয়ে পুকলুর ঘরে এলো । ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো একবার । চায়ের কাপ হাতে নিলো পুকলু, চোখ লাল , হবেই তো । গত সাতদিন ছেলের নাওয়া , খাওয়া , ঘুম কোনো কিছুরই ঠিক নেই । জয়া জানে পুকলু নিজেই এবার খুব টেনশনে আছে পরীক্ষা নিয়ে । সেশনের শুরুতেই একটি মেয়ে জয়েন করেছে পুকলুদের ক্লাসে । দেবস্মিতা , দেবস্মিতা দত্তগুপ্ত । মেয়েটি অসাধারণ মেধাবী স্মার্ট তুখোড় । বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশনের পিকনিকে মিসেস দত্তগুপ্তর সাথে আলাপও হয়েছে জয়ার । ব্লান্ট চুল, স্মার্ট জিন্স টপে মুখর মহিলা । বাড়িতে ফিরে জয়া অনিমেষকে বলেছিল ওরা মা মেয়ে দুজনেই ভালো করে জানে কিভাবে লাইম লাইটে আসতে হয় । এখনো মনে আছে, অনিমেষ মৃদু স্বরে বলেছিল , আহা! তুমি তো মিঃ দত্তগুপ্তের চেয়ারটার কথা মনে রাখবে । জয়া থমকে গিয়েছিল । সত্যিইতো । তারা দুজনেই যাদবপুরের কৃতি ছাত্রছাত্রী । স্রেফ ভাগ্যের পরিহাসে অনিমেষ এখনো সিনিয়র ম্যানেজার আর জয়া তো কখনো চাকরিই করেনি । এখন নিজেই ভাবে কেমন ডাকসাইটে লিডার ছিলো জয়া রায় ... কতোটা অপরিহার্য ! “আমায় চা দেবে না”? সুদীপ উঠে পড়েছে । গ্যাসের একদিকে চা আর অন্যদিকে আলু ভাজা । দেবস্মিতা মেয়েটিকে নিয়ে পুকলু খুব চিন্তায় আছে । প্রতিটা ক্লাস টেস্টে পুকলু আর ও, পুকলুকে পেছনেও ফেলে দিয়েছে দেবস্মিতা । পুকলুর কপালের ভাঁজগুলো স্পষ্ট গুনতে পারছে জয়া । পুকলু – জয়ার একমাত্র অহংকার,আর এই কলোনিগুলোতে নানা রকম কম্পিটিশন ... চেহারা , স্বামীর পদমর্যাদা , গাড়ীর ব্র্যান্ড এমনকি বাড়িতে কজন কাজের লোক তা নিয়েও ।
জয়া সব কিছুতেই
হেরে বসে আছে শুরু থেকে । একমাত্র পুকলুর কারণেই লোকে তাদের অন্য নজরে
দেখে , স্কুলের টিচাররা সমীহ
করে । পেরেন্টস মিটিঙে গিয়ে জয়ার মনে হয় ... সে যেন যাদবপুরে । হাতে
মাইক । জয়া বক্তৃতা দিচ্ছে ... হাততালিতে ভরে উঠছে বাতাস ...জয়ার গলায় বিশ্বাসের
জোর । কে বলবে , যাদবপুরের পাঁচটি এসএফআইয়ের
কোর কমিটির মিটিং এ প্রায় সমান সমান । কয়েক ক্ষেত্রে দৃঢ়তা
...না , আমাদের কিছুই দেখতে
হয়না । অভিলাষ একাই যথেষ্ঠ ... হি উইল শাইন ! হি মাস্ট ...কিন্তু এবার খুব ভয় করছে
জয়ার । এই সম্মানটুকু যেন কেড়ে নেবে ওই দেবস্মিতা নামের মেয়েটা । পুকলুর টিফিন বক্স
গুছিয়ে পুকলুর ব্যাগে ভরেছে সবে এমন সময় ফোন । রাগ হয়ে গেল জয়ার । এই সময়ে কে ফোন করতে
পারে ...হুম্ , বল কি হোলো
এই সকাল বেলায় , বিরক্তিটুকু
চেপে রাখতে পারে না জয়া। ওপারে মধুজা । অত্যন্ত উত্তেজিত, জানো ধাক্কা
খেয়েছে দেওয়ালে । মাথা ফেটে রক্তারক্তি ... কর্তা গিন্নি মেয়ে নিয়ে ছুটলো হসপিটাল আমার বরও
সাথে গেলো ওদের । আহারে ! মেয়েটা কি কাঁদছিল ... আজকেই শেষ পরীক্ষা ... এতো খারাপ
লাগছে ... পরীক্ষাটাই হয়তো দিতেই পারবে না ...এখনি তো সোয়া সাতটা, তুইতো বেরবি এখন পুকলুকে
নিয়ে ... রাখি এখন । কি হয়েছে ... দেবস্মিতা বাথরুমে পড়ে
গেছে... ,মাথা..., তুই তো… জয়ার মুখও
কেমন মেঘ । “কার ফোন মা”
? পুকলুর এলোমেলো চুল ঠিক করতে করতে জয়া
ভাবছে পুকলুর মুখে এত অন্ধকার কেন ? ছেলেকে বলে “ঘাবড়ে যাবে
না একদম , কোনো ভয় নেই” । জয়া আলোকিত হচ্ছে ক্রমশ ঠিক যেভাবে একদা মঞ্চে মিটিং’এ
অনশনে হতো ...। ছেলের
ব্যাগটা কাঁধে তুলে নেয় । এতোটুকু ভারও ছেলেকে বইতে দেবে না জয়া । মিনিট দশের পথ ।
অন্যদিন অনিমেষই পৌঁছে দ্যায় স্কুটারে । আজ
জয়া পৌঁছতে এসেছে । সে একেবারে নিজের চোখে দেখে নিশ্চিন্ত হতে চায় । স্কুলে
ঢোকবার আগে জয়াকে প্রণাম করার জন্য পুকলু নিচু হয় । জয়া ছেলের মাথায় হাত রাখে , “কি বলেছি
মনে আছে তো ? তুমি ফার্স্ট হবে এবারো , প্রতিটা অঙ্ক ভালো করে চেক্ করবে , বারবার ...এমসিক্যু গুলো ...খুব
সাবধানে” । এক দঙ্গল ছেলের মধ্যে পুকলু মিশে গেল
...।
জয়া দাঁড়িয়েই আছে গেটের পাশে বোগেনভেলিয়া গাছের কাছটিতে ঢুকছে , ফার্স্ট বেল ... কোয়েশ্চেন পেপার
দেওয়া হচ্ছে নিশ্চয়ই ... হিসেব করছে জয়া , হাসপাতাল পৌঁছতে
আধঘণ্টা তারপর ডাক্তার ...ওষুধ স্টীচ্ ..... এক ঘণ্টার ওপর ...আবার ফিরতে আধ ঘণ্টা ...। রেল গেট বন্ধ থাকলে আরো বেশি সময় লাগবে ।জয়া ঈশ্বর মানে না , বিশ্বাস করার প্রশ্নই নেই ...। তবু এই একদা
কট্টর মার্ক্সবাদী তুখোড় ছাত্রনেত্রী
এই মুহূর্তে ‘হে ইশ্বর , মেয়েটা যেন এসে পৌঁছতে না পারে ...’।
সেই ছবি
জানালার কপাটগুলো এক
হতে চাইছে যতবার, রিমি ততবার তাদের আলাদা করে দিচ্ছে – যেন তাদের মিলনে বিভাজক
। বৃষ্টির একটা ঝাপটা এসে তার টেবিলের বইগুলো ভিজিয়ে দিয়ে গেলো – সাবধান! এখনও অনেক
অস্ত্র বাকি! রিমি মোমবাতি জ্বালিয়ে একটা বই নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। গতকাল
রাতে শমীকের সাথে যখন কথা বলছিল ফোনে, তখন আকাশ পরিষ্কার
ক্যানভাস – এঁকে দেওয়া যায় মনের সব রঙ । একপাশে ক্যানভাসের উপরে চাঁদ এসে আলো ফেলছিল যাতে
তুলির টান পড়ে ঠিকঠাক। শমীকের আদৌ চাকরি করার ইচ্ছে আছে কিনা রিমির সন্দেহ আছে।
সারাদিন পড়ে থাকে রঙ – তুলি নিয়ে। জোর করে
কাউকে উঠিয়ে দেওয়া যায় না ; আর তাই রিমিও বাধ্য
হয়ে বলা ছেড়ে দিয়েছে। গল্প অনেকটা পড়া শেষ, রিমি কালকের কথাগুলো
মনে করতে করতে চোখ বুজল কিন্তু কপালে কোন ভাঁজ ছিল না তার।অনেকক্ষণ এপাশ ওপাশ করেও
ঘুম এলো না। “ আচ্ছা, এভাবে হয় নাকি সম্পর্ক? কাল আমি আমার পরিবারকে
কি জবাব দেবো? নানা, আমি ঠিকই করেছি ওঁর সাথে সম্পর্ক শেষ করে দিয়ে, তাছাড়া আমার তো নিজেরও
জীবন বলে কিছু আছে! “ ওর মনে একটা কুঁড়ি
অত্যন্ত দ্রুত ফুটে উঠল যখন আশেপাশে ধূধূ বালিয়াড়ি।
শমীক ব্যাগটা গুছিয়ে নিল, ওর ট্রেনের সময় হয়ে
গেছে। আজ রাতে রওনা দিতে হবে কলকাতা। কাল সকালে ওর ছবির প্রথম প্রদর্শনী আছে। অনেক
কষ্ট করে টাকা যোগাড় করেছে এই এতকিছু ব্যবস্থা করতে। চারদিকে বৃষ্টির শব্দে কান
পাতা দায়। শমীক বাড়ী থেকে ছাতা খুলে যখন বেরোল তখন তার পিঠে প্রবল বাতাসের
ধাক্কা। পথ চলতে তেমন অসুবিধে হচ্ছিল না বরং তার গতি আরও বেড়ে যাচ্ছিল। শমীক
মোবাইল বের করে রিমিকে ফোন করতে গিয়ে দেখে সুইচ অফ করা । এই বৃষ্টিও অনেক
বিশ্বস্ত হয় – অনেক জল ধুয়ে চলে যায়।
রিমি কোন কাজ না পেয়ে
একটা প্রবন্ধ লিখতে বসল – ‘ মায়ের বুক থেকে তার
সন্তানকে ছিনিয়ে নিলে মায়ের বুক যেমন খালি হয়ে কান্নায় ভেসে যায়, তেমনি প্রকৃতির কোল
থেকে আমরা গাছ কেটে নিজেদের সর্বনাশ দেখতে উদ্যত। সময় থাকতে যদি বৃক্ষরোপণ
সম্পর্কে আমরা সচেতন না হই তবে......’ হঠাৎ একটা বিদ্যুতের
শব্দে ঘর আলোয় ভোরে গেলো। রিমি মোবাইলের সুইচ অন করে শমীককে ফোন করার চেষ্টা করতে
লাগলো... অনেকবার চেষ্টা করার পর যখন রিং হল তখন আচমকা আর একটা বিদ্যুৎ এসে
মোবাইলের নেটওয়ার্ক ছিনিয়ে নিয়ে চলে গেলো কিন্তু এই বিদ্যুতের কোন আলো ছিল না ।
শমীক তার প্রথম
প্রদর্শনীতেই আঁকিয়ে মহলে পরিচিতি পেয়ে গেলো। কয়েকমাস কেটে গেছে – শমীক গত চারমাস ধরে
একটা ছবি আঁকছে। এই ছবির জন্য অনেক পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও, অনেক টাকার হাতছানি
সত্ত্বেও সে তার নিজের ঘরের দেওয়ালে রেখে দিল – শুধু নিজের জন্য। তার
আদর, আবদার, হাসি, কান্না সব দেখেছে ওই ছবিটা। এখনও ঝড় ওঠে কিন্তু ছবিটা ; শুধু ছবি হয়ে থাকে না।
ফাল্গুনি মুখোপাধ্যায়
[গল্পটা প্রায় ৩৫ বছর আগে ১৯৭৮এ লেখা ৭৯ও হতে পারে । তখন সবে - একবছর আগে ‘জরুরী অবস্থা’র কৃষ্ণ প্রহর শেষ হয়েছে , আগুয়ান মানুষের কন্ঠরোধ প্রক্রিয়ার স্মৃতি তখনও বেশ টাটকা । গল্প নিশ্চিত ভাবেই সময়ের দলিল । সেই ভেবেই গল্পটির পুণঃপ্রকাশ করলাম । গল্পটি অধুনা লুপ্ত একটি ছোট পত্রিকায় ছাপা
হয়েছিল ১৯৮২তে।]
দৃশ্যটা এইরকম । একটা বন্দুকের নল তার
কন্ঠনালীর সঙ্গে প্রায় ঠেকান রয়েছে । লোকটাকে চেনা চেনা মনে হচ্ছে কিন্তু ঠিক ঠাওর
করা যাচ্ছেনা। চীৎকার করার প্রচন্ড ইচ্ছা কিন্তু করা
যাচ্ছেনা বরং একটা গোঙ্গানির মত আওয়াজ বেরোচ্ছে গলা দিয়ে, আর টের পাওয়া যাচ্ছে - একটা নয়, অনেকগুলো বন্দুক তাক করে রয়েছে তার
কন্ঠনালী । পেছন দিকে হাঁটবার চেষ্টা করতেই মনে হচ্ছে পা দুটো যেন পেরেক দিয়ে কেউ
সেঁটে দিয়েছে । এবং কি আশ্চর্য, পেছনে পিঠেও একটা বন্দুকের নলের ঠান্ডা স্পর্শ । দৃশ্যটা ঠিক
এইরকম ।
দৃশ্যটা স্বপ্নের এবং এইরকম একটা
ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখে চলেছে আমাদের সত্যবান । সত্যবান রায়, একটা সওদাগরি অফিসের ছাপোষা
কেরাণী । দেখে চলেছে মানে এই রকম স্বপ্ন, একই দৃশ্য রোজই দেখে চলেছে সে, অন্তত গত
চারদিন ধরে । চারশো টাকা মাইনের কেরাণী সত্যবান বুঝতে পারেনা একই দৃশ্য – একই
দৃশ্যের আতঙ্ক রোজ তাকে, তার মত সাতে পাঁচে না থাকা লোককে তাড়া করে চলেছে কেন ?
ভাবতে পারেনা সত্যবান । যেদিন প্রথম স্বপ্নটা দেখলো সত্যবান, সেদিন বৌকেও কথাটা
বলতে পারেনি । একটা ঘড় ঘড় আওয়াজে ওর বৌএর ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল, ধাক্কা দিয়ে
সত্যবানের ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিয়েছিল । বিন বিন করে ঘেমে উঠেছিল সত্যবান ।
কিন্তু দ্বিতীয়,
তৃতীয় এবং চতুর্থ দিনেও যখন সেই একই দৃশ্য দেখলো তখন ভাবতে শুরু করলো । ঘুমোতে
গেলেই ভয় করে । ঘুমোলেই সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্যটা তাড়া করে । সেই দৃশ্য – কন্ঠনালী তাক
করা গোটা দশেক বন্দুকের নল এবং গলার ঘড় ঘড় আওয়াজ । তবু রাত্রে এক সময় সত্যবানকে
ঘুমোতে হয় এবং অবধারিত ভাবে সেই স্বপ্নদৃশ্যের তাড়া খায় ।
চতুর্থ দিনের পর
সত্যবান সত্যি সত্যিই ভাবতে শুরু করলো । পাড়ার লাইব্রেরীর ছেলেটি অবাক হয়ে গেল –
ফ্রয়েডের স্বপ্নতত্ব বইটা চেয়ে পাতা ঘাটতে লাগলো । বৌকে একসময় জিজ্ঞাসাও করে ফেললো
যে তাকে খুন টুন করার কোন মতলবের কথা সে শুনেছে কিনা। ওর বৌ ডুকরে কেঁদে উঠেছিল –
আর পাঁচটা কেরাণীর বৌ এরকম কথা শুনলে যা করে থাকে । সত্যবান ভাবার চেষ্টা করে, তার
এরকম ভয়ঙ্কর স্বাপ্ন দেখার রহস্যটা কি ? অথচ বন্দুকের নল কাছ থেকে সে কখনো দেখেইনি। সেই ছেলেবেলায় জি ইউ এন গান - গান মানে বন্দুক পড়েছিল আর একটা বন্দুকের ছবি
দেখেছিল, ব্যস ঐ পর্যন্ত । রক্তটক্ত দেখতে তার ভীষণ ভয় করে। স্কুল-কলেজে কোনদিন
মারপিট করেছে বলে মনে পড়েনা । এমনকি গত বছর ওদের বাড়ির উল্টোদিকে একটা উনিশ-কুড়ি বছরের
ছেলেকে কারা যেন খুন করে ফেলে রেখে গিয়েছিল , সত্যবান তখন অনেকটা রাস্তা ঘুরে উলটো
পথে অফিস গিয়েছিল । এইতো কয়েক বছর আগে যখন ওদের পাড়ায় খুব মারামারি খুনখুনি হ’তো,
পুলিশভ্যান ঘোরাঘুরি করতো কাদের যেন খোঁজে ! কিন্তু সত্যবান একদম মাথা ঘামায়নি ।
কাদের মারছে, কেন মারছে এনিয়ে সে মাথা ঘামায়নি । বৌকে নিয়ে সিনেমায় গেছে । স্ট্রাইকের উটকো ঝামেলায় যদি ট্রাম-বাস না চলে এই ভেবে সেবার
তো সারারাত অফিসেই শুয়েছিল । এহেন সত্যবানের সঙ্গে বন্দুকের কি সম্পর্ক ? দশ দশটা
বন্দুক তার কন্ঠনালি তাক করে রোজ তাড়া করছে কেন, বুঝতে পারেনা সত্যবান ।
ইদানিং সত্যবান
কোন ভয়টয় পেয়েছিল কিনা তাও মনে করার চেষ্টা করে । কিন্তু কিছুই খুজে পায়না । আগে
আলকাতরা দিয়ে দেওয়ালে কিসব লেখা থাকতো, সত্যবান কোনদিন সবটা পড়েও দেখেনি । কিন্তু
মনে পড়ে সেখানে বন্দুকের নল শব্দটা লেখা থাকতো । কিন্তু সেসব তো অনেকদিন আগেকার
কথা ! তার সঙ্গে ওর কি স্পম্পর্ক ? তাছাড়া আজকাল তো ওসব লেখা আর দেখতে পাওয়া যায়না !
সত্যবান কাউকে কোনদিন
ভয় দেখিয়েছিল কিনা তাও মনে করার চেষ্টা করলো । না কাউকে কোনদিন একটা চড় মারার
হুমকিও দেয়নি । অথচ সেই সত্যবানকে রোজ দশটা বন্দুক তাড়া করছে ! ব্যাপারটা খুব
অস্বাভাবিক লাগে । ছেলে কে ও কোনদিন বাঘ শেয়ালের গল্পও বলেনি, এমনকি জিম করবেটের
শিকার কাহিনীও পড়েছে বলে মনে করতে পারেনা । এইতো সেদিন, কালিপূজোর চাঁদার পঞ্চাশ
টাকার রশিদ ধরিয়ে দিয়ে গেলো পাড়ার ছেলেরা । ঠোঁটের ডগায় একটু হাসি মাখিয়েই বলেছিল ‘তার
মত চারশ টাকার কেরাণির পক্ষে অত টাকা চাদা দেওয়া...’ ইত্যাদি । ‘কাল এসে নিয়ে যাবো
দাদা’ বলে চলে গিয়েছিল পাড়ার ভাইএরা । আর সত্যবান অফিসের পিওনের কাছ থেকে পঁচাচাত্তর
টাকা ফেরত দেওয়ার কড়ারে পঞ্চাশ টকা ধার করে এনেছিল । ছেলেটা তার কালীপূজোর সময়
একটা খেলনা পিস্তল কেনার বায়না ধরেছিল , সত্যবান ভরসা পায়নি , কোথা থেকে কি হয়ে
যায় তার ঠিক নেই ! সেই সত্যবান আজ চারদিন ধরে একই ভয়ঙ্কর স্বপ্নটা দেখে চলেছে ।
ইদানিং, অর্থাৎ চতুর্থ দিনের পর থেকে
আর একটা ভাবনা ওকে তাড়া করতে শুরু করলো । আরো কেউ কেউ হয়তো একই স্বপ্ন দেখছে !
সত্যবান ঠিক করলো অফিসের বন্ধুদের জিজ্ঞাসা করবে , তারাও এই একইরকম স্বপ্ন দেখছে
কিনা । চতুর্থ দিনে তার গলার ঘড়ঘড় আওয়াজে যখন সেই ভয়ঙ্কর স্বপ্নদৃশ্যটা সরে গিয়ে
ঘুমটা ভেঙে গেল, সেই রাত্রে এক গ্লাস জল খেয়ে আলো জ্বালিয়ে বৌ আর ছেলের মুখটা
দেখলো, তাদের মুখে কোন দুঃস্বপ্ন দেখার ছাপ পড়েছে কিনা বোঝার চেষ্টা করলো । বৌএর নাক ডাকার শব্দ শুনল কিন্তু দুঃস্বপ্নের কোন ছাপ দেখতে
পেলনা । ছেলেটার মুখের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে ওর মুখের ছাপটা দেখতে চাইল । অবাক হ’ল
সত্যবান । তার ছেলে – মিন্টু ঘুমন্ত হাসছে আর হাত
বাড়িয়ে কি যেন একটা ধরার চেষ্টা করছে । কি ধরতে চাইছে মিন্টু ? আর হাসছেই বা কেন !
সত্যবান ভেবে পায়না ।
এবং পঞ্চম দিনেও
সত্যবান ঘুমালো । থিয়েটারে যেমন কোন রাত্রেই অভিনেতাদের পার্ট ভুল হয়না, ঠিক তেমনি
ভাবে আজও সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্যটা হাজির হ’ল । কিন্তু একি ! সেই ভয়ঙ্কর কন্ঠনালি তাক
করা বন্দুকের নলের দৃশ্যটার সঙ্গে আর এক্টা দৃশ্যও ভেসে এলো । আজ আর স্বপ্নের
মধ্যে সত্যবান পিছু হটার চেষ্টা করলোনা। দ্বিতীয় দৃশ্যটা দেখতে দেখতে আর আগের মত
ভয় পাচ্ছেনা সত্যবান, বেশ বুঝতে পারল। সত্যবান দ্বিতীয় দৃশ্যটা দেখতে লাগলো।
অনেকগুলো ছেলে – ওর ছেলে মিন্টুর বয়সী হবে, সত্যবানের কন্ঠনালি তাক করা বন্দুকধারী
লোকগুলোর কাছে এসে খিলখিল করে হাসছে আর হাত বাড়িয়ে বন্দুকগুলো ধরার চেষ্টা করছে –
যেন কি মজার ব্যাপার ! আজ সত্যবান লক্ষ্য করলো বন্দুকধারী লোকগুলো মুখোশ পরা । একটা
ছেলে – মিন্টুর মত বয়স, সত্যবানের দিকে তাক করা লোকটার মুখোশটা টান মারার চেষ্টা
করছে, বন্দুকটা কেড়ে নেবার চেষ্টা করছে । সত্যবান দেখলো আরে একি , ঐ ছেলেটা তো
মিন্টুই !
এবার ভয় পেতে শুরু করল সত্যবান । যে
মিন্টুকে কালীপূজোর সময় একটা খেলনা পিস্তল কিনে দেয়নি সত্যবান, সেই মিন্টু আসল
বন্দুক ধরার চেষ্টা করছে ! তাও ঐ ভয়ঙ্কর লোকগুলোর কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে ! সত্যবান
চীৎকার করতে চাইল – পালিয়ে যা মিন্টু , ওদের কাছে যাসনি, ওরা ভয়ঙ্কর লোক । মিন্টু বোধয় শুনতে পেলোনা । নিজের গড়ঘড় গোঙানির শব্দে ঘুম
ভেঙ্গে গেল । ওর বৌ ততক্ষণে বেড সুইচ টিপে আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে , আর সেই আলোতে
সত্যবান দেখলো, পিন্টু এখনও ঘুমন্ত খিল খিল করে হাসছে আর হাতটা ওপর দিকে বাড়াচ্ছে,
যেন কিছু ধরার চেষ্টা করছে ।
পরদিন অফিস গেল সত্যবান । কিন্তু কোন
কাজ করতে পারলোনা । ছুটি নিয়ে চলে এলো , ট্রামের সেকেন্ড ক্লাস কামরায় বসে ভাবতে
লাগল কালকের রাতে দেখা সেই স্বপ্নের দৃশ্যটা । কিসের একটা মিছিল যাচ্ছে , ট্রামটা
থেমে গেছে । কিসের মিছিল, কেন মিছিল জানার ইচ্ছে নেই
সত্যবানের । বেশ বড় মিছিল । সত্যবান ট্রামের জানালায় মাথা এলিয়ে দিল । এবং
আনিবার্য ভাবেই সেই দৃশ্যটা হাজির, যেন সিনেমার মেসিন চালু হয়ে গেল । দশ জন মুখোশ
পরা বন্দুকধারী, তার কন্ঠনালি তাক করা বন্দুকের নল,আর একদল মিন্টুর বয়সী শিশু
খিলখিল করে হাসছে আর বন্দুক কেড়ে নেবার চেষ্টা করছে । দৃশ্যটা এইরকম । আজকের দৃশ্যটা
একটু অন্যরকম । সত্যবান দেখলো একটা কদাকার লোক একটা উচু যায়গায় দাঁড়িয়ে যেন
নির্দেশ দিচ্ছে বন্দুকধারী লোকগুলোকে । সত্যবান বুঝতে পারলো আজই ওর শেষ দিন ।
সত্যবান মরিয়া হয়ে সামনে একপা এগোতে চেষ্টা করলো,
পারলোনা । বন্দুকধারী একটা লোক প্রায় তার গলাতেই
বন্দুকটা ঠেকিয়ে রেখেছে , মাথার ওপর হাত তুলতে বলছে,‘হ্যান্ডস আপ’! সত্যবানের দেহ
যেন হিম হয়ে গেল । আর ঠিক তখনই যেন কানের কাছে কার কন্ঠস্বর শুনতে পেল । মিন্টুর
কন্ঠস্বর, ফিস ফিস করে বলছে ‘কি করবে ? হাত তুলবে , না বন্দুক কাড়বে ?’ সঙ্গে
সঙ্গে দৃশ্যটা সরে গেল । একটা হালকা ঝাঁকুনিতে ঘুম ভেঙ্গে গেল । ট্রামটা চলতে শুরু
করেছে । মিছিলের শেষ অংশে গাওয়া গানটা শোনা যাচ্ছে তখনও ।