গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৯

ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়


অর্জুন



খুব ছোটবেলায় আমার বন্ধু ছিল অর্জুন, অর্জুন মাহাতো। ছোটোবেলা মানে সেই যখন পেনি ফ্রক পরতাম, দাদাদের গায়ে ঠ্যাং ছড়িয়ে ঘুমোতাম, সন্ধ্যে হলেই বিছানায় পা ছড়িয়ে বসে বাবাকে ডাকতাম পা টিপে দেবার জন্য, মা তখনও চোখ পাকিয়ে বলতেন না--কি হচ্ছে কি! যাও, দিদির কাছে গিয়ে বস...’ সেই তখন। অর্জুন আর আমি ছিলাম যাকে বলে হরিহর আত্মা।

অর্জুন আর আমি একসঙ্গে স্কুল যেতাম। স্কুল মানে আমাদের কলিয়ারীর প্রাইমারি স্কুল। স্কুল যেতাম পায়ে হেঁটে, বাবার হুকুম ছিল...কষ্ট করে বিদ্যা অর্জন করতে হয়। তা আমরা বিদ্যা অর্জন করতাম কিনা জানিনা, কিন্তু যাবার পথে পুকুরে শালুক ফুল তুলে দেবার জন্য স্নানার্থীদের বিরক্ত করা, মাটি থেকে টুকুটুকে লালা ভেলভেট পোকা ধরে শিশিতে ভরে রাখা, ধান গাছ দেখতে দেখতে দু-একট শীষ উপড়ে তুলে নেওয়া...এসব করতে করতে স্কুলে পৌঁছতে রোজ আধাঘন্টা দেরী হতই। গিয়েই অর্জুনের নামে নালিশ...হেডস্যার যে বুঝতেন না তা নয়, এই তেঁতুলবিছে মেয়েকে ভাল করেই জানতেন। অর্জুন কড়া চোখে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিত। ফেরার পথে যদি তাকে সঙ্গে না নিই!!

সেই অর্জুন, আমার ছোটবেলার সাথী অর্জুন, একদিন শুনলাম রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে। কি করে হয়! আমার এইসব হঠাৎ হঠাৎ করে আসা খবর ভালো লাগে না, একটুও ভালো লাগে না। কেন মারা যাবে অর্জুন! অর্জুনের ধান ক্ষেতের আল ধরে একটা হাতে তার দর্জি বাবার সেলাই করা কাপড়ের ব্যাগে বই ধরা আর একটা হাত উঁচু করে ছুটে আসার ছবিটাই আমার মনে পড়ে। আমি ওকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়তাম,অর্জুন হাঁপাতে হাঁপাতে আমার কাছে এসে আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেত যে দরোয়ান বিজয়, তার কাঁধ থেকে জলের বোতল থেকে ঢকঢক করে খানিকটা জল খেয়ে আমার কাঁধে হাত রেখে আবার আমরা দুজন স্কুলে যাবার জন্য হাঁটা শুরু করতাম।
সেই অর্জুন মারা যাবে কেন?

অর্জুনের একটা ভারি গুণ ছিল। সে পাথর চিনত। আমরা তখন কত ছোট...কত্ত ছোট। কিন্তু সেই বয়সেই অর্জুন আমায় পাথর চিনতে শিখিয়েছিল। এটা পৃথিবীর পেটের ভিতরে পাওয়া পাথর, এই পাথরটার গায়ে আগুন আছে, এই পাথরটা সিল্কের পাথর ( চিকন পাথর), এই পাথর দিয়ে শিবের পুজো হয়...এই পাথরটা...এমনি সব নানা জ্ঞান সে আমায় দিতে দিতে স্কুলবাড়ি অবধি নিয়ে যেত। আর রাস্তায় কোন গাছের তলায় সিঁদুর মাখা পাথর দেখলেই প্রণাম করত তার প্রায় ছিঁড়ে যাওয়া চটি খুলে রেখে। জিজ্ঞেস করলে বলত--ইয়ে মাঈ আছে রে’ কিংবা ‘ইয়ে হনুমানজি আছে, নমস্তে কর লে!’
সেই অর্জুন মারা যাবে কেন?

একদিন মার খেয়েছিল অর্জুন আমার জন্য হেডস্যারের কাছে। আমারই জন্য। আমি দেরী করেছি সেদিন ভেলভেট পোকা ধরে শিশিতে ভরতে। কিছুতেই পোকাগুলো ভরতে পারছিলাম না। রাগে আমারও মাথার পোকা নড়ে গেল। স্কুলে পৌঁছেই সোজা হেডস্যারের কাছে—অর্জুন খুব পাজি ছেলে’..
--কেন?
--আমার রোজ দেরি করে দেয়।।
প্রথমে বকুনি, আর তারপর অর্জুন কিছু বলার চেষ্টা করতেই দু-এক থাপ্পড়। বেচারি অর্জুন! ফিরবার পথে ভাল করে কথাই বলল না। কেঁদে ফেলল।
বললাম...মাকে বলবি, পড়ে গিয়েছিলি, তোর গাল লাল হয়ে আছে, বুঝলি?’
এবার জোরে কেঁদে কেঁদে বলল—মা তো, পত্থর বন গয়ী।‘

যাঃ, তা আবার হয় নাকি! কারো মা থাকে না,শুনিনি কোনদিন। এমনও হয়! অর্জুনের মাকে পাথর থেকে মানুষ করব এমন একটা প্রতিজ্ঞা করলাম সেদিন। সেদিন বুঝিনি,মানুষ থেকে একজন পাথর হয় কি করে। পরে বুঝেছি, অনেক পরে...বড় হয়ে। হয় বৈকি! মানুষই মানুষকে পাথর বানায়। তার মা’কে কলিয়ারীর দুটো গুন্ডা ধরে নিয়ে গিয়েছিল একদিন...তারপর তার মা পত্থর হয়ে যায়। পাগলের মত হয়ে গিয়েছিলেন ঘৃণায়, দুঃখে আর কষ্টে। কষ্ট কি শুধু জানোয়ারদের জন্য? কষ্ট যারা তাকেও দোষ দেয়, তাদের জন্যই বেশী। জলজ্যান্ত মানুষটা পাথরের মত হয়ে গিয়েছিলেন। কথা বলতেন না...এক জায়গায় শুধু বসে থাকতেন আর বাড়ীতে অচেনা কেউ এলেই ভয়ে সিঁটিয়ে যেতেন, যেই হোক!
সেই থেকে কাউকে না কাউকে মানুষ বানাবার চেষ্টা করে চলেছি...করেই চলেছি। অর্জুনের কাছে সেই খবরই দেবার কথা ছিল। আমিও ধরে নিয়ে যাওয়া কোন মেয়েকে পত্থর থেকে মানুষ করি। আবার তারা হাসে, খেলা করে, আবার স্বাভাবিক জীবনে ফি্রে আসে। আমিও একটা করে তাদের নামে গাছতলায় পাথরে সিঁদুর মাখিয়ে রাখি ...অর্জুনের সঙ্গে কখনও দেখা হলে বলব...ইয়ে মাঈ হ্যায়, লে নমস্তে কর লে!’
সেই অর্জুন মারা গেল কেন??