গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ২ আগস্ট, ২০১৬

মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী

পরিচয়


আলতো হাতে শাড়ির আঁচলটা ছাড়িয়ে নেয় আকাশী, ঘুমন্ত মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে অন্যমনস্ক ভাবে। তাকে ক্রিবে শুইয়ে সুরক্ষিত করে। যতোবার মেয়েকে দেখে, নিজের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে আকাশীর, হয়ত চোখেও জল আসে। মেয়ে বড় হলে কি পরিচয় দেবে তার? আর ভগবানেরও বলিহারি, তার কোলে দিলেন তো দিলেন আবার একটা মেয়ে? যার নিজেরই টালমাটাল অবস্থা সে কখনও চাইবে পৃথিবীর আলো দেখুক আরো একটা মেয়ে?

আকাশীর শ্বশুর বাড়িটা বিশাল বাড়ি, তার আসবাব পত্র, অন্দরসজ্জাও তেমনই মানানসই। আকাশীর কখনও মনেহয় সে বুঝি হোটেলে আছে, কখনও মনেহয় রাজবাড়িতে। তার মতো নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ের কাছে এ সত্যিই স্বপ্নসম। লোকের বাড়ি কাজ করা, বস্তিতে থাকা আর তারই মধ্যে পড়াশোনা করা এগুলো যেন গত জন্মের কথা। এ বাড়িতে কেউ তাকে অসম্মান করে না, বরং শ্বশুর শ্বাশুড়ি দেওর ননদ স্বামী সবাইই যেন প্রতিপদে তুষ্ট করতে চায় আকাশীকে। তার বন্ধুরা ঈর্ষা করে তার সৌভাগ্যকে। তবু আকাশী কাউকে কিছু বলতে পারে না।

যে আকাশী সুযোগ পেলেই সেজেগুজে থাকত, তাদের আর্থিক পরিস্থিতিকে উপেক্ষা করে। শাড়ি গয়নার প্রতি কি আকর্ষণ ছিল তার। সব সময়ে ভাবত এমন একটা বাড়ির বউ হয়ে, সিরিয়ালের মহিলাদের মতো জীবন কাটাবে। শাড়ি,গয়না, সাজগোজ, পঞ্চাশটা কাজের লোক, খাওয়া দাওয়া, বরের সোহাগ, সব মিলিয়ে নিশ্চিন্ত আকর্ষনীয় জীবন। হ্যাঁ তার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে বৈকি, কিন্তু যার বিনিময়ে তাতে এখন আকাশী এসব থেকে পালাতে চায়। সাজে না, ভালো শাড়ি পরে না, খাবার খেতে হয় তাই খায়। মা কে বলতে গেলে মা ও শোনে না, বলে, "যা হয়ে গেছে ভুলে যা। মেয়ের মুখের দিকে তাকা। তাছাড়া ওরা তো সবাই তোকে কতো সম্মান করে, তোর বোনের বিয়েতেও দেখতো কতো খরচ করল। আজকের দিনে কেউ করে বলতো? মন খারাপ করে না মা। সব ঠিক হয়ে যাবে, দেখিস"

নাঃ, কিচ্ছু ঠিক হবে না। কোনোদিনও হবে না। আকাশী কি করে বোঝায়। বিয়ের আগে সে যে এই বাড়িতেই কাজ করতো, আর তার সেই সাজের লোভই তো আজকের দিন দেখাচ্ছে। বাড়ির মালকিন, যিনি কি না এখন শ্বাশুড়ি তার, তিনি বাপের বাড়ি গেছিলেন ছোটো ছেলেমেয়েদের নিয়ে। বড় ছেলে কাজের খাতিরে দিল্লী না বোম্বে কোথায় যেন। কাজের লোকেদের মোটামুটি নির্দেশ দিয়েই গেছিলেন মাসিমা, কি কি করতে হবে; কারণ বাড়ির কর্তা একা থাকবেন দু'দিন। পরে অবশ্য তিনিও যাবেন, তখন কাজের লোকেদের দিন সাতেকের ছুটি সবার।
  সেইমতো আকাশীও কাজে আসে, বিকেলে ছাদের থেকে শুকনো কাপড় তুলে ভাঁজ করে জায়গা মতো রাখা এটা তার অন্যতম কাজ ছিল। সে সময়ে অন্যান্য কাজের লোকেরা হয় ঘুমাতো নয় বাড়ি যেতো, এ বাড়ি মোটামুটি শুনশানই থাকত। সেদিনও তেমনই ছিল। মাসিমার ঘরে কাপড়জামা রাখতে গিয়ে মেসোমশাই একটা দারুণ গয়নার সেট দেখায় তাকে। মেসোমশাইএর কি একটা কাজ করে দিতে পারলে নাকি ওই গয়নাটা দেবেন তাকে। তবে কাজটা একটু গোপন, কাউকে বললে হবে না।

পরে সাতদিন ছুটি পেয়েছিল আকাশী, কিন্তু বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেনি। মা ছাড়া কেউ জানেনি সে ঘটনা। রটলে তো আকাশীরই দুর্নাম, চারিদিকে ঢি ঢি পড়ে যাবে। সে আর এ বাড়ি মুখো না হলেও এরা কিন্তু আকাশীর খবর নিতো, পাড়ার সবাই বেশ অবাক, আকাশী এমন একটা কাজ হঠাৎ করে ছেড়ে দিতে চাওয়ায়। তারপর যখন ধরা পড়ে আকাশীর প্রেগন্যান্সি, খবরটা পেয়ে নিজের অপকর্ম চাপা দিতে তড়িঘড়ি ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে আকাশীকে বউ করে ঘরে নিয়ে আসেন। তার মতো রুপসী বউ পেয়ে ওর বর গলে জল। সাথে, অমন একটা মেয়ের এমন সর্বনাশ থেকে উদ্ধার করল সেই গর্বও আছে বৈকি। কারণ আকাশীর বর তো আর জানে না, কাজটা তার বাবারই। তার বর কেন, মা ছাড়া দুনিয়ায় আর তো কেউ জানেই না। ওঃ না, আরেকজন জানে তো, যে নিজে করেছে কাজটা।
  আকাশীর মা বাবার মুখ বন্ধ, টাকা আর সামাজিক প্রতিষ্ঠান দিয়ে। পাড়ার সবাই ধন্য ধন্য করে,আজকের দিনে এমন নজির গড়ে তোলায়। যতোযাই হোক, একে ধর্ষিতা, মা হতে চলেছে, তায় একটা কাজের মেয়ে, তাকে নিজের বাড়ির বউ করতে দম লাগে বৈকি।

কিন্তু, আকাশীর প্রতিদিন তার ধর্ষককে দেখতে হচ্ছে, এক ছাদের নীচে থাকা, একসাথে খাওয়াদাওয়া, পিতৃতূল্য সম্মান দিতে হচ্ছে। আজও তার ভয় করে কি জানি আবার সুযোগ পেলেই কিছু ঘটান কি না। চিৎকার করে সমাজকে বলতে ইচ্ছে করলেও মুখ যেন কিভাবে বন্ধ হয়ে গেছে তার। ধর্ষিতা হয়েও সামাজিক প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, মেয়েকে একটা পরিবার, বাবার নাম দিতে পেরেছে, কটা ধর্ষিতার কপালে এটা জোটে? কিন্তু তার অমন কেয়ারিং, লাভেবল স্বামীকে সে কি কোনোদিনও আসল পরিচয়টা দিতে পারবে? বলতে পারবে কি? এই মেয়েটি তোমার সন্তানতূল্য হলেও তোমারই বোন।