গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

জয়দেব সূত্রধর


 মাথা


বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টিতে গা বাঁচাতে যতটুকু আশ্রয় পেয়েছিলাম তাও সবার ঠেলাঠেলিতে হারানোর মতো অবস্থা। সন্ধ্যে নেমেছে অনেকক্ষণ হল।শহরের ল্যাম্প পোস্টগুলো জ্বালানো হয়নি, অন্ধকারে দু একটা কাক এই বৃষ্টিতে ভিজে চলেছে। এক কাপ চায়ের উদ্দেশ্যে বেরোতে এই নাজেহাল।ছাতা মাথায় দিয়ে পথচারীদের কেউ কেউ গন্তব্যে পৌছোচ্ছে। আমার গন্তব্য এখানেই। বাতাসে বৃষ্টির ছিট, প্যান্ট হাঁটু পর্যন্ত মুড়িয়ে নিয়েছি, গোড়ালী থেকে বাকিটুকু ভিজে চলেছে, যতটুকু পারা যায় রক্ষা করছি।এরই মধ্যে রাস্তায় একজন বয়স্কার পদস্খলন হয়েছে, আমি টের পাইনি, সেদিকে লক্ষ্য করিনি, গরম চায়ের গন্ধটা নাকে আসতেই ছট ফট করছি, এইতো আর একটু।

দোকানে দোকানীর হাসি, হার্ডওয়ারের দোকান, লোহার শব্দ কানে আসে, টিং টিং। ঘড়িতে কত বাজে? দেখার সময় নেই। একটা কথা কানে আসতেই চোখ ফেরালাম বৃদ্ধার দিকে, এতক্ষণ তাহলে এনাকে নিয়েই কথা চলছিল। বৃদ্ধা হাতে ভর দিয়ে শাড়ির আচঁল ঠিক করে ভিজতে ভিজতেই মিলিয়ে গেলেন, দোকানী বৃদ্ধ লোক, পাকা চুল দাড়ি, মাথায় জিন্নাহ টুপি, পানের খিলি গোগ্রাসে গিয়ে ফেলছেন, হাহা করে হেসে বললেন, বুড়ি মাগীটার কি আজো যৌবন আছে?

দোকানের ছেলেটি চোখ বড় বড় করে বলল, কী কন দাদু?

-আরে শালা। এতদিন ধরে আছিস তাও জানিস না। যৌবন কালে বুড়ি নামকরা বেশ্যা ছিল।

দোকানের ছেলেটি হেসে বলল, আপনে ক্যামনে জানলেন?

-আরে বেটা যৌবন কালে আমরাও কম মাগী খাই নাই। কিন্তু এই মাগীর দাম ছিল চড়া। মন্ত্রী মিনিস্টার ছাড়া কাউরে দিত না।

বৃষ্টি ছাড়ছে, পা বাড়াতেই আবার জোরে নামে, চশমার লেন্সে ছিটে ফোটা বৃষ্টির জল মুছে ফেলে চোখে দিই, কেমন অস্পষ্ট দেখাচ্ছে রাস্তা, দোকানপাট, চায়ের দোকানটাও বোধয় বন্ধ হয়! দম বন্ধ হয়ে আসছিল, ফাঁক খুজে সরে গেলাম, পকেট থেকে সিগারেট বের করে জ্বালালাম। ক্লান্তি চেপে বসেছে। নানা গুঞ্জনের মাঝেও বৃদ্ধ দোকানীর কথা বেশি কানে আসছিল। কত সহজে বলা যায় মাগী।

দোকানী টিউবওয়েলের উপরে লোহার পাত গুলো সাজাতে সাজাতে বলছে, আরে সাত মাথা মাহিগঞ্জের কথা বাদ দে। ওগুলো তো সব পঁচা। ঐ যে নারিকেল গাছটা দেখছিস, ওইখানে একটা দাওয়াত খানা ছিল, পাশেই তারির দোকান, গাঁজা ছিল এক পয়সা টোপলা, তখনকার মাগী ছিল ঘরের বউয়ের মতো, আমাদের বন্ধু কুলমুদ্দীন তো এক মাগীরে নিয়াই ভাগ।হাহাহা

-দাদু এইডা কই রাখি?

-আরে রাখনা। হিসাবগুলা পয়দা করছিস, শেষ করিস নাই কেন?

-ইকরাম চাচা কইল পড়ে দেখবো।

দোকানী বৃদ্ধ বাইরে এসে আকাশের পানে তাকিয়ে নিজে নিজে বললেন, "আজ আর কাস্টমার আসবে না। পানি বোধয় ছাড়বে না।" 

আমাদের দিকে তাকিয়ে গড়গড় করে বলতে লাগলেন, এই তোরা সর, তোদের চাপে তো দোকান দেখা যায়না।"

আমরাও খানিক সরে গেলাম। বৃদ্ধ বিড়বিড় করতে করতে চলে গেলেন।শরীর জ্বলছিল, কি বললেন, কেউ কি শোনেনি,নাকি সব নপুংসক। গুয়ার বেটা! ছি!

গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি তখনো হুমকি। এই বয়সে এসে গা ভেজানোর কল্পনা করতে পারিনা। উচ্ছ্বলতা চলে গেছে, এক প্রকার মানসিক ভারে উদ্যমতা নষ্ট হয়ে গেছে, যদিও বাউণ্ডুলেই রয়েছি, পিতার কোষাগারের যত্‍সামান্য অর্থও টিকে নেই, পিতাও এখন অথর্ব। পেটের ভাত জোটাতে গিয়ে বুঝতে পারিনি, আমায় ঘাড়ে চেপে কেউ আরামসে খাচ্ছে, তারই উচ্ছিষ্ট আমার জোগাড়কৃত অর্থ। বুঝতে পারি, মাথার উপর আরো কতক মাথা আছে, যতদূর চোখ যায়, মাথা আর মাথা। আমার কাছের টাই আমি ভাল দেখতে পাই না। বাবা সব সময় একটা কথা বলতেন, আমি যেমন জ্বী হুজুর জ্বী হজুর বলে সারাটা জীবন কাটিয়েছি তোমরা যেন তা না করো।"

কিন্তু কথাটা মনে থাকলেও বাস্তবতার মূলে তার কোনো দাম নেই, যদিও কৈফিয়ত দিতে দিতে আমরা নিজেদের স্বত্ত্বা হারিয়েছি।

অটো রিক্সা গুলো হাক ছাড়ছে, শাপলা জাহাজকোম্পানী, মেডিকেল। 

দু একদিন পকেট থেকে টাকা খরচা করে গণ আন্দোলনে নেমেছিলাম, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাপুরুষদের বক্তৃতা শুনেছিলাম, এবার চালের দাম কমানো না হলে রেল পথ অবরোধ, তখন পাশ দিয়ে বায়ান্নবগি যুক্ত ট্রেন বিকট শব্দ করে ধীর গতিতে চলছে, মালবাহী ট্রেন, তেল ভর্তি। সবার মনোযোগ ছিল ওদিকেই,তারপর আরেকদলের হোক্কা দেয়াতে ছত্র ভঙ্গ হয়ে যায় সমাবেশ, একমাস পরে সেই হোক্কার প্রতিবাদ। হাস্যকর। আমি সভাপতিকে বলেছিলাম, হাতে চুড়ি পরে ঘরে বসে থাকুন।

সভাপতি রেগে গিয়ে বললেন, ওষুধ খেলেই তত্‍ক্ষণাত রোগ নিরাময় হয়না, ধৈর্য ধরতে হয়।" 

-আপনারা রোগ নিরাময় করতে নামেননি, রোগ ধরাতে নেমেছেন, চল্লিশ বছর ধরে রোগ নিরাময় করছেন। ভাল।

সভাপতিকে এ যাবত কোনো আন্দোলনে দেখিনি, ডয়ারে আমাদেরই টাকাগুলো রাবারে বেঁধে গাড়িতে চড়ে উধাও হতেন, সমাবেশ শেষ হলে পকেটের টাকা খরচা করে সভাপতি সেবায় নামতাম। সভাপতির মাতা পিজি হাসপাতালে পয়সা দাও, সভাপতির মেয়ের গলগণ্ড রোগ পয়সা দাও। অবাক করা কথা হল সভাপতির মেয়েকে সেদিন দেখলাম, বটতলায় গান গাইতে। তবে গলগণ্ড উধাও! এ তো চমত্‍কার। অনেকে কানে কানে বলল, আরে এটা উনার অন্য পক্ষের।"

কে জানে কতগুলো পক্ষ! আমরা তো সরল মনেই দিয়েছি। প্রভাকর কাঁধে হাত রেখে বলল, সব মাথা বুঝলি সব মাথা।"

আন্দোলনে যে নারী নেত্রীরা ছিলেন, তারা ছিলেন লোক দেখানো ফুয়ারা মাত্র, যাতে মানুষ বোঝে খিদেয় জ্বালায় নারী পুরুষ সবারই বেহাল দশা, মসজিদের মতো দান বাক্স সামনে রেখে বলেন, ভাইয়ারা বোনেরা দূর্গতদের পাশে দাঁড়ান, সাহায্য করুন। তাতে প্রেমিক প্রেমিকার সাথে একবেলা ডেটের টাকা টা তো জুটবে! কারা দূর্গত। ভারী কড়া লিপস্টিক, সাহেবী স্যুটের নেতা, শাড়ি আর বেনারসি পল্লবী দি আর বিনয় দাদা'রা! আর আমরা খিদের চোটে খিদে মেটাতে এলাম তারা! কিংবা যারা খিদের চোটে মরছে।

সব মাথা বুঝলেন সব মাথার কারসাজি।

বৃষ্টি থেমেছে, ফেরা দরকার।