গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

কৃষ্ণা মালিক


 বোবা


খদ্দের সামলাতে হিমসিম খাচ্ছে মানিক। হাটের দিন সকালে, চাকের চারপাশে মৌমাছিদের ওড়াউড়ির মতো দোকানে ভিড়টা জমেছেও খুব। যত ব্যস্ততা বাড়ছে তত লোকটা বেকুব বনে যাচ্ছে।কখনও এর মাল ওকে, ওর মাল তাকে দিচ্ছে ; নয়তো সংখ্যায় কমবেশি। মালিক একবার গম্ভীরসে আওয়াজ ছাড়লেন, এই মানকে -! যেন সাবধানবানী।যাইই হোক, তিনি হলেন ভদ্রলোক। তাই দাঁতমুখ যতই খিঁচুন না কেন , বাঞ্চোত , জানোয়ার শূয়ার – গালাগালগুলো বিড়বিড় করে বর্ষণ করেন। যার উদ্দেশ্যে বলা সে হাজার বোবা হোক , শুনতে পায় পরিষ্কার। মালিক যত দাঁত খিঁচোন , তার দাঁত তত খুলে যায়।

  পায়ের কাছে গড়িয়ে আসা বল সবাই লাথায়। মানিক হলো পায়ে পায়ে ঘোরা বলের মতো সুলভ।মালিকের মুখে শুনে শুনে মানিক হয়ে গেছে “মানকে”। তার বয়সটা ঠিক বোঝা যায় না।সাতাশ আঠাশ হতে পারে, হতে পারে সাঁইত্রিশ আটত্রিশ।কিন্তু স্বভাবে ছেলেমানুষি সরলতা। হয়তো বুদ্ধিটা ঠিক পরিপক্ক হয়নি।দোকানের মালিক বংশী এমনিতে ভদ্রললোক।বেশ গম্ভীর।তবে মাঝে মাঝে তিনি বেশ তরল হয়ে পড়েন।তখন তিনি মানকের পিছনে লাগেন।আসলে তিনি নিজে ঠিক লাগেন না, তিনি অন্যদের ইঙ্গিত করেন , আর তারাও মানকের কোমড়ের ঢিলে প্যান্ট পিছন থেকে টেনে নামিয়ে দিয়ে খুব মজা করে।

      রোগা প্যাঁকাটি, আর কুঁজো।নির্বোধ চেহারায় সামান্য উঁচু ঈষৎ হলদেটে দাঁত হাসিতে সর্বদাই চিকনাই দিচ্ছে।যখন হাঁটে পা মাটিতে দেবে দিয়ে শরীরটা সামান্য উঁচিয়ে, জিরাফের ঢঙে।একটা ঢ্যাঁক রেখে রেখে, তাল দেবার মতো ছন্দে।ঠাট্টা তামাশা, বকাবকি – সবেতেই তার হাসি। এই একটাই প্রতিক্রিয়া জানা আছে তার।মুখে কোনো কথা নেই।তাকিয়ে থাকবে আর হাসবে , যেন বোবা।তবে চিন্তাশক্তিতে সে খোঁড়া নয়।

  দোকানে মালিক ছাড়া কর্মচারী থাকে পাঁচজন। মানিক ভাবে, পাঁচটার মধ্যে দুটো লোক নেই আজ, তাতেই এত সমস্যা।চাঁদু তার বোনের বিয়েতে বাড়ী গেছে।তিনদিন পর ফেরার কথা।তার বাড়ী ধামাস।মনোজের বাড়ী এখানে, এই সপ্তহাটিতে হলেও সেও ছুটি নিয়ে বাড়ী বসে আছে।গতকাল থেকে তার ধূম জ্বর।বাকি তিনজনের দুজন – রাকেশ আর দিলুকাকা সিঙ্গারা ভাজার কাজে ব্যস্ত। দোকানে সকাল বিকেল সিঙ্গারা ভাজা হয়, রাতে তৈরি হয় মিষ্টি। তখন মালিক বংশীবদনও হাত লাগাবেন।যারা রোজকার ছানার যোগানদার তারা ছানা জাঁক দিয়ে ,জল ঝরিয়ে, মিহি করে, দলামলা করে রসগোল্লার গোল্লাও পাকিয়ে দিয়ে যায়।রাত এগারোটা, সারে এগারোটা পর্যন্ত মিষ্টি বানানো চলে। বিয়ের মরশুম আর পুজো -টুজোর মরশুমে আরও ব্যস্ততা , মিষ্টি বানাতে আরও রাত।তারপর সব গুছিয়ে বাগিয়ে বাড়ি যাওয়া।

  রাতে মিষ্টি বানানোর সময় সাধারণত দোকানের অন্য কর্মচারিদের কাজ থাকে না।তারা বিশ্রামে যেতে পারে।থাকবে মালিক আর ছানার যোগানদাররা।ওদের সঙ্গে তেমন কড়ারেই বন্দোবস্ত।আর থাকবে রাকেশ-দিলীপের জুটি।

   সিঙ্গারা বানানোতে ওরা দুজনই পটু।এত বচ্ছর করে চলেছে।এই যে সকাল বিকেল এতো খদ্দের ভীমরুলের চাকের চারপাশে পনপন করছে, সে তো ওদেরই কেরামতি।বংশীধরের দোকানের সিঙ্গারা কী আর এমনি এমনি এতো নাম করেছে? হাতের কাজ তো সেই দিলীপ দন্ডধরের।তার যোগ্য শাকরেদ হয়ে উঠেছে রাকেশ।দুজন দুজনকে ছাড়া কাজ করে ঠিক তৃপ্তি পায় না।মালিকেরও পোষায় না।রসগোল্লাটা আবার বংশীবদনের মতো করে এ বাজারে অন্য কেউ বানাতে পারে না।সব মিলিয়ে তার খুব রমরমা।বাইরের আশপাশের লোকও এ দোকানে আসতে পছন্দ করে যাওয়া আসার পথে।সব মিলিয়ে বংশীর বেষ্পতি তুঙ্গে।

  দিলীপের হয়েছে খ্যাতির বিড়ম্বনা।হাজার দরকার থাকলেও মালিক তাকে সহজে ছুটি দিতে চায় না। এই তো , মেয়ের শ্বশুড়বাড়িতে নাকি কীসব সমস্যা হয়েছে, মেয়ে জামাই রোজ ফোন করে যাবার জন্য বলছে। বংশীকে বলতে সঙ্গে সঙ্গে নাকচ।মেয়েটাকে দেখেও নি অনেক দিন।সে সঙ্গে করে নিয়ে না গেলে গিন্নিরও যাওয়া হবে না।কিন্তু ওই! সমস্যা।মাঝে মাঝে ধিৎকার ধরে যায়।চাকরি ছেড়ে দিতে মন যায়।কিন্তু সত্যি তো আর তা সম্ভব নয়। কাজ না করলে খাবে কী? আজকের বাজারে তেমন তেমন কাজই বা কোথায়? লোকে হন্যে হয়ে যাচ্ছে একটা কাজের জন্য।বংশীদা তাকে খাতির করে, দেয় থোয়ও খুব।তাই এভাবেই চলছে।

    খদ্দেররা বংশীর দোকানের সিঙ্গারা খেয়ে অভ্যস্ত, ঠিক ধরে ফেলে তার বানানো কিনা।দিলীপ না থাকলে লোক তারাপদর দোকানে ছুটবে।বংশী তা মেনে নিতে পারে না।

  মানিক বিখ্যাত হাসি মুখে মালিকের প্রতিটি গালাগালের পর এমন করে তাকাচ্ছে যেন মালিক প্রশংসায় তার গালে চুমু খেয়েছে।সে তত চৌখস নয়, তবু বংশীবদন তাকে দোকানে রেখে দিয়েছেন। মানিকের বিধবা মা তাদের বাড়িতে কাজ করত একসময়।ছেলের জন্য বংশীবদনের মায়ের কাছে খুব কাকুতিমিনতি করেছিল।-“দিদি, ছেলেটাকে নিয়ে আমার খুব চিন্তা।বংশীকে বলো না, তাকে দোকানে রেখে দিতে!”

      মায়ের নির্দেশ বংশীবদন লঙ্ঘন করতে পারেননি। আছে সেই থেকে।সেই ছোট দোকান বড়ো হল।বংশীর একমাত্র অভিভাবক - তাঁর মা, গত হলেন।একটার বদলে এখন তাঁর দোকানে তিনটে কায়দার শোকেস।রকমারি মিষ্টি।কিন্তু বদলাল না শুধু মানিক।বয়সটাই বেড়েছে।তাও আবার বয়স তার ধরা যায় না।

  সব ধরণের গায়েগতরে খাটার কাজ মানকে ছাড়া কে করবে? বিনা প্রশ্নে সে সবার হুকুম পালন করে।তবে ন্যালাভোলা বলে তাকে বংশী ভালওবাসেন।বাজারের লোকও , যতই তাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করুক না কেন সে অজাতশত্রু।

  এখানে প্রতি সপ্তাহে মঙ্গলবার হাট বসে। দোকানে এদিন সপ্তাহের অন্য দিনগুলোর তুলনায় ভীড়টা বেশী হয়।এ অঞ্চলে এটাই সবথেকে বড় হাট।গরুমোষের হাট বর্ধমান জেলার দক্ষিনে দ্বিতীয় আর নেই।পাকা রাস্তাটা চলে গেছে সোজা বর্ধমানের দিকে।রাস্তার একদিকে গরুর হাট , অন্যদিকে মোষের হাট।হাটের দিন এখানে সব পাওয়া যায়।নানা জিনিসপত্র নিয়ে কোথা না কোথা থেকে লোকেরা ব্যবসা করতে চলে আসে।কী না পাওয়া যায়! জামাকাপড়, শৌখিন জিনিস, চীনা ছাতা, সস্তার ঘড়ি, আরশোলা মারা বিষ , এমনকি শুঁটকিমাছ পর্যন্ত। বিক্রেতা যেমন, ক্রেতার ভীড়ও তেমনি।

   সপ্তহাটিতে হাটের সঙ্গে সঙ্গে দোকান বাজার দিনে দিনে বেড়ে গেল কত। ভাতের হোটেলই এখন পনের ষোলোটা।রেস্টুরেন্ট নয় নয় করে গোটা দশেক।আগে তো ছিল গোটা দুই ঠেলাগাড়ী। বিকেলের দিকে বাজারে এসে দাঁড়াত। একটা ছিল রামুদার।ঠেলার গায়ে নামাবলির মতো সর্বত্র লেখা রামনাম, রামুদার ঘুগনি , রামুদার ভেজিটেবল চপ, কিংবা রামুদার ফুচকা। খদ্দের নেহাত কম হত না। আর একটা ঠেলাগাড়ি ছিল ফটকের।ও কিছুটা ছন্নছাড়া ধরণের।ব্যবসায় তেমন মন নেই যেন। এখন এই ছোট বাজার এলাকাটায় বিরিয়ানীর দোকানই তিন তিনখানা। এত এত রাইস মিল এলাকায়।মাঠে নানা চাষের কাজ, জব কার্ডের কাজ।মানুষের হাতে কাঁচা টাকা।টোটোর দৌলতে আশপাশের গ্রাম থেকেও বাজারমুখী লোকজনের ঢল নামে বিকেলে সকালে।এরাই মূলত খাবার দোকানগুলোর খদ্দের।

    সকালের দিকে এগারো সাড়ে এগারোটার পর দোকানের ভীড়টা আলগা হয়ে যায়।মানিক তখন রাজ্যের বাসন ধোবে, ঝাঁট দেবে।বারোটা নাগাদ ভাতটা বসিয়ে দেবে গ্যাসে।কিছুদিন হলো সিঙ্গল ওভেন গ্যাস এসেছে।আগে তো দোকানের উনুনেই রান্না হতো।ভাত বসিয়ে চান করতে যেত একজনকে দোকানে রেখে।সেই সময় বেশি খদ্দের জুটে গেলে সেও তখন ভাতের হাঁড়ির কথা বেমালুম ভুলে যেত। তারপর ফ্যান-ট্যান পড়ে উনুন নিভে যা তা কান্ড।রান্নাখাওয়া সারতে দেরি হতো, গাল খেতো মানকে।দিলীপকাকে মালিক একটু খাতির করে।সে বোঝালো যে দোষটা আসলে মানকের নয়।তাই বংশীদাকে বলে বলে অবশেষে গ্যাসটা জুটলো।

  সাধারণত ভাত বসানোর দায়িত্ব মানিকেরই।সে সিমে বসিয়ে যোগদিতে চান করতে যায়। দিলীপকা দোকানের বাইরের বেঞ্চে বসে রোজই  এইসময়টা খানিক বিশ্রাম করে।মানিক তার খোনাখোনা গলায় বলল, “ও দিলীপকা! আমি তবে ডুবটা দিয়ে আসি।এই যাবো আর আসবো।”

“হ্যাঁ হ্যাঁ! সে আর আমি জানি না বাপধন !”

পুকুর পাড়ে বসে সে ঘষে ঘষে গায়ে তেল থাবরাচ্ছে ,তারপর জলে নামবে।কোনো কাজ সে খুব নিরুপদ্রবে সারতে পারে এমন নয়।বাজারের অনেকেই এখন যোগদিতে চান করতে এসেছে।বস্তির নানা বয়সের লোকও।ঘাটগুলোতে এখন চান করবার ধূম। ‘মানকে মানকে’ করে রসিকতা শুরু হলো।

    “এই মানকে! তোর  তো চুলের বিশাল ছাঁট? দেখি দেখি –” বলে চুল টেনে দিল‌ো সরকার হার্ডওয়ার্সের অজয়।ও হাসতে হসতে হাত সরিয়ে দিতে চায়, তখন পাশ থেকে একজন চিমটি কাটে।একজন সুরসুরি দেয় কোমরে।সমবেত উল্লাস ওঠে।হোহো হাসি।ওর কপালে একটুও ভাঁজ পড়ে না।তেলের শিশির ছিপি এঁটে ও যখন পুকুরে নামতে যাচ্ছে তখন রাকেশ আচমকা ওর কোমরের গামছাটা হ্যাঁচকা টানে খুলে নেয়।ও ধরে থাকার চেষ্টা করে , পারে না। সঙ্গে সঙ্গে জলে ঝাঁপ দেয়।এবার যেন চারপাশের গাছপালা, অদূরের স্কুলবাড়ি, দুপুরের ছুটন্ত ট্রেন - সবাই সমবেত হাসিতে ফেটে পড়ে। লুঙ্গি বা গামছা টেনে ধরা, অস্থানে হাত দেবার চেষ্টা রোজদিনই চলতে থাকে।তাকে উলঙ্গ করে ছাড়তে পারলে সবাই খুশি হয়। আর সব কিছুর উত্তরে সে শুধু হাসে।

  যেমন আমরা সবাই করে থাকি সাধারনত।যখন আমাদের কিছু বলার থাকে না, আসলে বলার থাকলেও বলাটা কতটা সমীচীন হবে , কতটা বিপদ ঘনিয়ে আসতে পারে বুঝতে পারি না, তখন বোবার ভূমিকা পালন করি।কিংবা হাসি।সে হাসির অর্থ থাকতেও পারে ,নাও পারে।হতে পারে সে হাসি বোকা বোকা, কিছুই বুঝছি না গোছের, কিংবা অসহ্য রাগ , দুঃখ লুকিয়ে আছে তার মধ্যে – এমনও হতে পারে। তবু বছরের পর বছর আমরা শুধু ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করি , আমাদের মতো সাধারণ মানুষকে করা সব অপমান আর বঞ্চনা এবার নিশ্চয় শেষ হবে।কিন্তু অপেক্ষার শেষ হয় না। সে চলতেই থাকে। আমরাও হাল ছাড়ি না সব সময়।তবে মানিকের কথা আলাদা, সে কিছু বলতে পারে না কখনই।সবসময় শুধু হাসে।

  মানিক সবই শুনতে পায়, সবই দেখতে পায়। তবু দরকারের বেশী কথা সে বলে না।বোবা হয়ে থাকে।

  তার মা তাকে বলে দিয়েছিল , “বাবা, বেশী কথা বলবি না।জানিস তো, বোবার শত্রু নেই?” - কথাটা মনে রেখে দিয়েছে।সে কাঁচাবুদ্ধির মানুষ, তাই কথার যে সময় বিশেষে হেরফের হয়, সেটা সে বোঝে না।চুপ করে থাকলেও শত্রু খাতির করে না, তার মা তাকে একথা বলে দেয়নি বলে এভাবে ভাবতে শেখেনি।

   সে জানে , তাকে নিয়ে মায়ের বড়ো চিন্তা।সহজ আর বোকা মানুষ সে।লোকজন বুঝে চলতে পারে না।তার মা তাকে আর তার দাদাকে একা মানুষ করেছে।বাবা কবেই গত ।ভয়ে ভয়ে সাবধানে থাকতে থাকতে এখন ভয়টাই অভ্যাস।

  পরের দিন হঠাৎ দাদা এসে পড়ল।ব্যস্ততার ফাঁকে দাদার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

      মানিকের বড়ো ভাই রতন একটা বড়ো পোলট্রি ফার্মে কাজ করে।আসলে করছিলো। ফার্ম মালিকের অনেকগুলো ব্যবসা। মালদার লোক।শেয়ারে টাকা খাটায়।ইতিমধ্যে নোটবন্দির কারনে ও নানা সরকারি নিয়ম বদলে যাওয়ায় আর্থিক মন্দা দেখা দিয়েছে। প্রায় সব ক্ষেত্রগুলো থেকেই লোক ছাঁটাই করেচেন।রতনের কপাল খারাপ ,তার উপর কোপ এসে পড়লো।তার সংসার আাছে, সে তো গভীর জলে পড়ে গেলো।অথচ ছাঁটাই হওয়া কর্মীরা যখন মালিকের কাছে দরখাস্ত দিলো তখন একটা সই দিতে তার চোখে ন্যাবা, আঙুলে বার্ধক্য। এদিকে কাজের খোঁজে যেখানেই যায় সেখানেই একটা কথা , ভোটটা মিটুক।

   রতন নিজেই এসব কথা জানাল মানিককে।মানিক হাসে।তোতলাতে তোতলাতে তার ঈষৎ খোনা খোনা গলায় জিগ্যেস করে , কী করবি এখন তাহলে?

      দেখি।কিছুতো করতে হবেই।ভোটটা না চোকা পর্যন্তই অসুবিধে।তারপর একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।মোটা বুদ্ধি তো, তাই মানকে ভোটের গুরুত্ব বুঝতে না পেরে বলে, “ভোটের সঙ্গে কাজের কি সম্পক্ক রে, দাদা?” উত্তরে দাদাও হাসে বোকার মতো।

   রতন বংশীর সঙ্গে দেখা করল।সব শুনলেন তিনি।রতন বলল, কাকা , একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন না?

তিনি বললেন, “দেখছি –!”

     ভোটের বেশি দেরি নেই।তার তোড়জোড় বেশ চোখে পড়ে।মিটিঙ মিছিল ফেস্টুনে একেবারে উৎসব যাকে বলে।সেই উৎসবের ভেতর দিয়ে রতন ভিখিরির মতো চলে যাচ্ছে দেখতে পায় মানিক।

 

বিকেলে বাজারে মিটিং।রুলিং পার্টি ডেকেছে।সেখানে আবেগ কম্পিত গলায় বেশ মডিউলেশন দিয়ে বক্তারা বক্তৃতা দিচ্ছে একের পর এক।“মানুষ” শব্দটা উচ্চারণ করতে গিয়ে যেন কত পবিত্র মন্ত্র সেটা, এমন ভাবে জেলা স্তরের নেতা গলবস্ত্র হয়ে পড়লেন।সেই পবিত্র মানুষের দুঃখে চোখ খিমচে জলও বার করে ফেললেন কয়েক ফোঁটা।

বিশ্রামাগারের সামনে টেবিল চেয়ার পেতে মিটিং।মিটিংএ থাকতে হবে – কৈলাস বলে ছেলেটা দলবল নিয়ে বলে রেখেছিল দোকানে দোকানে।বংশীবাবু দুপুরে বাড়ি যাবার সময় কর্মচারিদের বলে গিয়েছিলেন তারা যেন মিটিং চলার সময় পালা করে গিয়ে দাঁড়ায়।দোকান বন্ধ থাকবে না, আবার কৈলাসকেও চটানো হল না।কখন কাকে কী দরকার হয় , তার ঠিক কী?

বিকেলের দিকে বাজারে ভীড়টা আবার চাগাড় দেয়।বাস লরী অন্যান্য চারচাকা চলার বিরাম নেই।টোটো , সাইকেল, ভ্যান – তারই ভেতর মাইকে তারস্বরে হাসি কান্না প্রতিবাদ বিবেক প্রতিশ্রতির লহর বেরিয়ে আসছে।মিটিংএর শেষ পর্যায়ে মানিক এসেছে। বক্তার সঙ্গে সঙ্গে সেইসব গমক তার মুখে খেলে যাচ্ছে।শুনতে শুনতে আনন্দে তার মুখ ঝলমল করতে লাগল।মনে হল তার, নাঃ , আশা আছে। তার দাদার একটা ভালো মতো হিল্লে এবার হয়ে যাবে।যতই হোক দাদা তার খানিকটা লেখাপড়া করেছে। শিক্ষিত যুবকদের – ওই যে বক্তৃতা দেবার সময় কীসব বলল না? তার মতো গোমুখ্যু নয় তার দাদা।সে নিজেও বেশ একটা স্বপ্ন দেখে ফেলল।যেন একটা আনন্দ কোলাহলের ছবি দেখতে পাচ্ছে সে।কাউকে কখনও না বললেও তার আবছা মতো মনের ভেতর সেই সব ছবি চলে আসে মাঝে মাঝে।

       মিটিং ভাঙতে যে যার নিজের নিজের ধান্দামুখো হয়েছে।সব্জিওলা ফারুক তাকে আওয়াজ দিল।পিছন থেকে পিঠে জোর থাবড়া দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরল।মানিক বলল, কী বু-বুঝলি? এবার তাহলে সব ঠ-ঠিক হয়ে যাবে , - বল?

   ফারুক বুঝতে পারল না, মানকে কী বিষয়ে বলতে চাইছে।– কী ঠিক হবে?

“মিটিংএ কী বলল ম-মনে নেই? –” উজ্জ্বল মুখে তাকায় সে মানকের দিকে।

     ওরা বকুল তলায় চলে এসেছে। “তুই বক্তিতার কথা বলছিস? সে তো –” বলতে বলতেই মানকের ঢিলে প্যান্টটা পিছন থেকে টেনে নামিয়ে দিল ফারুক।খ্যা খ্যা করে হাসতে শুরু করল।

      মানিক মন্ডল একবার তাকাল শুধু।তারপর কোনো কথা না বলে চুপচাপ তার প্যান্ট উঠিয়ে নিল।ফারুকের দিকে তাকাতে তাকাতে চলে গেল দোকানের দিকে।আর ফারুক হাসতে থাকল।হাসতেই থাকল …