গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ৬ অক্টোবর, ২০১২

মৌ দাশগুপ্তা



কোন এক গাঁয়ের বধুর কথা
    

        নলগ্রামের কুসুম আর কুলসুম খুবই কাছের বন্ধু,মানে দেশ গাঁয়ের ভাষায় গলায় গলায় বন্ধু বললেও অত্যুক্তি হয়না।  যদিও তারা ভিন্ন দুটি জায়গা থেকে বিয়ের মাধ্যমে দুজন ভিন্ন দুটি পরিবারের বউ হয়ে এ গ্রামে এসেছিলো তাছাড়াও ধর্মের দিক দিয়েও দুজনের স্বামীর বাড়ি আর পরিবারের মাঝে খানিকটা প্রভেদ থাকারই কথা, তবুও  ধীরে ধীরে দুই সমবয়সী নারীর মধ্যে সামান্য পরিচিতিটুকু সখীসুলভ অন্তরঙ্গতায় বদলে যেতে দেরী হয়নি। কুসুম আর কুলসুমের শ্বশুরবাড়ীর মাঝখানে একটি পুকুরের ব্যবধান। সেই পুকুরই আবার নড়বড়ে সেতুর মত জোড়া দিয়ে রেখেছিলো বাড়ি দুটোকে। কসুমের বর বাদল আর কুলসুমের বর বদরউদ্দিন মোটামুটি সমবয়সী, বদর হয়তো একটু ছোটই হবে বয়সে। তবু পাশাপাশি বাড়ী হবার সুবাদে , কিম্বা খেলার মাঠে, স্কুলের পথে, ক্লাবঘরে তাস পিটতে যাবার সময় দুজনে একই পথের পথিক হওয়াতে জানাশোনাটা ভালোই ছিল। বদর বয়সে ছোট হলেও ওর বিয়েটাই আগে হয়েছিল । কুসুম যখন নতুন বৌ হয়ে আসে তখন নতুন বৌ দেখতে আসা কৌতুহলী পড়শীর ভীড়ে কুলসুমও হাজির ছিল ছয়মাসের রেহানকে কোলে নিয়ে। সেটাই ছিলো ওদের প্রথম সাক্ষাৎ । তারপর ওদের কেউ একজন যখন স্নান করতে বা কোনো কিছু ধোয়ার কাজে পুকুর ঘাটে আসতো, ঠিক সেই সময়টিতে আরেকজন হয়তো সদ্য ধুয়ে আনা কোনো কাপড় মেলে দিয়ে ঘরে ফিরে যেতো, বা একরাশ এঁটো বাসন নিয়ে ঘাটে যেত, বাসন ধুতে । সে সময়ে তাদের মুখোমুখি, চোখাচোখি হতোই। কে যে কাজের ফাঁকে প্রথম কথা বলা শুরু করে তা কারোরই মনে নেই। তবে তারপর থেকেই যেন তাদের সখ্যতা আর বোঝাপড়া দিনদিন নিবিড় হতে থাকে। পুকুরপাড়টাই ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছিল ওদের আড্ডাঘর। তাছাড়াও কাজের ফাঁকে, অলস দুপুরে, গোয়ালঘরের পাশে, উঠানের ওপর,শান বাঁধানো বটগাছের তলায় কথা চালাচালির কমতি ছিল না । কাকতালীয় ভাবে কিনা জানিনা, বাদল থাকতো মুম্বাইতে সোনার দোকানে কাজ করতো, ছুটিছাটায় বাড়ি আসতো, বদর তখন খালাত ভাইয়ের সাথে রুটিরুজির জন্য মধ্যপ্রাচ্যে। সংসার খরচের সিংহভাগ তারাই টানতো, ফলে বউদের স্বাধীনতাও অপেক্ষাকৃত বেশী ছিল। গ্রামের অনেকেই লক্ষ্য করত যে, কখনো মাছের বাজারে, কখনো বা সবজি বাজারে, কখনো কাপড়ের দোকানে একই সঙ্গে দেখা যাচ্ছে দুজনকে। তা নিয়ে গুজবও কম ছিলো না । মন্দ কথা শোনা আর শোনানোর ঘটনাও প্রায়শই ঘরোয়া কোন্দলের রূপ নিত।

          গুজব ছড়ালো দুজনেই নাকি গ্রামের জোতদার দোবরুদ্দিনের আশ্রিত নুটুমুন্সির প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে । এ নিয়ে ঘরের চারদেওয়ালের ভিতর ছোটখাটো বিচার-সালিসিও হয়ে গেছে বলে শোনা যাচ্ছিলো। দোবরু মিয়া লোক মারফত দুই পরিবারকে একঘরে করার হুমকিও দিয়ে রেখেছিল। ঘরে বাইরে ফিসফিসানি কানাকানিটা ক্রমশ বেশ রসালো হয়ে উঠছিলো। অন্যদিকেত্রিভুজ প্রেমের ঘটনা জানাজানি হয়ে যেতে নিজের মান বাঁচাতে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে গিয়েছিলো নুটুমুন্সি। গুজবের উৎস জানা না গেলেও লক্ষ্যবস্তুতে ভালোই আঘাত হেনেছিল। বিশেষত নুটুমুন্সির পালিয়ে যাওয়াটা জনমত উসকে দিয়েছিল বেশী। চার দেওয়ালের সঙ্কীর্ণ গন্ডীতে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছিল দুই বন্ধু। কিন্তু মজার ঘটনা হচ্ছে যে, ঠিক এই সময়েই প্রবাসে বদরের ওয়ার্ক পারমিট হারিয়ে যাওয়ার কারণে এবং মুম্বাইয়ে বাংলাদেশী সন্দেহে হুমকিতে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে একই সময়ে ঘরে ফেরত এল বাদল আর বদর। এসেই এই নাটক। ঘরে যতই বউয়ের ওপর হাতের সুখ আর রসনার সাধ মেটাক,একই সাথে দুজনের ঐ বাপের বয়সী চিমসে চেহারার লোক ঠকানো মুন্সীর সাথে প্রেম কাহিনিটা মন থেকে মানতে পারেনি দুজনে, অথচ লোকলজ্জাটাও ফেলনা নয় । রোজগারর অবস্থাও সঙ্গীন। আগে যারা বাবা বাছা করত তারাই এখন হূল ফোটায় বেশী। অতএব প্রথমে বাদল এবং পরে বদর বাপ পিতামহর ভিটে ছেড়ে রওয়ানা দিল অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে। গ্রামে ওদের সামান্য জমি জিরাত যা ছিলো তার পুরোটাই জলের দরে কিনে নিয়েছিলো দোবরু মিয়া। কানাঘুষোয় তখন এটা পরিস্কার যে নুটুর সাথে কুসুম কুলসুমকে জড়িয়ে নোংরা রটনা,নুটুর হঠাৎ গা ঢাকা দেওয়া, গ্রামে সালিশীসভা ডাকা, একঘরে করার হুমকি দেওয়া সবই ঐ দোবরুদ্দিনের মস্তিষ্কপ্রসূত। কারনটা কিছুই না। জমির লোভ । কদিন পরে নুটুমুন্সি যথারীতি ফিরেও এলো আর বহাল তবিয়তে যেন কিছুই হয়নি এই ভাবে মুন্সীগিরিও চালাতে লাগলো। খালি গ্রাম থেকে দুটো পরিবার জমিজিরাতসহ উৎখাত হয়ে গেল। কাকতালীয়ভাবে,একে অপরের অজান্তে দুপরিবারের গন্তব্য ছিলো একই। শহর কোলকাতা। শহরতলীর দুই প্রান্তে মাথা গোঁজার ঠাঁই মিলেছিল দুপরিবারের। অনেক খোঁজাখুঁজি,অনেক তদ্বির তদারকির পরে বাদল এক সোনার দোকানেই অস্থায়ী কাজ জুটিয়ে নিয়েছিল, বদর নিয়েছিল সব্জী বেচার কাজ। একার আয়ে শহরে সংসার চালানো দুস্কর বলে স্বভাবলাজুক কুলসুম একটা হোম কেটারিং সংস্থায় রান্নার কাজ করতো, আর কুসুম এক হস্তশিল্প সংস্থায় দৈনিক মজুরীতে সেলাইয়ের কাজ করতো। জীবনে আর দেখা কোনদিন হবার কথাও বোধহয় কেউ ভাবেনি। মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক। রাজ্যের শাসকগোষ্ঠীর ডাকা এক সমাবেশে এবং তদপূর্বের মিটিংয়ে মিছিলে ঐ রাজনৈতিক দলের মহিলা শাখার বাধ্যতামূলক অংশ হিসাবে ভাগ নিতে গিয়ে মুখোমুখি দেখা দুজনের। পেটের অসুখে কাবু বাদল আসতে পারেনি, কিন্তু পরিবার পিছু একজনকে আসতেই হবে,অতএব একদিনের রোজগার মাটি করে কুসুমই এসেছে। একইভাবে বদরের পা ভাঙ্গায় স্বামীর বদলী হিসাবে এসেছে কুলসুম। হঠাৎ ই মুখোমুখি দেখা হবার প্রাথমিক উচ্ছাস শেষ হবার পর দুজনে যখন ধাতস্থ হোল, সূর্য তখন মাথার ওপর। দুপুরের খাবার কূপন হাতে গল্প করতে করতেই দুজনে ময়দানের অস্থায়ী শিবিরে খাবারের লাইনে এসে দাঁড়ালো।খুব ভীড়, পাশাপশি তিনটে লাইন। দুজনে দুটো লাইনে দাঁড়ায়, কথা থাকে যে আগে কাউন্টারে পৌঁছাবে সে আরেকজনকে ডেকে নেবে। কুলসুম কাউন্টারের দিকে আগাতে আগাতে দেখতে পায় ঠিক নুটুর মতোই একটি লোক, মাটিতে নামিয়ে রাখা ব্যাগ হাতড়িয়ে কিছু একটা খুঁজছে। লোকটি হঠাৎ মাথা তুলে কুলসুমকে দেখতে পেয়ে বলে উঠলো, -আরে কুলসুম! তুই এখানে কী করিস? আরে নুটু ভাই মনে হয়? সঙ্গে সঙ্গেই যেন কুলসুমের মন থেকে যাবতীয় খুশী আর হাসির ঝলক দূর হয়ে যায়। মনের ভেতর দানা বাঁধে যাবতীয় উদ্বেগ আর অনিশ্চয়তা । মনে হয় দীর্ঘকাল পর আবার কোথাও ঝড় উঠবে। কিন্তু মনের ভাব প্রকাশ না করে ইতি উতি তাকিয়ে কুসুমকে খোঁজে। নুটুমুন্সী ব্যাগের জিপার টেনে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে খানিকটা এগিয়ে আসে। বলে, “আমি কি এতটাই পর গেলাম যে, তুই আমাকে চিনতে পারিস না!

- না, তা কেন ? না চেনার কথা বলেছি কি ? নুটু ওর স্বভাবসিদ্ধ মার্কামারা বদমাইশের হাসিটা হাসে, ভীড়ের সুযোগে আরো একটু গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে মাথা থেকে পা অবধি জরীপ করতে করতে বলে,
- মিটিনে এলি বুঝি ?  তা  তোর সোয়মী কই? ছেলেমেয়ে?
- তারা আসে নাই তো। আমি একাই এসেছি।
- শুনলাম তোরা গাঁও ছেড়ে কোথাও চলে গেছিস । তা এখন থাকিস কোথা? বাড়ীতে আর ঝামেলা টামেলা হয় না তো? প্রশ্নটা কুলসুমকে করলেও, ও মুখ খোলার আগেই জবাবটা এল অন্য জায়গা থেকে।
- ঝামেলা ? কে আর ঝামেলা করবে? গেরামে তো মুখে চুনকালি পড়লো, মান বাঁচতে শহরে এলাম তো দুজনের পোড়ারমুখো সোয়ামীরা আতান্তরে ফেলে পালালো। আমারা দুজন এখন আলাদাই থাকি। রেহানের আব্বু, অমুর বাবা থাকলে মিটিনে তো তারাই আসতো, আমরা বউমানুষ মিটিন মিছিল বুঝি নাকি?
নির্ভেজাল মিথ্যে বলে আড়ালে কুলসুমের দিকে তাকিয়ে চোখ টেপে কুসুম। দুজনকে কথা বলতে দেখেই বোধহয় নিজের লাইন ছেড়ে বেড়িয়ে এসেছে। অদ্ভুদ উত্তেজনায় জ্বলছে ওর দুচোখ। মুখে চকচুক শব্দ করে হাসিমুখেই নুটু বলে,
- আরে কুসুম যে, বেশ বেশ, তা থাকিস কোথায়, পেট চলে কি করে?
- নৈহাটির বোসপাড়ায়, আমার এক দূর সম্পর্কের মাসীর বাড়ী। টিপছাপ মানুষ, কি আর করবো? গতরে খেটে খাই গো, ঝিগিরি করি। তা তোমার কি খবর? কুসুমকে দেখে ভরসা পায় কুলসুম। কুসুমও কথা বলতে বলতে হাতটা জড়িয়ে ধরে নেয় বান্ধবীর, জোরে চাপ দেয়। ঈশারা বুঝে বোবার মত খালি হু হা করে যায় কুলসুম । খাবার হাতে হাঁটতে হাঁটতে একটু সরে আসে ভীড় থেকে। মুন্সী বলে,
- মিটিনের সময় কি করবি?
- কি আর করবো? সবাই যা করবে তাই, দল থেকে আলাদা হয়ে গেলে বাড়ী ফিরতে অসুবিধা হবে।
- তা তো বটেই, তবে কিনা এখানে এলি মুজিয়াম চিড়িয়াখানা দেখবি না?
- চিনি না যে নুটু ভাই, হারিয়ে যাই যদি?
- দুর পাগলী হারাবি কেন? আমি আছি না ? দেখতে যাবি তো বল। মিটিন শেষ হবার
আগেই ঘুরে আসবো । আরে, আমায় ও তো ফিরতে হবে নাকি? আমি আর এখন তোদের মত কোলকাত্তাইয়া নই, এখনও গেঁয়ো ভুতই রয়ে গেলাম। বলে নিজের নিজের রসিকতায় হসে ওঠে। দুবন্ধু নীরবে একে অপরের দিকে তাকায়। কথা বলতে বলতে সমাবেশ থেকে বেরিয়ে একটা অটোতে ওঠে তিনজন, কুলসুমের অনিচ্ছাসত্ত্বেও হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে কুসুম। কি এক অজানা রহস্যের টানে
যেন হাতটা ও ছাড়াতেও পারে না। চিড়িয়াখনায় টিকিট কেটে ঢোকে, বড্ড ভীড়, হাবভাবে পরিস্কার যে ওদের মত মিটিং পালানো অনেকেই আছে এখানে। টুকটাক কথা বলতে বলতে হাঁটে। নুটু পেছনে, দুই বান্ধবী আগে। নুটুর নজরটা কিন্তু অশ্লীলভাবে দুজনের ওপর ঘুরতে থাকে। একটু জড়সড় হয়ে আঁচলটা টেনে গায়ে জড়িয়ে নেয় কুলসুম। মিচকি হেসে নুটু বললো
- গলায় বুঝি তোর সোনার চেন কুলসুম?
- না তো।
- মিছাকথায় কাজ কি কুলসুম। নুটুভাই পর নাকি? ওটা রূপোর ওপর সোনার জল
চড়ানো। খেয়াল করে নি, পরে চলে এসেছে। তা কসুম সঙ্গে একজন ব্যাটাছেলে আছে যখন, চেনটা নুটুভায়ের কাছে রাখ না এখন, চৌখস লোক, কেউ কাড়তে পারবে না। তুই যা বোকাহাবা! হতভম্ব কুলসুম রথের মেলা থেকে কেনা নতুন গিল্টিকরা চেনটা খুলে দিতে যাবে, কুসুম তাড়াতাড়ি ওর হাত থেকে নিয়ে একটা কাপড়ে মুড়ে নুটুর দিকে বাড়িয়ে ধরে। হাতে নিয়ে রুমালের মোড়ক খুলে বোধহয় যাচাই করার ইচ্ছে ছিল নুটুর আর কুসুমও অপেক্ষায় ছিল সেই স্বর্ণসুযোগের। চেনটা নুটুর হাতে দেখামাত্র কুলসুমকে জোরে চিমটি কেটে গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো,
- চোর চোর, আমার গলার চেন নিয়ে যাচ্ছে,…
শহর কোলকাতার প্রাত্যহিক জীবনে যারা অভ্যস্ত তারা জানেন, গনপিটুনী জিনিষটা কি। মহিলার আর্তচিৎকার আর সাথেসাথে অপরাধীর বামাল হাতে ধরা পড়ার অপেক্ষামাত্র। কে আর যাচাই করতে যচ্ছে ওটা সোনা না সোনারঙের। সবাই হাতের সুখ করতে ব্যস্ত । এই ফাঁকে হ্যাচকা টান দিয়ে সরিয়ে নিয়ে হতভম্ব কুলসুমকে নিয়ে গেটের দিকে দৌড়ায় কুসুম, রঙীন ঝান্ডা বাঁধা চলন্ত একটা অটোকে হাত দেখিয়ে উঠে পড়ে। এতক্ষনে বুঝি শ্বাস নেবার ফুরসত পায়। মনে হয় দীর্ঘকাল যেন সে আকাশ দেখেনি। শ্বাস নিতে পারেনি মুক্ত বাতাসে। আজ মুক্তমনে বুকভরে শ্বাস টেনে বান্ধবীর দিকে তাকিয়ে তিরতিরে কাঁপা ঠোঁটে বিজয়ীর হাসি হাসে। পরম ভরসায় জলভরা চোখে কুলসুম কুসুমকে বুকে জড়িয়ে ধরে।