বজবজ স্টেশনে
-অরবিন্দ দা কেমন আছ ?
-ভাল নেইরে ।
-দেখেতো মনে হচ্ছে বেশ ভাল । মাথায় একটা বড় হ্যাট ;চেহারা টাতেও দেখছি বেস তিলে তিলে মেদ জমিয়েছ ।কোট প্যান্ট পরে তোমাকে তো জেমন্স বন্ডের নাতি দেখাচ্ছে । ভাল নও কেন ?পরমার সাথে সংসার টা কী জমল না ? ওকি ওর আগের পক্ষের বরের কাছে ফিরে গেল শেষমেষ ?
সত্তর বছরের যে বুড় টার কাছে টাকা নিয়েছিল ওকে বিয়ে করবে বলে যা তুমি বাড়ি বেচে শোধ করলে ;
সে কী আবার পরমাকে ফাঁসিয়ে ছে ? ওই যে শেয়াল শকুন গুলো যারা সবসময় পেছনে লেগে থাকতো ওকে খাবে বলে । তাদেরয়ই কেউ কী ওকে গ্রাস করেছে ?
পৈত্তিক বাড়িটা বেচে দেবার পর তুমি কী এখন আশ্রয় হীন ? ওর প্রাক্তন স্বামীর যেমন সুখ দেবার ক্ষমতা ছিলনা ;
যার জন্য তোমাকে বিয়ে করলো ;
সে অসুখ কী তোমার মধ্যেও ও আবিষ্কার করেছে ?
পরমা কী নতুন পুরুষ খুঁজছে ?
তোমাকে বলা হয়নি কিছু মনে করবে ভেবে; জলদা পড়ার জঙ্গলে পিকনিকের ফাঁকে নিরালায় আমাকে একাকী বলেছিল
'' তোমায় একবার ঘেঁটে দেখতে চাই ; সত্যিই তোমার কোন ফিলিংস নেই আমার ওপর নাকি ভানকরো ঋষি মুনিদের ।''
আমাকে জাগিয়ে কী খুঁজতে চেয়েছিল পরমা ?
সত্যিই আমার কী কোন অনুভূতি নেই ? ভালবাসা, স্নেহ, মমতা, এসব কী পৃথিবীর কিছু বোকা শব্দ;মেঘের আড়ালের মেঘদূত কামনা কে রক্ষা করে চলে ? তুমি যে পরমার জন্য সবকিছু ছাড়লে ঘর আত্মীয় পরিজন তাকি শুধু এটুকুর জন্য । এ তো তুমি সোনাগাছিতেও চরিতার্থ করতে পারতে । কি বলছ ;সুন্দর ছারা তৃপ্তি হয়না ?
এখন কী তুমি তৃপ্ত ?
আমার সবকিছু কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে অরবিন্দ দা। পুরুলিয়ার জঙ্গলে মনে আছে তুমি মহুয়া খেয়েছিলে নেশা করবে বলে । এক সন্ধ্যেয় সাঁওতাল কুঠিরে বসে বলেছিলে এদের কোন দুঃখ নেই সভ্যতা থেকে দূরে বলে । বুক খোলা যে মেয়েটা মহুয়ার মদ দিচ্ছিল ;
আমার খুব তার প্রেমিক হবার ইচ্ছে-করছিল । তেঁতুল আর শুঁটকি মাছের চাটে টাকনা দিতে দিতে ইচ্ছে-করছিল আদিম হয়ে যেতে ।চলো আজ আর একবার এ সভ্যতা থেকে মুখ ফেরাই ;
বন্ধ্যা যে সুখ দিতে জানেনা । কেন আমি সুখে নেই?কেন তুমি সুখে নেই ? কেন কেউ সুখে নেই ? কে সুখ চুরি করলো আমাদের !
অরবিন্দ দা বলতে পার তোমার অসুখটা কী ?
-মাথা খানা পচে গেছে ।
-হৃদয় ?
-ওটা এখনো জীবিত তাইতো কবিরা কবিতা লেখে আজও ।
-এইযে তোমার গর্দানের ওপর বসানো একটা হাঁড়ির মত;হেডলাইটের মত চোখ,সাইলেন্সরের মত নাক; ঠোঁট-দুটো বিড়ি-খেয়ে চায়ের দোকানের উনুনের মুখ; আর গুটখার দৌলতে দাঁতগুলো বারোয়ারীর খাটা পায়খানা বানিয়েছ । যার ওপর একটা টুপি খচিত । স্টেশনে ঢোকার মুখে ;
যেটার কপাল হাত ঠুকে শনি মন্দিরে নমস্কার করে এলে ; সেটা কী ?
-এটা বড়বাজারে কেনা । দেখবি.....
কি দেখছি আমি । উনুনের মুখের থেকে ভোজবাড়ির পেল্লায়ই হাড়ি নামানোর মতো গলা থেকে মাথাটা নামিয়ে দুই হাতে আমার মুখের সামনে তুলে ধরল অরবিন্দ দা। মাথাটা দেখতে অবিকল সত্যিকারের মত । শুধু চোখের না পরা পাতা বলছে এটা নকল ।
-গলা কোথায় ?
গলা তো দেখতে পাচ্ছি না ।
-ওটা কাটা গেছে রেল লাইনে ।
-কবে !
- যেদিন জানলাম পরমা সন্তান সম্ভবা ।
-এতো সুখের !
-ডি.এন.এ টেস্ট করলে বুঝতে পারবি; এটা সুখ না অসুখ ।
-তুমি ওকে সন্দেহ করছ ? এটা পাপ ।
-নারে সন্দেহ করছি নিজেকে । হটাৎ আমি শুক্রাণু পেলাম কোথায় । আমার অক্ষমতায় প্রথম বৌটা গলায় দোঁড়ি দিয়েছিল মা হতে না পাড়ার অতৃপ্ত বাসনা নিয়ে । আমি এখন অতৃপ্ত রেললাইনের কাটা বডি। এনে...... আমার মাথাটা ধর তোকে দেখাই কাটা গলাটার মধ্যে রক্ত জমে জমাট বেঁধে কালশিটে পড়ে গেছে ।
অরবিন্দ-দার টুপিসহ মাথাটা আমার হাতে । অরবিন্দ দা একটার পর একটা জামা খুলছে ;
আর ভিতর থেকে বেড়িয়ে আসছে আর একটা জামা । আস্তে আস্তে ওপর থেকে দেখা তার স্ফীত চেহারাটা ভেতরে শীর্ণ মনে হচ্ছে । কি বেড়তে যাচ্ছে । কঙ্কাল । নাকি সভ্যতার যোগাযোগ ব্যবস্থায় থেঁতলানো পচা কালশিটে আধ-খাওয়া গলা ।
-না...না....আমি দেখতে চাই না ।
আমি ছুটছি । আমার হাতের মধ্যে অরবিন্দ-দার মাথাটা হেসে বলে উঠলো;
- ছুটিস না আমার মতো হোঁচট খাবি ;
আর উঠে দাঁড়াতে পারবি না ।
মাথাটা যে আমি হাতে নিয়ে ছুটছি । বুঝতে পেরে ছুড়ে ফেলে দিলাম । ওটা আরো জোরে অসুরের মত হাসছে । অ্যানিমেশন ছবির মত মাথার ওপরের টুপিটা লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে হাঁসির চোটে ।
আমি ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছি । পিছেনে গলাকাটা বডিটা আমাকে ধাওয়া করলো নাকি ?
ঘুরে দেখি ।
একি ! আমার মাত্র দুহাত দূরে বজবজ লোকাল ।
একটুও সময় দিল না আমাকে । ঝম;ঝম করেই সেই বাঁধা লাইনের বুকে আমাকে দুখণ্ড করে বেরিয়ে গেল সভ্যতার গতির উচ্ছ্বাস ।
ধরে চেতনা আছে মাথাটা সংজ্ঞাহীন । অরবিন্দ দা বড়বাজারে পেতে পারি আমার মাথা ।
হয়তো পাব তবে চোখের পাতা পড়বে না ।