গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৯

নীহার চক্রবর্তী


কালবন্ধন


মদ খেয়ে বেহুঁশ হয়ে পথের পাশে পড়েছিলো জব্বরের আব্বা ।
দেখে আর সইল নাওর । তড়িঘড়ি ছুটে গিয়ে ঝুঁকে পড়ে মাতাল আব্বার দু'গালে জোরসে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো । তবু সে হুঁশে ফিরল না ।
আকস্মিক এ দৃশ্য দেখে কয়েকজন জব্বরকে খুব বকতে থাকলো ।
একজন মেজাজের তুরীয় মার্গে উঠে ওকে বলল,'তুর লজ্জা বলে কিছু নাই ? আব্বার গায়ে কেউ হাত তুলে ? আল্লায় কি গুনা দিবো জানস তুই ?'
মুখের মতো জবাব দিলো জব্বর,'আমার আব্বারে তুমরা আইজ থেইকা চিনো না । কিন্তুক কুনুদিন কইছ তাকে মদ খাইতে নাই ? সংসার ভাসি যায় ? কও নাই । লজ্জা কারে কয় আমারে শিখাইতে আইস না কেউ ।'
লোকের ভিড়ের মাঝে ছিল বৃদ্ধ মুসলেউদ্দিন ।
সে বড় বিষণ্ণ-গলায় বলল,'জব্বর কতাটা খারাব কয় নাই । আমরা সেলিমরে অনেকদিন ধইরা চিনি । কিন্তু কেউ আমরা অরে সৎ উপদেশ দিই নাই । বজা দেখছি দিনে-দিনে । আইজ মুনে হয় আমাগোর অনুতাপের দিন আইছে ।'
একথা বলেই সে নিজে একটা ভ্যান ডেকে জব্বরকে সাহায্য করলো ওর আব্বাকে ভ্যানে তুলতে । জব্বরের দু'চোখ তখন অশ্রু-সজল ।
মুসলেউদ্দিন জব্বরের পাশে বসলো । সারাক্ষণ ওর পিঠে সে স্নেহের হাত রেখে গেলো । তবে জব্বরের চোখের পানি সে মুছতে চাইলো না ।
আধঘণ্টার মধ্যে ভ্যান এলো জব্বরের বাড়ির সামনে । সেখান থেকে জব্বর,মুসলেউদ্দিন আর ভ্যান-চালক খুব কষ্টে জব্বরের আব্বাকে ঘরে নিয়ে গিয়ে তুলল । স্বামীর অমন অবস্থা দেখে জব্বরের আম্মা কেঁদে আকুল্ল । তাকে খুব বকল মুসলেউদ্দিন ।
সে তাকে বলল,'আমি যহন আইছি একটা ব্যবস্থা হইবই । তুমি চুপ মেরে থাহ ।'
সে নিমেষে চুপ করে অপলকে কটমট চোখে চেয়ে থাকলো স্বামীর দিকে ।
সহসা মুসলেউদ্দিন জব্বরের আব্বা সেলিমের দু'গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো । অবাক কাণ্ড । তার দু'চোখ খুলে গেলো । হুঁশেও ফিরল বুঝি ।
অঝোর-ধারায় কাঁদতে কাঁদতে জব্বরের আব্বা তাকে বলল,'এমন করে কেউ মারে ? আমার দু'গাল জ্বইলা গেলো যে ।'
অমায়িক-হেসে মুসলেউউদিন তাকে বলল,'বেশ হইছে । কাঁদলে আরও থাপ্পড় খাবি তুই । পোলার থাপ্পড় বুঝস নাই । আমারডা বুজছস । দুই কাল মিইলা তরে আইজ শাস্তি দিচ্ছে । এইডাই আল্লার শাস্তি । আইর মদ খাবি কখনো ? সংসার ভাসাইবি আর ?'
জব্বরের আম্মা তাকে মেজাজের সুরে বলল,'মাতাইলের কান্না,চাচা । এতে আমি ভুলতাছি না । অনেক দেখছি এমন ।'
কিন্তু জব্বরের আব্বা সকাতরে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলতে থাকলো,'আমি এহন আর মাতাল নাই গো । হুঁশে ফিরছি । এ হুঁশ থাইকব বাকি জীবন পর্যন্ত । পোলার হাতে মার । চাচার কাছে স্নেহের শাস্তি । আমি কুনুদিন আর ভুলুম না ।'
কথা শেষ করে সে আকাশ-ভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়লো সে । তৎক্ষণাৎ বৃদ্ধ মুসলেউদ্দিন জব্বরের আব্বাকে বুকে চেপে ধরল । জব্বরের সারা মুখে হাসির ছটা দেখা দিলো । তবে ওর আম্মা মনে হয় গলল না । সারা মুখে বিরক্তি নিয়ে ঘরের বাইরে চলে গেলো ।
বাইরে থেকে হঠাৎ শুনল সে জব্বরের আব্বা নিজের 'মা-বাবা'র নাম ধরে কাঁদছে । সে শুনেই আবার ঘরে গেলো সে ।
মুসলেউদ্দিন তাকে দেখে কাছে ডাকল ।
হাত ধরে সে অনাবিল-হেসে বলল,'আইর ভয় নাই । দুই কালের শাস্তির মর্ম ও বুঝছে । তুমি ওর একটু হাতটা ধইরা হাইস ত।'
একান্ত বাধ্য হয়ে জব্বরের আম্মা ওর আব্বার হাত ধরে এক চিলতে কষ্টের হাসি হাসল ।
সাথে-সাথে আনন্দ-অশ্রুতে ভেসে গেলো জব্বরের আব্বা ।
শিশুর মতো কাঁদতে কাঁদতে স্ত্রীকে বলল,'আমার উপর এবারডা ভরসা রাখতি পারো । দুই কাল আমার চক্ষু খুইলা দিচ্ছে । আমি আর কখনো...'
তারপরেই জব্বরের আম্মা হেসে আকুল হল । সেই যে হাসি.... বিরের প্রথম রাত । জব্বরের আব্বা সেলিমের প্রথম একটা নিষ্পাপ ফুলের পাপড়ি খসাতে চাওয়ার মুহূর্তের সলাজ-হাসির মতো ।
তবে জব্বর লজ্জায় ওর আব্বার দিকে মুখ তুলে চাইতে পারলো না ।
তখন ওকে কাছে টেনে নিয়ে সেলিম পরম খুশির হাসি হেসে বলল,'আমার আব্বায় আমারে খুব মাইরত । সেই আব্বারে তুই আইজ ফিরায়ে দিচ্ছিস । আমি তর মাইর বুক ভরে নিছি ।'
আব্বার কথায় একটু-একটু করে হাসি ফুটে গেলো জব্বরের মুখে একসময় সারা মুখে সে হাসির দূতি খেলতে থাকলো ।
বৃদ্ধ মুসলেউদ্দিন সবকিছুর শেষে চোখ-ভরা পানি নিয়ে নিজের বাড়ির পা বাড়াল । সে সারা পথ চোখের পানি ফেলতে থাকলো সদ্য-মৃত মাতাল জামাইয়ের জন্য । তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার কেউ নেই তখন । খানিক শীতলতা দিতে চাইলো বৃষ্টি । বুঝি পরম করুণাময় আল্লাতালার বার্তা পেয়ে ।
তবে একবার অনেক পথ পেরিয়ে আসা জব্বরদের বাড়ির দিকে চেয়ে সে প্রশান্তর হাসি হেসে ফেললো ।
বুকে হাত রেখে বৃদ্ধ মুসলেউদ্দিন ভাবতে চাইলো,এভাবে যদি একে-একে অন্ধকার থেকে সব সূর্য বেরিয়ে আসে...