রমাকান্তর এক সাবেকি বন্ধু এখনও কাছেভিতেই
থাকেন। জীবনের ধার ঘেঁষে কত যে বন্ধু এলো গেল সে সব হিসেব আজ হারিয়ে গেছে ! যে জন
এখন টিকে আছেন তাঁকে নিয়েই চলা। অম্বিকা, ওর সঙ্গে আগে প্রায়ই দেখা হত, কুশল বিনিময় হত।
--কেমন
আছ অম্বিকা ?
--ভালো, শরীর চলছে এখনও ঠিকঠাক। তুমি কেমন আছ
বল ?
--শারীরিক
ভালো--নানান চিন্তা তো লেগেই থাকে মনে।
--শৈলবালার শরীর এখন ভালো?
--একটু
ভালোর দিকে। তোমার নাতি নাতনীরা এলো ?
--ওরা
চলে যাবে, এত
দিন তো ছিল, একবার আসতে পারতে ?
--কি
করে আসি বল ? ঘরে
স্ত্রী অসুস্থ। দেখাশোনারও তো কেউ নেই।
এমনি
গল্পস্বল্প চলে অম্বিকার সঙ্গে। ওঁর বউ মারা গেছেন বছর দুই আগে। সেই থেকে ওঁ একা।
এক মাত্র ছেলে, বউ-মেয়ে নিয়ে বিদেশে থাকে। বছরে, দু বছরে একবার আসে। রমাকান্তর স্ত্রী এখনও বেঁচে
আছেন। অনেক দিন ধরে বিছানায়। ডাক্তার ওষুধ পাল্টে যাচ্ছেন। এই ভালো, এই খারাপ
অবস্থা। রমাকান্ত জানেন আর বেশীদিন নেই শৈলবালা। এ কথা কাকে বলবেন তিনি, কেই বা শোনার আছে ? অম্বিকার মত তাঁর ছেলেও বিদেশে পড়ে
আছে। বছরে এক পাক দিয়ে যায়। বাপ, মাকে দেখে যায়। তাও রমাকান্তর মাঝে মাঝে মনে হয়
ভেতরে কতটা আন্তরিকতা নিয়ে বাপ মাকে দেখতে আসে কে জানে ! তবে হ্যাঁ, নাতনী তার খুব
ভালো, দাদু
দিদাকে যে মনে প্রাণে চায় এটা তার হাব-ভাবে ধরা পড়ে। নাতনী আসলে রমাকান্ত তাঁর
বয়েসটা ভুলে যান। সময়ে অসময়ে নাতনীর সাথে নেচে ওঠেন--এমন কি স্ত্রী ভাল থাকতে
তাঁকে নিয়ে নাতনীর সঙ্গে এক আধবার লুকোচুরিও খেলেছেন। এ সব ক্রমশ: যেন স্মৃতি হয়ে যাচ্ছে!
সময় সময়ের মত কেটে যাচ্ছিল,তাকে এক মুহূর্ত ধরে রাখার সাধ্যি বুঝি স্বয়ং ভগবানেরও
নেই !
এক
দিন হঠাৎই শৈলবালা মারা গেলেন। আসলে মৃত্যুর দরজাতেই তিনি শয্যাশায়ী ছিলেন। আশপাশের
কিছু লোকজন এসে ছিল। তারা অতি পরিচিতের মত কথা বলছিল রমাকান্তর সঙ্গে। কিন্তু
রমাকান্ত আশ্চর্য হয়ে ছিলেন, ওদের বেশীর ভাগকেই তাঁর অপরিচিত মনে হয়েছে। তার মানে তার
চোখে পরিচিতরাও এখন ক্রমশ অস্পষ্ট অপরিচিত হয়ে যাচ্ছে ! তিনি জানেন যে ওরা গতানুগতিক
সান্ত্বনা দিয়ে চলে যাবার পর বাকী পরিচয়টুকুও মুছে যাবে।
আজ
রমাকান্ত একলা। অম্বিকার মতই ঝারা হাত-পা। সাধু-সন্ন্যাসী না হয়েও এমনি নির্ঝঞ্ঝাট
কজন হতে পারে ? জন্মের পর অনেকের মাঝে মানুষ লালিত পলিত হয়। বন্ধুবান্ধব আত্মীয়
স্বজন সব মিলিয়ে চেনা জানা পরিচিতের এক ছড়ানো জাল বিছিয়ে যায়। হাসি কান্না গানের
মাঝ দিয়ে বয়ে যায় সংসার। তারপর মাঝ বয়স পেরোলে ভাঁটার টান শুরু হয়। জীবনের লতাপাতা
ডালপালা ধীরে ধীরে ছাঁটতে থাকে। এমনি করে সবাই, সবাই আজের রমাকান্তর অবস্থায় এসে দাঁড়ায়।
রোজ
ভোরে হাঁটতে বের হন রমাকান্ত। তিনি জানেন এই সচল অবস্থার পতন মানে তাঁরও পতন। যতক্ষণ
শ্বাস ততক্ষণ আশ--বেঁচে থাকার আশ কার নেই?
যে বৃদ্ধ শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করছে সেও আরও ক’বার এ
পৃথিবীর শ্বাস টেনে নিয়ে যেতে চাইবেন। কারণ মৃত্যু হল এক মহা অনিশ্চয়তা। মৃত্যুই
যদি মানুষের এক জন্মের সমাপ্তি হয় তবে এ জন্ম কেন ?
আর ভাবতে পারছিলেন না রমাকান্ত। আজ ভোরে হাঁটতে হাঁটতে
বেশ খানিকটা পথ তিনি এসে গেছেন। বেশ পরিশ্রান্ত লাগছিল তাঁর। পাশের পার্কে এসে
বসলেন তিনি। আজকাল একটু পরপর বিশ্রাম নিতে হয়। তিনি জানেন দিন প্রতিদিন শরীরের
ক্ষয় হয়েই চলেছে ! এ ক্ষয়ই তো জীবনের ধর্ম--বৃদ্ধি ক্ষয় জন্ম মৃত্যু। সব প্রাকৃতিক
ধর্ম। সব জানি আমরা, তবু ভুলে থাকতে চাই ! তবু একটা সময় আসে যখন অহরহ তা মনে পড়ে
যায়।
--তুমি
এখানে ?
রমাকান্ত
দেখলেন তাঁর সামনে অম্বিকা দাঁড়িয়ে। ওঁর হাতে অবলম্বনের লাঠি উঠে এসেছে। অম্বিকা
বসলেন রমাকান্তর পাশটিতে। ওঁরা উভয়ে উভয়ের গা ছুঁয়ে বসে আছেন। কেউ কারো সঙ্গে কথা
বলছেন না। সামনের মাঠে ছোট ছেলে মেয়েরা খেলে বেড়াচ্ছে। বাগানে রং ফুল ফুটে আছে।
রাস্তা দিয়ে গাড়ি হর্ন বাজিয়ে যাচ্ছে। লোকেরা আসছে যাচ্ছে। হাওয়া বইছে। স্নিগ্ধ
হওয়া। রমাকান্ত, অম্বিকার গায়ের ধুতি শার্ট কাঁপছে। ওঁদের চুলগুলি বাতাসে এলোমেলো উড়ছে।
ওঁরা নির্বাক বসে আছেন। মনে হচ্ছে অনন্ত কাল ধরে এমনি ভাবে ওঁদের ওপর দিয়ে হাওয়া
বয়ে চলেছে।