ধারাবাহিক হ্যান্টেড কাহিনী--৪০
সুন্দর
বনের অলৌকিক এক বাঘিনীর কথা
সুন্দর বনের একটি
গল্প।
সেখানে মানুষের বসতির পাশের গভীর জঙ্গলে বাস রয়েল ব্যাগল টাইগারের। এমনি ধরনের বাসিন্দাদের মাঝে বৈরী তো থাকবেই। আসলে
মানুষ ও জন্তুর মাঝে তফাত তো অনেক--আর
সে যদি হয় হিংস্র কোন জন্তু।
সুন্দর বনের এমনি
এক গ্রাম, নাম তার লালমোহন। গ্রামের একেবারে পাশটায় ছোট বড় ঝোপঝাড়,
তারপর শুরু হয়েছে ঘন বন। এখানে সুন্দরী, গড়ান, গর্জন,
অর্জুন এমনি সব বড় বড় গাছের জঙ্গল। কিছু
দিন আগে থেকেই এখানকার এক বাঘ মানুষ মারতে শুরু করেছে। বাঘের
নাকি এমনি স্বভাব ! একবার
মানুষের রক্তের স্বাদ পেলে, সব
ছেড়ে মানুষের মাংস খেতেই সে বেশী পছন্দ করে। আর এ কারণেই হবে, এ গ্রামের তিন তিনটে মানুষকে বাঘে খেয়ে নিয়েছে। তার আগে বাঘ অনেক গরু-বাছুর- ছাগল
খেয়ে বেরিয়েছে।
সে দিন দিনে-দুপুরে বিনয় তার জমি চাষ করতে করতে দেখতে
পেলো সেই মানুষখেকো বাঘটাকে। এ বাঘ যে গ্রামের ভেতর অনেকবার এসেছে। দীর্ঘ আকৃতির সে বাঘ, উচ্চতা তার পাঁচ ফুটের ওপরে হবে। বাঘের
সে লম্বা, চওড়া ও বলিষ্ঠ চেহারা
দেখেই বিনয়ের শরীর কেঁপে উঠল।
ওরে বাবা, বিনয় দেখল,
বাঘটা তার দিকেই তাকিয়ে আছে। সে বাঘ দেখে চীৎকার করে উঠতে
চাইলো কিন্তু তার মুখ থেকে কোন শব্দই বের হল না। মুহূর্তে
সে নিজেকে সামলে নিয়ে পেছন ফিরে ছুটে পালতে চাইলো। কিন্তু
তার পা’ও যেন চলতে চাইছিল
না !
ইতিমধ্যে একটা কাঁপানো
গর্জন শোনা গেলো। গ্রামের অনেক মানুষ সে ডাক শুনতে পেলো। পায়ের নিচের মাটিও যেন কেঁপে উঠলো। অনেকেই
ভয়ে ছুটে ঘরের ভেতর গিয়ে ঢুকল। কিন্তু বিনয়
? সে ক’পা
মাত্র এগোতে পারলো। তারপর তার কানে এলো ঘড়ঘড়, হুড়মুড়,
ভয়ঙ্কর সব শব্দ আর তার পরই তার ওপর পাথর প্রমাণ এক দৈত্য এসে যেন ঝাঁপিয়ে
পড়লো।
বিনয়ের অবচেতন মন বাস্তবতা হারিয়ে ফেলল। তাঁর
গলায় তীব্র একটা যন্ত্রণা অনুভূত হল। ভয়ে সে চোখ বুজে গেলো। বাঘের ধারালো দাঁতগুলি যেন তার শরীরের এফোঁড় ওফোঁড় হতে লাগলো। কোন রকম শব্দই সে আর টের পেলো না--সে জ্ঞান হারাল। বাঘ এবার ক্ষতবিক্ষত বিনয়ের আধমরা অবচেতন দেহটা
এক ঝাপটায় তুলে নিলো তার পিঠে। আর সাবলীল গতিতে সে ঢুকে গেলো জঙ্গলের গভীরে। এ ছিল বাঘের তৃতীয় শিকার।
বাঘের প্রথম শিকার
ছিল, অন্তু। অন্তু ছিল লালমোহন গ্রামের ছোট একটা ছেলে,
বয়স বছর দশের মত হবে। খুব ভোরে উঠে সে বন্ধুর বাড়ির দিকে যাচ্ছিল
আর ঠিক সেই সময় জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এলো সেই বাঘ,
এসে ঝাঁপ দিল তার ওপর। সেটা অন্তুকে ঘায়েল করে পিঠে তুলে জঙ্গলের
ভেতর ঢুকে গিয়েছিল। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তার দেহের চিহ্নটুকুও
আর খুঁজে পাওয়া গেল না। বাঘের দ্বিতীয় শিকার ছিল এই গ্রামেরই মধু
বুড়ো।
সে সন্ধ্যে বেলায় রাস্তা দিয়ে হাঁটাহাঁটি করছিল, তার সামনের জঙ্গলে সে হঠাৎ দেখতে পেল কিছু
যেন নড়েচড়ে উঠছে। তারপর সে দেখল ভয়ঙ্কর সেই বদনাম বাঘটা তার
দিকেই ঝাঁপ দিয়েছে। ব্যাস,
থাবা দিয়ে মধু বুড়োকে ঘায়েল করে পিঠে চড়িয়ে সে বাঘ জঙ্গলে ঢুকে গেল। এর পরই বাঘের তৃতীয় শিকার ছিল বিনয়। তারপর
সরকারের তরফ থেকে এক শিকারি এলো ওই মানুষ খেকো বাঘ মারতে। কিন্তু
সে শিকারী বাঘের হিংস্রতার কথা হয়ত আন্দাজ করতে পারেনি। বাঘ
তার তৈরি বার ফুট উঁচু মাচা থেকে তাকে ধরে নিয়ে গেল। পরদিন
সে শিকারীর খুবলে খাওয়া হাড়-পাঁজরের
সামান্য অংশ মাত্র খুঁজে পাওয়া গেলো।
এবার বাঘের ভয়ঙ্কর
রূপের কথা আন্দাজ করতে পেরে সরকার এক সঙ্গে তিন জন শিকারিকে পাঠাল। সেই বাঘ মারতে অবশেষে সেই তিন শিকারি পাশাপাশি তিন মাচান বেঁধে নিলো। অনেক কলা-কৌশল
করে শেষে তিন শিকারি মিলে বাঘকে গুলি বিদ্ধ করলো। ছ’ছটা গুলি খাওয়ার পরেও সে বাঘ পালিয়ে যাচ্ছিল। শেষ আরও দুটো গুলি খেয়ে বাঘ গ্রামের শেষ প্রান্তে এসে মাটিতে লুটিয়ে
পড়ে গেলো। শেষ বারের দুই গুলি বাঘের ঠিক কপালের মাঝখানে
এসে লেগেছিল। এবার বাঘ ফটফট করতে করতে মাটিতে পড়ে গিয়ে দু-তিনবার গড়াগড়ি খেয়ে স্থির হয়ে
গেলো।
অবশেষে সে অত্যাচারী বাঘ মারা পড়লো।
বাঘ দেখতে গ্রামের
প্রায় সব লোক এসে জড়ো হল। খবর পেয়ে আশপাশের অনেক গ্রাম থেকে লোকজন বাঘ
দেখতে ভিড় জমাল। এ খুঁখার বাঘ সুন্দর বনের এক ইতিহাস সৃষ্টি
করে ছিল। সুন্দর বনের সব লোকের মাঝে এ বাঘের হিংস্রতা ও
দুর্ধর্ষতার কথা মুখে মুখে ফিরতে লাগলো।
এর পরেই বুঝি আসল
ঘটনা জন্ম নিলো। সে বাঘের মৃত্যুর পর থেকে যেখানে বাঘের মৃত্যু
ঘটেছিল সেই গ্রামের প্রান্তভাগে অদ্ভুত অলৌকিক কিছু ঘটনা ঘটতে শুরু করলো। গ্রামের লোক হঠাৎ মাঝ রাতে জেগে উঠত। ওরা
বাঘের ভয়ংকর গর্জন শুনতে পেত। এমন মনে হত বাঘ যেন তার শিকার ধরার জন্যে ঝাঁপ
দিল। তারপর মানুষের মৃত্যুর আর্তনাদ
শোনা যেত। এবার মুহূর্ত কয় পরে ঘায়েল বাঘের মৃত্যু যন্ত্রণার
মত শব্দ শোনা গেলো। সে মৃত্যু যন্ত্রণার তোলপাড় করা আওয়াজ ছিল
আরও ভয়াবহ ! গ্রামের
বেশীর ভাগ লোক তা শুনেছে। গ্রামের যে প্রান্তে বাঘটা মারা গিয়েছিল সে
প্রান্তের ঘরের লোকরা ভয়ে ত্রাসে রাত জেগে কাটাত। এমনি
নিয়ম মত প্রায় প্রতি রাতে চলছিল সে ঘটনা। অবশেষে সরকারকে এ ঘটনার কথা জানানো হল। সরকারী
তরফ থেকে আবার সেই তিন শিকারীদের বাঘের উৎপাত বন্ধ করতে পাঠানো হল। কারণ, সরকারী
মহলের বিশ্বাস ছিল--ও
সব ঘটনা অলৌকিক কিছু হবে না--বাঘেরই
উৎপাত হবে।
তিন শিকারী গ্রামে
গিয়ে সেখানকার অলৌকিক ঘটনার কথা শুনতে পেলো। ওরা অবাক হল। বিশ্বাস-অবিশ্বাস
ওদের মনে দোলা খেতে লাগলো। ওরাও ঘটনার সত্যতার ব্যাপারে সন্দিহান ছিল। তিন শিকারীর তিন মাচা তৈরী হল--ঠিক সেখানে যেখানে সেই হিংস্র বাঘটাকে ওরা মেরে ছিল। শিকারীরা এই ধারণায় উপনীত হয়ে ছিল যে এটা অলৌকিক ব্যাপার-টেপার কিছুই হবে না। আসলে
যে বাঘটাকে তারা মেরেছিল, সেটা
ছিল একটা বাঘিনী। বাঘিনীর জোড়ার বাঘটা নিশ্চয় রোজ রাতে এসে এমনি
হিংস্রতা দেখিয়ে বেড়াচ্ছিল। বাঘ বাঘিনীর মৃত্যুতে শোকে দুঃখে আরও হিংস্র
হয়ে ওঠে আর তার বদলা নেবার ভাবনায় সব সময় তৎপর থাকে। গ্রামের
লোকরা আসলে এটাকেই কোন ভৌতিক উপদ্রব বলে ধরে নিয়েছে।
তারপর সেই রাত এলো। তিন শিকারী তিন মাচায় বন্দুক হাতে নিয়ে বসে থাকল। অন্যদিকে রাত বাড়ছে, শিকারিরা
চরম উৎকণ্ঠায় মুহূর্ত গুনছিল। ঠিক এমনি সময় হঠাৎ তারা কানফাটা এক আর্তনাদ
শুনতে পেলো। আচমকা শিকারীরা ভয়ে কেঁপে উঠল। ঠিক যেন ওদের তিন মাচানের মাঝখানেই একটা বাঘ এসে দাঁড়িয়েছে। অন্ধকারে বাঘের দীর্ঘতর ছায়া ওদের চোখের সামনে কেঁপে কেঁপে উঠছে। ওর দুটো বড় বড় চোখ বারবার জ্বলে উঠছে,
নিভে যাচ্ছে। তিন শিকারী এ দৃশ্য দেখতে লাগল। ওরা টের পাচ্ছিল ভয়ংকর জাঁদরেল এক বাঘের উপস্থিতি।
এবার শিকারিরা অদ্ভুত
এক দৃশ্য দেখতে পেলো। ওরা দেখল,
সাদাটে এক আলোকিত দৃশ্যপট। সেই সাদা আলোর ফোকাসের মাঝখানে
এক জীবন্ত বাঘের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠল। ওরা দেখতে পেলো সেই মৃত বাঘটাকে, বাঘটা যেন ওদের দিকেই তাক করে ওঁত পেতে বসে
আছে ! একটা ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট
ছবির মত জীবন্ত বাঘকে ওরা দেখতে পাচ্ছিল। যেন এক চলচ্চিত্রের রীল ওদের
চোখের
সামনে ঘুরে যাচ্ছে ! তিন শিকারী একই দৃশ্য দেখতে পাচ্ছিল। ওরা দেখল, বাঘ
ওদের দিকেই ওঁত পেতে আছে। শিকারিদের বন্দুক তৈরি করা ছিল। শিকারিরা একই সময় দেখল, বাঘ তাদের দিকেই ঝাঁপ দিলো
! ওরা দেখতে পাচ্ছিল সে বাঘটা যেন পুরোপুরি বাঘ নয়--একটা সাদা-কালো বাঘের জীবন্ত ছবি--তাদের দিকেই ঝাঁপ দিতে উদ্যত হয়েছে। এমনি
এক অবস্থায় একসঙ্গে তিনটে বন্দুক গর্জন করে উঠলো। যদিও
সে গুলি শিকারীদের ভীত কাঁপা হাত থেকে সশব্দে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে দিকহারা হয়ে ছুটে
গেলো।
চারদিক সব কিছু অন্ধকার। সে অন্ধকারের মাঝে কোন আর্ত মানুষের চিৎকার শোনা গেল। মনে হতে লাগলো, বাঘ
মানুষ শিকার করছে। এমনি বাঘের গর্জন ও মানুষের আর্তনাদ কয়েক মুহূর্ত
পরে থেমে গেল। চারদিকে
তখন গাঢ় অন্ধকার নেমে এসেছে। স্তব্ধতার মাঝে,
এক চিরন্তন বনের নীরবতা বিরাজ করতে লাগলো। একটু
আগের সমস্ত ঘটনা যেন এক দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
.