গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১৬ জুন, ২০১৯

ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

দশভূজা



সুবিমল বিয়ে করেছে একথাটা রণেন কয়েকবারই শুনেছে নানাজনের কাছ থেকে। কিন্তু সুযোগ-সুবিধে করে যাওয়া হয়ে ওঠেনি ওর কাছে। গতকাল বাজারে বিকাশের সঙ্গে দেখা হতেই সুবিমলের কথা উঠল। রণেনই পাড়ল কথাটাএই সুবিমল বিয়ে করেছে,শুনেছিস?
--
জানি, দেখা করেও এসেছি।
-
কেমন রে?’
--
দেখতে খুবই সুন্দর, তবে একেবারে দশভূজা।
মানে? রাগী, প্রতাপশালী মহিলা?? রণেন ঠিক কথাটার মানে বুঝল না। চেয়ে রইল বিকাশের দিকে। বিকাশ মুচকি হেসে বললসুবিমলও যেমন, এখনও সেই পাগলাই রয়ে গেছে। যা, গিয়ে দেখে আয় একদিন!
সেদিন থেকেই  ইচ্ছেটা মনের মধ্যে ছিল। আজ পরপর দুটো দিন ছুটি পেয়ে যেতেই সুবিমলের কাছে যাওয়ার বাসনাটা তাড়া দিয়ে উঠল। দু-এক দিনের জন্য ঘুরে আসাই যায়!
দুখানা পাজামা-পাঞ্জাবী, দাড়ি কামাবার সরঞ্জাম, মুখ ধোবার ব্রাশ আর একটা তোয়ালে কাঁধের ঝোলায় পুরে সাত  সকালেই বেরিয়ে পড়ল রণেন।  

বেলা তখন প্রায় এগারোটার কাছাকাছি। দরজা খুলে সুবিমল অবাক!
--
তুই! তুই এখানে কি করে এলি? কে বলল তোকে আমি এখানে আছি?’ হাসিমুখে দরজা থেকে সরে গিয়ে রণেনকে ভিতরে আসার পথ দিল সুবিমল। 
--কে বলল, কার কাছে শুনলি?—আবার বলল সুবিমল। সারা ঘরটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিল রণেন। নতুন স্বামী-স্ত্রীর ঘর যেমন হয় তেমনই। না, খুব সাজানো-গোছানো বড়লোকের বাড়ির অন্দরমহল নয়,আবার একেবারে খুব সাদামাটাও নয়। যতটা পেরেছে সুবিমল গুছিয়েই সংসার পেতেছে। সুবিমলের দিকে তাকিয়ে হাসল রণেন। বলল--- আমাদের বিকাশ রায় রে,আবার কে? আমিও দুদিনের ছুটি পেয়ে চলে এলাম। কিন্তু কই, তোর পিয়সহি কই? ডাক তাঁকে...চা-ফা দিতে বল! 
--হ্যাঁ, এই যে ডাকি...বলে চেয়ার ছেড়ে উঠতেই ঘরে এল কণা, সুবিমলের স্ত্রী। ভারি সুন্দর দেখতে, মন জুড়িয়ে যায় দেখে।  সুবিমলের ভাগ্যকে ঠিক ঈর্ষা নয়, বাহবা দিল রণেন। গায়ে শাড়ির  আঁচল জড়ানো। রণেন বুঝল এটা বাইরের লোকের সামনে শালীনতা। আরো ভালো লাগল। 
সুবিমল রণেনকে দেখিয়ে বলল---আমাদের বন্ধু, রণেন, বুঝলে? আমাদের কলেজের বন্ধু...মাথাটা একটু ঝুঁকিয়ে অভিবাদনের মত করল কণা। রণেনের মজা লাগল। ভিতর থেকে রণেনের জন্য চা এনে দিল। আর একবার গিয়ে সুবিমলের জন্য। 
--আর আপনি?’ শুধালো রণেন।
--আনছি।
একটু অবাক হল রণেন। এভাবে বারবার আনার কি আছে? একেবারে  নিয়ে এলেই তো হত! কিন্তু চুপ করে রইল। 
নিজের চা খাওয়া হলে ভিতরে গেল কণা। সুবিমল হেঁকে বলল---তুমি রান্না-বান্না সেরে নাও। আমি এগুলো পরে দিয়ে আসব...বলে জুত করে দুই বন্ধুতে গল্প করতে বসল।

কণার সঙ্গে আবার দেখা একেবারে দুপুরে ভাত খাবার সময়। খাবার  ব্যবস্থা দেখে অবাক রণেন। এইটুকু সময়ের  মধ্যে এত রকম কি করে পেরে উঠল কণা। সত্যিই খুব গুণের মেয়ে তো! সেকথা মুখে বলতেই স্মিত হাসি হাসল   কণা। ভালো লাগল এই সৌজন্যটুকুও। খাবার সময় এটা-সেটা, টুকিটাকি , হাসাহাসি-গল্প করতে করতে খেয়ে  উঠবার সময় রণেনের হাত থেকে জল খাবার কাঁচের গেলাসটা ফস্‌কে মাটিতে পড়ে যাচ্ছিল। কণা জোরে কিছু বলে উঠল। সুবিমল দৌড়ে এসে মাটির থেকে একটু ওপরে ক্যাচ নেবার মত করে ধরে ফেলল। তারই মধ্যে ধাক্কাধাক্কিতে কণার গায়ের  আঁচল সরে গেল। বিস্ময়ে হতবাক রণেন। কণার বাঁদিকের হাত কনুয়ের আরো কিছুটা উপর থেকে কাটা। রণেন সব ভুলে গিয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো। কণা কেমন যেন ঘোরের মধ্যে ভিতরের ঘরে চলে গেল। সুবিমল যেন নিজেকেই বোঝাচ্ছে এভাবে বলে উঠল---ও তুই চিন্তা করিস না। ও এক হাতেই দশ হাতের কাজ করে। সত্যিই ও দশভূজা রে! দেখতেই তো পাচ্ছিস...দু-হাতের মেয়েরাও এমন পারে,বল?” 
রণেন বিস্মিত, ব্যথিত মন নিয়ে বাইরের ঘরে এসে বসল। সুবিমলই বললএকবার শীতকালে পাটনা থেকে ফিরবার সময়  ট্রেনে দেখা মেয়েটির সঙ্গে, মানে কণার সঙ্গে। তিনটে ব্যাগ এক হাতে নিয়ে উঠতে যাচ্ছিল, পারছিল না, ব্যাগ পড়ে যাচ্ছিল। প্রায় এক্সিডেন্ট হতে হতে বেঁচে গেল। তখন সুবিমলই ধমক দেবার গলায় চীৎকার করে উঠেছিল---এভাবে কি মানে হয়? পারেন না তো এতগুলো নিয়ে উঠেছেন কেন? আর একহাতে কখনও পারা যায় নাকি, একি সার্কাস দেখাতে এসেছেন?’ বলে কিছুটা বিরক্ত হয়ে ব্যাগগুলো তুলে দিয়েছিল।    
সারাটা রাস্তা মেয়েটি একটি কথাও বলেনি। শুধু নামবার আগে গায়ের চাদর গুছিয়ে নিয়ে ব্যগগুলো তুলতে গিয়ে  মৃদুস্বরে বলেছিল---আমার বাঁ হাতটা নেই, কাটা। তাই একহাতে...
সুবিমল আর কোন কথা বলেনি। নিজের জিনিসপত্র নিয়ে কণার সঙ্গে ওই স্টেশনেই নেমে পড়েছিল। কেন, সে জানে না। সেই শুরু। তারপর বছর তিনেক পর বিয়ে। 
--এত  ভালো একটা মেয়ে, শুধু একটা হাতের অভাবে কারো ভালোবাসা পাবে না, সংসার পাবে না... হয় কখনো, বল?’
অবাক হয়ে শুনছিল রণেন। গাঢ, কোমল গলায় সুবিমলের হাতটা টেনে নিয়ে বলল---তুই পেরেছিস, আমরা কেউ পারিনি রে! তুই পেরেছিস বলেই সব সুখের কণাগুলো তোর বুকের ভিতর জড়ো হয়ে আছে। সবাই কি তোর মত করে ভালোবাসতে জানে!

দুই বন্ধু একে অপরের হাত ছুঁয়ে রইল...যেন ভালোবাসার তাপটুকু সইয়ে নিচ্ছিল।