গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৯

সুদীপ ঘোষাল


রহস্য গল্প

কে খুনী?

এ কি দেখলাম আমি। কই গো শুনছো...। আর সেকেন্ডের মধ্যেই মাথায় মুগুর মেরে পালিয়ে গেলো অপরাধী। দুকড়ি বাবু চোখে অন্ধকার দেখলেন।তার মাথা ঘুরতে লাগলো।পাঁচ মিনিটের মধ্যেই তার প্রাণপাখি উড়ে গেলো।
পরের দিন সকালবেলায় পুলিশের ভিড়। কে মারলো এমন শান্ত ভদ্রলোকটিকে।
দুকুড়ি বাবু পেশায় পার্শ্বশিক্ষক। সামান্য আয়ে তার সংসারে তিনি সুখী ছিলেন। তার কন্যার বিয়ে হয়েছে। সঙ্গে তার বর এসেছে। বাড়িতে ভাড়া থাকে একটি মেয়ে। সে একটা অফিসে চাকরী করে। এত লোক থাকতে কে মারলো দুকুড়ি বাবুকে। সকলের মনে একই প্রশ্ন। তার শত্রু বলতে কেউ নেই।দুকুড়ি ভালো লোক ছিলো গো,বললেন তার বন্ধু তমালবাবু।
পুলিশ নিজের কর্তব্য পালন করে লাশ নিয়ে চলে গেলো।আজ তিন মাস পরেও তার খুনের কিনারা হয় নি কোনো।
দুকুড়িবাবুর মেয়ে কচি রামুকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলো।তাদের কোনো সন্তান হয় নি।রামু কচির সঙ্গে থাকে।তাকে সাবধান হতে বলে।কচিদের বাড়িতে যে মেয়েটি ভাড়া থাকে সে একাই থাকে।তবে মাঝে মাঝে একটা ছেলে ওর বাসায় আসে।কচি বললো,তোমার বাড়িতে কে আসে গো? কে হয় তোমার? মেয়েটির নাম ফুচি। স বললো,ও আমার পিসতুতো দাদা।আমার কাছে মাঝে মাঝে আসে।ওরা খুব গরীব। আমি কিছু টাকা মাসে মাসে ওকে দিই।
কচি আর রামু ভাবে কে সেই খুনী। আমদের ভেতরেই কি সেই খুনী আছে।আবার ভাবে,না তা কি করে হতে পারে।বাড়ির কর্তা ছিলেন দুকুড়িবাবু।তাকে মারলো কে? কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না কচি। কচির ছটফটানি দেখে রামু বললো,তাহলে সেই রাতে ছাদের দরজা খুলে চোর এসেছিলো।সেই চোর নিশ্চয় নিজে বাঁচার জন্য এই কাজ করেছে।কচি বললো,ছাদের দরজা খোলা ছিলো,তুমি কি করে জানলে?রামু বললো,আমি সেই সময় একবার ছাদে গিয়েছিলাম।গিয়ে দেখলাম ছাদের দরজা খোলা।
ভাড়াটে মেয়েটা কোথায় কাজ করে কচি জানে না। এখন বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে কচি এখানেই থাকে। রামু মাঝে মাঝে আসে। সে বলে,আমি যখন থাকবো না, তুমি সতর্ক হয়ে থেকো। কারণ এবার খুনী তোমাকে টার্গেট করতে পারে। কচি বললো, কেন? আমি কি করলাম? রামু বলে, নিশ্চয় তাদের কোনো রাগ আছে। তাই তোমাদের সরানোর ইচ্ছে।
ভাড়াটে মেয়েটা কচির সঙ্গে আলাপ করলো।সে বললো,তোমার বাবাকে আমি মেসোমশায় বলতাম।আমাকে নিজের মেয়ের মত দেখতেন। তাই আমি তোমাকে একটা কথা বলি। শোনো তুমি থানায় গিয়ে পুলিশের সাহায্য নাও। তোমার কিন্তু এখনও বিপদ কাটে নি।
তোমার বাবাকে মারার পরে ওরা আবার কাকে যে টার্গেট করবে, কে জানে? সাবধানে থাকতে হবে।
দুৃকড়ি বাবুর স্ত্রী কিছুই বুঝতে পারছেন না। এখন কচি তার কাছেই আছে বাবা মরে যাওয়ার পরে। রামু মাঝে মাঝে আসে। দুকড়ি বাবুর স্ত্রী রমাদেবী রামুকে বললেন,বাবা,আমার তো ছেলে নেই। তুমি আমার বাড়িতে ছেলের মত থাকলে আমি সাহস পাই। কচি বললো,ঠিক আছে তাই হবে। তারপর রামুকে বললো,তুমি আজ থেকে এখানেই থাকবে। রামু তার বাড়িতে বলে সব ব্যবস্থা করে চলে এলো শ্বশুরবাড়ি।আর ভাড়াটে মেয়েটার নাম ফুচি। সে রাতে রামুকে দেখে বললো,ঠিক করেছেন। আপনি এখানে থাকলে মাসীমার অনেক সাহস বাড়বে।
কয়েকদিনের মধ্যে  রামু সংসারের প্রধান হয়ে গেলো।সে সমস্ত ব্যবস্থা করে বাড়িটাকে ঠিকঠাক রাখার চেষ্টা করছে। 
রামু ভাবুক প্রকৃতির লোক।রাতে সবাই খাওয়া দাওয়া করার পরে শুয়ে পড়লে রামু ছাদে গিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকে। চুপচাপ নির্জন রাতে গাছগুলো বড় রহস্যময় লাগছে। রামুর ভাবনার মাঝেই একটা চিৎকার শুনতে পেলো।মা গো বাঁচাও গো,চিৎকারে রামু ছুটে নেমে এলো।নীচে এসে দেখলো,কচি পড়ে আছে মেঝেতে। তার মাথা বেয়ে রক্তের ধারা। রামু, ফুচি,রমাদেবী সবাই অবাক। কে মারলো কচিকে। রামু বললো,ওসব চিন্তা পরে হবে। এখন আমি কচিকে নিয়ে হাসপাতালে যাই। আঘাতটা খুব বেশি নয়। ঠিক হয়ে যাবে। এইবলে রামু একটা টোটো ডেকে কচিকে নিয়ে চলে গেলো হাসপাতালে।
পরের দিন আবার পুলিশ এলো। এসেই রামুকে প্রশ্ন করতে শুরু করলো।
-----আপনি রাতে কোথায় ছিলেন?
-----ছাদে
------এত রাতে ছাদে কি করছিলেন?
-----এমনি বসে ছিলাম। তারপর কচির চিৎকারে আমি নিচে নামি।
-----আপনাকে আমাদের সঙ্গে থানায় যেতে হবে। পরপর দুটো অঘটনের পর আমরা আপনাকে সন্দেহ করছি। চলুন।
রমাদেবী বললেন,ও আমার ছেলের মত। ও নির্দোষ।ওকে নিয়ে যেয়ো না বাবা।
কিন্তু কে শোনে কার কথা। পুলিশ সন্দেহবশত নিয়ে যেতেই পারে, বললো,ফুচি। ফুচি বললো,আমি আছি। আপনার কোনো ভয় নেই।
আজ রবিবার। ফুচির ঘরে ছেলেটা এসেছে। নানারকম রান্নাবান্না হচ্ছে। রমাদেবী নিমন্ত্রিত। রমাদেবীর মন ভালো নেই। মেয়েটা আজ চারদিন হাসপাতালে। জামাই থানায়। একা একা নিজে ভীষণ অসহায় হয়ে পড়েছেন। ফুচি আছে বলে একমুঠো খেতে পাচ্ছেন। তা না হলে উপোস করতে হতো। 
খাওয়া দাওয়া কম্প্লিট হওয়ার পরে রমাদেবী শোওয়ার ঘরে ঢুকলেন। খাওয়ার পরে একটু বজ্রাসনে বসেন তিনি।চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। এমন সময়ে রমাদেবীর চোখে গামছা বেঁধে ফেললো একটা লোক।রমাদেবীর মুখও বেঁধে ফেলেছে লোকটা। রমাদেবী ভাবছেন,এবার জীবন শেষ। এ কি চোর না খুনী। তিনি ভাবছেন,এই খুনীই কি আমাদের একে একে মারছে। কি এর উদ্দেশ্য।
রমাদেবীকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। একটু পরেই লোকটা বললো,পেনটা ধরুন। তারপর এখানে সই করুন। রমাদেবীর এখন চোখ খোলা। সব দেখতে পাচ্ছেন। শুধু পিছন দিকে আর একজন মাথাটা চেপে ধরে আছে। কে এরা? তিনি ভাবছেন, এখন কি চিৎকার করবো। তাহলে ফুচি আসবে ছেলেটা আসবে। হঠাৎ ধমকের সুরে লোকটা বলে উঠলো,সই করুন। তা না হলে আজকেই আপনার জীবন শেষ।রমাদেবী দলিলের কাগজে পর পর অনেকগুলো সই করতে বাধ্য হলেন। তিনি ভাবলেন,এসব কিছুই বুঝি না। কি জানি কি সব্বোনাশ করলো। এরপরে আবার লোকটা চোখ,মুখ বেঁধে দিলো রমাদেবীর। তারপর নাকে কি একটা স্প্রে করে দিলো। রমাদেবী জ্ঞান ফেরার পরে পুলিশের সামনে সকালে বললেন, আর কিছুই আমার মনে নেই।
----আপনার কাকে সন্দেহ হয়।
 ফুচি বললো,আমাকে ডাকলেন না কেন?আমি আসতাম। আমার বন্ধুও ছিলেন। এই দেখুন আপনার বিপদ দেখে পুলিশে খবর দিয়েছি।
----- আপনার সন্দেহ হয় কাকে?
-----কার নাম করবো। বাড়িতে আমরা তিনজন ছিলাম। আর কোনো চোর হয়তো ঢুকেছিলো ঘরে।
---হুম। এটা সাধারণ চোরের কাজ নয়।
তারপর পুলিশ ঘরে ঢুকলো। রমেশবাবু জাঁদরেল পুলিশ অফিসার। ঘরে তিনি একটা গামছা পেলেন। হয়ত তাড়াতাড়ি পালাতে গিয়ে ফেলে গেছে। সবার চোখের আড়ালে তিনি গামছাটা তুলে ব্যাগে রাখলেন।
রমাদেবীকে গাড়িতে তুলে নিয়ে থানায় চলে এলেন।
 
কচি এখন হাসপাতালে। বিপদ কেটে গেছে। রামু কচিকে নিয়ে থানায় চলে এলো।
রমেশবাবু রমা দেবীকে গামছাটা দেখালেন। তিনি বললেন,দেখুন তো। এই গামছাটা আপনি চিনতে পারছেন?
রমাদেবী ভালো করে দেখে বললেন, এই গামছা আমি ফুচির ঘরে দেখেছি।
রমেশবাবু বললেন,এই গামছা দিয়েই আপনাকে বাঁধা হয়েছিলো। অপরাধীরা এই রকম ছোটোখাটো ভুল করে। আর সেই ভুলেই ওদের পতন হয়। ওরা ধরা পড়ে যায় সহজেই।
কচি বললো,আমারও ওকে আর ওর বন্ধুকে সন্দেহ হতো। কিন্তু কোনো প্রমাণ না পেয়ে ওদের ধরা যাচ্ছিলো না।
তারপর সদলবলে রমেশবাবু রমাদেবীর বাড়ি গেলেন। অফিস থেকে ফুচিকে ডাকা হলো। সবার সামনে রমেশবাবু  বললেন,এই গামছা কার?তোমার ফুচিমণি।
ফুচি বললো,না আমার নয়।
রমাদেবী বললেন,মিথ্যাকথা বলছো কেন?আমি তোমার ঘরে এই গামছা দেখেছি।
-----না, আমি বলছিলাম এটা আমার নয়। আমার বন্ধুর।
রমেশবাবু হুংকার দিয়ে বললেন,ডাকো তোমার বন্ধুকে। সেই খুনী। তোমরা দুজনে এই বাড়ি দখলের ছক কষেছো। লজ্জা করে না লোভের কবলে মনুষ্যত্ব
 হারিয়েছো।
একজন মহিলা অফিসার গিয়ে সপাটে এক চড় মারার সঙ্গে সঙ্গেই ফুচি সব কথা বলতে শুরু করেছে। 
সে বলছে,আমার বন্ধুকে বারবার বারণ করেছি। কথা শোনেনি। ইতিমধ্যে জরুরি কল পেয়ে বন্ধু ফুচির কাছে এসে ফেঁসে গেছে।
রমেশবাবু খুনীর জামার কলার চেপে ধরে বললেন,শালা খুনী।এবার কোথায় যাবি। ধনী হওয়ার ইচ্ছে তোর জন্মের মত গেলো।
বল কি করে খুন করলি দুকুড়ি বাবুকে।কি দিয়ে আঘাত করেছিস নিয়ে আয়।
ফুচি সঙ্গে গেলো ঘরের ভিতরে। তারপর একটা শিলনোড়া নিয়ে এসে বললো, এটা দিয়ে।
রক্ত লেগে থাকা নোড়া রুমাল দিয়ে ধরে রমেশবাবু ব্যাগে ভরলেন। তারপর খুনীর পিছনে একটা লাথি কষিয়ে বললেন,এইবার তুই বল। কেন মেরেছিস।
খুনী ছেলেটি বললো,ধনী হওয়ার অন্ধ বাসনায় আমি একাজ করেছি। ফুচিকে বিয়ে করে এই বাড়ি দখল করে এখানেই থাকতে চেয়েছি। কোনোদিন ভাবিনি একটা গামছা সব প্ল্যান ওলট পালট করে দিতে পারে। 
রমেশ বাবু বললেন,চল শালা এবার সারাজীবন পচে মরবি চল। আর খুনীকে সাহায্য করার জন্য ফুচিকে গ্রেপ্তার করা হলো।
খুনী ছেলেটি বললো,এই গামছা দিয়েই আমি রমাদেবীর চোখ মুখ বেঁধে রেখেছিলাম।
ফুচি ঘর থেকে নকল দলিলটা এনে বললো,এই নিন স্যার দলিল।
সবাই চলে গেলে রমাদেবী ঠাকুরকে গলায় কাপড় দিয়ে প্রণাম জানালেন।