আবেগ
হাসপাতালের
সবচে' খারাপ কাজের দায়িত্ব হাউস সার্জেনদেরকেই দেওয়া
হয়।ওয়ার্ড বয়,আয়া,জমাদার,
কারো ডিউটি এত খারাপ না।
বড় ডাক্তাররা সব সময় এক জায়গায় আটকে থাকতে পারেননা। প্রধান চিকিৎসা পদ্ধতি সুরু করে দিয়ে বাকি দায়িত্ব জুনিয়রদের হাতেই দিয়ে যান।ব্যাস।রুগিদের মরা বাঁচা,ব্যথা যন্ত্রণা, সেরে ওঠার যত্ন আত্তি সবি ছোট ডাক্তারবাবুরা সামলায়।বয়েস কম।ল মৃত্যুর মোকাবিলা করার সবে হাতে খড়ি হচ্ছে।সদ্য গজানো গোঁফের মত ডাক্তার হবার গর্ব সব সময় কুটকুট করে ভিতরে।তাই রুগিদের দেখভাল করতে প্রান দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।স্টেথোস্কোপ গলায় হাসপাতালের মধ্যে হাঁটার যে কি আনন্দ। চারদিকের মানুষ ডাক্তার বাবু বলে যে সম্ভ্রমে রাস্তা ছেড়ে দ্যায়, তার দাম কোটিপতি হবার চেয়েও বেশি। আর রুগির অবস্থা খারাপ হলে যে গালি আর মার তার বাড়ির লোকের কাছ থেকে আসে তার দাম ও এদেরই চোকাতে হয়।বড়দের তো আর পাবলিক হাতে পায় না।
তাতে অবশ্য ঘাবড়ায় না খুদে ডাক্তাররা। লড়তে থাকে প্রানপন।
এমার্জেন্সি ডিউটিটা নিয়ম করে করতাম।ফরেনসিক পছন্দের বিষয় ছিল। যদিও মায়ের বারণ ছিল লাশ কাটা ডাক্তার বনায়। গাইনি হব বড় হলে। কিন্ত এমার্জেন্সি ডিউটিটা আগ্রহী হয়েই করতে আসি রাতে।থার্ড ইয়ার।একুশে পা। এই ঘরটায় এলে যেন নিজেকে সত্যি ডাক্তার মনে হয়।জীবনের জোয়ার ভাঁটার তীব্র স্রোত এখানে আছড়ে পড়ছে সারাদিন। একটাই মুশকিল। এখানে একটা মাত্র দরজা।হুড় হুড় করে জন স্রোত ঢুকে পড়ে যদি আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে ডাক্তারদের কোন নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেই।
সেদিন সন্ধ্যে থেকে জ্বর সর্দি, হাতাহাতি করে গালে কালশিটে ফ্যালা দম্পতি, এই সব দেখে কাটাচ্ছিলাম।ভাবছিলাম আর দু একটা কেস পুলিসের খাতায় উঠলে কেটে পড়ব।
হঠাৎ এক দল মানুষ চীৎকার করতে করতে ঢুকে এল।গ্রিলের দরজায় ওয়ার্ড বয় আটকে দেওয়ার চেস্টা করল।বল্ল,"দুজনের বেশি যাবেননা ----"
গর্জন করা জনতা ওকে ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়েছে ততক্ষনে। আমি সামনের টেবিলে ছিলাম।ভিতর থেকে ঠেলে ওঠা ভয়কে গিলে ফেলে ভাবলেশহীন মুখে "কি ব্যাপার আপনাদের _" বলে গলা তোলার চেস্টা করতেই দেখলাম ঊস্কোখুস্কো চুল,লালচোখ এক দল ছেলে বলছে "আগে দেখুন, একটু তাড়াতাড়ি দেখুন প্লিজ। "
খুব মারমুখী নয়,কিন্তু কেমন যেন দিশাহারা চোখগুলো। দৃস্টি নামিয়ে দেখলাম সবাই মিলে পাঁজাকোলা করে রেখেছে একটা বাচ্চাকে। বছর ন দশ মনে হয়।
"আচ্ছা আচ্ছা, " যথা সম্ভব শান্ত গলায় বলি,"টেবিলে শুইয়ে আপনারা বাইরে যান।তবেই দেখতে পারবো। "
ওরা দৌড়ে ভিতরে ঢুকে শুইয়ে দিল ছেলেটাকে। আমি এগিয়ে গিয়েই থমকে গেলাম। রাইগর মর্টিস সেট করে শক্ত হয়ে রয়েছে বডি।
"একে তো কিছু করা যাবে---"
বলতে সুরু করতেই চীৎকার করে কেঁদে উঠল সামনে দাঁড়ানো তরুন। এবার খেয়াল করলাম খালি গা,হাফ প্যান্টের ওপর গামছা জড়ানো। হাত জোড় করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, "কিছু তো চেস্টা করুন,বাবা মা এখনো অফিস থেকে ফেরেনি, ওই একটাই ছেলে, পাড়ার সবাই চোখে রাখব এই ভরসায় কাজে যায়।বিকেলে কখন পানায় আটকে গেছে পুকুরের। আমরা কি ভাবে ডুবে তুলে এনেছি। দিদি প্রানপন চেস্টা করুন, বাপ মাকে কি বলব ফিরলে?"
হিম শীতল লাগল ভিতরটা।ইসস। আমিও অফিসে যাওয়া বাবা মায়ের একটা মাত্র! আর এই বাচ্চাটা অনেক ক্ষন আগে মরে গেছে। এই তরুন ছেলেগুলোর বুক ভেংগে যাচ্ছে যন্ত্রণায়।ওরা, কেউ কিছুই চেস্টা করলো না বাঁচানোর এটা মানতে পারবেনা। জমাট বাঁধা কষ্ট আছড়ে পড়বে চিকিৎসকদের এবং হাসপাতালের ওপরেই।
সেই মুহুর্তে ডাক্তারির সবচেয়ে বড় পাঠটি আত্নস্থ করলাম। মানুষের আবেগকে সম্মান জানাতে হবে।
ভিতরের ঘরে গিয়ে আলতো ঠোঁট রাখলাম টেবীলে শুয়ে থাকা মৃত বালকের ঠোঁটে। মাসাজ করলাম বুকে অনেকক্ষন। ব্লাড প্রেসার মাপলাম যত্ন করে।ফেটে যাচ্ছিল বুকের ভেতরটা।শেষে যখন বাইরে এসে বল্লাম,"ভাই কিছু করার নেই গো", হাল ছেড়ে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পড়ল ছেলের দল।আমি স্টেথোস্কোপটা গলা থেকে খুলে একেবারে ভিতরকার একটা চেয়ারে গিয়ে বসলাম। ভিতরটা কাঁপছিল থরথর করে।পাসের বন্ধুকে ডেকে বল্লাম, "ড্রাউনিং, ব্রট ডেড,পুলিসের কেস খাতাটায় তোল।"
সে ছেলেটি অবাক হয়ে বলল,"তবে যে মাউথ টু মাউথ দিলি?"
বল্লাম, "দরজা তো একটাই। পালাতি কি করে? মব -এর চেহারা দেখেছিলি? "
চুপ করে গেলো সবাই।
মনের খাতায় লাল অক্ষরে লেখা রইল মৃত্যুর ঠোঁটে ঠোঁট রাখার তারিখ। সুরু করলাম আপোশে লড়াই। কখনও সে জেতে,কখনো আমি। পুরোনো বন্ধুত্ব্ব।
বড় ডাক্তাররা সব সময় এক জায়গায় আটকে থাকতে পারেননা। প্রধান চিকিৎসা পদ্ধতি সুরু করে দিয়ে বাকি দায়িত্ব জুনিয়রদের হাতেই দিয়ে যান।ব্যাস।রুগিদের মরা বাঁচা,ব্যথা যন্ত্রণা, সেরে ওঠার যত্ন আত্তি সবি ছোট ডাক্তারবাবুরা সামলায়।বয়েস কম।ল মৃত্যুর মোকাবিলা করার সবে হাতে খড়ি হচ্ছে।সদ্য গজানো গোঁফের মত ডাক্তার হবার গর্ব সব সময় কুটকুট করে ভিতরে।তাই রুগিদের দেখভাল করতে প্রান দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।স্টেথোস্কোপ গলায় হাসপাতালের মধ্যে হাঁটার যে কি আনন্দ। চারদিকের মানুষ ডাক্তার বাবু বলে যে সম্ভ্রমে রাস্তা ছেড়ে দ্যায়, তার দাম কোটিপতি হবার চেয়েও বেশি। আর রুগির অবস্থা খারাপ হলে যে গালি আর মার তার বাড়ির লোকের কাছ থেকে আসে তার দাম ও এদেরই চোকাতে হয়।বড়দের তো আর পাবলিক হাতে পায় না।
তাতে অবশ্য ঘাবড়ায় না খুদে ডাক্তাররা। লড়তে থাকে প্রানপন।
এমার্জেন্সি ডিউটিটা নিয়ম করে করতাম।ফরেনসিক পছন্দের বিষয় ছিল। যদিও মায়ের বারণ ছিল লাশ কাটা ডাক্তার বনায়। গাইনি হব বড় হলে। কিন্ত এমার্জেন্সি ডিউটিটা আগ্রহী হয়েই করতে আসি রাতে।থার্ড ইয়ার।একুশে পা। এই ঘরটায় এলে যেন নিজেকে সত্যি ডাক্তার মনে হয়।জীবনের জোয়ার ভাঁটার তীব্র স্রোত এখানে আছড়ে পড়ছে সারাদিন। একটাই মুশকিল। এখানে একটা মাত্র দরজা।হুড় হুড় করে জন স্রোত ঢুকে পড়ে যদি আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে ডাক্তারদের কোন নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেই।
সেদিন সন্ধ্যে থেকে জ্বর সর্দি, হাতাহাতি করে গালে কালশিটে ফ্যালা দম্পতি, এই সব দেখে কাটাচ্ছিলাম।ভাবছিলাম আর দু একটা কেস পুলিসের খাতায় উঠলে কেটে পড়ব।
হঠাৎ এক দল মানুষ চীৎকার করতে করতে ঢুকে এল।গ্রিলের দরজায় ওয়ার্ড বয় আটকে দেওয়ার চেস্টা করল।বল্ল,"দুজনের বেশি যাবেননা ----"
গর্জন করা জনতা ওকে ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়েছে ততক্ষনে। আমি সামনের টেবিলে ছিলাম।ভিতর থেকে ঠেলে ওঠা ভয়কে গিলে ফেলে ভাবলেশহীন মুখে "কি ব্যাপার আপনাদের _" বলে গলা তোলার চেস্টা করতেই দেখলাম ঊস্কোখুস্কো চুল,লালচোখ এক দল ছেলে বলছে "আগে দেখুন, একটু তাড়াতাড়ি দেখুন প্লিজ। "
খুব মারমুখী নয়,কিন্তু কেমন যেন দিশাহারা চোখগুলো। দৃস্টি নামিয়ে দেখলাম সবাই মিলে পাঁজাকোলা করে রেখেছে একটা বাচ্চাকে। বছর ন দশ মনে হয়।
"আচ্ছা আচ্ছা, " যথা সম্ভব শান্ত গলায় বলি,"টেবিলে শুইয়ে আপনারা বাইরে যান।তবেই দেখতে পারবো। "
ওরা দৌড়ে ভিতরে ঢুকে শুইয়ে দিল ছেলেটাকে। আমি এগিয়ে গিয়েই থমকে গেলাম। রাইগর মর্টিস সেট করে শক্ত হয়ে রয়েছে বডি।
"একে তো কিছু করা যাবে---"
বলতে সুরু করতেই চীৎকার করে কেঁদে উঠল সামনে দাঁড়ানো তরুন। এবার খেয়াল করলাম খালি গা,হাফ প্যান্টের ওপর গামছা জড়ানো। হাত জোড় করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, "কিছু তো চেস্টা করুন,বাবা মা এখনো অফিস থেকে ফেরেনি, ওই একটাই ছেলে, পাড়ার সবাই চোখে রাখব এই ভরসায় কাজে যায়।বিকেলে কখন পানায় আটকে গেছে পুকুরের। আমরা কি ভাবে ডুবে তুলে এনেছি। দিদি প্রানপন চেস্টা করুন, বাপ মাকে কি বলব ফিরলে?"
হিম শীতল লাগল ভিতরটা।ইসস। আমিও অফিসে যাওয়া বাবা মায়ের একটা মাত্র! আর এই বাচ্চাটা অনেক ক্ষন আগে মরে গেছে। এই তরুন ছেলেগুলোর বুক ভেংগে যাচ্ছে যন্ত্রণায়।ওরা, কেউ কিছুই চেস্টা করলো না বাঁচানোর এটা মানতে পারবেনা। জমাট বাঁধা কষ্ট আছড়ে পড়বে চিকিৎসকদের এবং হাসপাতালের ওপরেই।
সেই মুহুর্তে ডাক্তারির সবচেয়ে বড় পাঠটি আত্নস্থ করলাম। মানুষের আবেগকে সম্মান জানাতে হবে।
ভিতরের ঘরে গিয়ে আলতো ঠোঁট রাখলাম টেবীলে শুয়ে থাকা মৃত বালকের ঠোঁটে। মাসাজ করলাম বুকে অনেকক্ষন। ব্লাড প্রেসার মাপলাম যত্ন করে।ফেটে যাচ্ছিল বুকের ভেতরটা।শেষে যখন বাইরে এসে বল্লাম,"ভাই কিছু করার নেই গো", হাল ছেড়ে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পড়ল ছেলের দল।আমি স্টেথোস্কোপটা গলা থেকে খুলে একেবারে ভিতরকার একটা চেয়ারে গিয়ে বসলাম। ভিতরটা কাঁপছিল থরথর করে।পাসের বন্ধুকে ডেকে বল্লাম, "ড্রাউনিং, ব্রট ডেড,পুলিসের কেস খাতাটায় তোল।"
সে ছেলেটি অবাক হয়ে বলল,"তবে যে মাউথ টু মাউথ দিলি?"
বল্লাম, "দরজা তো একটাই। পালাতি কি করে? মব -এর চেহারা দেখেছিলি? "
চুপ করে গেলো সবাই।
মনের খাতায় লাল অক্ষরে লেখা রইল মৃত্যুর ঠোঁটে ঠোঁট রাখার তারিখ। সুরু করলাম আপোশে লড়াই। কখনও সে জেতে,কখনো আমি। পুরোনো বন্ধুত্ব্ব।