গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৯

সুমনা সাহা


গন্ধেশ্বরী ভাণ্ডার


 হাওড়া স্টেশনে নেমে ধন্দে পড়ে গেল পলাশ। “এ তো মানুষের সমুদ্র! এই ঢেউ ঠেলে এগোব কি করে?” ভ্যাবলা মুখে ধাক্কাধুক্কি খেতে খেতে স্রোতের সঙ্গে সঙ্গে পলাশ প্রস্থান লেখা গেটের নিকটবর্তী হতে থাকে। বেরোনোর গেট আবার অনেকগুলো। ওর ঢোলা ইজের প্যান্ট, আধ ময়লা শার্ট, উস্কোখুস্কো চুল, হাওয়াই চপ্পল আর হাতের চটের ব্যাগ দেখলে যে কেউ বুঝবে যে এ ছেলে গণ্ড গ্রাম থেকে প্রথমবার কলকাতা শহরে পা রাখছে। দাদু বারবার করে সাবধান করে দিয়েছে—“কলকাতা শহর কিন্তু চোরের রাজত্ব, চোখ কান খোলা রাখবি। কাউকে বিশ্বাস করবি না। ভালমানুষ সেজে অনেকেই সাহায্য করতে আসবে—খবরদার তাদের পাল্লায় পড়বি না। একটা কথা দশটা জায়গায় শুধিয়ে তবেই নিশ্চিত হবি। নয়তো নাকে ক্লোরোফর্মে ভেজানো রুমাল চেপে ট্যাক্সিতে তুলে নিয়ে নিমেষেই বেচে দেবে দালালের হাতে আর যখন জ্ঞান ফিরবে, দেখবি তুই ভিন্ দেশে পৌঁছে গিয়েছিস। সুতরাং খুব সাবধান!” তাই পলাশ মুখের অবাক ভাবটা চেপে রেখে যথেষ্ট ব্যক্তিত্ব নিয়ে কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করে নিল। তারপর যে লোকটা শসা নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে ‘দেব নাকি ছাল ছাড়িয়ে নুন মাখিয়ে?’ বলে বলে মুখ ব্যথা করে ফেলছে, তার থেকে পাঁচ টাকায় একটা শসা কিনে খেয়ে জল তেষ্টা মেটালো। ধীরে সুস্থে এবার বাসে উঠে বসল। মা বলে দিয়েছে, “বাসে উঠেই আগে টিকিট কাটবি না। যদি মাঝপথে কোন গণ্ডগোলে বাস থেমে যায়, তুই টিকিটের পয়সা ফেরৎ পাবি না। কন্ডাকটর অনেক বার তাগাদা দিলে তবেই টিকিট কাটবি!” দাদু, মা এরা এত কিছু জানলো কোথা থেকে কে জানে? ওরা তো কোনদিন কলকাতায় যায়নি। দাদু অবশ্য খবরের কাগজে মুখ ডুবিয়ে থাকে, সেখান থেকেই সব খবর পায়। আর মাকেও দাদুই এসব বলে মনে হয়।

যাই হোক, বাসে উঠে জানলার ধারে সিট পেয়ে ব্যাগটা পায়ের কাছে রেখে আরাম করে বসে পলাশ। ওকে দাদু যত বোকা ভাবে, ততটা বোকা সে নয়। ক্লাসের শিক্ষকরা কি তাকে এমনিই এত ভালবাসেন? গরীব, মেধাবী ছেলে বলে তাঁরা নানা ভাবে পলাশের পড়াশুনার খরচ হালকা করে দেওয়ার চেষ্টা করেন। মায়ের কথামতো টিকিট না কেটে পারা গেল না। কন্ডাকটর টিকিটের জন্য বার বার বিরক্ত করবে—তার চেয়ে ভাল ঝামেলা মিটিয়ে নেওয়া। সে কন্ডাকটরকে বলে, “আমাকে রথতলা এলে বলে দেবেন দাদা।” “হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলব—সে এখন অনেক দেরী আছে”—এই বলে “টিকিট, টিকিট” হাঁকতে হাঁকতে কন্ডাকটর এগিয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই পলাশ ঘুমের দেশে।

বাদল বাবু দুর্গা দুর্গা বলে ঘর থেকে বেরোবেন বলে সবে এক পা বাড়িয়েছেন, নিভা চেঁচিয়ে উঠল,
“শুনছো, বেরোচ্ছ তুমি? ওই র‍্যাকের উপর থেকে চশমাটা একটু আমার হাতে দিয়ে যাও না!”
“দেখছ বেরোচ্ছি, অমনি পিছু ডাকা! উঠে নিজে নিলেও তো পারো!”
“আহা ঢং দেখে গা জ্বলে যায়! বেরোনো তো এ ঘর থেকে ও ঘর। তার কায়দা কত! আমি বাতের জ্বালায় মরি, তাই তে এত কথা চশমাটা চাইলাম বলে! মরণ!”
চপ্পল খুলে বাদল বাবু আবার ঘরের ভিতরে এলেন, নিভাও আঃ উঃ করে হাঁটু চেপে উঠে পড়েছে পূজোর আসন ছেড়ে। মুখে গজগজ, “লাগবে না, আমি নিয়ে নিচ্ছি, পূজোর আসন ছেড়ে উঠতে চাই না—ছাতার মাথা ভুলে যাই যে কেন?”
বাদল বাবু মৃদু স্বরে বলেন, “তোমার যেমন এটা পূজো, আমার দোকানও আমার পূজো, এটা কেন বোঝ না?”
“হ্যাঁ, ওই পূজো করে করে টিপে টিপে যত টাকা জমাচ্ছ, সেগুলো কার ভোগে লাগবে, শুনি? একটা পয়সা তো হাতে করে কাউকে দিতে পারো না, তোমার মতো হাড় কেপ্পন জন্মে দুটি দেখিনি। বাড়িঘর করতে হল না। ঘরজামাই হয়ে বাড়ি পেয়ে গেলে। ছেলেপুলে আমার হল না। তাদের পড়াশুনো, ডাক্তার-বদ্যি কিছুতেই লাগলো না। তোমার পয়সা খাবে কে? তবু পাড়ার ছেলেরা দু’পয়সা চাঁদা চাইতে এলে তোমার কত তর্জন গর্জন! লোকে হাসে তোমায় নিয়ে আড়ালে, বোঝ না? এখন বলাইদা কাকে পাঠাচ্ছে, তাকে বিনা পয়সায় দোকানের কাজে খাটাবে ভেবে আহ্লাদ করছ, বলাইদা কিন্তু তাকে কলকাতায় পড়তে পাঠাচ্ছে, সেটা ভুলো না!”
বাদল তেতো মুখে বলেন, “তোমার বক্তৃতা পরে শুনবো, এখন আসি, দোকান খুলতে হবে।” 
নিভা বলেন, “আচ্ছা, এসো এখন, দুগগা দুগগা। আচ্ছা সে ছেলে আসবে কখন?”
“দুপুরের আগে তো এসে যাওয়ার কথা। এসে দুপুরের ভাত খাবে। আমি ওকে নিয়ে খেতে ঢুকব।”

বাড়ির সামনের অংশটাকেই মুদি দোকান করা হয়েছে। সেই কোন্ কালে, আটাত্তরের বন্যার সময় বড়বাজার থেকে আলুর বস্তা এনে সামনের খোলা দাওয়ার মতো বারান্দাতে সস্তায় পাড়ার লোকেদের সাপ্লাই দেওয়া শুরু করেছিলেন। সেটাই ধীরে ধীরে কেমন করে ফুলে ফেঁপে আজ এত বড় দোকান হয়ে গেছে, তাঁর অবসরপ্রাপ্ত জীবনের একমাত্র উদ্দীপনা, আনন্দ, অবলম্বন—‘গন্ধেশ্বরী ভাণ্ডার।’ কি নেই তাঁর দোকানে! নিজেই অনেকসময় মনে রাখতে পারেন না। আটা-তেল-নুন-চাল-ডাল-সাবান-পাউডার থেকে শুরু করে ছুঁচ-সুতো-কাগজ-কলম-চা-বিস্কুট-চুলের ক্লিপ-টিপ-কাজল-মশা মারা ধূপ-ন্যাপথলিন-ন্যাপকিন পর্যন্ত! ছেলেপুলে ঈশ্বর দিলেন না, তাই ওই ঈশ্বর নিয়েই রাত-দিন পড়ে থাকে নিভা। আজ সোমবারের শিবের ব্রত, ধুতরো ফুল আর বেলপাতা চাই, কাল মঙ্গলবার মহাবীরের লাড্ডু আর লাল ফুল,  বেস্পতিবার লক্ষ্মীবার—লক্ষ্মীপূজোর ফুল-মিষ্টি লাগবে, শনিবার কালীর বার—লাল জবার মালা চাই--মাথা খেয়ে ফেলার জোগাড়! দোকানে সব সময়ের কাজের জন্য সুবলকে রাখা হয়েছে—নাহলে বাদল বাবু আর এখন খদ্দেরের চাপ একলা সামাল দিতে পারেন না। সন্ধ্যার সময় একেক দিন এত ভীড় হয় যে খদ্দেরদের মধ্যে জিনিস আগে পরে পাওয়া নিয়ে ঝগড়া বেঁধে যায়। বাদল বাবুর বাঁধা গৎ, ‘আমি দোকান বন্ধ করে দেব।’ ব্যস, এই কথাতেই ম্যাজিকের মতো কাজ হয়। অশান্ত ক্রেতারা চুপ করে। প্রথম দিন থেকে আজ পর্যন্ত বাদলবাবুর দোকানের জিনিস নিয়ে খদ্দেরদের কোন অভিযোগ আসেনি, না দামে, না কোয়ালিটিতে। তাই আজকের বিগ বাজার আর মলের হুজুগের যুগেও পাড়ার পুরনো লোকেদের মাসকাবারি বাজারের সিংহভাগ আসে বাদল বাবুর দোকান থেকে। সুবল ছেলেটা ভাল। মুখে কথা কম, হাসিটি লেগে আছে, সব্বাইকে তুষ্ট রেখে ঠিক ঠাক মাল ওজন করে দিয়ে যায়। তবে ইদানীং সুবলের স্ত্রীর শরীর খারাপ। ক্যান্সার ধরা পড়েছে। যদিও ডাক্তাররা এখনো একশো ভাগ সিওর হতে পারেননি, তাই ভেলোরে নিয়ে গিয়ে সুবলকে আবার সব কিছু পরীক্ষা করাতে বলেছেন। এ মাসের শেষের দিকে সুবল তাই বৌকে নিয়ে ভেলোরে যাবে। ওর ছেলেমেয়েদের দেখাশুনার জন্য সুবলের বৌ-এর এক মাসী এসে থাকবে।
সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে বাদল বাবু দোকানে এসে গেলেন। তালা খুলে দোকানের ঝাপ খুলে দিলেন। তারপর ধূপদীপ জ্বেলে কুলুঙ্গিতে রাখা গণেশ আর লক্ষ্মীর মূর্তির সামনে খানিকক্ষণ আরতী করলেন। এবার আরাম করে বসে একটা বিড়ি ধরিয়ে ড্রয়ার থেকে পোস্টকার্ডটা বের করে আবার ভাল করে পড়লেন—

“প্রাণের ভাই বাদল,
পলাশের কথা তুই সবই তো জানিস। নতুন করে কি আর বলব? দেখ, অনাথ ছেলেটাকে এতখানি বড় করলাম। আতুপুতু করে তো মানুষ করিনি। খেটে নিজের ভাত জোগাড় করেছে। তবুও বলতে বাধা নেই, সারাদিন আমার চা-দোকানে কাজ করেও ছেলেটা এত ভাল রেজাল্ট করে। ও কলকাতায় গিয়ে ভালভাবে পড়াশুনাটা চালাতে চায়। মাস্টাররাও সবাই চায় ও যেন আরও পড়ার সুযোগ পায়। আমি আর আপত্তি করি কি করে? আমার কলকাতায় জানাশুনো বলতে তো এক তুই। তোরও তো বয়স হচ্ছে। ছেলেটাকে নিজের কাছে রাখবি? দিনের বেলা ইস্কুল যাবে, রাত্রে তোর দোকান দেখাশুনো করবে। নিভারও তো শরীর ভাল না। ঘরে একটা জোয়ান ছেলে থাকলে টুকটাক কাজেকম্মে সুবিধাই হবে। তুই বলিস তো তোর কাছে পাঠিয়ে দিই। পলাশ খুব ভাল ছেলে। লোভী নয়। মিথ্যা কথা বলে না। ওর মাধ্যমিকের রেজাল্ট বের হতে এখনও কিছুদিন দেরী আছে, এর মধ্যে তুই ওকে দোকানের কাজ শিখিয়ে দিস। রেজাল্ট বের হলে ‘কালাচাঁদ’-এ ভর্তি করে দিস। ঘর থেকে হেঁটেই যাতায়াত করতে পারবে। তোর উত্তর পেলে আমি ওকে পাঠাবো।
আমার ভালবাসা রইল। নিভাকে আমার স্নেহ দিস।
ইতি,
তোর বলাই।“

বাদল এটাকে মা গন্ধেশ্বরীর কৃপা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেন না। সুবলের অভাবে দোকান কি করে চালাবেন, ভেবে কোন কূল-কিনারা পাচ্ছিলেন না। মেঘ না চাইতে জল পেলেন। তিনি দেরী না করে উত্তর লিখে দিলেন—
“ভাই বলাই,
তুই অনুরোধ করবি, আর আমি রাখব না, তাও কি হয়? মামা বাড়িতে মানুষ। ছেলেবেলায় মায়ের স্নেহ কি বস্তু তা তো মাসিমার কাছেই জেনেছি। তোর বাড়ি, তোর মায়ের হাতের রান্না পাঁচফোড়ন সম্বার দেওয়া ডাল, মোচা ঘণ্ট, লেবুর আঁচার—কোনদিন ভুলতে পারি? ইস্কুল ছাড়ার পর সেই আমি কলকাতায় মেসে চলে এলাম, তুই রয়ে গেলি গ্রামে—তারপর মাসিমা চলে গেলেন, তুই বাড়িটাকেই চায়ের দোকান বানিয়ে বিয়ে থা না করে দিব্বি কাটিয়ে দিলি!তোরও কেউ নেই, আর নিভার কোলেও তো ঠাকুর কিছু দেননি! পরের ছেলেটাকে তুই যদি এতদিন টানতে পারিস, আমি কেন রাখতে পারব না? তুই নিশ্চিন্তে আমার কাছে পাঠিয়ে দে, আমার ঘরে থাকবে, খাবে, পড়াশুনাও করবে, দোকানও দেখবে।
ভালবাসা সহ,
তোর বাদল।“

ধীরে ধীরে খদ্দের আসতে শুরু করেছে। রোজই একটা দেড়টা পর্যন্ত বিক্রিবাটা করে তিনি ভিতর বাড়িতে আসেন, খাওয়া দাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার বিকেল সাড়ে-তিনটে চারটে নাগাদ দোকান খোলেন। বেলা বারোটার একটু পরে, দোকান খানিক হালকা, বাদল বাবু খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছেন, সুবল র‍্যাকে জিনিসপত্র সাজাচ্ছে, এই সময় কয়েকটি কচি কণ্ঠ কানে এলো। কেউ জিজ্ঞেস করল, “এ পাড়ায় ‘গন্ধেশ্বরী ভাণ্ডার’-টা কোথায়?” দুটো বিচ্ছু উত্তর দিলো, “গন্ধ দাদুর দোকান? ওই ত্তো।” বাদল বাবু দেখলেন, একটি কিশোর আসছে দোকানের দিকেই, হাতে ঠিকানা লেখা একটা কাগজ।

সেই দিনটার কথা মনে পড়লে আজও শিউড়ে ওঠেন বলাই। রোগের সঙ্গে দীর্ঘ ক্লান্তিকর এক যুদ্ধ শেষে পরাজিত সৈনিকের মতো মা তখন সদ্য বিদায় নিয়েছেন। জনম দুখিনী মায়ের শেষ সময়টাও ভগবান শান্তি দেননি। বলাই মায়ের সেবা করতে করতেই কখন যৌবন ফুরিয়ে যাওয়া প্রৌঢ় হয়ে গিয়েছিলেন, নিজেই জানতে পারেননি। ঠেকায় পড়েই রান্না শেখা। মা চলে যাওয়ার পর আর কিছুই ভাল লাগত না। বাড়ির সামনের বারান্দায় উনুন পেতে চা বিক্রি করতে শুরু করেছিলেন। বন্ধুবান্ধবরা আসত প্রথম প্রথম, পরে তাদের পরামর্শেই পাউরুটি, মুড়ি, ঘুগনি এইসব টিফিনও চালু করেছেন। সেই দোকানই এখন বলাই-এর বেঁচে থাকার একমাত্র রসদ। এই দিক থেকে দুই বন্ধুর জীবনের আশ্চর্য মিল। গ্রামের পাঠশালা, ইস্কুলের গণ্ডী পেরিয়ে দুই বন্ধুর একসময় ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলেও চিঠিতে যোগাযোগ রক্ষা করে গেছেন দুজনেই।
সেই আটাত্তরের বন্যার সময়কারই কথা। রাত্রে দোকান বন্ধ করে বলাই দু’চারজন বন্ধুর সঙ্গে টর্চ নিয়ে বের হলেন জল দেখতে—গ্রামের কোথায় কত জল জমেছে। ফেরার পথে গ্রামের শেষ প্রান্তে, যেখানে শ্মশান, তার হাত খানেক দূরে কচু বনের মধ্যে থেকে গোঙানির শব্দ পেয়ে ছুটে গিয়ে দেখেন এক কিশোরীর শরীর কাদার মধ্যে পড়ে গোঙাচ্ছে—রক্তে আপাদমস্তক মাখামাখি! মুহূর্তের মধ্যে ব্যাপারটা আঁচ করে নিতে অসুবিধা হয়নি। পাষণ্ডগুলো ধর্ষণ করে এই অন্ধকার জঙ্গলে একটি অসহায় নিষ্পাপ মেয়েকে ফেলে পালিয়েছে। তখনই কোমরের গামছা খুলে মেয়েটিকে জড়িয়ে নিয়ে পাঁজাকোলা করে নিজের ঘরে নিয়ে আসেন। বন্ধুরা সবাই পরিবারওয়ালা গৃহস্থ মানুষ। এক বলাই ঝাড়া হাত-পা। থানা-পুলিশ করে মেয়েটির যন্ত্রণা আর তিনি বাড়াতে চাননি। ধীরে ধীরে শুশ্রূষা করে সুস্থ করে তুলেছেন তাকে। পরে যখন শুনলেন, মেয়েটির নিজের বলতে কেউ নেই, তাকে বললেন, “তোকে আর কোথাও যেতে হবে না, এখানেই থেকে যা।” ওর নাম পারুল। ও নিজে থেকেই বলাইকে বাবা ডাকতে শুরু করল। দোকানের মধ্যেই এক কোণায় রাত্রে গুটিসুটি মেরে পড়ে থাকে। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই ঘর দোর ঝেড়ে মুছে ঝকঝক তকতক করে তোলে। বলাই-এর হাতের কাজ কেড়ে নিয়ে করে। বলাইকে এত যত্ন করে যে তার নিজের মেয়ে থাকলেও করত কি না, সন্দেহ! বড় মায়া পড়ে গেল পারুলের উপর। পারুলের যৌবন, না কি হাতের ঘুগনি-চপের স্বাদ, বলা মুস্কিল, তবে চা-এর দোকানের রমরমা খুব বেড়ে গেল।

এই পারুল একবার রথের মেলা দেখতে গিয়ে সঙ্গে করে নিয়ে এলো দুই বছরের একটা ছেলেকে। মেলায় হারিয়ে গিয়ে চিল চিৎকার করছিল। বহু খোঁজাখুঁজির পরেও তার অভিভাবকের দেখা মেলেনি। বাচ্চা ছেলে না বলতে পারে নিজের নাম, বাপ-মায়ের পরিচয়, না বলতে পারে ঘরের ঠিকানা। পারুল তাকে খাইয়ে দাইয়ে নিজের কাছে নিয়ে ঘুম পাড়ায়। বলাই ভাবে, কার বাড়ির ছেলে, কে জানে? এমন করে রেখে দেওয়া কি উচিৎ কাজ হয়? কিন্তু পারুল কোন কথা শোনে না। পারুলের বয়স তখন পঁচিশ হয়েছে। বলাই দেখে, বাচ্চাটাকে বুকে চেপে ধরে পারুল যখন আদর করে, তার মুখ যেন সুখে, গর্বে, মাতৃত্বের গৌরবে দুর্গা মা’র মতো হয়ে যায়। বলাই-এর মায়া হয়। ভাবে, যা হবার হবে। মেয়েটা বাচ্চাটাকে পেয়ে যেন চাঁদ পেয়েছে কোলে। থাক তবে ওই সুখটুকু নিয়ে। পারুলের নামের আদ্যক্ষর ‘প’-এর সাথে মিলিয়ে বলাই বাচ্চাটির নাম রাখে পলাশ। সেই অর্থে এই তিনটি প্রাণির মধ্যে কোনও রক্তের সম্পর্ক নেই। অথচ কি মমতায় তিনজন এক হয়ে গেছে—তা এক ঈশ্বর জানেন! পলাশের কিছু মনে নেই এখন। সে জানে, পারুল তার মা, বলাই তার দাদু।

রোগা ডিগডিগে ঢ্যাঙা ছেলেটা একটা চিরকুট হাতে নিয়ে দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালো। বাদল বুঝলেন, এই সেই পলাশ। ছেলের চোখ দুখানা পদ্মপলাশ লোচন যাকে বলে। মুখে গ্রাম্য সরলতার ছাপ। সুবলকে বলেন, “তুই ওকে ভিতরে নিয়ে গিয়ে মাসিমার কাছে হ্যান্ড ওভার করে আয়। আমি দোকান বন্ধ করে আসছি।“
আরও আধঘণ্টা পরে দোকান বন্ধ করে ভিতরে গিয়ে দেখেন, ইতিমধ্যেই পলাশ স্নান করেছে, নিভা ওকে খেতে বসিয়ে পাশে বসে গল্প জুড়েছে। পলাশ জিজ্ঞেস করেছে, “দোকানের নাম গন্ধেশ্বরী কেন? গন্ধেশ্বরী বলে কোন দেবী হয়, শুনিনি তো!” বাদল বাবু শুনতে পান, নিভা বলছে, “গন্ধেশ্বরী কোন্ দেবী আমিও জানি না। তবে শুনেছি প্রাচীন কালে যারা গন্ধ দ্রব্যের ব্যবসা করত, যেমন- সেন্ট, ধূপ এইসব আর কি, তাদের বলা হতো গন্ধ বণিক, যেমন সোনার ব্যবসায়ীদের সুবর্ণবণিক বলে না? সেই রকম। এই গন্ধবণিকরা গন্ধেশ্বরী দেবীর পূজো করত। বৈশাখ মাসের পূর্ণিমায় এনার পূজো করতে হয়। মা দুর্গার মতোই দেবী সিংহবাহনা। অনেক জায়গায় দেবীর আঠারো হাত মূর্তি গড়ে। তবে আমার কি মনে হয় জানিস, গন্ধ যেমন চোখে দেখা যায় না, কিন্তু বাতাসে গন্ধ ভাসে, টের পাওয়া যায়, এই দেবীও তেমন গন্ধের মতো সূক্ষ্ম ভাবে ভক্তের সঙ্গে থাকেন। ফুল ফুটলে যেমন সে তার গন্ধ না বিলিয়ে থাকতেই পারে না, তুই না চাইলেও ফুল গন্ধ ছড়াবেই—তেমনই এই দেবীর কৃপা। তোর দাদু কোথায় গিয়ে এনার ছবি দেখেছেন ক্যালেন্ডারে, নামটা ভাল লেগেছিল, তাই এনার নামে দোকানের নাম দিয়েছেন।” বাদল বাবু নিজের দোকানের নামের ব্যাখ্যা স্ত্রীর মুখে শুনে অবাক হলেন। নিভা এত সুন্দর করে ভেবেছে!দেখলেন, ছেলেটা বড় বড় গ্রাস মুখে তুলছে। গ্রামের ছেলে, অনেক ভাত খায়। নিভাকে বলে দিতে হবে, প্রথম থেকেই ভাত বেশী দিয়ে পেটের খোলটা বাড়াতে নেই। অভ্যাস মতো ঠাকুরঘরের ফ্যানটা বন্ধ করলেন যেটা নিভা সব সময়ই ভুলে যায়। কারেন্টের বিলটা তো দিতে হয় না তাকে, তাই বোঝে না, কত ধানে কত চাল! বললেই বলবে, “হাড় কেপ্পন!” ছেলেটা এর মধ্যেই নিভাকে বেশ হাত করে নিয়েছে! এটা সেটা চেয়ে চেয়ে খাচ্ছে বেশ! বাদল বাবু খেয়ে উঠে হাত ধুতে ধুতে বললেন, “খোকা, তুমি খেয়ে একটু জিরিয়ে নাও। বিকেলে তোমাকে দোকানের কাজ বুঝিয়ে দেবে সুবল। এখানে থাকতে হলে একটু দোকানের কাজ দেখতে হবে বাবা। আমার বয়স হচ্ছে তো। দাদু বলেছেন তো তোমায়?” পলাশ সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে। নিভার দৃষ্টিতে বিরক্তি।

অনেক বছর পরে নিভার আজকাল অত্যন্ত সুখনিদ্রা হয়। তার বুকের ভিতরটা যেন শরৎকালের পুকুরের মতো টলটল করে আনন্দে। পলাশ সারা বাড়িময় ঘুরে বেড়ায়, যখন তখন দিম্মা বলে ডাক দেয়, এটা সেটা খাবার বায়না ধরে, তার হাঁটুতে বাতের তেল মালিশ করে দেয়, পারলে যেন দিম্মাকে মাটিতে পা ফেলতে দেয় না। এত ভালবাসতে জানে এক ফোঁটা ছেলে!
অমন যে হাড় কেপ্পন বুড়ো, তাকেও জাদু করেছে ঐ ছেলে। দাদু,দাদু করে অস্থির। বাদল রীতিমতো কুঁড়ে হয়ে গেছে। কোন কাজ ওনাকে করতেই দেয় না পলাশ। কয়েকদিনের মধ্যেই সুবলের কাছে কাজ শিখে নিয়েছে। মাল ওজন করা, খদ্দেরের লিস্ট মিলিয়ে প্যাক করে দেওয়া এইসব। শুধু দিনের বেলায় যে সময়টায় ও স্কুলে যায়, তখন সুবলকে একাই সামলাতে হয়। ছুটির দিন গুলোতে ও মাঝে মাঝে সুবলকেও ছুটি দিয়ে দেয়। ছেলেটা যেন আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের দৈত্য। মুহূর্তের মধ্যে কত কাজ যে ও করে ফেলে! ওদিকে সকালে ইস্কুল যাওয়ায় কামাই নেই। ঘুম থেকে ওঠে কাক ডাকার আগে। কলকাতায় আসার এক মাসের মধ্যেই মাধ্যমিকের রেজাল্ট বের হল। মার্কশিট আনতে গ্রামে গেল, তিনটে বিষয়ে লেটার নম্বর নিয়ে স্টার পেয়ে পাশ করেছে। সারা সন্ধ্যা দাদুর দোকানে কাজ করে রাত জেগে বইপত্র নিয়ে পড়াশুনা করে। অথচ দেহে মনে কোথাও কোন ক্লান্তি নেই, বিরক্তি নেই, সদা হাসিমুখ। এমন ছেলেকে ভাল না বেসে থাকা যায়? কিন্তু তা বলে বাদল বাবু যে সব কিছু ছেড়ে দিয়ে চোখ বুজে বসে আছেন—তা মোটেই নয়। তিনি প্রত্যেকদিন হিসাব না মিলিয়ে ঘুমাতে যান না। পলাশের দেওয়া হিসেবে এক চুলও ভুল থাকে না। বাদল বাবু ভাবেন, “কার ঘরের ছেলে মেলায় হারিয়ে গেল, কে জানে?”

পলাশের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার দিন এগিয়ে আসে। নিভা বাদল বাবুকে বলেন, “এবার ছেলেটাকে দোকানের কাজ থেকে রেহাই দাও, দুটো দিন বাদে পরীক্ষা। এখানে এসেছে তো পড়তে? পরীক্ষা ভাল না দিলে বলাইদাকে কি জবাব দেবে বলো তো?” বাদল বাবু বলেন, “এ মায়া প্রপঞ্চময়! মায়া বাড়িও না। জাতপাতের ঠিক নেই, কোথাকার কে? আর জোয়ান ছেলে, একটু পরিশ্রম না করলে ভাত হজম হবে কি করে?” নিভা অবাক চোখে চেয়ে থাকেন।

পলাশ রাত জেগে জেগে পড়ে। খাটছে, খুব খাটছে ও। অংকের মাস্টারমশায় শান্তি স্যার বলেন, “জানলে পলাশ, পরিশ্রমের বিকল্প নেই। আর মানুষ পারে না, হেন জিনিস নেই। আমাদের ক্ষমতা হল গিয়ে আন-লিমিটেড। এই যে আচার্য শংকর, আট বছর বয়সেই বেদ-বেদান্ত পড়ে ফেললেন, স্বামী বিবেকানন্দ—দশদিনে এক্সাইক্লোপিডিয়া এগারো খণ্ড মুখস্থ করে ফেললেন—এসব কি গল্প কথা? সব সত্য। মানুষ ইচ্ছা করলে সব পারে। তুই অনেকদূর যাবি রে। আমি তো জীবনে অনেক ছাত্র দেখলাম। আমি বুঝি। তবে নিজের রুট কোনদিন ভুলে যাস না। যারা তোকে আশ্রয় দিয়েছে, খাইয়েছে, যত্ন করেছে, তাদের যদি ভুলে যাস, তাহলে তুই মানুষের বাচ্চা না!” শান্তি স্যারের কথাগুলো পলাশ বুকের মধ্যে গেঁথে রেখেছে। সে খুব আন্তরিক ভাবে পরিশ্রম করে—যেমন পরীক্ষার পড়ার জন্য, ঠিক ততটাই দোকানের জন্য।

উচ্চমাধ্যমিকও ভালভাবেই পাশ করে পলাশ। কলেজের ফর্ম তোলা ইত্যদি কাজে ব্যস্ত থাকায় কদিন দোকানের কাজে গাফিলতি হয়। সেদিন রাত্রে খেতে বসে পলাশ বলে, “দাদু, আমার কলেজে ভর্তির ফি বাবদ আর বইপত্র কিনতে কিছু টাকা লাগবে।“
বাদল জিজ্ঞেস করেন, “কত?”
“হাজার দশেক।“
বাদল চমকে ওঠার অভিনয় করেন, “অ্যাঁ, অ্যাতো?”
তিনি কোনদিন কাউকে জানতে দেননি যে, বলাই পলাশের পড়ার খরচা হিসাবে মাসে মাসে ১০০০ টাকা করে মানিঅর্ডার পাঠাতো। দু’বছরে সেই টাকা ২৪,০০০ এর কিছু বেশী হয়েছে সুদে আসলে। গ্রামে চা-এর দোকান চালিয়ে এর বেশী ও আর কিই বা দেবে?
পলাশ আবার বলে, “দাদু, টাকাটা না হয় ধার হিসেবেই দাও। আমি চাকরি পেলে শোধ করে দেব।”
বলাই গম্ভীর মুখে খাওয়া শেষ করে। ওঠার আগে বলে, “কাল সকালে নিও।”

পলাশ এখন আর আগের মতো দোকানের কাজ দেখতে পারে না। প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হয়েছে অংকে অনার্স নিয়ে। যাতায়াতে অনেকটা সময় চলে যায়, পড়াশুনার চাপও খুব। কলেজ থেকে ফিরে ক্লান্ত থাকে। তবুও ঘণ্টাখানেক দোকানে থাকার চেষ্টা করে। দিম্মার খেয়াল রাখতেও ভোলে না। বলাই দাদু একটা মোবাইল ফোন কিনেছে। মায়ের সঙ্গে কথা হয় প্রায়ই এ বাড়ির ল্যান্ড ফোন থেকে। মনটা তার উদাস হয়ে যায়। শিকড়গুলো ভাসছে—মা, দাদু ওদিকে, এদিকে দাদু, দিম্মা, সুবল কাকা, শান্তি স্যার—এদের সবার উপর গভীর মায়ায় মন জড়ানো। কিন্তু এগুলোই পায়ের বেড়ী। পাস করে একটা চাকরি জুটিয়ে এদের সবাইকে সুখি করা যায়। কিন্তু তার স্বপ্ন আলাদা। একমাত্র শান্তি স্যার ছাড়া আর কাউকেই সে তার স্বপ্নের কথা বলেনি। অনেকদিন ধরে একটু একটু করে সে একটা প্রোজেক্ট নিয়ে কাজ করছে। বিদেশের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির সঙ্গে মেইলে যোগাযোগ করে। একটা ইউনিভার্সিটি থেকে এসেছে একটা লোভনীয় প্রস্তাব। এক বিখ্যাত গণিতজ্ঞের রিসার্চ সহকারী হিসাবে কাজ করার প্রস্তাব এসেছে। পলাশ এখন শুধু গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি পাওয়ার অপেক্ষায়। গণিতের এক নতুন আবিষ্কারের স্বপ্নে সে দিনরাত মশগুল হয়ে থাকে। দাদু বা মা বা দিম্মা এরা কেউই তার চিন্তার জগতের শরিক হতে পারবে না। শুধু শান্তি স্যারের সঙ্গে মাঝে মাঝে আলোচনা হয়।
অবশেষে একদিন সাহস করে রাত্রে দাদুর ঘরে আসে পলাশ। একথা সেকথার পর ধীরে ধীরে তার স্বপ্নের কথা বলতে শুরু করে। বলে, দিনের পর দিন কি ভাবে সে বাইরের ইউনিভার্সিটির সঙ্গে কথা বলে প্রোজেক্টটাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। এখন সে বিদেশে গিয়ে ঐ প্রোজেক্টের উপর কাজ করতে চায়। কিন্তু তার জন্য দরকার অনেক টাকা। পাসপোর্ট ও ভিসা করতে হবে। প্লেনের টিকিট কাটতে হবে। বেশ কিছু জামাকাপড় জুতো ইত্যাদি কেনা দরকার। এছাড়াও প্রাথমিক ভাবে ওখানে গিয়ে সেটল করার জন্য, স্কলারশিপ চালু হওয়ার আগে পর্যন্ত অন্তত মাসখানেক চলার মতো টাকাও নিয়ে যেতে হবে। এই সবের জন্য তার লাখ পাঁচেক টাকা খুব শিগগিরি দরকার। সমস্ত শুনে দাদু কেবল একটা নিঃশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করলেন। তাঁর দু’চোখের কোণ বেয়ে নেমে এলো দু’ফোঁটা জল। পলাশ নিঃশব্দে চলে এলো তার নিজের ঘরে।

পলাশের যাওয়ার দিন ক্রমশ এগিয়ে আসছে। গ্রাম থেকে বলাই দাদু আর মা এসেছে। বাড়িটা এখন জমজমাট। বাদল দাদু কদিন দোকানে যাওয়া শিকেয় তুলে সুবলকাকার উপর সব ছেড়ে দিয়ে রাতদিন শুধু বলাই দাদুর সঙ্গে গল্প করছে। মা আর দিম্মা মিলে পলাশের জন্য নাড়ু বানাচ্ছে, নয়তো তার জামাকাপড় গোছাচ্ছে। পলাশকে এখন প্রচুর মেইল করতে হচ্ছে, যাত্রার প্রস্তুতির অনেক কাজ।

আগামীকাল সকাল এগারোটা পনেরোয় দমদম বিমানবন্দর থেকে ফ্লাইট ছাড়বে। ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইটের জন্য প্রায় তিন ঘণ্টা আগে এয়ারপোর্ট পৌঁছাতে হবে। সাতটা থেকে সাড়ে সাতটার মধ্যে। তাহলে ঘর থেকে বেরোতে হবে প্রায় আরও ঘণ্টাখানেক আগে। খুব সকাল সকাল উঠতে হবে। রাত্রে শুতে যাওয়ার আগে সে দাদুদের একবার প্রণাম করে ভাল ভাবে বিদায় নেবে ভেবে দাদুর শোবার ঘরের দিকে গেল। ঘরে আলো জ্বলছে। দরজা আধ ভেজানো। বুড়ো দুটো ঘুমায়নি। দুই বন্ধুতে প্রাণের কথা হচ্ছে। দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতে গিয়ে এক মুহূর্ত থমকালো পলাশ। এ কি শুনছে সে? কানের ভিতর দিয়ে যেন কেউ গরম সীসা ঢেলে দিচ্ছে। বাদল দাদু বলছেন, “হ্যাঁরে বলাই, ছেলেটার বাপ-মা কেউ আর কোনদিন ওর খোঁজ করল না? ছেলেটা তার পিতৃপরিচয় জানলো না?”
বলাই দাদু নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “আমার কি মনে হয় জানিস? ওকে ওর নিজের লোকেরা ইচ্ছে করেই মেলায় ফেলে পালিয়েছিল।“

পলাশ নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না—“তাহলে আমার কথাই হচ্ছে!”
নিঃশব্দে নিজের ঘরে ফিরে আসে সে, এক নিমেষে সমস্ত পৃথিবীটা অন্যরকম হয়ে যায়। “এরা কেউ তাহলে আমার কেউ না?” এই একটা প্রশ্ন নিদারুণ শেলের মতো তাকে বিদ্ধ করে চলে সমস্ত রাত ধরে। কখন পূবের আকাশ ধীরে ধীরে লাল হয়ে উঠেছে টের পায়নি। ভারী পায়ে সে এগোয় দিম্মার ঘরের দিকে। আরও কিছু বাকি ছিল শোনার। ঘরের বাইরে থেকে ভেসে আসছে উচ্ছ্বসিত কান্না। তার নকল মা কাঁদছে—“পেটে না ধরেও মা হওয়া যায়, সে আমার থেকে ভাল আর কে জানে, বলো? কিন্তু একটা বেটা ছেলে যে এমন করে মা হতে পারে, সে কি বাবার কাছে না এলে জানতাম? আমার মতো একটা আগাছাকে বুকে করে উনি আগলে রাখলেন এতগুলো বছর! নিজের না আছে বৌ বাচ্চা, না সংসার, অথচ আমার জন্য উনি সংসারী সেজে রইলেন! আর তোমরাই বা কম কিসে? কে আমি? কে পলাশ? কার জন্য তোমরা বুক দিয়ে এত করলে? রক্ত জল করা টাকা কার জন্য খরচ করছ? ভগবানের দেখা পেতে হলে অনেক পুণ্য লাগে। আমি যে এতগুলো ভগবান দর্শন করেছি—সে কোন্ পুণ্য বলো দেখি?”

পলাশ সরে আসে। তার চোখের সামনে থেকে যেন একটা পর্দা উঠে যায়। এই এত বড় পৃথিবীটা, কত মানুষ বুকে ধরে বনবন করে ঘুরছে। সে তো বিজ্ঞান পড়েছে—মাধ্যাকর্ষণের টানে তারা পৃথিবীর গায়ে থেকে যায়, ছিটকে যায় না। আসলে বিজ্ঞান একটা জিনিস প্রমাণ করতে পারে না, ঐ মাধ্যাকর্ষণের থেকেও তীব্র এক টান মানুষগুলোকে ধরে রাখে—সেটা হল ভালবাসা—যেটা এখনই আবিষ্কার করেছে পলাশ। সে অনুভব করে তার পায়ে জড়ানো অস্বস্তিকর বেড়ীর মতো শিকড়গুলো আলগা হয়ে গেছে—কিন্তু সে নিজেই যেন হঠাৎ করে হয়ে উঠেছে যোজনব্যাপী এক বিরাট মহীরূহ—এখন সে নিজেই তার শাখাপ্রশাখা থেকে নামিয়ে দেবে অনেক ঝুড়ি মূল। দেওয়ালে টাঙানো ‘গন্ধেশ্বরী ভাণ্ডার’-এর ক্যালেন্ডার থেকে মা গন্ধেশ্বরীর হাসির সৌরভ ছড়িয়ে পড়ে সমস্ত ঘরে।