গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৯

তাপসকিরণ রায়

ধারাবাহিক -৪৭


জীবন বাস্তব, ঘটনা অলৌকিক


জীবনকে উপভোগ করতে গেলে তার মধ্যে ভয় আতঙ্ক অলৌকিকতা বা রোমাঞ্চ না থাকলেই যেন নয়। তাই জীবনের একঘেয়েমি কাটাতে আমরা মাঝে মাঝে ভৌতিক, অলৌকিক কিংবা রোমাঞ্চকর গল্পের আসর জমিয়ে বসতে ভালবাসি। রাতের নির্জনতায় এমনি একটা পরিবেশ যেন জমে ওঠে। আমরা বসে ছিলাম এক অলস দুপুরে, সেখানে নির্জনতা ছিল, মেঘলা ছায়াময় পরিবেশে আমাদের আসর গল্পে গল্পে জমে উঠেছিল। রিয়া আমার বড় শালির মেয়ে। থাকে দুর্গাপুর। আমাদের গল্পের মাঝখানে সে তার জীবনের অলৌকিক অভিজ্ঞতার কথা বলা শুরু করলো
রিয়া তখন ব্যাঙ্গালোরের আচার্য ইনস্টিটিউট অফ গ্রাজুয়েট স্টাডিজে পড়ছিল। হোস্টেলের নাম ছিল, বালাজি গার্লস হোস্টেল--যেটা হেসারাঘাট্টা মেইন রোডের লাগোয়া ছিল। হোস্টেলে আরও বেশকিছু মেয়েরা থাকতো। এক একটা রুমে দুজন করে স্টুডেন্টের থাকার ব্যবস্থা ছিল। ওদের বেশ কিছু দিন স্বাভাবিক ভাবেই কেটে গেছে। ইতিমধ্যে ওরা কিন্তু কিছুই টের পায়নি।  ভাবে ফাইনাল পরীক্ষা  এসে গেল। সবার পড়ার চাপ বেড়ে গেল। ফলে মেয়েদের রাত জাগা শুরু হল। সে দিন রাত বারোটা বেজে গেছে। ওদের ওপর তলার ঘরগুলির সামনে বড় লম্বা একটা লন। ওদের ঘরের বাইরে লন পার হয়ে কয়েকটা সিঁড়ি উঠে গেলেই ছাদের দরজা পড়ে। সে দরজা সারাদিন খোলা থাকার পর বিল্ডিঙের চৌকিদার প্রতি রাতেই ছাদের দরজা তালা দিয়ে যেত।
সে দিন রাতে তখনও রিয়ার ঘরের দরজা খুলে রাখা ছিল। তার ঘরের পার্টনার একটু আগে শুয়ে পড়েছে, মনে হয়েছে সে গভীর নিদ্রায় আছে। খোলা দরজার ফাঁক দিয়ে লন বারান্দার সামান্য অংশ  তার এক কোণে দেখা যাচ্ছে ছাদে উঠে যাবার সিঁড়িগুলি ধাপে ধাপে ক্রমশ উঠে গেছে ছাদের দরজা পর্যন্ত। একটু ঘুম ঘুম পাচ্ছিল রিয়ার। সে দিনের পড়া শেষ করার টার্গেট অনুযায়ী তার অনেকটা পড়াই বাকী রয়ে গিয়েছিল।  পড়ছিল, ঠিক এমনি সময় দরজার ফাঁক দিয়ে হঠাৎ তার চোখে পড়ল দরজার বাইরে একটা কালো ছায়া চকিতে যেন আড়ালে সরে গেল !
রিয়ার ঘুম ছুটে গেল--কি হল ব্যাপারটা ? ঘুম ঝিমের মাঝে সে কি কিছু ভুল দেখলো ? ভয় বিশেষ একটা সে পেলো না। বেশ কিছু দিন তো ওরা এখানে আছে--কৈ কোন রকম অলৌকিকতার আভাস তো ওদের মধ্যে কেউ কোন দিন পেয়েছে বলে মনে হয় না ! সে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো। চারিদিকে আবছায়া, অস্পষ্ট আলোয় চারপাশের ঘরগুলি স্তব্ধ হয়ে আছে। দু-একটা ঘরের ফাঁক ফোকর গলিয়ে সামান্য আলোর রশ্মি বাইরে বারান্দার আনাচে-কানাচে এসে পড়েছে। তাকালো রিয়া। বারান্দার লনে কেউ নেই, একদম ফাঁকা।  সিঁড়ির কাছে এলো, ফিরে তাকাল উপরে ছাদের দরজার দিকে। না, কেউ তো নেই ! তবে, তবে কিছু একটা ভুল ভাবনাই তার হবে। একটা ছায়ার দ্রুত পায়ে সরে যাবার দৃশ্য, এমনি এক ক্ষীণ আলোছায়া পরিবেশ। এতে তার ভ্রম দর্শন হতেই পারে। ঘরের দিকে পা বাড়াল রিয়া। সবে মাত্র ঘরের ভেতরে পা রাখতে যাচ্ছিল সে, হঠাৎ তার মনে হল তার পেছনে কেউ যেন দাঁড়িয়ে আছে।  পাশ ফিরল। না তো কেউ নেই ! এবার একটু ভয় নিয়ে সে একটা পা ঘরের ভিতরে রাখল। আর সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট সে টের পেল ওর ঘাড়ের উপর কারও যেন শ্বাস এসে পড়লো। সে এক লাফে ঘরের মধ্যে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। অলৌকিক অস্তিত্বের ব্যাপারে তখনও সে সন্ধিহান। হতে পারে নির্জনতা  বাইরে আলোছায়ার পরিবেশে তার মনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। শুয়ে শুয়ে ভাবনার মাঝে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল রিয়া।



পরদিন দিবালোকে গত রাতের অলৌকিক ঘটনাগুলোকে তার অনেকটা লৌকিক বলেই মনে হতে লাগল। ঘটনাটার কথা কাউকে আর সে প্রকাশ করল না।
এরপর আরও টা দিন কেটে গেল। এক দিন ওদের তালার কয়েকজন মেয়ে মিলে পড়াশোনার অবকাশে ছাদে একটু ঘুরে আসবে বেলে উঠে এলো। এদের মধ্যে রিয়াও ছিল। মেয়েদের অনেকের চুল খোলা ছিল--কেউ কেউ ছাদে এসে চিরুনি নিয়ে চুল আঁচড়ে  নিচ্ছিল। একটু সময়ের জন্য রিয়া ছাদের একধারে একলা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ তার মনে হল তার পেছনে যেন কেউ এসে দাঁড়াল !  ভাবল, অন্য মেয়েদের মধ্যে থেকেই বুঝি কেউ হবে।  পাশ ফিরে দেখল, না, কেউ নেই !  তখন ভয় পেয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল অন্য মেয়েদের কাছে। অন্য মেয়েরও তখন মাঝে মাঝে অনুভব করছিল, কেউ যেন তাদের চুল বারবার স্পর্শ করছে। এবার সবাই সবকিছু স্পষ্ট অনুভব করছিল, তাদের মনে হচ্ছিল, কেউ যেন বাতাসের সঙ্গে ফিসফিসিয়ে কথা বলে চলেছে। মেয়েরা সবাই ভয় পেয়ে গেল। রিয়া সবাইকে তাদের চুল তাড়াতাড়ি বেঁধে নিতে বলল।  জানে, বাইরে কখনও খোলা চুল রাখতে নেই। সবাই তখন ভয়ে ভয়ে তাড়াতাড়ি ছাদ থেকে নেমে এলো। সব মেয়েরাই তখন আতঙ্কিত।
এরপর থেকে ভয়ে ভয়ে রিয়ার তালার মেয়েরা রাত 'টা বাজলেই ঘরের দরজা এঁটে বসে থাকত। ওদের অনেক রাত পর্যন্ত আতঙ্কে ঘুম আসত না। কিছু দিন ধরে রাত বারোটার পর থেকে ওদের কানে নতুন এক রহস্যময় উপসর্গ ভেসে আসছিল,  নূপুরের শব্দ, কেউ যেন নূপুর পায়ে নিচের থেকে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসত। তারপর সে শব্দ উঠে যেত ছাদের দিকে। একটা সময় ছিল রাত বারোটা থেকে একটার মধ্যে এসব অলৌকিক ঘটনাগুলি ঘটতে থাকত। একবার আট দশ জন মেয়ে মিলে সাহস ভরে রাতে বেরিয়ে এলো ঘরের বাইরে। তাদের  মনে হয়ে ছিল যে এমনি ঘটনা কেউ তাদের ভয় দেখাবার জন্যে করছে না তো ? এমনটা হতেও  পারে ? এমন ধারণা নিয়ে তারা ব্যাপারটা যাচাই করতেই সে দিন নিজেদের ঘর থেকে বাইরের দীর্ঘ লনে বেরিয়ে এলো। কিছু সময় কিছুই ওরা টের পেল না--সামান্য পরেই ওরা শুনতে পেল, নূপুরের ঝুমঝুম আওয়াজ নিচের তলা থেকে উপরে উঠে আসছে। মেয়েরা সবাই আতঙ্কিত, উত্তেজিত। নূপুরের অস্পষ্ট শব্দ ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে আসছিল। ধীরে ধীরে সে শব্দ ওদের কাছে এগিয়ে আসছিল, ওরা ভয় পেয়ে নিজেরা পরস্পর নিজেদের গা ঘেঁষে জটলা করে দাঁড়ালো।
একদম কাছে বেজে চলেছে ঝমঝম শব্দ। ওরা শুধু কনে শব্দ শুতে পাচ্ছিল। কোন কিছুর ছায়া বা অস্তিত্ব টের পাচ্ছিল না। তারপর হঠাৎই শব্দ থেমে গেল। নিস্তব্ধ রাত টের পাওয়া যাচ্ছিল। মেয়েরা নিজেদের অস্তিত্ব হারিয়ে স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এমনি কয়েক মুহূর্ত পার হয়ে গেল। হঠাৎ ওদের মনে হল ওদের পাশ ঘেঁষে কোন অলৌকিক অস্তিত্ব যেন সরে গেলো। ওরা শুধু অনুভব করতে পারছিল, কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না। ভীত অস্পষ্ট চীৎকার দিয়ে মেয়েরা তখন সবাই ছুটে গিয়ে যে যার ঘরে ঢুকে পড়ল।



মেয়েদের মধ্যে একেবারে শেষপ্রান্তে একটা সাউথের মেয়ে থাকতো। সে নাকি বেশ সাহসী ছিল। সহজে ভয় পেত না। সেও দিন তিন আগে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে স্পষ্ট অনুভব করতে পারছিল, তার পেছনে কেউ যেন আসছে, তার ঘাড়ের উপর কারও শ্বাস বারবার এসে পড়ছিল।
আরেক দিনের কথা, হোস্টেলের উপর তলার সব মেয়েরা তখন ভয়ে একটা ঘরের মেঝেতে শুয়ে রাত কাটাচ্ছিল। ওরা রোজ রাতে শব্দ শুনতে পেত, কেউ যেন নূপুর পায়ে হেঁটে চলছে। একে বারে  নিচের তলা  থেকে কেউ উঠে আসে। তারপর ক্রমশ: উপরে উঠে আসে, ওদের ফ্লোরের পাশ ধরে সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠে যায়। এমনি এক দিনের কথা--মেয়েরা ভয় পেয়ে ঘর ছেড়ে নিচে গ্রাউনড ফ্লোরে নেমে এসেছে। একলা ঘরে থাকা সেই সাউথের মেয়েটা সাহস ভরে আর আলাদা ঘরে একলা থাকতে পারেনি। সেও ভয় পেয়ে দিন ধরে সবার সঙ্গে এক ঘরে থাকা শুরু করেছিল।
ভৌতিক উৎপাত ইতিমধ্যে বেড়ে গিয়ে ছিল। হোস্টেলের চৌকিদার ভয় পেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ছিল। তাকে নিয়ে শেষে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল। এমনি ভাবে হোস্টেলের একটা মেয়েও ভয় পেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ল। শেষে তাকেও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। তখন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে হোস্টেলের সমস্ত মেয়েদের মধ্যে। মেয়েরা ভয়ে জটলা করে এক ঘরে রাত কাটাতে শুরু করল। সাউথের মেয়েটা ভীষণ ভয় পেয়েছে। সে কয়েকবারই অনুভব করেছে যে সবার সঙ্গে থাকা সত্ত্বেও ঘরের মধ্যে তাকে কেউ যেন অনুসরণ করছে। দেখা যায় না, শুধু অনুভূত হয়। তার আশপাশ ঘিরে কেউ যেন চলাফেরা করে। সে দিন রাত কটা হবে ? বারোটা, সাড়ে বারোটা, সাউথের মেয়েটা ভীত আতঙ্কিত সন্ত্রস্ত নির্ঘুম অবস্থায় সবার সঙ্গে রাত কাটাচ্ছিল। এমন সময় সে আতংকে চিৎকার করে উঠল।
--কি হল ? কি হল তোর ? অন্য মেয়েরা ভীত-সন্ত্রস্ত প্রশ্ন করে উঠলো। মেয়েটা তার পাশে রাখা জলের বোতলটা দেখিয়ে কিছু যেন বলতে চাইল--তার মুখ থেকে শব্দগুলির স্পষ্ট উচ্চারিত হচ্ছিল না।
--কি বলছিস তুই ? মেয়েরা আবার ভয়ে  প্রশ্ন করল। মেয়েটার মুখ-চোখ ভয়ে লাল হয়ে উঠে ছিল। সে আরও ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে চীৎকার করে বলে উঠলো, জলের বোতলে, জলের বোতলে ভূত আছে ! ভূত ঢুকে আছে ! মেয়েটা ভয়ের কাঁপা গলায় চীৎকার করে বলে উঠলো, ওই দেখ, ওই দেখ, বোতলের মধ্যে থেকে ধোঁয়া বেরচ্ছেওর মধ্যে সবুজ একটা ভুত ঢুকে আছে ! এসব বলতে বলতে এক সময় মেয়েটা জ্ঞান হারাল। শেষে তাকেও নিয়ে যাওয়া হল হাসপাতালে।
নিজের জীবনের সত্যি ঘটনার বর্ণনা দিতে দিতে বারবার রিয়ার মুখে আতঙ্কের ছায়া পড়ছিল। রিয়া শুধু গল্প বলছিল না, বলতে বলতে স্পষ্টত ওর চোখে মুখে ফুটে উঠছিল ভয় শঙ্কার চিহ্ন। তার কারণ,  ঘটনা যে ছিল তার নিজস্ব জীবনের বাস্তব অনুভূতির গল্প।