গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ১৭ অক্টোবর, ২০১২


    একলব্য

          প্রদীপ দাশগুপ্ত বর্তমানে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছড়াকার। তাঁর প্রতিটি ছড়ার বই-এর একাধিক সংস্করণ বেরিয়েছে। কিন্তু তিনি অধিক গর্বিত, মুখে মুখে ছড়া তৈরির সহজাত ক্ষমতার জন্য। এ কারণে পরিচিত মহলে ও বিভিন্ন ছড়ার আসরে তিনি আলাদা মর্যাদা পেয়ে এসেছেন। দর্শকদের যে কোনো প্রশ্নের উত্তর তিনি ছড়ার মাধ্যমে দিয়ে থাকেন। মন্ত্রীর অনুরোধে কলকাতা ছেড়ে উত্তরবঙ্গের এক গ্রামে যেতে হচ্ছে।সরকারি উদ্যোগে তিস্তা-গঙ্গা উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে তিনি বিশেষ অতিথি। গ্রামের মানুষকে ছড়া শুনিয়ে তাঁর কিছুই এগোবে না। থাকা খাওয়ার কী ব্যবস্থা হবে কে জানে? এমনিতেই তিনি সারা বছর পেটের রোগে ভোগেন। কিন্তু গত দু-বছর সরকারি পুরস্কার কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। সুতরাং এ বছর মন্ত্রীর গুড-বুকে থাকার সুযোগ নষ্ট করা উচিৎ নয়
আয়োজনের কোনো ত্রুটি নেই। জলপাইগুড়ির সবথেকে ভালো হোটেলে থাকা খাওয়ার চমৎকার ব্যবস্থা। তাকে অনুষ্ঠান মঞ্চে নিয়ে যাওয়ার জন্য স্করপিয়ো প্রস্তুত। এমন আদরযত্ন শহর কলকাতায় কল্পনাও করা যায় না। হোটেল থেকে প্রসন্ননগর গ্রাম মাত্র ত্রিশ মিনিটের পথ। তিনি মঞ্চে উঠে অভিভূত হয়ে যান। অজস্র স্রোতা। প্রতিটি ছড়া পাঠের পর প্রবল করতালি। এর পরেই শুরু হল বহু প্রতীক্ষিত প্রশ্নোত্তর পর্ব। কিন্তু প্রশ্ন করার জন্য কোনো দর্শকই এগিয়ে এলো না। এ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কেউ কোনো প্রশ্ন করে না। দর্শকদের মধ্যে একজন বললেন রিকশাচালক জংলু ভাই-কে ধরে আনা হোক। যা কিছু প্রশ্ন ওই করবে। জংলু ভাই কিছুটা দূরে রিকশার সিটে বসে ছিলেন। তাঁর কোনো প্রতিরোধ কাজ করল না। তাঁকে পাঁজা কোল করে মঞ্চে তুলে আনা হল। ছড়াকার প্রদীপ দাশগুপ্ত অবাক। এত লোক থাকতে শেষে রিকশাওয়ালা নিমেষের মধ্যেই তাঁর ভুল ভাঙল প্রাথমিক জড়তা কাটিয়ে উঠে জংলু ভাই একের পর এক প্রশ্ন শুরু করলেন। প্রতিটি প্রশ্ন ছন্দবদ্ধ। মাত্রার কোনো ভুল নেই। ছড়াকার প্রদীপ দাশগুপ্তের জীবন, শহর, লেখালেখি, নিয়ে কথ্য ভাষায় অনর্গল প্রশ্নবাণ ছুটে আসছে। লেখক এমন পরিস্থিতিতে কখনও পড়েননি। তার নিজস্ব ছন্দ কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। দর্শকদের উৎসাহ বেড়েই চলেছে। এও যেন এক প্রতিযোগিতা তিনি বুঝলেন এই একলব্যের সঙ্গে এঁটে ওঠা অসম্ভব। প্রশ্নোত্তর পর্বকে সংক্ষিপ্ত করে হঠাৎ তিনি অনুষ্ঠান শেষ করলেন। তারপর জংলু ভাইকে জড়িয়ে ধরলেন গাড়িতে ওঠার আগে গ্রামের কিছু মাতব্বর গোছের মানুষ শহরের ছড়াকারকে ঘিরে ধরলেন। তাদের বক্তব্য হল নিরক্ষর রিকশাওয়ালা জংলু ভাই সমস্ত কথাই নাকি ছন্দে বলে। বিগত দশ বছর কেউ ওকে ছন্দ ছাড়া কথা বলতে দেখেনি। লেখক যদি জংলু ভাই-কে টিভি-তে কোনো অনুষ্ঠানের সুযোগ করে দেন তা হলে গ্রামের মান বাড়ে।  সকলকে যথাসাধ্য প্রতিশ্রুতি দিয়ে দিয়ে প্রদীপ দাশগুপ্ত হোটেলে ফিরে এলেন।
এমন সময় বউ-এর ফোন এলো, - “ তোমার অনুষ্ঠান কেমন হল” ? প্রখ্যাত ছড়াকার রাগত স্বরে বললেন। অসভ্য ছোটলোকের জায়গা, রিকশাওয়ালাকেও মঞ্চে তুলে দেয়।