বিলুপ্তপ্রায় শিয়াল
দীর্ঘ বেশ
কয়েক বছর পরে হঠাৎ সেদিন কয়েকটা কুকুরের তাড়া খেয়ে একটা শিয়ালকে এক ছুটে রাস্তা
পার হয়ে পাশের একটা আগাছায় ভরা ফাঁকা জমিতে চলে যেতে দেখে ছেলেবেলার কতো স্মৃতি
চোখের সামনে ভেসে উঠলো।
একবারে
ছোটবেলাটা কেটেছে গ্রাম, বা একবারে ছোট আধা শহরে। তারপর সেই কৈশোর থেকে এখন পর্যন্ত শহরের বুকেই বসবাস করছি। যদিও সেই শহর আর আগের
মতো নেই, ধীরে ধীরে সিমেন্ট, বালি, কংক্রীট্, তাকে
ক্রমশঃ অনেক ঘিঞ্জি করে ফেলেছে। লোকসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে নতুন নতুন বাড়ি ও
আধুনিক ফ্ল্যাটগুলো ধীরে ধীরে গাছপালা, আগাছার জঙ্গল, ফাঁকা জমি, ও পুকুরকে গ্রাস করে ফেলেছে। শুধু কি
তাই? গ্রাস করে ফেলেছে রাতের অন্ধকারকে। চোখের ওপর হাত না রাখলে, এখন বাইরের বড় রাস্তার আলোয় রাতের বেলা নিজের ঘরের বিছানাতেও ঘুমনো
অসম্ভব। অমাবস্যার রাতেও হাত থেকে রাস্তায় একটা সুচ পড়ে গেলে, আলো বা টর্চ ছাড়াই সেটা খুঁজে বার করা এখন অসম্ভব নয়।
মনে পড়ে ছোটবেলার দিনগুলোর কথা, সন্ধ্যার
পর একসাথে শিয়ালের কল্যাণ ঠাটে সান্ধ্য রাগে গলা সাধার কথা। শুধু গ্রাম নয়, এই শহরের
বুকেও যত্রতত্র শিয়ালের আনাগোনা লক্ষ্য করা যেত, মাঝেমাঝেই
শোনা যেত শিয়ালের ঐকতান। আজ হয়তো অনেকেই শিয়ালের কথা শুনে নাক সিটকে ভাবতে পারেন, কোন গোবিন্দপুরে বাস ছিল বাপু? তাঁদের দোষ
দেওয়া যায় না। ছোটবেলায় শিয়ালের ডাকে ভয় পেয়ে তাঁরা তো আর চোখ বুজে মা বা
ঠাকুরমাকে জড়িয়ে ধরে একটা আওয়াজ পর্যন্ত না করে, কোনদিন
নিদ্রা যাওয়ার মধুর সুযোগ পাননি। এক শিয়াল ডাকলে সব শিয়াল ডাকে কথাটা নীল শিয়ালের গল্পে পড়ে বা শুনে থাকলেও, কোথাও
একটা শিয়াল ভুলেও একবার হুক্কা হুয়া রবে ডেকে ফেললে যেখানে যত শিয়াল আছে, ‘দুনিয়ার
শিয়াল এক হও’ বলে ডেকে ওঠার সাথে তাঁরা তো পরিচিত নন।
হ্যাঁ, শুধু শহর নয়, গ্রাম
থেকেও এই প্রাণীটি ক্রমে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। তার অনেক কারণ আছে, থাকার জায়গার অভাব ও খাদ্যাভাব তো আছেই, তার সাথে আছে চাষের জমিতে তীব্র কীটনাশকের ব্যবহার, চামড়ার লোভে শিয়াল হত্যা, বা আরও কিছু কারণ। পরিবেশবিদরা ইকোলজি রক্ষার দোহাই দিয়ে এদের সংরক্ষণ
করা, বা হত্যা না করে বাঁচিয়ে রাখার আর্জি জানাতে পারেন, কিন্তু তাঁদের কথা শুনছে কে? শিয়ালের
ডাক শোনা গেলে তো শহর তার কৌলীন্য হারাবে, রাতের সুখনিদ্রা বিঘ্নিত হবে। বেশ কয়েক বছর আগেও তো খবরের
কাগজে পড়েছিলাম, কোন এক সম্মানীয় নামী ব্যক্তির বাসস্থানের কাছে রাতে অভদ্র
শিয়ালরা অকারণে চিৎকার করে তাঁর রাতের ঘুম বিঘ্নিত করায় নাকি তাঁর দেখভাল করার কড়া
মেজাজের লোকেরা, কড়া হাতে জায়গাটা শিয়ালমুক্ত করার কঠোর ব্যবস্থা করেন।
আসলে আমাদের ভাললাগাগুলোও তো অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আগে প্রাকৃতিক যেসব
ব্যাপারগুলোয় আমরা অভ্যস্ত ছিলাম, আজ আর সেগুলো আমাদের আকৃষ্ট করে না। কিছু মানুষ এখনও সত্যিই আছেন, যাঁরা
প্রকৃতিকে নিয়ে সত্যসত্যই চিন্তা করেন, ভালবাসেন, জীবজগৎ ও
উদ্ভিদজগতের সামঞ্জস্য নিয়ে চিন্তা করেন, কাজ করেন। কিন্তু
বেশিরভাগ মানুষই বোধহয় মৌখিক বক্তব্য ও আদেশের মাধ্যমে এই সামঞ্জস্য রক্ষা করাটাই
বেশি পছন্দ করে থাকেন। শুধুমাত্র নিজ স্বার্থে, মানুষ অন্যান্য অনেক প্রাণীর মতো নির্বিচারে শিয়াল নিধন করায়, আরও পাঁচটা বন্যপ্রাণীর মতো শিয়ালও ক্রমশঃ দেশ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।
আমরা কি পারি না তাদের আবার নিশ্চিন্ত জীবন ফিরিয়ে দিয়ে রক্ষা করতে, মুখে নয়
কাজে চেষ্টা করলে এখনও বোধহয় তাদের রক্ষা করা সম্ভব।
আমি নিজে দু’-দু’বার এই শিয়ালের মৃত্যু প্রত্যক্ষ করি। একবার হত্যা আর একবার আত্মহত্যা, এবার সেই কথাই বলবো। তখন আমি কলেজে পড়ি। কাছেই এক আত্মীয়র বাড়িতে
গিয়ে হঠাৎ দেখি একদল মানুষ, হাতে মোটা মোটা লাঠি, চটের
বস্তা, টিনের ক্যানেস্তারা, দড়ির জাল, ইত্যাদি
নিয়ে হনহন করে চলেছে। চেহারা ও পোশাক আশাক দেখেই মনে হলো, তারা খুবই দরিদ্র ও সম্ভবত আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত। পিছন পিছন
কিছু স্থানীয় লোকজন চলেছে। কোথায়, কি
উদ্দেশ্যে যাচ্ছে বুঝলাম না, জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম, যে তারা শিয়াল ধরতে যাচ্ছে। এতো কিছু প্রাণী থাকতে হঠাৎ শিয়াল ধরে
তারা কি করবে জিজ্ঞাসা করেও কোন লাভ না হওয়ায়, তাদের
পিছন পিছন আমিও চললাম।
একটু এগিয়েই একটা বেশ বড় জঙ্গুলে জমি। কোনদিন পরিস্কার
না করায়, পড়ে থেকে থেকে একমানুষ সমান উঁচু আগাছা ও কাঁটা গাছে জায়গাটা বেশ গভীর জঙ্গলে পরিণত
হয়েছে। তারই একটা পাশে, সামান্য কিছুটা জমির জঙ্গল কেটে পরিস্কার করে, একজন
জল্লাদ আকৃতির লোক, প্রায় দশ-বারো ফুট
দূরত্বে বাঁশের তৈরি দুটো ছোট ছোট মজবুত খুঁটি পুঁতে, টেনিস খেলার জালের মতো একটা জাল খুঁটি দুটোর সাথে
টানটান করে বেঁধে দিয়ে, হাতে একটা তেলতেলে শক্ত মজবুত লাঠি নিয়ে মাঝখানে
দাঁড়িয়ে পড়লো। সম্ভবত এই ব্যক্তিটিই আজকের যুদ্ধের সেনাপতি। জঙ্গল না থাকলে এখানে
টেনিস খেলার আয়োজন হচ্ছে বলে মনে হতেই পারে। বাকিরা যে যার হাতে লাঠি ও টিনের
ক্যানেস্তারা নিয়ে, কিছুদুর অন্তর অন্তর জঙ্গলটার চারিদিকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে দাঁড়িয়ে
পড়লো। হঠাৎ দেখি জঙ্গলের চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা সৈনিকরা একসাথে প্রবল চিৎকার করতে
করতে, টিনের ক্যানেস্তারা পিটিয়ে জঙ্গল ভেঙে এগিয়ে আসছে।
তাদের সকলেরই নিশানা কিন্তু সেই মাটিতে বাঁধা জালের দিকে, যেখানে সর্দার লাঠি নিয়ে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের ক্যানেস্তারা পিটিয়ে
উচ্চৈঃস্বরে চিৎকারের আওয়াজে জঙ্গলের যত শিয়াল, প্রবল
বেগে যেদিকটা নিরিবিলি, অর্থাৎ জালের দিকে ছুটে এসে জালে ধাক্কা খাওয়ার সাথে সাথে, সর্দারের লাঠির ঠিক একটা বাড়িতেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে। সম্ভবত শিয়ালের মাথা, বা অন্য কোন নির্দিষ্ট স্থানেই আঘাত করা হচ্ছে, কারণ একটা
শিয়ালকেও একবার লাঠির বাড়ি খেয়ে বেঁচে থাকতে বা পালাতে দেখলাম না। এইভাবে
কয়েক মিনিটের মধ্যেই অনেকগুলো শিয়ালের মৃতদেহ জালটার কাছে জড়ো হয়ে গেল। এবার সবকটা
দেহ বস্তায় পুরে, কাঁধে নিয়ে তারা ফিরে চললো। শিয়ালগুলো নিয়ে তারা কি
করবে জানতে চাইলে হিন্দীতে উত্তর পেলাম, পেটিগুলো
কাজে লাগবে। ইলিশের পেটি জানি, তবে
শিয়ালের পেটি কোনটা ও সেটা কি কাজে লাগে আজও অজানা রয়ে গেল।
এরও অনেক পরে আমি একটা শিয়ালের মৃত্যু দেখেছিলাম। না, এবার আর
শিয়াল হত্যা নয়, কারণ জানি
না তবে এবার একবারে আত্মহত্যা। সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় থেকে চাকরির তিন বছর পূর্ণ
হওয়া পর্যন্ত, আমরা একটা দোতলা বাড়ির ওপর তলায় ভাড়া থাকতাম। রাস্তা
থেকে টিনের দরজা দিয়ে ঢুকে, নীচে দুটো ও ওপরে দুটো ফ্যাট। পাশাপাশি দুই ফ্ল্যাটের
মাঝখান দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে। সিঁড়ি দিয়ে সোজা ওপরে ওঠার পর যেখানে সিঁড়িটা বাঁক
নিয়ে আবার ওপরে উঠছে, ঠিক সেই জায়গার দেওয়ালে একটা দু’-তিনটে লোহার শিক লাগানো ছোট
জানালা ছিল। অসম্ভব হিসাবি ও কৃপণ বাড়িওয়ালা পকেটের পয়সা খরচ করে নিজে থেকে ওখানে
কেন জানালা করতে গেলেন, সেই বয়সে প্রথমে বুঝতে না পারলেও, কয়েকদিন
পরেই বুঝে ছিলাম। টিনের দরজা দিয়ে ঢুকে একটা ছোট্ট ছাদহীন ঘরে একটা কুয়ো, এটা
দোতলার দুই ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের জন্য নির্মিত। আর দেড়তলার ওই জানালাটার
ঠিক নীচেই ছিল দ্বিতীয় একটা কুয়ো। অ্যাটাচ্-বাথ শুনেছি
বা দেখেছি, কিন্ত এতো বছর বয়সেও অ্যাটাচ্-কুয়ো দ্বিতীয়বার দেখা তো দূরের কথা, কোনদিন শুনিওনি। কুয়োর ওপরে একটা লোহার রডে পরপর দুটো কপিকল লাগানো
ছিল। নীচের দুই ফ্ল্যাটের ব্যবহারের জন্য নির্মিত ওই কুয়ো থেকে একতলার দুই ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা যে যার নিজ নিজ ফ্ল্যাটের ডাইনিং স্পেস থেকে, নিজ নিজ
কপিকলের সাহায্যে জল তুলতেন। বাইরের পৃথিবীর সাথে সরাসরি কোন আলো হাওয়ার যোগাযোগ না থাকায়, জানালা
দরজাহীন জায়গাটা স্বাভাবিক ভাবেই খুব অন্ধকার ছিল। আলো বাতাসের অভাবে কুয়োর জল যাতে নষ্ট হয়ে না যায়, তাই
অদ্ভুত এই ব্যবস্থা।
সে যাইহোক, দোতলায় আমাদের পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের এক ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হওয়ায়, ঘরের অভাব দেখা যায়। আমাদের ফ্ল্যাটের একতলায় এক স্বামী স্ত্রী
বাস করতেন। অসম্ভব শুচিবাইগ্রস্ত স্ত্রী আবার একটা স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন। দোতলার
বাসিন্দাদের অনুরোধে তাঁরা তাঁদের আড়াইটে ঘরের একটি ঘর ভাড়া দিতে সম্মত হন, শর্ত
একটাই, শুধুমাত্র একটা ঘরই ব্যবহার করা যাবে, বাথরূম নয়। বাথরূম ব্যবহার করার কোন উপায়ও ছিল না, কারণ নির্দিষ্ট ঘরটার দ্বিতীয় দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তাতে
অবশ্য কোন সমস্যা ছিল না। কারণ দোতলার অবিবাহিত ছোটভাই, অমলদা দোতলাতেই স্নানাহার করে অফিসে চলে যেত, আবার অফিস
থেকে ফিরে দোতলাতেই থাকতো। শুধুমাত্র রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে, নীচের ঘরে
শুতে আসতো। কোনদিন রাতে বাথরূম যাওয়ার প্রয়োজন হলে, দরজা খুলে
বাইরে এসে রাস্তার পাশের ছোট্ট ডোবাটায় কাজ সেরে ফিরে এলেই হলো। এইভাবেই দিব্যি দিন কাটছিল, হয়তো কেটেও যেত। দু’পক্ষই
খুশি, কিন্তু ওই যে কবি বলে গেছেন—“চিরদিন
কাহারও সমান নাহি যায়”, কবি বাক্য মিথ্যা হওয়ার নয়।
একদিন বেশ ভোরে একতলায় চিৎকার চ্যাঁচামেচি শুনে কোন বিপদের আশঙ্কায় প্রায়
ছুটে নেমে যে ঘটনার সম্মুখীন হলাম, তা কোনদিন কেউ স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারবে না। ভোরের দিকে
বাথরূম যাওয়ার প্রয়োজনে অমলদা টিনের দরজা খুলে সবে বাইরের রাস্তায় পা রেখেছে, একটা
শিয়াল রাস্তা দিয়ে ছুটে যাওয়ার সময় হঠাৎ ফিরে এসে অমলদাকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে, টিনের দরজা দিয়ে ঢুকে, দশ-দশটা
সিঁড়ি ভেঙে জানালাটার কাছে গিয়ে জানালা গলে নীচে ঝাঁপ দিয়ে কুয়োর ভিতর পড়ে। কোন কিছু ভারী জিনিস জলে পড়ার তীব্র আওয়াজে সকলের ঘুম ভেঙে যায়।
শুরু হয়ে
গেল যুদ্ধকালীন তৎপরতায় শিয়াল উদ্ধার পর্ব। দুই দিক থেকে দুই ফ্ল্যাটের কর্তা
কুয়োয় টর্চ জ্বেলে, বালতি নামিয়ে, শিয়ালকে ওপরে তোলার
চেষ্টা চালাতে শুরু করে দিলেন। আমরা বামদিকের ফ্ল্যাটে ঢুকে তদারকি করতে শুরু করলাম। এতো অল্প পরিসর জায়গায়
পাশাপাশি দু’জন দাঁড়ানোই মুশকিল, অথচ
ডানদিকের ফ্ল্যাটে ঢুকতে গেলে, গঙ্গা স্নান সেরে নতুন পোশাক পরে যেতে হবে। শিয়ালটা কয়েকবার
বালতির লিফটে চেপে বেশ কিছুটা উঠে এসেও সিদ্ধান্ত নেয়, যে সে এই জীবন আর রাখবে না। এইভাবে কখনও বালতি চেপে বেশ কিছুটা উঠে
পুনরায় কুয়োয় ঝাঁপ দিয়ে, কখনও গভীর কুয়োর জলে অন্ধকারে হাঁকুপাঁকু করে, ক্রমে তার লাফঝাঁপ কমে যেতে যেতে, একসময়
নিস্তেজ হয়ে গেল। অন্ধকারে গভীর কুয়োর ভিতর থেকে মৃত শিয়ালের ডেডবডি বালতি করে
ওপরে তোলা সম্ভব নয় বুঝে, বামপাশের ফ্ল্যাটের ভদ্রলোক সিদ্ধান্ত নিলেন, যে একটু বেলা হলে কোন একজন কুয়ো মেরামত করার লোককে ডেকে এনে শিয়াল
তোলার ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু সমস্যা দেখা দিলো ডানপাশের ফ্ল্যাটের ভদ্রমহিলাকে
নিয়ে। অচেনা অজানা লোককে অপরিস্কার জামাকাপড়ে কুয়োয় নামাবার কথা তিনি স্বপ্নেও
কল্পনা করতে পারেন না।
ফল যা হবার তাই হলো। ডানপাশের
বুদ্ধিমতী শুচিবাইগ্রস্ত শিক্ষিকার বুদ্ধিতে, দুই
ফ্ল্যাটের দুই মহিলা নিজেদের রান্নাবান্না, ঘরের কাজ, সবকিছু
ছেড়ে কুয়োর দু’দিক থেকে
দড়ি নামিয়ে বালতি বালতি জল তুলে পাশের জল ফেলার জায়গায় ফেলতে শুরু করে দিলেন।
উদ্দেশ্য, কুয়োর সব
জল তুলে ফেলে, শুকনো কুয়ো থেকে মৃত শিয়াল তুলে নিয়ে আসা। বেশ বেলা
পর্যন্ত কুয়ো থেকে বালতি বালতি জল তুলে ফেলেও দেখা গেল, দুটি
ফ্ল্যাটের মেঝেয় এক হাঁটু জলবৃদ্ধি হলেও, একটিমাত্র
কুয়োয় এক ইঞ্চি জলও হ্রাস পায়নি। অগত্যা বুদ্ধিমতী শিক্ষিকার অনুমতিক্রমে কুয়ো
মেরামতের লোক খুঁজতে বেরনো হলো। সেই আমলে অনেক বাড়িতেই কুয়োর ব্যবহার থাকায়, কুয়ো খনন
ও মেরামতির লোকেরও অভাব ছিল না। কাজেই কিছুক্ষণের মধ্যে দু’জন লোককে অকুস্থলে হাজির করাও সম্ভব হলো।
তারা এসেই কুয়োয় নেমে মৃতদেহ তুলে আনার প্রস্তাব দিলো
বটে, কিন্তু সমস্যা দেখা দিলো দুটো। প্রথমত, অচেনা
অপরিস্কার একজন অশুচি মানুষ কুয়োর জলে নামলে সেই জল ব্যবহার করা, আর
দ্বিতীয়ত মৃত শিয়াল এতক্ষণ জলে পড়ে থাকার পরেও সেই জল ব্যবহার করা স্বাস্থ্য ও শাস্ত্রসম্মত
হবে কী না।
বিপদে পড়লে আইন শিথিল ও পরিবর্তন করতেই হয়, এক্ষেত্রেও তাই হলো।
মুহুর্তের মধ্যে একজন লোক লম্বা দড়ির একটা প্রান্ত নিয়ে কুয়োয় নেমে, শিয়ালের দেহে বেঁধে ফেললো। অপরজন ওপর থেকে দড়ি টেনে সেটা ওপরে
তুলে এনে কুয়োর পাশে ফেললো। সমস্ত কাজটাই যে বামপাশের ফ্ল্যাটের ভিতর থেকে সম্পন্ন
হলো, একথা বোধহয় আর উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। কুয়ো থেকে
শিয়াল তো তোলা হলো, কিন্তু কুয়ো থেকে জল তোলার কি হবে, সেটা তো
আর দু’জন মানুষ অতটুকু জায়গায় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে করা সম্ভব হবে না।
শেষে অনেক ভেবে, অনেক
বিচার করে, সম্ভবত শুচিবাই সংক্রান্ত অনেক পুঁথি ঘেঁটে, দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের
শিক্ষার ধারক ও বাহক ঠিক করলেন, যে ওই
অপরিচিত দু’জন মানুষের
থেকে শিয়াল অধিক অপরিস্কার, অপবিত্র, ও অশুচি। সুতরাং শিয়াল ভেজা জল ব্যবহার করার থেকে, একজন
মানুষকে নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকে তাঁর কুয়োর বালতি ব্যবহার করতে দেওয়াই শাস্ত্র মতে
সমীচীন হবে। একসময় কুয়োর জল তুলে ফেলা পর্বও নির্বিঘ্নে সমাধা হলো।
অনেক বুঝিয়ে, অনেক অনুরোধ করে, ওই
লোকদুটোকে শিয়ালটার পায়ে দড়ি বেঁধে নিয়ে গিয়ে কোথাও ফেলে দেওয়ার ব্যবস্থাও পাকা
করা গেল। তবু রক্ষে যে এক্ষেত্রে পোস্ট মর্টেম
করার ঝামেলা নেই।
সারা ফ্ল্যাটের চারিদিকে জলে থৈথৈ করছে। লোকদুটো শিয়াল
নিয়ে বিদায় নিলো। শেষ হলো শিয়ালের আত্মহত্যা পর্ব। যে
ভদ্রমহিলার বাড়ির কাজের মেয়েটিকে কাজ সেরে ন্যাতা দিয়ে চলার পথ মুছতে মুছতে বাইরের
দরজা পর্যন্ত গিয়ে একপাশে ন্যাতা রেখে বাড়ি ফিরতে হতো, তাঁর ফ্ল্যাটে এরকম একজন অশুচি মানুষ প্রবেশ করায়, তিনি ফ্ল্যাটটিকে আবার আগের মতো
শুদ্ধ করার জন্য কি কি ব্যবস্থা নিয়েছিলেন, জানার আর
সুযোগ হলো না। ভেবেছিলাম একটা বড় করে পূজো করে যজ্ঞ-টজ্ঞ হবে, আমরা
অপবিত্রের দল একদিন একটু প্রসাদ পাবো, কিন্তু কপালে তাও
জুটলো না। হয়তো ‘বললে হবে খরচা আছে’ মন্ত্রে তিনিও বিশ্বাস করতেন।