গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৯

সুবীর কুমার রায়


মধু চন্দ্রিমা



বিয়ের পরে, সে যত বছর পরেই হোক না কেন, স্বামী স্ত্রীর একসাথে কোথাও ভ্রমণে যাওয়া নিয়ে সাধারণ মানুষের কৌতুহলের সীমা নেই। এখন ব্যাপারটা নিয়ে যতটা হইচই লাফালাফি করা হয়, আগে কিন্তু তা ছিল না। ঘটনাটা যদিও চিরকালই ছিল, আজও আছে। তবে এখনকার মতো বিয়ে ঠিক হওয়ার সাথে সাথে, কোথায় অনুষ্ঠান হবে, মেনু কি হবে, পিওর সিল্ক না কাঞ্জিভরম, ইত্যাদি ঠিক হওয়ার আগেই, উভয়ে মিলে জায়গা পছন্দ, হোটেল বুকিং, টিকিট কাটা সম্পন্ন হতো না। এমনকী আগে এই নিয়ে ব্যস্ততা বা মাতামাতিও বিশেষ লক্ষ্য করা যেত না।
আজ আমি আটের দশকের গোড়ায়, এক নবদম্পতির সেই অর্থে মধুচন্দ্রিমা না হলেও, বিয়ের পর দু’জনের একসাথে প্রথম বাইরে বেড়াতে যাওয়ার ঘটনা শোনাবো। হ্যাঁ, ঘটনাটি আমার নিজের জীবনের এক তিক্ত অভিজ্ঞতাও বটে। বিয়ের দিন কুড়ি-পঁচিশ পরে জানুয়ারী মাসের এক শনিবারের সকালে হঠাৎ ঠিক করলাম,  যে আজ অফিস থেকে ফিরে দিন তিন-চারেকের জন্য সস্ত্রীক দীঘা ঘুরতে যাবো। পূর্বে বহুবার দীঘা ঘুরতে যাওয়ার সুবাদে, ছোট্ট দীঘা শহরটি আমার হাতের তালুর মতোই পরিচিত ছিল। স্ত্রীকে সেইমতো সবকিছু গুছিয়ে রাখতে নির্দেশ দিয়ে, অফিস চলে গেলাম। তখন ইন্টার নেট, মোবাইল, গুগল, অনলাইনের গল্প এদেশে চালু হয়নি। হাতেগোনা কিছু মানুষের বাড়িতে দশফুটোর কালো বেঢপ টেলিফোন দেখা যেত মাত্র। কাজেই আগে থেকে হোটেল বুকিং করার সময় ও সুযোগ, কোনটাই আমার হাতে ছিল না। ছোট্ট দীঘা শহর বললাম, কারণ নিউ দীঘা তখন পরিকল্পনার মধ্যে থাকলেও, সেই অর্থে তৈরিই হয়নি। পূর্বে হাওড়া বা  কলকাতা থেকে দীঘা যেতে হলে, খড়গপুর থেকে বাস ধরে যেতে হতো। কিন্তু হলদি নদীর ওপর মাতঙ্গিনী সেতু, যা নরঘাট ব্রিজ নামেও পরিচিত, তৈরি হওয়ায় এখন আর খড়গপুর পর্যন্ত না গিয়ে, মেচেদা থেকে বাসে সরাসরি যাওয়া যায়।
অন্যান্য শনিবারের তুলনায় অনেক আগে অফিস থেকে ফিরে, এতটুকু সময় নষ্ট না করে, দু’জনে দীঘার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। মেচেদায় নেমে জানা গেল, নরঘাট ব্রিজের কাছে নিজেদের মধ্যে কি নিয়ে গোলমাল  হওয়ায়, এদিকের বাস ব্রিজ পর্যন্ত যাচ্ছে। ব্রিজের ওদিকে সম্ভবত বাস চলাচল বন্ধ আছে। স্থানীয় একজন উপদেশ দিলেন, এখান থেকে মাতঙ্গিনী সেতু পর্যন্ত বাসে গিয়ে, নৌকায় ওপারে গিয়ে যাহোক কিছু একটা ম্যানেজ করে স্বচ্ছন্দে দীঘা চলে যেতে পারবেন। এইভাবে আন্দাজে ব্রিজ পর্যন্ত বাসে গিয়ে, যাহোক কিছু একটা ম্যানেজ করে দীঘা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া শুধু মুর্খামি নয়, গোঁয়ার্তুমি ও হঠকারীতার নামান্তরও বটে। সকাল থেকেই গন্ডগোলের জেরে বাস বন্ধ, তাই আর বৃথা সময় নষ্ট না করে, খড়গপুর হয়ে দীঘা যাওয়া স্থির করে ফেললাম। মেচেদার কাছেই হাওড়া জেলার একটি রেলওয়ে স্টেশনে, আমার এক নিকট আত্মীয় থাকেন, অসুবিধা হলে তাঁর বাড়িতে রাতে ফিরে এসে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে খড়গপুরের ট্রেন ধরলাম।
খড়গপুর এসে দেখি, দীঘা যাওয়ার জন্য সামান্য কিছু যাত্রী নিয়ে একটি বাস প্রস্তুত। কখন ছাড়বে জিজ্ঞাসা করায় জানা গেল, অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ছেড়ে দেবে, তবে বাসে উঠতে গেলে আগে টিকিট কেটে তবে বাসে উঠতে দেওয়া হবে। এই জাতীয় নিয়মের সাথে আগে পরিচিত না হলেও, পরিস্থিতির চাপে বাধ্য হয়ে দীঘার দু’টো টিকিট কেটে বাসে উঠে আসন গ্রহণ করলাম। বেশ কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হলেও, নানা অজুহাতে বাস আর ছাড়ে না। আগেই টিকিট কাটতে হয়েছে, তাই নেমে যাওয়ারও কোন উপায় নেই। শেষে চিৎকার চ্যাঁচামেচি শুরু হতে, অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাস ছাড়লো। আমাদের ঠিক সামনে এক অল্পবয়সি দম্পতি বসেছেন। কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর থামতে থামতে বাসটা যেভাবে যাচ্ছে, তাতে বেশ বুঝতে পারছি, যে দীঘা পৌঁছতে বেশ রাত হয়ে যাবে।   
যাহোক্, বাস ক্রমশ ফাঁকা হতে হতে শেষপর্যন্ত রাত প্রায় সাড়ে দশটা নাগাদ দীঘা এসে পৌঁছলে, প্রায় সমস্ত যাত্রীই নেমে পড়লেন। একটি পুলিশ জীপকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। ওই জীপের ড্রাইভার জীপ থেকে নেমে, খুব খাতির করে আমাদের সামনের সিটে বসে আসা সেই অল্পবয়সি দম্পতির মালপত্র নিজে বয়ে নিয়ে গিয়ে তাদের জীপে বসালেন। জীপ ছেড়ে দিল, সম্ভবত তারা দীঘা থানার বড়বাবু বা অন্য কারও অতিথি।  তখন দীঘার সমুদ্রে, এই ঘাটটির কাছেই সবথেকে বেশি ভিড় হতো। বাঁদিকে সৈকতাবাস, সামনেই দীঘা সমুদ্র সৈকতের প্রধান ঘাট, এখান থেকেই ডানদিকে কিছুটা দূরে গিয়ে বাস স্ট্যান্ড। আমাদের বাসের যাত্রীরা সকলেই সম্ভবত স্থানীয় অধিবাসী। যে যার মালপত্র নিয়ে চলে যেতেই, জায়গাটা একবারে ফাঁকা হয়ে গেল। অনেক রাত, জানুয়ারী মাসের ঠান্ডা, তাই বোধহয় ঘাটেও কোন ট্যুরিস্ট নেই। এখানেই একটি হোটেল, এতদিন পরে ঠিক স্মরণ করতে পারছি না, তবে সম্ভবত সি ভিউ নামে হোটেলটিতে গিয়ে একটি ঘরের কথা বলতে জানা গেল, যে হোটেলটিতে একটি ঘরও ফাঁকা নেই। ভদ্রলোক জানালেন, যে গতকাল থেকে একটি প্রধান রাজনৈতিক দলের গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশনের তিন দিনব্যাপী কনফারেন্স দীঘায় শুরু হওয়ায়, কোথাও কোন হোটেল ফাঁকা নেই। আপনাদের একটু খোঁজ নিয়ে আসা উচিৎ ছিল। আমাদের এই খবর জানা ছিল না। যে কোন ভাড়ায় যে কোন একটা ঘর অন্তত আজকের রাতটার জন্য দিয়ে আমাদের এই বিপদ থেকে উদ্ধার করার অনুরোধে তিনি জানালেন, যে আজ এবং আগামীকাল কোন ঘর তাঁর পক্ষে দেওয়া কোনভাবেই সম্ভব নয়। তবে পরশু দিন তিনি অবশ্যই আমাদের জন্য একটি ভালো ঘর রেখে দেবেন।  
রাত বাড়ছে, এখানে আর সময় নষ্ট করে লাভ নেই বুঝে রাস্তায় নামলাম। নির্জন ফাঁকা রাস্তায় শীতের রাতে এক এক করে অনেক জায়গায় ঘুরে ঘুরে বুঝতে পারছি, আজ এই রাতে কোন একটা নিরাপদ আশ্রয় পাওয়ার আশা, লটারির পুরস্কার পাওয়ার থেকেও ক্ষীণ। ইতিমধ্যে একটি রোগা মতো যুবক কোথা থেকে এসে হাজির হয়ে আমাদের ঘর লাগবে কী না জিজ্ঞাসা করলো। তার চেহারা ও ট্যারা চোখ দেখে, আশার থেকে ভয় হয় বেশি। বুঝতে পারছি, যে যুবকটি ঘরের দালালি করে।  
এখন দেখি দীঘায় গেলে সঙ্গে নারী না থাকলে, ঘর পাওয়া খুবই ঝামেলা সাপেক্ষ। তখন কিন্তু সঙ্গে নারী থাকলে, অন্যরকম বিপদের সম্ভাবনা অনেক বেশি ছিল। তখন ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড, বার্থ সার্টিফিকেট, প্যান কার্ড, পাসপোর্ট, আধার কার্ড, বা এখনকার মতো হাজার একটা পরিচিতিপত্রের প্রয়োজন হতো না। বিপদটা আসতো প্রশাসনের রক্ষাকর্তাদের কাছ থেকে। পুলিশ যে তাদের মাস মাহিনার ওপর সন্তুষ্ট থাকতে  না পেরে, বিভিন্নভাবে উপরি আয়ের ফন্দিফিকির খুঁজে বেড়ায়, এই ঘটনা তখনও দেখেছি আজও দেখি। হয়তো পুরাতন প্রস্তর যুগেও, এদেশের মানুষ তা দেখেছে। সম্ভবত এই জাতীয় দালাল অনুচরদের কাছ থেকেই স্থানীয় থানা খোঁজখবর জোগাড় করে, একঘরে নারী-পুরুষ আছে এমন ঘরে, বিশেষ করে অনামী কমদামি হোটেলে রাতদুপুরে গিয়ে ঝামেলা করে থানায় তুলে আনতো, এমনকী লক-আপে ঢুকিয়ে দিত। লোকলজ্জার ভয়ে অধিকাংশ নরনারীই প্রশাসনিক ভগবানকে মূল্য ধরে দিয়ে মুক্তি পেত। পরবর্তীকালে একটি বিখ্যাত দৈনিক সংবাদপত্রে দেখেছিলাম, যে এক দম্পতিকে গভীর রাতে জোর করে থানায় তুলে এনে তাঁরা যে স্বামী-  স্ত্রী প্রমাণ চাওয়া হয়। এ বড় কঠিন সমস্যা, পরিচয়পত্র ছাড়া, তখন যেটা বাধ্যতামূলক ছিল না, এটা প্রমাণ করা স্বয়ং ভগবানের পক্ষেও সম্ভব নয়। ডি.এন.এ. পরীক্ষা করে হয়তো পিতা-কন্যা, মাতা-পুত্র, ভ্রাতা-ভগ্নি প্রমাণ করা সম্ভব, কিন্তু স্বামী-স্ত্রী কোন্ পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়, আমার সঠিক জানা নেই। যাহোক, তাঁদের সাথে কোন পরিচিতিপত্র না থাকায়, মুখের কথা ছাড়া প্রমাণ করার কোন দ্বিতীয় উপায় ছিল না। এই নিয়ে তর্কাতর্কির শেষে তাঁদের লক-আপে স্থান হয়। লোকলজ্জার হাত থেকে নিজেদের রক্ষা  করতে, তাঁরা বাধ্য হয়েছিলেন পুলিশকে উপযুক্ত নজরানা দিয়ে মুক্তি পেতে। ফিরে এসে ওই প্রথম শ্রেণীর সংবাদ পত্রে তিনি গোটা ঘটনাটা চিঠি দিয়ে জানান। তিনি ছিলেন কোন এক নামী ডাক্তার। তাঁর পত্র সংবাদ পত্রে প্রকাশিত হওয়ার পর তাই নিয়ে খুব হইচই হয়, অনেকেই তাঁদের অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা জানিয়ে ক্ষোভ উগরে দেন। শুনেছিলাম ওই অফিসারটিকে স্থানান্তরিত করা হয়। কিন্তু ওই অফিসারটিই তো রাজ্যের একমাত্র অসৎ ও লোভী ছিলেন না।     
সে যাইহোক, শেষে কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে বিশাল ট্যুরিস্ট লজে গিয়ে হাজির হলাম। পিছন পিছন কিন্তু যুবকটি একটাই কথা বলতে বলতে হেঁটে চলেছে, “আজ আপনারা কোথাও জায়গা পাবেন না। আমার সাথে চলুন, ঘরটা পছন্দ হবেই, এরপর ওই ঘরটিও হাতছাড়া হয়ে যাবে”। এই ট্যুরিস্ট লজে থাকার খরচ অনেক জেনেও, অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যেতেই হলো। এখানেই কয়েক বছর আগে একটা শুটিং-এর সময় এসে, মহানায়ককে থাকতে দেখেছিলাম। এখানেও ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোট সে তরী অবস্থা। আমি জানালাম যে, যেকোন মূল্যের ঘর নিতে আমি প্রস্তুত। কিন্তু অনেক অনুরোধ করেও কোন ফল না হওয়ায়, তাঁদের সমস্ত ঘটনার কথা খুলে বলে আমাদের বিপদের কথা বললাম। তাতেও কোন ফল না হওয়ায়, ট্যুরিস্ট্ লজের বারান্দায় আজকের রাতটা নিরাপদে কাটাতে দিতে অনুরোধ করায়, তাঁরা পরিস্কার জানিয়ে দিলেন যে এই অনুমতি তাঁরা দিতে অক্ষম।
এতক্ষণে বুঝলাম যে যথেষ্ট ঝুঁকি সম্পন্ন হলেও, আজ রাতে ওই দালাল যুবকটির নির্দেশিত ঘরটি ছাড়া গত্যন্তর নেই। বাইরে এসে দেখি যুবকটি আমাদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। ঘরটি কোথায় ও কতো ভাড়া  জিজ্ঞাসা করায়, সে জানালো সামনেই ঘর এবং আমাদের পছন্দ হবেই। আমরা ঘর দেখে যা সঠিক বলে বিবেচনা করবো, সেই ভাড়া দিলেই হবে। এখন অনেক রাত, হাতে কোন বিকল্প ব্যবস্থাও নেই, তাই তাকে অনুসরণ করে এগতে শুরু করলাম। বলা ভালো, অনুসরণ করতে বাধ্য হলাম।  
রাস্তার পাশেই ‘ভবার হরবোলা মন্দির’ লেখা একটা সিমেন্টের তৈরি বেশ বড়ো সাইনবোর্ড। এর আগেও অনেকবার দীঘায় এসে সেটা লক্ষ্য করেছিলাম। কিন্তু ওই পর্যন্তই, ভবা বা তার হরবোলা মন্দিরটি কোথায়, দেখা বা জানার সুযোগ হয়নি। রাস্তার অপর পারে দু’পাশে আগাছার জঙ্গলে ভরা মোরাম ঢালা একটা সরু রাস্তা নেমে গেছে। যুবকটির পিছন পিছন সামান্য পথ হেঁটে গিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “আর কত দূরে”?  সে জানালো, সামনেই গভর্নমেন্ট্ কোয়ার্টার্সের কাছে। এপথে আগে কখনও আসিনি, তাই চিনিও না। কাজেই বিশ্বাস না করেও উপায় নেই, তাই তাকে অনুসরণ করতে বাধ্য হলাম। আরও কিছুটা পথ যাওয়ার পর, আমার স্ত্রী অত্যন্ত ভয় পেয়ে আমাকে আর এগতে বারণ করলো। ভয় পাওয়াই স্বাভাবিক, অথচ না এগিয়েও উপায় নেই। তাই দাঁড়িয়ে পড়ে এবার বেশ চড়া গলায় তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “ঠিক করে বলোতো ঘরটা কোথায়”? সে জানালো, আমরা এসে গেছি সামনেই ঘর।  
হ্যাঁ, এবার আমরা সত্যিই এসে গেছি। সরু রাস্তাটার ডানপাশে সামান্য একটু মাঠের মতো ঘাসে ঢাকা খালি
জমি। জমির শেষ প্রান্তে, অন্ধকারে ছোট্ট একটা একতলা বাড়ি চোখে পড়লো। বাড়ির ঠিক সামনে একটা টিউবওয়েল। চারিদিক নিস্তব্ধ। আমরা মোরাম ঢালা রাস্তা থেকে নেমে, তার সাথে ছোট জমিটার ওপর দিয়ে বাড়িটার কাছে এসে, দুটো সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে আমাদের ঘরের দরজার কাছে হাজির হলাম। যুবকটি পকেট হাতড়ে ঘরের চাবি বার করে, ছোট্ট একটা তালা খুলে দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকে সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দিল।
এবার বাড়িটার একটা বিবরণ দেওয়া প্রয়োজন। দু’টো সিঁড়ি ভেঙে উঠেই, একটা ছোট বারান্দার মতো বাঁধানো জায়গা। সামনেই একটা দরজা, এটা দিয়েই আমাদের ঘরে ঢুকতে হলো। বারান্দার ডানপাশে শেষ   প্রান্তে, ভিতর থেকে বন্ধ আর একটা দরজা। জানা গেল যে ওটা অপর ঘরে ঢুকবার দরজা। এই বাড়িটায় দু’টোই ঘর। আমাদের ঘরে ঢুকে দেখা গেল একটাই বাল্ব, সেটা নাইট ল্যাম্প হিসাবে ভুল হলেও, আসলে ওটাই একমাত্র আলোর ব্যবস্থা। স্যাঁতসেঁতে ঘরটার বাঁদিকে প্রায় দেওয়ালের সাথে ঠেকানো একটা খাট। খাটের বিছানা দেখলে শোয়া তো দূরের কথা, বসতেও প্রবৃত্তি হবে না। খাটের ওপরে দু’টো ততোধিক নোংরা বালিশ, ও একটা ভাঁজকরা মশারি রাখা আছে। খাটের বাঁপাশে ও মাথার কাছে, সরু সরু শিক লাগানো দু’টো ছোট ছোট জানালা। স্বল্প আলোয় যেটুকু দেখা গেল, তাতে বুঝলাম যে বামদিকের জানালার বাইরে কোমর পর্যন্ত উচ্চতার জঙ্গলে ভরা একটা ফাঁকা জমি। মাথার দিকের জানালার বাইরে সম্ভবত একটা ডোবা। দু’টো জানলার কোনটাই কিন্তু বন্ধ করে ছিটকিনি লাগানো যায় না। খাটের মাথার দিকে ডানপাশে আর  একটা দরজা, শুনলাম ওই দরজা দিয়ে বাথরূমে যেতে হয়। খাট ও এই দরজাটির মাঝখানে একটা কাঠের ছোট টেবিল ও একটা চেয়ার। টেবিলের ওপর একটা অর্ধেক জলপূর্ণ নোংরা প্লাস্টিকের খাবার জলের জগ্, ও অ্যালুমিনিয়মের তৈরি বাঁকাচোরা একটা অ্যাশট্রে। ব্যস্, এই ঘরের জন্য এইটুকুই ব্যবহার্য মূল্যবান সম্পদ। যুবকটির সাথে ডানপাশের দরজা খুলে বাথরূমের সৌন্দর্য সন্দর্শনে গেলাম। ছোট্ট একটু জায়গা। তার ডানপাশে একটা দরজা ও বামপাশে ঘরের সাথে মানানসই একটা ছোট্ট বাথরূম-পায়খানা, ও ভিতরে একটা ছোটো চৌবাচ্চা। না, আবাসিকদের ব্যবহারের সুবিধার্থে একটা প্লাস্টিকের মগও চৌবাচ্চার ওপর রাখা রয়েছে। খুব পরিস্কার সবকিছু দেখা সম্ভব হলো না, কারণ শোয়ার ঘরের তুলনায় বাথরূমে আলোর প্রয়োজন স্বাভাবিক ভাবে অনেক কম হওয়ায়, অনেক হিসাব করে বাথরূমে সত্যিই একটা নাইট ল্যাম্প লাগানো হয়েছে। জানা গেল, ডানপাশের দরজাটি দিয়ে অপর ঘর থেকে বাথরূমে আসতে হয়। এও জানা গেল যে, দু’টো ঘরের ব্যবহারের জন্য এই একটিই বাথরূম।  
যাইহোক, দর কষাকষির কোন সুযোগ নেই জেনেও, এবার ভাড়ার কথায় আসা গেল। যথারীতি অনেক বেশি, প্রায় একটি পরিস্কার পরিচ্ছন্ন মাঝারি মানের হোটেলের ভাড়া চাওয়া হলো, সাথে একটি অদ্ভুত আবদার— ঘরটি তিনদিনের জন্য ভাড়া নিতে হবে। এই অদ্ভুত আবদারের কারণ জানতে চাইলে জানা গেল,  যে ঘরটি একজন তিনদিনের জন্য ভাড়া নিয়েছিলেন। তিনি না আসায় আমাদের ঘরটি ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তাই এই ব্যবস্থা। আমি বললাম, “তাহলে তো ভাড়া নেওয়াই উচিৎ নয়, বা নিলেও অনেক কম নেওয়া উচিৎ। তাছাড়া সেই ভদ্রলোক যদি এক মাসের জন্য ভাড়া নিতেন, তাহলে কি আমাদেরও এক মাসের ভাড়া দিতে হতো”? যুবকটি সংক্ষেপে উত্তর দিলো, “ভেবে দেখুন কি করবেন”। দাবিদাওয়ার কিন্তু এখানেই শেষ নয়। ঘর ভাড়া ছাড়া একটা ভালো পরিমান কশন্ মানি চাওয়া হলো, যেটা ঘর ছাড়ার সময় ফেরৎ পাওয়া যাবে। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ঘরের আসবাবপত্রের মূল্যের থেকেও বেশি কশন্ মানি প্রদানের প্রস্তাবও মেনে নিতে হলো। সময় নষ্ট না করে টাকা মিটিয়ে যুবকটিকে বিদায় করে, দরজা বন্ধ করতে গিয়ে দেখলাম কোন খিল নেই। একটিই ছিটকিনি, যার আকার একটা ছোট মিটসেফে ব্যবহৃত ছিটকিনির থেকেও ছোট। আর সময় নষ্ট না করে, পরের কাজগুলো খুব দ্রুত সেরে নেওয়ার প্রচেষ্টা শুরু হলো।
খাবার জলের জগটা নিয়ে বাইরের টিউবওয়েলের কাছে এসে দেখি, হাতের কড়ে আঙুল দিয়েও সহজেই হ্যান্ডেলটি ওপর নীচে করা যাচ্ছে। অভিজ্ঞতা থেকে জানি, যে কলের মুখ চেপে ধরে ওপরের ফুটো দিয়ে কিছুটা জল ঢেলে পাম্প করলে, অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই টিউবওয়েল থেকে জল পড়া শুরু হয়ে যায়। জগের জলটা কলের ভিতর ঢেলে দিয়ে, কলের মুখ চেপে ধরে পাম্প করা শুরু করলাম। কপাল ভালো, অল্প সময়ের মধ্যেই কলের হাতল ক্রমশ শক্ত হয়ে জল পড়তে শুরু করলো। ভালো করে জগটা ধুয়ে অনেকটা জল খেয়ে জগটা ভরে নিলাম, যদিও জানি না এই জল আদৌ খাওয়া উচিৎ কী না। এবার চটপট দ্বিতীয় কাজটা সেরে ফেলতে হবে। সঙ্গে সামান্য কিছু ফল ছাড়া কোন খাবার নেই। শীতকালের এতবড় রাতটা কিছু না খেয়ে থাকা ঠিক হবে না, তাই খাবারের সন্ধানে যেতে হবে। যদিও জানি না এতো রাতে কোন দোকান খোলা পাবো কী না, তবু চেষ্টা তো একবার করে দেখতেই হবে।
স্ত্রীর চোখমুখ দেখে নিজেরই খারাপ লাগছে, কিন্তু আমার কিছু করার নেই, কারণ পরিবেশ আমার হাতের বাইরে। স্ত্রীকে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করতে বলে সাবধান করে দিলাম, আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত কোন অবস্থাতেই দরজা না খুলতে। ছিটকিনির আকার দেখে খুব ভয় পেয়ে, সে আমায় বাইরে যেতে বারণ করলো। কিন্তু না গিয়েও উপায় নেই তাই আমাকে বেরতেই হলো।  
খুব দ্রুত পা চালিয়ে সমুদ্রের ধারে এসে হাজির হলাম। তখনকার দীঘার চেহারা যাঁদের মনে আছে, তাঁরা জানেন যে তখন এই অঞ্চলটাতেই বেশি দোকানপাট ছিল। সমুদ্রের ধারের ঘাটে একটাও পর্যটক নেই, খাবার দোকানগুলো বন্ধ করার আয়োজন করছে। অথচ এর আগে এর থেকেও অনেক রাত পর্যন্ত বন্ধুবান্ধবের সাথে এই ঘাটের সিঁড়িতে বসে কাটিয়েছি। আমাকে দেখে দোকানের একজন আমার কি চাই জিজ্ঞাসা করায়, জানতে চাইলাম কি খাবার পাওয়া যাবে। দোকানদার একে একে দোকানে অবিক্রীত যা যা পড়ে আছে, তার বিবরণ শোনাতে শুরু করলো। তাকে থামিয়ে রুটি ও একটা সবজি প্যাক করে দিতে বললাম।
খাবার নিয়ে ফিরে আসছি, সম্ভবত হোম গার্ডের পোষাক পরিহিত একটি যুবক কোথা থেকে এসে আমায় জিজ্ঞাসা করলো, “কোথা থেকে আসছেন”? তাকে দেখতে প্রায় একটু আগে দেখা দালাল যুবকটির মতো, এমনকী এরও একটা চোখ ট্যারা। বিরক্ত হয়ে উত্তর দিলাম, “আমি কোথা থেকে আসছি সেটা আপনার কি প্রয়োজন”? সে উত্তর দিলো আমি জিজ্ঞাসা করছি, তাই বলুন আপনি কোথা থেকে আসছেন? “আমি কোথা থেকে আসছি আপনাকে বলতে আমি বাধ্য নই” বলে আমি পা চালালাম।
বাসায় ফিরে এসে জগের জলে হাত ধুয়ে রাতের খাবার খেয়ে নিলাম। এবার তৃতীয় ও শেষ কাজ, বিছানা করে মশারি টাঙানো। সঙ্গে দুটো বিছানার চাদর নিয়ে এসেছিলাম। বিছানায় পাতা চাদরটা তুলে ফেলে বাড়ি থেকে আনা একটা চাদর পাতা হলো। নোংরা লেপটা গায়ে দিতে ঘেন্না করলেও বেশ ঠান্ডা, কাজেই গায়ে না দিয়েও উপায় নেই। অবশেষে আর একটা চাদর পেতে তার ওপরে লেপটা পাতা হলো। দুই চাদরের মাঝে আমাদের অনেকটা স্যান্ডউইচের মতো শুতে হবে। লেপের আকার দেখলাম দরজার ছিটকিনির মতোই ছোট। তোষকটা যদি পাঁচ ফুট চওড়া হয়, তাহলে লেপটা হয়তো চার ফুট হবে। মেনে নিতে হবে, মেনেও নিলাম। কিন্তু মশারি টাঙাতে গিয়ে দেখি সেটা সম্ভবত একটা সিঙ্গল্ বেডের মশারি, কোনভাবেই সেটাকে খাটের ছত্রিতে লাগানো সম্ভব নয়। অবশেষে সুটকেস খুলে পায়জামা বার করে, তার দড়ি দিয়ে কোনমতে কাজটা সম্পন্ন হলো। এবার কিন্তু লেপটাকে আর ছোট মনে হচ্ছে না। তোষকের নীচে মশারি গোঁজার কোন সুযোগ নেই, তাই একদিকে তোষকের নীচে গুঁজে অপরদিকে নিজের জামা প্যান্ট ইত্যাদি চাপা দিয়ে কাজটা কোনমতে সম্পন্ন করে শুয়ে পড়লাম। মনে একটাই চিন্তা, ওই ট্যারা হোম গার্ডটা বা পুলিশ রাতে ঝামেলা করবে নাতো? সারাদিনের পথশ্রমে বেশ ক্লান্ত থাকায় কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না।
ঘুম ভাঙলো বেশ ভোরে মুখ ধুয়ে বাথরূম সেরেই বেড়িয়ে পড়লাম নতুন কোন আস্থানার খোঁজে। দিনের আলোয় তন্নতন্ন করে খুঁজেও, একটা থাকার জায়গার সন্ধান পেলাম না। সকলেরই এক বক্তব্য, কালকের আগে কোন ঘর দেওয়া সম্ভব নয়। অবশেষে আবার কাল রাত্রের প্রথম হোটেলটায় গিয়ে অনুরোধ করলাম। ভদ্রলোকটি খুব ভালো। তিনি বললেন, দেওয়ার উপায় থাকলে গতকাল রাতেই আপনাদের ঘর দিয়ে দিতাম। অতদূর থেকে কষ্ট করে এসেছেন, কাজেই ফিরে না গিয়ে আজকের দিনটা কোনমতে কষ্ট করে কাটিয়ে দিন। আগামীকাল অবশ্যই আপনাদের একটা ভালো ঘর দেবো। কি আর করবো, চা জলখাবার খেয়ে সমুদ্রের ধারে ঘুরেফিরে দুপুর পর্যন্ত কাটিয়ে, নরকে ফিরে গেলাম। নোংরা বাথরূমে কোনমতে স্নান সেরে আবার সমুদ্রের ধারে যাবো বলে বেরিয়ে ডানদিকে নজর পড়লো। সেখানে আগাছার জঙ্গলের ধারে স্তুপীকৃত কন্ডোম পড়ে আছে। অনেকের মুখেই শুনি মেদিনীপুরের এইসব অঞ্চল নাকি তিনটি ‘ব’, অর্থাৎ বাদাম বালি ও বালিকার  জন্য বিখ্যাত। হয়তো এই বাড়িটিও তৃতীয় ‘ব’-এর জন্য ব্যবহৃত হয়।  
সমুদ্রের পাশে এসে মানসিক দুঃখ কষ্ট অনেকটাই লাঘব হলো। সত্যি, সমুদ্র প্রকৃতির এক আশ্চর্য সৃষ্টি। এর কাছে এলে সমস্ত দুঃখ কষ্ট ক্লান্তির সাময়িক অবসান হয়। চা জলখাবার খেয়ে দুপুর পর্যন্ত সমুদ্রের ধারে ঘুরেফিরে আমাদের একমাত্র আশার আলো, হোটেলটায় মধ্যাহ্ন ভোজের জন্য এসে উপস্থিত হলাম। একতলায় বেশ বড় ও পরিস্কার ডাইনিং হল। এখানে আসার আরও একটা কারণ, আর একবার আগামীকালের কথাটা স্মরণ করিয়ে দেওয়া। আমাদের দেখে ভদ্রলোক নিজে থেকেই জানালেন, যে আগামীকাল ঘর রাখা থাকবে। এখানে খাবারের মানও দেখলাম বেশ ভালো। মনে দুঃখ থাকলেও পেট ও জিভের সুখ মন্দ হলো না। খাওয়া দাওয়া সেরে অনেকক্ষণ বসে, শেষে আবার অগতির গতি, সেই সমুদ্রের কাছেই ফিরে গেলাম।  
ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নেমে এলো। রাত একটু বাড়তে, আবার সেই একই হোটেলে নৈশভোজ সেরে মর্তের নরকের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। যেতে ইচ্ছা করছে না, পা চলছে না, তবু যেতে হলো। বাড়িটাতে পৌঁছে ঘরের দরজা খোলার সময় অপর ঘরটা থেকে তীব্র অ্যালকোহলের গন্ধ জানিয়ে দিল, পাশের ঘরে লোক এসেছে। আজ কাজ অনেক কম। নতুন করে বিছানা করা ও মশারি টাঙানোর ঝামেলা কমাতে, সকালে বিছানা যেমন ছিল সেই অবস্থাতেই রেখে গেছি। জল খেয়ে গতকালের প্রক্রিয়ায় জগে জল ভরে নিয়ে এসে, ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলাম। মনে একটাই আনন্দ, রাত পোহালেই এই নরক যন্ত্রণার অবসান।
বাথরূম সেরে আলো নিভিয়ে রাজশয্যায় শরীর এলিয়ে দিলাম। একটু তন্দ্রা মতো এসেছিল, পাশের ঘর থেকে মহিলা কন্ঠের তীব্র আর্তনাদে ঘুমটা ভেঙে গেল। দীর্ঘক্ষণ এই আর্তনাদ চললো। সবকিছুর একটা শেষ আছে, আর্তনাদেরও শেষ আছে। একসময় সব চুপচাপ হয়ে গেল। কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না, যথারীতি ঘুম ভাঙলো বেশ ভোরে। উঠে পড়ে মুখ ধুয়ে বাথরূম সেরে মশারি খুলে বিছানায় পাতা দুটো চাদর ভাঁজ করে মালপত্র গোছাতে বসবো, এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। ভেবেছিলাম পাশের ঘরের লোকটি বোধহয় মহিলাটির মৃত্যু সংবাদ জানাতে এসেছে। দরজা খুলে দেখি সেই দালাল যুবকটি এসেছে। সে এই সকালে কেন এসেছে জানি না। সে কি একটা বক্তব্য রাখতে যাচ্ছিল, তাকে সেই সুযোগ না দিয়ে ভিতরে ডেকে এনে মশারিটা টাঙিয়ে গুঁজে দিতে বললাম। সে বোধহয় এই জাতীয় প্রস্তাবের জন্য প্রস্তুত ছিল না। আমতা আমতা করে মিনমিনে গলায় একবার বললো, “কেন কোন অসুবিধা হয়েছে নাকি”? সেকথার কোন উত্তর না দিয়ে বেশ জোর গলায় হুকুমের সুরে তাকে মশারিটা টাঙিয়ে দিতে বললাম। বিছানার সাথে মশারির বেমানান সম্পর্কের ইতিহাস, তার বোধহয় জানা ছিল না। তা নাহলে সে কিছুতেই অহেতুক সেই চেষ্টা করে নিজের বিপদ ডেকে আনতো না। তিন ফুটের মশারির দড়ি পাঁচ ফুটের খাটের ছত্রির একদিকে লাগিয়ে অপরদিকে লাগাতে গিয়ে অসমর্থ হয়ে সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। কথা না বাড়িয়ে কশন্ মানি ফেরৎ চাইলাম। সে বললো, “আপনারা তো আগামীকাল যাবেন, কাল সকালে দিয়ে যাবো”। পরশু রাতে আমার বিপদ ছিল, আজ কিন্তু নেই। তাই চিৎকার করে ধমক দিয়ে টাকা ফেরৎ দিতে বললাম। এবার সে সুরসুর করে পকেট থেকে টাকা বার করে আমার হাতে দিয়ে দিলো। আমি তাকে বাইরে অপেক্ষা করতে বলে, মালপত্র সুটকেসে ভরে বেরিয়ে এসে তার হাতে ঘরের চাবি দিয়ে, নতুন হোটেলের উদ্দেশ্যে এগিয়ে গেলাম।  
এত সকালে মালপত্র নিয়ে আমাদের আসতে দেখে, হোটেলের ভদ্রলোক তো অবাক। তিনি বললেন, “এতো সকালে কখনও ঘর খালি হয়? আগের বোর্ডার চলে গেলে ঘর পরিস্কার করে, তবে নতুন বোর্ডারকে ঘর দেওয়া হয়”। এ তথ্য আমারও অজানা নয়, তাই বললাম “সেতো আমি জানি। ওখানে আর এক মুহুর্ত  থাকার ইচ্ছা নেই, তাই মালপত্র নিয়ে চলে এলাম। মালগুলো একপাশে রেখে দিন, আমরা ঠিক সময় চলে  আসবো”। তিনি রাজি হলেন। মালপত্র একপাশে রেখে আমরা রাস্তায় নামলাম।
একটা দোকানে চা জলখাবারের অর্ডার দিয়ে স্ত্রীকে দোকানে বসিয়ে, একটা বড় স্টেশনারি দোকানে গিয়ে হাজির হলাম। ওই জাতীয় হোটেলের বিছানা থেকে নোংরা চর্মরোগ হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকার একটা ভয় মনের মধ্যে প্রথম দিন থেকে ছিলই। তখন সালফার সাবান ও নিকো সাবান নামে দু’রকমের গায়ে মাখার সাবান পাওয়া যেত। শুনতাম ওই সাবান দু’টো চর্মরোগ থেকে রক্ষা করে। সত্যি মিথ্যা জানি না,  তবে একটা নিকো সাবান কিনে চায়ের দোকানে ফিরে এলাম। চা জলখাবার খেয়ে সকালের মিঠে রোদে সমুদ্রের ধারে অনেকটা সময় কাটিয়ে, হোটেলটায় এসে হাজির হলাম।
ভদ্রলোক দোতলার একটা অ্যাটাচ্ড্-বাথ্ ঘর আমাদের দিয়ে জানালেন, এই ঘরটার পাশেই তিনি পরিবার নিয়ে থাকেন। তাই এই ঘরটা বয়স্ক ফ্যামিলি বা নব দম্পতি ছাড়া কাউকে দেন না। ঘর দেখে খুব ভালো লাগলো। একটু আগে শুনেছিলাম ওনারা স্বামী স্ত্রী এখানে থাকেন। দু’জনের একজন বাঙালি ও একজন  নেপালি না ভুটানি। ঘরের পিছন দিকে ব্যালকনি। ভদ্রলোক চলে গেলে, দু’বার করে আগাপাস্তলা নিকো সাবান মেখে স্নান সারলাম। মনে হল নিকো সাবানের সাথে একটা সিরিশ কাগজ কিনে এনে স্নানটা সারলে নিশ্চিন্ত হওয়া যেত। আমার হয়ে গেলে আমার স্ত্রী, গত দু’দিনের ব্যবহৃত বিছানার চাদর ও জামাকাপড় নিয়ে বাথরূমে ঢুকলেন। দীর্ঘক্ষণ সময় নিয়ে সমস্ত কিছু কেচে, স্নান সেরে তিনি বাইরে এলেন। ব্যালকনিতে দড়ি টাঙিয়ে সব কিছু শুকতে দিয়ে, আমরা তৈরি হয়ে নীচের ডাইনিং হলে গেলাম। আজকের মধ্যাহ্ন ভোজের আনন্দ ও খাবারের স্বাদই আলাদা বলে মনে হলো।
দু’টো দিন এখানে ছিলাম। অন্য কারও একটা গলার আওয়াজ পর্যন্ত শুনিনি। বুঝলাম এই জন্যই তিনি সবাইকে এই ঘরটা দেন না। দু’টো দিন খুব ভালো কাটলো। এর আগে বহুবার দীঘায় এসে সমুদ্রে নৌকা চাপার চেষ্টা করেও অসফল হয়েছি। এবার একজন নৌকা নিয়ে নিজে থেকেই “নৌকা চাপবেন নাকি বাবু” বলায়, আমরা ও অপর একটা ফ্যামিলি সমুদ্রে নৌকা চেপে অনেকটা দূর পর্যন্ত ঘুরে আসার সুযোগও পেলাম। যাইহোক, এবার ঘরে ফেরার পালা। হোটেল মালিককে ধন্যবাদ জানিয়ে ফেরার বাস ধরলাম। এবার কিন্তু নরঘাট ব্রিজের ওপর দিয়ে মেচেদায় এসে ট্রেন ধরলাম।