গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১৬ জুন, ২০১৯

নীহার চক্রবর্তী

অনুপম - জোড়

খুব চেনা মেয়ে একটা  সলাজ হাসতে হাসতে হাসতে একটু ঝুঁকে স্কুলের গেট পেরিয়ে স্কুলের মধ্যে ঢুকে গেলো । 
পায়েল দিদিমণি দেখে ভাবতে লাগলো,কে ও ? সেই মেয়েটা না ? কী নাম যেন ওর ? এখন ঠিক মনে আসছে না তো । দেখি কোথায় আসে ও ।
এসব প্রশ্ন নিয়ে পায়েল দিদিমণি স্টাফ-রুমে আরও কয়েকজন দিদিমণির মাঝে এসে বসলো । মিনিট পাঁচেকের মধ্যে সেই মেয়ে প্রাণ-খোলা হাসতে হাসতে তার কাছে এগিয়ে এলো  
একেবারে কাছে এসে বলল,'আমাকে চিনতে পারছেন না,ম্যাম ? আমি সেই শাশ্বতী । মানে শাশ্বতী সাহা । ২০০৯-এর ব্যাচ । দশবছর পর আবার এলাম আমার স্কুলে । আর আপনার কাছেই ।'
মনে পড়ে গেছে তখন পায়েল দিদিমণির সেই হাসিখুশি মুখটা । একটা সময় ও গান-বাজনায় স্কুলের ঘেরা আকাশ ভরিয়ে রেখেছিলো ।
পায়েল দিদিমণি মহাখুশি ।
সারা মুখে উজ্জ্বল হাসি নিয়ে শাশ্বতীকে বলল,'এতদিন পরে বুঝি আমাকে মনে পড়লো ? আমি তো প্রায় ভুলেই বসেছিলাম তোকে । তা আবার কী মনে করে,শুনি ?'
সঙ্গে-সঙ্গে শাশ্বতী একটা সুদৃশ্য ব্যাগ থেকে একটা বিয়ের কার্ড বার করে পায়েল দিদিমণির হাতে তুলে দিলো ।
লজ্জায় লজ্জাবতী হয়ে মাথা নিচু করে বলল,'আমার বিয়ে তো । আগামী ২০শে এপ্রিল । আপনার কিন্তু নেমন্তন্ন থাকলোমনে করে আসবেন কিন্তু আমাদের বিয়েতে ।'
শাশ্বতীর কথা শুনে উপস্থিত কিছু দিদিমণি বেশ অবাক । পরস্পর মুখ চাওয়াচায়ি করতে থাকলো ।
তাদের একজন পায়েল দিদিমণিকে বলল,'তুমিই বুঝি শুধু ওর দিদিমণি ? আমরা নই ?'
পায়েল দিদিমণি তার কথায় বেশ বিব্রত । সে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই শাশ্বতী এক চিলতে হেসে মুখ খুলল ।
বলল,'সবাই তো আমার দিদিমণি । তবে বুকে দাগ কাটে কজন আর । আর দাগ কেটেছিল বলেই ছুটে এসেছি এই দিদিমণির কাছে । তবে আমার শ্রদ্ধা-ভালোবাসা সব্বার জন্য ।'
পায়েল দিদিমণি শাশ্বতীর কথা শুনে বেশ গর্বিত হল । 
মনে পড়ে গেলো তখন তার কত কথা । একটা সময় শাশ্বতীকে পইপই করে বোঝাতো মেয়েদের জীবনের চলার নিয়ম । শুনত বা শুনত না । তবে মুখে হাসি লেগেই থাকতো ওর ।
পায়েল দিদিমণি মুখভরা হেসে জিজ্ঞেস করলো শাশ্বতীকে,'তা আমাদের জামাই কী করে ?'
শাশ্বতী অনাবিল-হেসে বলল,'আমারই বন্ধু । ওর নাম দেবব্রত । অন্য স্কুলে পড়তো । চাকরী পেলো না । তাই এখন পথে টোটো চালায় ।'
ওর কথা শুনে বেশ হতাশ পায়েল দিদিমণি । অন্য দিদিমণিরা শুনে মিটমিট করে হাসছে তখন ।
পায়েল দিদিমণিকে হতাশ হতে দেখে শাশ্বতী গর্বের হাসি হেসে বলল,'চিন্তা করার কিছু নেই,ম্যাম । আমি একমাস হল প্রাইমারী-স্কুলে চাকরী পেয়েছি । দুজনের আয়ে বেশ চলে যাবে আমাদের । শুধু আপনাদের সবার আশিস চাই । ভাবলাম,এতদিনের প্রেম আমাদের । সত্যি করা তো চাই । তা আসবেন কিন্তু । না এলে খুব কষ্ট পাবো ।'
কথাগুলো শেষ করেই শাশ্বতী পায়েল দিদিমণি সহ উপস্থিত দিদিমণিদের পা ছুঁয়ে প্রণাম করে সেই আগের হাসি মুখে নিয়ে স্টাফ-রুম থেকে বেরিয়ে গেলো ।
দেখা গেলো সব দিদিমণির হাত উঠে গেছে শাশ্বতীকে আশিস দেওয়ার জন্য । হাত নামলো সবার কিছু পরেই । তার আগে বুঝি শাশ্বতীর দিকে সবার আশিস মন্দাকিনীর স্রোতের মতো বয়ে গেলো । 
সব দিদিমণির মুখে যখন হাসির পরশ,তখন শুধু পায়েল দিদিমণির দু'চোখ ছলছল করে উঠলো ।
রিনা দিদিমণি তাকে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,'কী হল তোমার ?'
পায়েল দিদিমণি কান্না-জড়ানো গলায় অস্ফুটে বলল,'তাহলে তো আসতেই হচ্ছে । সে যেভাবেই হোক ।'