গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

গোপেশ দে


শুকদেবের বেঁচে থাকা




সুকদেবের বয়েস ত্রিশ প্লাস।এই ত্রিশ বছর বয়েসে হঠাৎ একদিন তার মনে হল, মানুষ একটা স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকে।প্রতিটা মানুষের মধ্যেই স্বপ্ন আছে, আশা আছে, সেটাই তার বাঁচার অনুপ্রেরণা। কিন্তু সে কয়েকদিন ধরে অনেক ভেবে দেখেছে তার কোনো স্বপ্ন নেই, আশা নেই, তাহলে সে বেঁচে আছে কেন ?



এই চিন্তা এখন মাথায় ঘুরপাক খায়। এই ত্রিশ বছর জীবনটাই তার নানা ঝক্কি ঝামেলা আর গালিগালাজের একটা মিলন মেলা যেন।লেখাপড়াটা শিখলে হয়ত একটা স্বপ্ন থাকত, একটা চাকরি হত যেমনটি এই গন্ড-গ্রামেরও কয়েকটা ছেলে করে।কিন্তু সে নিজে থেকেই তো পড়াশুনা ঠিকঠাক মত করেনি।সে দায়টা তো তার নিজের।এখন সংসার পাততেও তার মন চায় কিন্তু কে তাকে বিয়ে করবে? সংসার পাতলে বউ, বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে দিব্যি জীবন।একটা বেঁচে থাকার রসদ।বাড়িতে তার যা অবস্থান তাতে সজ্ঞানে কি অজ্ঞানে কোনো মেয়ের বাবাই তার সাথে বিয়ে দিতে রাজী হবে না।বাড়িতে সুকদেবরা ছয় ভাই বোন।সে আগের পক্ষের।

সুকদেবের বয়েস যখন সাত বছর তখন তার মা কলকাতায় কাজের উদ্দেশ্যে যায়।আর ফেরেনি।সুকদেবের বাবাও আর খোঁজ খবর নেননি বিশেষ।তবে অপেক্ষায় ছিলেন বছর খানেক যদি বউ নিজ থেকে ফিরে আসে।ফিরে আর আসেনি তাঁর স্ত্রী।তারপর বাবা বিয়ে করে ফেললেন একদিন হুট করেই।সেই ঘরে এখন পাঁচ ছেলে মেয়ে তাঁর। ছেলে মেয়েগুলো যে যার মত।ভাইয়ে -ভাইয়ে, ভাইয়ে -বোনে, বোনে- বোনে ঝগড়া ঝাঁটি লেগেই আছে।পান থেকে চুন খসলে কেউ কাউকে ছেড়ে কথা কয় না।মাঝেমধ্যে ঝগড়া ঝাঁটিতে যোগ দেন বাবা মাও।সুকদেবের সাথে ভাই-বোন কারুর ঝগড়া লাগলে তা বাবা মায়ের গালিগালাজ, চর থাপ্পড় সুকদেবই খায়।খাবেই বা না কেন? সুকদেবেরও যে এক আধটু দোষ থাকে।মুখ দিয়ে খিস্তি পারতে ওস্তাদ।তাছাড়া সে সুযোগ পেলেই বাবার পকেট থেকে টাকাও সরায়।সেটা বাড়ির সবাই জানে।হাতে নাতে ধরাও পড়েছে দু'চারবার।বাবার চোখে এ জন্য সে ভয়ানক অপরাধী।তার অন্য ছেলেমেয়েরা যে সরেস ব্যাপারটা তা নয়।ওরাও টাকা হাতায়।কিন্তু সেখানে বাবা তাদের কিছুই বলেন না।অথচ তার চুরি ধরা পড়লেই বাবা বলবেন, 'মানুষ হ শুয়োর।বুড়ো বয়েসে চুরি করতে লজ্জা লাগে না ?' সুকদেব তখন ভাবে, বাবার পকেট মারতে লজ্জা কীসের ? সে একা তো নয় আর সব ভাই- বোনও তো পকেট থেকে টাকা হাপিস করে।

এরকম পক্ষপাতিত্ব তার ভালোও লাগে না।এ বাড়িতে মাঝেমধ্যে তার দম বন্ধ হয়ে আসে।সে জানে এই পাঁচকাঠার ওপর বাড়িটায় তার অংশীদারীত্ব নেই বললেই চলে।তার আর সব ভাই বোনেরাই পাবে বাড়ির ভাগ।তার কপালে লাঠি জুতো।বাবা অগোচরে এতদিনে তাঁর অন্য ছেলেমেয়েদের নামে বাড়ি ভাগ বাটোয়ারা করেছেন কি না কে জানে ? সৎমা কী আর সুকদেবের কথা ভাববে ? এমনিতেই কড়া কড়া কথা শোনায় তাকে সুযোগ পেলেই।

সুকদেবের জন্য বাইরের রান্নাঘরের পাশে একটা গোয়াল ঘরের মত ঘর করে দিয়েছেন বাবা।সেখানেই সে মহানন্দে আছে।কারণ রাতে নিরিবিলি দরজা আঁটকে ঘুমিয়ে থাকে।প্রায় প্রতিটা রাতেই মূলঘরের ভিতর থেকে আর সব ভাই বোনগুলোর ঝগড়ার আওয়াজ কানে আসে সুকদেবের।এক গাছা ভাই- বোন থাকলে যা হয় আর কি।বাবা মা দুজনেই পাগলের মত বকতে থাকেন।বাবার গলাটা কড়া শোনায় বেশি।কিন্তু গায়ে হাত তুলেন না।অথচ সুকদেব বেশ মার খায় বাবার হাতে।এই বয়েসেও খায়।মা অবশ্য মারে না কিন্তু কটু কথা বলতে ছাড়ে না তাকে।


সুকদেবের দুটো বোনের সাথে দা-কুমড়া  সম্পর্ক।সম্পর্ক ভালো রাখার মত কাজ সুকদেব করেনি অবশ্য।সে জানে যে এমনি ওরা দাদাকে ভালো চোখে দেখে না তার পরে বোনদের মন রক্ষা করার কাজটাও ঠিকমত করতে পারে তো না-ই উল্টো ওদের মন- বিরোধী কাজ করে।বোন দুটোর ইদানীং পাখা গঁজিয়েছে।কারণে অকারণে বাজারে যায় , পার্লারে যায় , দু'চারটে ছেলে বন্ধুও জুটেছে , তাদের সাথে সিনেমায় যায় বাবা মাকে গোপন করেই।সুকদেব এই ব্যাপারগুলো মাঝেমধ্যে নিজ চোখে দেখেছে বলেই একদিন সব ফাঁস করে দেয় বাবা মাকে।সেই থেকে বোনদুটো তার দিকে ক্রুদ্ধ চোখে তাকায়।বোনদের ভালোর জন্য করেছে ব্যাপারটা তা নয় আসলে বাবা মার কাছে কঠিন বকা খাবে সেই মজাটা নিজ চোখে দেখার জন্যই করেছে সে । এর ফল অবশ্য সুকদেব একদিন পেয়েও গেছে । তার এক বোনের দুটো বন্ধু একদিন সন্ধ্যায় তাকে একা পেয়ে জামার কলার ধরে চর থাপ্পড়, কান ধরিয়ে তবেই ছেড়েছে । সে কোনো প্রতিবাদ করতে পারেনি । ছেলেগুলো কম করে হলেও তার দশ বছরের ছোট । এতে সুকদেব শারীরিক কষ্ট পেলেও মানসিক কষ্ট পায়নি।

সুকদেব ভেবে দেখেছে তার এভাবে বেঁচে থাকাটার কোনো তাৎপর্য কি আছে? বাড়ি থেকে কোনদিনও বিয়ে দেবে না। সেটা সে ভালো করেই জানে।বিয়ে করলে নিজের ইচ্ছায় করতে হবে।তার আগে একটা কিছু আয়ের পথ তো করা চাই।তার যা দু'চারজন বন্ধু আছে গ্রামে সবাই গাঁজা খেয়ে চোলাই খেয়ে টালমাতাল অবস্থা।ওদের সাথে সেও টানে গাজা, খায় মদ।ফাও ফাও খায়।কিন্তু একদিন একজন খাওয়ালে আরেকদিন যে তাকেও খাওয়াতে হয় সেটাই স্বাভাবিক।কিন্তু টাকা পাবে কোথায় সুকদেব? তাই বন্ধুগুলো তাকে আর বিশেষ পাত্তা দেয় না।চোরের মত সেখানে যাওয়াটাও কেমন যেন লাগে তার।তবুও মাঝেমধ্যে যায় সে।মনটা যখন খুব খারাপ থাকে তখন লাইনপাড়ের দক্ষিণ দিকের জঙ্গলটার কাছে যায় সে।বন্ধুদের গাঁজার আস্তানা।বন্ধুরা তাকে দেখামাত্রই হাড় কেপ্পন, কঞ্জুস, ইতর, খচ্চর এইসব হাবিজাবি বললেও দেয়।সে সরল মনে গাজায় দু চার টান দেয়।দু পেগ চোলাইও জুটে যায়।

সুকদেব আজ রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবল একটা মেয়েকে প্রেমের জন্য পটাতে হবে।এটাই তার বেঁচে থাকার রসদ।তারপর কারো হাতে পায়ে ধরে একটা কাজের বন্দোবস্ত করতে হবে দরকার হলে খারাপ কাজও করবে সে।কোনো চোর, ডাকাতের সাক্ষাৎ পেলে তার সঙ্গে কাজে লেগে যাবে সে।তারপর বিয়ে করে সংসার।বউ নিয়ে মহা ফুর্তি...জীবনটা কাটবে রসেবশে।আহা...! বেঁচে থাকার রসদ।কিন্তু প্রেম কিভাবে করতে হয়, একটা মেয়ে পটাতে হয় কিভাবে সেটা সে জানে না।তার ওপরে পোশাক আশাকের যা ছিরিছাদ তাতে এই দিনে কোনো মেয়ে কি তাকে পছন্দ করবে? এই গ্রামে এমনিতেও তার হবে না।কারণ তার বাড়ির যা পরিবেশ তাতে কোনো মেয়েই সজ্ঞানে বউ হয়ে আসতে চাইবে না।পাড়াপড়শিরা গোপনে এই বাড়িটাকে পাগল ছাগলের বাড়িও বলে।কেউ বলে ঝগড়ুটে বাড়ি, খেয়োখেয়ির বাড়ি আরও কত কী...তাহলে মেয়ে পটানোর উপায় ? অন্যগ্রাম ছাড়া গতি নেই।কর্মঠ মেয়ে খুঁজতে হবে।বড় লোকের আয়েসী, আহ্লাদী ফর্সা মেয়ের পেছনে লাগা যাবে না।রাজী তো তারা হবেই না উলটো বড় কোনো হাঙামা হয়ে যাবে।জীবনের ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে যেতে পারে।এমনিতে ঝড় কম বয়নি তার জীবনে।এখনো বইছে।তাছাড়া তার ঘরবাড়ি থেকেও এক প্রকারে যেন নেই।পরগাছার মত জীবন।তার চেহারাটাও কালোর দিকে।গায়েও মাংস নেই।চিমসানো শরীর।একটু লম্বা এই যা ভালো।


সকাল বেলা একটা সাইকেল নিয়ে সুকদেব বেড়িয়েছে প্রেমের খোঁজে।আজ মনে হচ্ছে তার কপালটা ভালো।কারণ সাইকেল বাবাজী নিজে থেকেই তার হাতে ধরা দিয়েছে।মানে সাইকেলটা সে চুরি করেছে।সকালে দাঁতব্রাশ করে ময়লা জামা- প্যান্ট পরে দুটো মুড়ি চা গিলে বেড়িয়েছিল মেয়ে পটানোর উদ্দেশ্যে।পায়ে হেঁটে যাবে তিন চার কিলোমিটার ভিতরের কোনো গ্রামে।যেখানে তাকে কেউ চেনে না।সেখানে কোনো মেয়ের সাথে একটু গল্প বলে ভাব জমানোর চেষ্টা করবে তারপর মেয়েটার মোবাইল থাকলে নাম্বার নিয়ে আসবে (যদি মেয়েটা দেয়)। তার নিজের মোবাইল নেই তাতে কি? কোনো এক বন্ধুর কাছে ধার কার্য করা যাবে।আগেতো প্রথম ধাপ অতিক্রম হোক।কিন্তু পায়ে হাঁটাটাই যা কষ্টের।ভেবেছিল একটা সাইকেল থাকলে মন্দ হত না।

কিন্তু সৌভাগ্য একেই বলে।হঠাৎ দেখে একটা সাইকেল তালা লাগানো ছাড়া দাড় করানো একটা চালের আড়তের পাশে।সবে সকাল। দোকান এখনো সব খুলেনি।এই বাজারটায় দোকান একটু দেরিতেই খোলে।লোকজনও খুব একটা ধারেকাছে নেই।সে সাইকেলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।হঠাৎ চোখ পড়ল সাইকেল থেকে দশ হাত দূরে একটা লোক কল খুলে দুহাত পেতে প্রাণ ভরে জল খাচ্ছে।বুঝে নিল এই লোকটাই সাইকেলের মালিক।লোকটা জল খেয়েই যাচ্ছে।সাইকেলের দিকে তাকাচ্ছে না।এই সুযোগ।মনে হল সাইকেলটাও তাকে বলছে, 'পালা পালা আমাকে নিয়ে পালা...'

আর দেরি না করেই সাইকেল নিয়ে ঝড়োবেগে ছুট।সাইকেলটা বেশ চলছে।সামান্য প্যাডেলেই ভোঁ ভোঁ করে দৌড়াচ্ছে।পনের মিনিট ধরে চালিয়েই যাচ্ছে সে।গ্রামের প্যাঁচানো সরু রাস্তা ধরে সে যাচ্ছে।পিচের রাস্তা ছেড়ে  মোরামের রাস্তা ধরে যাচ্ছে সে এখন।একবারের জন্য ভাবল রাস্তা চিনে আবার বাড়ি ফিরতে পারবে তো? এই সব রাস্তায় সে কোনোদিন আসেনি।মাত্র তিন- চার কিলোমিটার অবধি এসেছে অথচ এই সব গ্রাম তার অদেখাই ছিল এতদিন।না আর চলা ঠিক হবে না এটা ভেবে সে দাঁড়াল একটা মেহগনি গাছের নীচে।গাছটা প্রকান্ড।ছায়াটাও দারুণ।আসলে সাইকেল চালাতে গিয়ে হয়রান হয়ে গেছে সে।রোদের তেজটাও কাঠফাটা।জৈষ্ঠমাসের রোদ।গ্রামটা বেশ নির্জন।রাস্তার যেখানটায় সে দাঁড়িয়ে তার দুই পাশে ফাঁকা ছোট মাঠ।মাঠে গোরু- ছাগল চরছে।মাঠের শেষ দিকে বেশ কিছু বাড়িঘর।বাড়িগুলো আবছা লাগছে দেখতে।ঘন গাছপালায় ঢেকে আছে বাড়িগুলো।বাড়িগুলো দেখতেও আহামরি কিছুই নয়।টিন, টালির তৈরি ঘর।মাটির ঘরও দেখা যাচ্ছে।অবশ্য তাদের গ্রামটাও অনেকটা তাই।সুকদেবের বাড়িটা অবশ্য ইটের তৈরি।ওপরে টিন।

হঠাৎ সুকদেব দেখল একটা মেয়ে দুটো ছাগল নিয়ে তার দিকেই আসছে।মেয়েটার দিকে সে গভীর মনোযোগে চাইল।দেখতে খারাপ না।খারাপ হলেও কিছু যায় আসে না তার।মেয়ে হলেই হল।রোগা লিকলিকে চেহারা মেয়েটার।শ্যামলা বর্ণ।মাথায় এক গোছা চুল তাও আগোছালো।ময়লা একটা চুড়িদার পরা।হাতে সস্তার চুড়ি।কানে মাকড়ি।এই মেয়েটা দিয়েই শুরু করা যাক, এই ভেবে সে দেখতে লাগল মেয়েটা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়।মেয়েটা একেবারে তার কাছে এসে ছাগল গুলো একটা গাছের সাথে বাঁধল।গাছের তলায় প্রচুর লতাপাতা আর ঘাস।সেটা লক্ষ্য করেনি এতক্ষণ সুকদেব। এখন করল।
কীভাবে কথা বলতে হয় মেয়েদের সাথে এই জ্ঞান তার কোনদিন ছিল না।এখনো নেই।তাই কী বলবে কী বলবে ভেবে সাহস নিয়ে জিজ্ঞেস করল, 'ভালোবাসো?'
মেয়েটি আড়চোখে চাইল।না শোনার ভান করে চলে যেতে লাগল।
সুকদেব পিছন পিছন গিয়ে মিইয়ে গলায় বলল, 'ভালোবাসো ?'
মেয়েটি এবার পিছনে ফিরে কর্কশ গলায় বলল, 'কে আপনি ? আমার পিছু নিয়েছেন যে !'

'আমি সুকদেব।তোমাকে ভালোবাসি।চলো না ওই ঝোপের আড়ালে বসে দুটো কথা কই।'
'ছি! কী যা-তা বলছেন 'সুখের কথা বলব।আমাদের সংসার, ছেলে মেয়ে।তোমার ভালো পোশাক নেই বুঝি ? তোমার জামার বগল ছেঁড়া।হা হা হা...!'
মেয়েটা লজ্জা আর উৎকন্ঠা নিয়ে বলল, 'পাগল নাকি ? এই বলে সে দ্রুত হাঁটতে লাগল।'
সুকদেব ভাবল, মেয়েটা যেহেতু পাগল বলেছে তার মানে তাকে পছন্দ করেছে।
'এই শোনো তোমার নাম কী ? একটু দাঁড়াও।আমি তোমাকে ভালো পোশাক কিনে দেব।ভালোবাসি বল।মোবাইল নাম্বার দাও।কথা বলব।আমি অনেক দূর থেকে এসেছি।'
মেয়েটা দেখল সুকদেব তার পিছু ছাড়ছে না।সে খানিকটা ভয় আর উৎকন্ঠায় চেচিয়ে উঠল, 'আপনি আমার পিছু নিচ্ছেন কেন ? আমি লোক জড়ো করব।'
দুটো ষন্ডা চেহারার ছেলে রাস্তা দিয়ে এদিকটাতেই আসছিল।
'এই রে!' সুকদেব ভয় পেয়ে গেল।এতক্ষণ রাস্তার ধারে কাছে কেউ ছিল না।এখন এদের কাছে উল্টোপাল্টা যদি কিছু বলে দেয় মেয়েটি।
মেয়েটি বলেও দিল চিৎকার করে।সুকদেব এক দৌড়ে সাইকেলের কাছে গেল।কিন্তু শেষ রক্ষা হল না।এমন ধোলাই খেল যে শুধু জানটাই রইল।পাশের একটা ঝোপে ছেলেগুলো চ্যাংদোলা করে তাকে ফেলে দিল।প্রায় আধঘন্টা পর অনেক কষ্টে সেখান থেকে উঠল।সাইকেলের কথা মনে পড়ল।সাইকেলটায় তালা দেয়া নেই।সাইকেলটা আছে তো ? সে ভাবল হয়ত সাইকেলটা নেই।চুরির মাল আবার চোরেই নিল বুঝি।কিন্তু একটু ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে আসতেই দেখল সাইকেলটা দিব্যি স্টান্ডে ভর করে দাঁড়িয়ে আছে।তার মানে এই গ্রামে কি চোর নেই ? এভাবে সাইকেলটা এতক্ষণ পড়ে আছে তাও তালা ছাড়া।এভাবে তো থাকার কথা নয়।চারিদিকে তার মতই চোর ছ্যাঁচড়।সাইকেলটা দিব্যি আছে এও এক বিস্ময়।সারা শরীর ব্যাথায় টনটন করছে তার।ওষুধ না খেলে বাচঁবে না হয়ত।এই চিন্তা হতে লাগল তার।সে সাইকেলটা নিয়ে অনেক কষ্টে সেটা চালিয়ে রাস্তার একটা চাপকলের কাছে এল।পেট ভরে জল খেল।চোখে মুখে জল দিল।এখন একটু শক্তি পাচ্ছে সে।ভালো করে হাত পা ধুয়ে নিল।জল কাটা জায়গায় লাগতেই শরীর ঝাঁকি দিয়ে উঠল।যেখানে সেখানে নুনছাল উঠে গেছে।এভাবে কেউ মারে ? এবারেও তার হাঁটুর বয়েসী ছেলেপেলের হাতে মার খেল সে।সিদ্ধান্ত নিল সাইকেলটা বেচবে।যা পাবে তার কিছু টাকায় ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ কিনবে।কিছু টাকা দিয়ে ফল মূল কিনবে।গায়ে শক্তি দরকার।


এভাবে ছয় মাস কেটে গেল সুকদেবের।অনেক গ্রাম ঘুরেছে শুধু প্রেমের জন্যে।মার খেয়েছে গুনে গুনে আরো দু'বার।ছয়-সাত বার কান ধরে উঠবস করেছে।তাড়াও খেয়েছে দু-চারবার।শুধু প্রেমে প্রত্যাঘাত হয়ে।আসলে সে মেয়ে পটানোর কোনো মন্ত্রই জানে না সেটাই ভাবে এখন।বাচ্চা বাচ্চা স্কুল পড়ুয়া ছেলেদের কাছে কান ধরে উঠবোস, মার খাওয়া,  তাড়া খাওয়া যেন সে মেনেই নিতে পারছে না এখন।নিজেকে খুব লজ্জিত লাগছে।
আজ রাতে সিদ্ধান্ত নিল আত্মহত্যা করবে সুকদেব।গলায় ফাঁস দিয়ে।বেঁচে থেকে কীই বা লাভ।সকাল হলেই শুধু খাই খাই পেট, বাড়িতে রাবনের চিতা, কোনো সুখ নেই স্বপ্ন নেই, আশা নেই।শুধু শুধু এভাবে বেঁচে থাকা কেন ? আজ রাতেই কাজটা সারতে হবে।তবে কাছে কিনারে না।নিজের গ্রাম থেকে দু চার কিলোমিটার দূরে।ঘন ঝোঁপের আড়ালে।

প্রায় আধঘন্টার মত পায়ে হেঁটে সুকদেব একটা ঘন জঙ্গলের মধ্যে এল।চারিদিকে ঝিঁঝিঁপোকার ডাক যেন ভৌতিক পরিবেশ তৈরি করেছে।মরেই যখন যাবে ভূতের চিন্তা করে লাভ কী ? সে নিজেও একটু পরে ভূত হবে।

জ্যোৎস্না রাত।চাঁদের আলো বড় ছোট গাছের পাতায় ঝিকিমিকি একটা খেলা করছে।সুকদেব এই দৃশ্যের মধ্যে আনন্দ খুঁজতে লাগল।যদি আনন্দে মন ভরে ওঠে তবে আর সুইসাইড নয়।প্রতিদিন রাতে এখানে চলে আসবে, আনন্দে থাকবে কিছুটা সময়।কিন্তু না ! জীবনটা তবুও বিস্বাদ লাগছে।তার বেঁচে থাকার রসদ নেই।বাড়িতে অশান্তি।বাড়ি থেকেও যেন তার নেই।প্রেমের চেষ্টা করেও বারবার ব্যর্থ।একটা মেয়েও তার মনের দুঃখ বুঝল না।শুধু হাঁটুর বয়েসী ছেলেদের হাতে মার খেল।

বাড়ি থেকে তার বিয়ে কোনোদিনই দেবে না বাবা।বাবা তার বিয়ে নিয়ে কোনোদিন মাথাও ঘামাবে না।ছোট ভাই বোনগুলোর বিয়ে হয়ে যাবে তার চোখের সামনে দিয়ে।আর সে চিরকুমার।একটা সংসার হলে অনেক স্বপ্ন তৈরি হত তার।বেঁচে থাকার আনন্দ।আর দেরী নয়।তড়িঘড়ি করে একটা গাছে উঠে গাছের শক্ত ডালের সাথে ফাঁসের দড়িটা বাঁধল কষে।তারপর গাছে বসেই চারপাশে তাকালো একবার।ঝিঁঝিঁপোকার ডাক ছাড়া আর বিশেষ কোনো শব্দ নেই।

'কে মরতে যাচ্ছিস ?'
সুকদেব চমকে উঠল, 'কে ? ভূত...!'
বড় টর্চের একটা আলো সুকদেবের মুখে ফেলল একটা লোক, 'নীচে নেমে আয় হতভাগা...! আমি ভূূূত নই !'
টর্চের আলোয় সবকিছুই ঝাপসা লাগছিল তাই সে একটা হাত দিয়ে চোখটা একটু আড়াল করে লোকটাকে দেখল, দশাসই চেহারা লোকটার।
সুকদেব নামতে নামতে বলল, 'কে হে আপনি ? আমি মরছি তাতে আপনার কী ? আমি কি মরতে পারি না ? আমার কি আত্মহত্যার অধিকার নেই ?'
লোকটা লাইট নিভিয়ে সুকদেবের কাছে এসে গলা খাঁকাড়ি দিয়ে জিজ্ঞেস করল, 'কেন ? মরতে হবে কেন ? সংসারে সুখ নেই ?'
'সংসারই নেই।আবার সুখ !' সুকদেব ঠোঁট ওল্টালো।
'কোনো কাজ করিস না তুই ?'
'না।'
'আমার সাথে চল।সংসার, টাকা পয়সা সব হয়ে যাবে।'
'কোথায় ?'
'ডাকাতি করতে।'
সুকদেবের চোখটা চকচক করে উঠল।সে সঙ্গে সঙ্গে লোকটাকে একটা প্রণাম ঠুঁকে দাঁড়াল তারপর বলল, 'আপনি ডাকাত ? কি সৌভাগ্য আমার।গুরু আমি আপনার সাথে যাব।'
ডাকাত বলল, 'তাহলে চল।এখন বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে ?'
'খুউব।আচ্ছা ডাকাত হলে সংসার করতে পারব তো ?'
'কেন পারবি না আহাম্মক ? আমারও সংসার আছে।তোরও হবে।'
'টাকা পাব তো ডাকাতি করে ?'
'হ্যাঁ হ্যাঁ সব পাবি।এই তো পরশু একটা অপারেশন আছে যদি আমাদের দলে থাকিস তো তুইও ভাগ পাবি।ডাকাতি করে যা পাই তা সমান ভাগ করি।আমি একটু বেশি পাই।সর্দার কিনা।তোর পারফরম্যান্স ভালো হলে বেশী ছাড়া কম  পাবি না ?'
'বেশ বেশ।আমি রাজী।'
'মদ গাঁজা চলে ?'
'চলে না আবার দৌড়ায়।আমি ডাকাত হলে আমাকে কেউ বিয়ে করবে ?'
'করবে না মানে? আমি আছি কী করতে? তোর হিল্লে হয়ে যাবে।আর বিয়ে না করা অব্ধি মেয়েছেলে নিয়ে মস্তি করতে পারবি।আমার ডেরায় সব আছে।'
সুকদেব ডাকাতের সাথে হাঁটছে আর ভাবছে আহা !  এই তো জীবনটা এখন রঙিন লাগছে।মরে গেলে কী ভুলটাই যে হত ? এরকম একটা লোকের সাথে আর সাক্ষাৎ হত না।মৃত্যুর হাত থেকে যেন বাঁচালো লোকটা।এই তো স্বপ্ন উঁকি দিচ্ছে।টাকা কামাবে দু হাত ভরে সে।মন প্রাণ ঢেলে দেবে ডাকাতিতে।সংসার পাতবে, হোক না ডাকাতি করে আয় তাতে কি ? জীবনে বেঁচে থাকার একটা মানে তো হবে।সবচেয়ে বড় কথা একটা সংসারও হবে।ডাকাতেরও সংসার থাকে।