গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

সজল কুমার মাইতি

 


গ্রামের নাম শিয়ালমারি


" এই প্রজাপতি, তোরা এইদিকে বোস ফড়িং, তোরা প্রজাপতিদের ডানদিকে সারিবেঁধে বোস ফুলেরা তোরা মাঝখানে থাক কাঠবেড়ালি, তোরা আমার বাঁদিকটায় বোস মৌমাছি, তোরা কিন্তু ফুলেদের কাছে বসবি না পাখিরা, একদম ফাঁকি দিবি না দূরে দৃরে থাকবি না আজ যা পড়াব, কাল সেগুলো সব পড়ে আসবি আমি কিন্তু কাল সবার পড়া ধরবো কোন ফাঁকি চলবে না" ছোট্ট মিলির ক্লাসে এরাই ছাত্রছাত্রী রোজ নিয়ম করে এদের সঙ্গে পড়ানোর ছলে খেলা করে মিলি মিলি শিয়ালমারি গ্রামের পাঠশালার মাস্টার স্থিতধীর মশাই এর একমাত্র কন্যা ছোট্ট মিলির ছাত্রছাত্রী রূপী খেলার সাথী এরা মিলির এক ডাকে এরা সবাই হাজির হয় মিলি এদের নয়নের মনি শিয়ালমারি মিলির কল্যাণে যেন ছবিছড়ার দেশ এর একদিকে তীর্ণা অন্য দিকে তপস্যা দুই নদী ঘিরে রেখেছে শিয়ালমারিকে

শিয়ালমারি একটি ছোট্ট কিন্তু বর্ধিষ্ণু গ্রাম তীর্ণা তপস্যা দুই নদী মিলে শিয়ালমারিকে অনেকটা দ্বীপের মতো করে সাজিয়ে রেখেছে দুদিকে দুই নদী আর একদিকে ছোট্ট টিলার পাহাড় সঙ্গে লতা গুল্মে ভরা অরন্য দূর থেকে দেখলে শিয়ালমারিকে কোন দেবশিশুর আঁকা ছবির মতো লাগে এই গাঁয়ে দারিদ্র্য যেন হার মেনেছে এখানকার বাসিন্দাদের মোটা ভাত মোটা কাপড়ের কোন অভাব হয় না গাছপালায় ভরা সবুজের সমারোহ শিয়ালমারিকে শান্তির নীড়ে পরিনত করেছে ফুলে ফলে প্রকৃতি এখানে দরাজ হস্ত প্রতিবেশীদের মধ্যে ভালোবাসার অভাব নেই একে অপরের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ে উৎসবে সবাই মিলে নতুন পোষাকে আনন্দে মেতে ওঠে শিয়ালমারি যেন এক সুখী পরিবার এরা সবাই সুখ দুঃখ শেয়ার করে নিতে জানে চাষবাস এখানে সবাই মিলে করে ফসল তোলা তাও সবাই মিলে করে গ্রামে বড়রা সাংসারিক কাজে ব্যস্ত থাকে ছোটরা খেলাধূলায় মত্ত ঋতুর পরিবর্তন এখানে রীতিমতো জানান দেয় গাছপালা ফলফুল আকাশ বাতাসে সেই  পরিবর্তন চোখে পড়ে গ্রীষ্মের দাবদাহ এখানে মানুষ ভোলে আম কাঁঠালের আমোদে বর্ষা তার অশ্রুধারার অকৃপণ বর্ষনে ক্ষেত খামার শস্য শ্যামল করে তোলে বাকী ঋতুরা শিয়ালমারিকে তাদের আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত করে নি সেই জন্য এই গাঁ আজ স্বয়ংসম্পূর্না শস্য শ্যামলা লোভনীয় এক আস্তানা গাছপালা পশুপাখি শিয়ালমারির বাসিন্দাদের কাছে

হঠাৎ এই সুখের সংসারে দুঃখের কালো ছায়ার মেঘ ঘনিয়ে আসে সুখ শান্তির নীড় এই শিয়ালমারি আজ আতঙ্কে ভয়ে জড় হয়ে আছে এই আতঙ্ক ভয়ের কারন বিশু ডাকাত তার দলবল বিশু ডাকাত তল্লাটের সন্ত্রাস তার লোমহর্ষক ডাকাতি সন্ত্রাস মানুষের মনে আতঙ্কের বাতাবরণ তৈরি করেছে সেই বিশু ডাকাত এই শিয়ালমারিকে তার টার্গেট করেছে মা লক্ষীর কৃপায় এই গ্রামের বাসিন্দাদের ঘরে ধন সম্পত্তির অভাব নেই বর্ধিষ্ণু গ্রাম শিয়ালমারির এই সম্পদের অমোঘ আকর্ষণ বিশু ডাকাতকে এই গ্রামের ওপর হামলা করতে প্রলুব্ধ করেছে

প্রথমদিকে বেছে বেছে কিছু বাড়িতে বিশু তার দল আক্রমন করা শুরু করল গ্রামবাসীরা একজোট হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে কিন্তু, তারা ডাকাত দলের সঙ্গে পেরে উঠবে কি করে? ডাকাতদের সঙ্গী যে আগ্নেয়াস্ত্র বিশুর দল আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে অনেক নিরীহ গ্রামবাসীর প্রাণ নেয় বিশুর দল শুধু মানুষ খুন করে না, ধন সম্পত্তি লুট করে নিয়ে যায় আজ শিয়ালমারির চারিদিকে মানুষের হাহাকার সুখ শান্তিতে ভরা গাঁ আজ অশান্ত, সন্ত্রস্ত বিশু ডাকাতের ভয়ে আতঙ্কে বহু গ্রামবাসী তাদের প্রাণের প্রিয় গাঁ শিয়ালমারির মায়া ত্যাগ করে অন্যত্র চলে গেছে ফুলে ফলে হাসি খেলায় মেতে থাকা শিয়ালমারিতে আজ শ্মশানের নিস্তব্ধতা ছোট্ট মিলির মা বাবা বিশু ডাকাতের হাতে প্রাণ দিয়েছেন ছোট্ট মিলি এখন একা অনাথ পাখি ফড়িং প্রজাপতিদের আর দেখা মেলে না তারাও শিয়ালমারিকে ত্যাগ করেছে বৃক্ষেরা সব পর্ণমোচী হয়ে গেছে তাতে ফুল ফলের আর দেখা মেলে না মৌমাছিদের আর গুন গুন স্বরে গান করতে দেখা যায় না মিলি চারিদিকে ঘুরে ঘুরে  বেড়ায় আর থেকে থেকে  ডাক পাড়ে " অ্যাই, প্রজাপতি, পাখি মৌমাছি - তোরা কোথায়? তোদের পড়ার সময় যে বয়ে যায় আর কত ফাঁকি দিবি?" মিলির ডাকে আর কেউ সাড়া দেয় না কেউ আসে না বিষন্ন মিলির নাওয়া নেই  খাওয়া নেই সে শুধু তার ছাত্রদের খুঁজতে খুঁজতে হেঁটে বেড়ায় হাঁটতে হাঁটতে একসময় তপস্যা নদীর পাড়ে এসে পৌঁছয় কুলু কুলু রবে নদী বয়ে চলেছে ক্লান্ত অবসন্ন মিলি নদীর পাড়ে বসে পড়ে উদাস নয়নে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয় বিকেলের সূর্য নদীর জলে মুখ লুকায় শিয়ালমারিতে অন্ধকার নামে ছোট্ট মিলি কাঁদতে কাঁদতে নদীর পাড়েই ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে নদীর ছলাৎ ছলাৎ শব্দই কেবল শিয়ালমারির নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করতে থাকে হঠাৎ নদীর জলের ঝপাং শব্দে ছলাৎ ছলাৎ শব্দের সুর কাটে নদীর পাড়ের আবছা মূর্তিটাকে আর দেখা যায় না অভাগা শিয়ালমারি কেবল নিষ্ঠুর সাক্ষী হয়ে  থাকে