আচমকা ঘুম ভেঙ্গে যায় কামরুল আলমের। দুঃস্বপ্ন দেখেছে আবার। কাঁপছে শরীর। জলের বোতল তুলে নেওয়ারও জোর পাচ্ছে না । হাতপা
গুটিয়ে শুয়ে থাকে মরার মতন। রুমের ছাদ ছুঁয়ে কয়েকটি আকাশপ্রদীপ ঝুলছে। লাল হলুদ। ছাদ
জুড়ে আদিবাসি ছবি আঁকা। ছবিতে এক শক্তিশালী পুরুষ ভালুক নাকি শুয়োর শিকার করছে।
উদ্যত তীরধনুক। তারপাশে এক মা পিঠে শিশু সন্তান বেঁধে মাথায় জলের ভান্ড অন্য হাতে
ধরে রেখেছে আরেকটি শিশু। ছবিটি দেখতে দেখতে পয়তাল্লিশ বছরের কামরুল আলম একটি চপল ডাক শুনতে পায়, তোতন
তোতন এই তোতন এক ছুট্টে এদিকে আয় তো !”
তোতন হলুদ ঘুড়ির লাল লেজ সামলে ছুটে আসে সফেদা তলায়। সেখানে লাল শাড়ি কাঁচের
চুড়ি চিকন চেনের লম্বা মালা পরে মা বসে আছে। মার মুখে সুখের হাসি। “নে, কি পাকা
দেখেছিস! এখুনি খেয়ে নে বেহেশতের স্বাদ পাবি।”
তোতন সফেদা খেতে খেতেই মায়ের উঁচু পেট ছুঁয়ে বলে, আম্মা বুনুকে আনতে কবে হাসপাতাল
যাব?” মা হাসে । কি মধুর হাসি। ছোটকা শিখিয়েছে মধুর শব্দটি। বিশেষ্য, বিশেষণ, সর্বনাম,
অব্যয়, ক্রিয়ার কেবল দুটি পদ সে শিখেছে। মাঝে মাঝে অবশ্য গুলিয়ে ফেলে। ছোটকা যখন তখন জিগ্যেস করে।
তাতেই বেশি বেশি ভুল হয়ে যায়।
“ধুনেপাতা লাউ শোলমাছের তরকারিটা কেমন হয়েছে রে তোতন ?” ছোটকা জানতে চাইতেই
“মধুর মত” কথাটি বলতেই সেকি ধুন্ধুমার কান্ড ঘটে গেল সেদিন রান্নাঘরে। দাদাভাই কিছুতেই কোনদিন
শোলমাছ খান না। শত সাধ্যসাধনা করলেও মুখ ফিরিয়ে নেন। নিজেই সেদিন চেয়ে নিলেন, বড়
বউমা একটু মধুর তরকারী দাও তো।” বাপি ছোট কাকাকে বললেন, বিকেলে ফার্মেসিতে আসিস
তোর মাস্টারির ডাবল পারিশ্রমিক দিয়ে দেব।” দাদিমা ছদ্ম রাগ দেখিয়ে বাপির প্লেটে
আরো এক চামচ তরকারী দিয়ে বললেন, বাহ বেশ তো চেটেপুটে খাচ্ছ! আমার দাদুভাই কি ভুল বলেছে
কোন যে এত হাসছ?” কেবল মা আঁচলে ঢাকের মত বড় পেট ঢাকতে ঢাকতে সেই মধুর হাসিটি আবার হেসে
ছিলো। তোতন কাউকে বলেনি, সে সবার হাসিকে অক্ষরবন্ধে শব্দ বানিয়ে সেন্টেন্স করতে
পারে। এই যে যেমন তার মায়ের এই মধুর হাসিকে শব্দবন্ধ করলে অর্থ হবে, ওরে আমার
সোনামোনা সাত রাজার ধন মানিক রে। ”
চোখ ঝাপটে জল আসছে। কামরুল আলম আস্তে ধীরে নিজেকে টেনে তুলে পাহাড়ি রেস্ট
হাউসের জানালার কাছে চেয়ার পেতে বসে পড়েন। কত হল তার বয়েস ? এই মার্চে চুয়াল্লিশ পেরিয়ে গেছে। সত্তর
সালে জন্ম। স্বাধীন দেশে সে প্রথম কথা
বলতে শিখেছিল জয় বাংলা। ছোটকাই তাকে শিখিয়েছ। একবার বললেই সে হাত মুঠি করে বলে উঠত,
তয় বাংয়া। সবাই বুঝে নিত এটাই জয় বাংলা।
আশির দশকে দাদু ছোটকার সাথে বাবার বিরোধ চরমে উঠল। ক্ষমতায় তখন সামরিক শাসক। একেবারে সূতোসহ টোপ গিলে
নিলো বাবা। মানুষের জন্যে কাজ করতে করতে
বাবার ভেতর ক্ষমতা অর্জনের একটি গোপন লোভ সব সময়ই ছিল। কিন্তু যে রাজনৈতিক দল করত
তাদের ক্ষমতায় আসার কোন সম্ভাবনা ছিল না
আগামী একশ বছরেও। চড়া হতাশাও ছিল। কিছুতেই কোনোভাবে বাংলার মানুষ কাস্তে হাতুড়ির সমর্থনে ঝাঁপিয়ে এলো না। সকলেই
অবশ্য স্বীকার করত কাস্তে হাতুড়ির নেতাকর্মীরা অপেক্ষাকৃত সৎ কর্মঠ
দেশপ্রেমিক। যে কোন বিপদে এরাই জনগনের পাশে দ্বিধাহীন আশ্বাসে ঝাঁপিয়ে আসে । অথচ
ভোট যা পেত তাতে জমানত বাজেয়াপ্ত হওয়ার অবস্থা হত!
সেই সময় অনেকেই নৌকা ছেড়ে চলে গেল লাঙ্গলে। আদর্শ আঁকড়ে তখনো
শক্ত হয়ে ছিল বাবা। শেষ পর্যন্ত আর পারল না। বড় টোপ গিলে ভিড়ে গেল লাঙ্গলে। তাই
নিয়ে প্রতিদিন ঝগড়া, বিবাদ, খ্যাচ্চোড় লেগেই থাকত বাসায়। একদিন ধুত্তরি, লালের বাল বলে দুই পুরুষের বাম আদর্শকে
ঝেড়ে ফেলে পাকাপোক্তভাবে বাবা জুতে গেল লাঙ্গলে।
দাদু নিলেন কঠিন সিদ্ধান্ত। আদর্শের গরিমায় তিনি কাঁপতে কাঁপতে বললেন, আমার বাড়িতে কোন সুযোগ সন্ধানীর
জায়গা নেই।”
এক বিকেলে বাবা এসে মাকে জানালো, বাড়ি পেয়েছি
ছেলেমেয়েকে ডাকো। কুইক কুইক। বামাতিদের সাথে এক সেকেন্ডও না”। সেদিন ছেলেমেয়ের হাত
ধরে দাদুভাইয়ের কাছে গিয়ে সর্বহারা গলায়
মা ডেকেছিল, বাবা!” দাদুভাই পাথর। দাদিমা তোতন টিয়াকে বুকে জড়িয়ে বলেছিল, এক পা
নড়বে না তুমি বড় বউমা। অই হারামজাদা শুয়োর যেখানে খুশী যে চুলোয় যায় যাক।” তোতনের
মনে আছে সে আর টিয়া দাদিমাকে জড়িয়ে ধরেছিল শক্ত করে। বাবাকে তখন ভয় পেত ওরা। আর
দাদু বন্দুক নিয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন। পাড়ার লোক ছুটে এসেছিল।তিন পুরুষের সঞ্চিত বইয়ের আলমারিতে লাথি মেরে উদ্ভ্রান্তের মত বেরিয়ে
যেতে যেতে চীৎকার করে বলে গেছিল বাবা, সব সম্পর্ক শেষ। সবার সাথে। মনে রেখো।”
ছোট শহরে বাবা আলাদা সংসার পেতে নিলো। তখনো দ্বিতীয় বিয়ে করেনি কিন্তু ভাড়া বাড়ির গল্প অকথ্য ব্যঞ্জনে
ভেসে বেড়াতে লাগল বাতাসে। একজন মুখরা রান্নার ঝি রঙ্গীন কাপড় পরে অতিরিক্ত সাজগোজ করে বাড়ির
ঘরদোর সামলে রাখত। অনেক রাতে হাসি হুল্লোড়, ছক্কাপাঞ্জা খেলার সাথে মদ আর মাতালের
নিত্য নতুন কিস্সা জন্ম নিত সে বাড়িতে । সাধারণ ভাল মানুষরা দাদু দাদিমাকে বলত, এত
চরম নাই বা হতেন। কাছে থাকলে ঘরে থাকলে ছেলেটা এত খারাপ হতে পারত না।” কেউ কেউ
মাকেও ভর্তসনা করে যেত, কেমন স্ত্রী তুমি! যাও স্বামিকে নিয়ে এসো” ।
মা দাদু দাদিমা ঘরেই থাকত বেশি। দাদু বারান্দার পুরানো সোফায় স্থায়ী বন্দোবস্ত করে নিয়েছিল । রাস্তা দিয়ে
যাওয়ার সময় কেউ কেউ সালাম দিত কেউবা শুনিয়ে
শুনিয়ে বলত, ছেলেকে ত্যাজ্য করে কেমন চা বিস্কুট খাচ্ছে নাস্তিক শকুনটা ।” এই
ধরণের লোকেরা কাজ উদ্ধারের জন্যে বাবার কাছেও যাতায়াত করত। বাম
ঘরানার লোক হিসেবে বাবাকে বেশ মান্য করত লাঙ্গলের কর্তা ব্যক্তিরা। বাবা এই সব
পেটি মানুষদের কাজ করে দিয়ে খুব হাসত। মদ খেয়ে চীৎকার করত, আরে রে রে দেখ দেখ আজ
টেনপার্সেন্ট দিয়ে হাফিজ কমরেড মেয়ের চাকরি বাগিয়ে নিল। বুঝলি মঞ্জু আমার বাম
বাবার ডানহাত এই হাফিজকাকু।”
মঞ্জু ক্যাডার। অস্ত্র রাখে সাথে। কোমরেরটি কেড়ে নিলে কোত্থেকে যেন আরো
একটি হাতে চলে আসে। হাতেরটা নিলে ভোজবাজির মত আরেকটা। শহরের অনেকেই বলে মঞ্জুগুন্ডার পেটের ভেতর
অস্ত্রের কারখানা। মানুষ মারা ছিল মঞ্জুর নেশা পেশা আনন্দ। ক্ষমতাধারীদের পোষা
আজরাইল। কেউ জানে না মঞ্জু গুন্ডার বাড়ি কোথায়।
মঞ্জুর মাথায় রেড মেসেজ ছিল, বাবা ঘরমুখো হতে চাইলে বা ফিরে যেতে চাইলেই খাল্লাস । সময় এক সেকেন্ড ।”
মেসেজটি বাবাও জানত। তাই আরো বেপরোয়া জঘণ্য
হয়ে উঠছিল। দেড় বছরের মাথায় বিয়ে করে বসল। মহিলা দু সন্তানের মা । ডিভোর্সি। রান্নার ঝি মুখ বেঁকিয়ে
হাত ঘুরিয়ে পাড়ার মহিলাদের বলত, কি করবে
জোয়ান মদ্দ বেটাটা। শরীর তো আর ঘুমায় থাকে না । তারও তো তেল জল চাই।”
সিক্স ছেড়ে তখন সেভেনে উঠছে তোতন। ছোটকা মাথা মাথা শিক্ষক
এনে কোচিং করাতে লাগল । যে করে হোক ক্যাডেট ইশকুলে চান্স পেতেই হবে। এই নোংরা
পরিবেশ থেকে দূরে পাঠাতে হবে তোতনকে। আর কি আশ্চর্য তোতন চান্স পেয়ে গেল । ছোটকাই সবচে বেশি খুশী হল।
দৌড় ঝাঁপ করে সব কিছু কমপ্লিট করে তোতনকে দিয়ে এলো ক্যাডেট ইশকুলে। ফিরে যাওয়ার
সময় শুধু বলে গেছিল ছোটকা, টিকে থাকার চেষ্টা করবি তোতন। টিকে থাকাই হচ্ছে শেষ কথা।” কালো ব্যাগের ফিতা দুহাতে আঁকড়ে ধরে দাঁতে
দাঁত চেপে কান্না থামিয়ে ছোটকার চলে যাওয়া দেখেছিল তোতন। কাঁদেনি। ঠান্ডা মেঝেতে
অনেকক্ষণ বসেছিল একা একা। সেই সময় রোজ রাতে স্বপ্ন দেখত হারিয়ে যাচ্ছে সে! ছোটকার
হাত ছুটে পড়ে যাচ্ছে শূণ্যে।
ক্যাডেট ইশকুল শেষ করতে করতেই বাবা, দাদু দাদিমা মরে গেল। বাবার মৃত্যু
নিশ্চিত করেছিল মঞ্জুগুন্ডা। অভিযোগ উঠেছিল দলের গোপনসভায়। বাবা নাকি দল ভেঙ্গে
নতুন দল গড়তে চাইছে। লাশ পড়েছিল কাজি টেইলার্সের সামনে। সেখান থেকে হাসপাতালের
মর্গে। কারো বিরুদ্ধে কোন নালিশ করেনি দাদু ছোটকা। তিনদিন ঘরেই ছিল সবাই। পুলিশ
এসেছিল। দাদু বলে দিয়েছিল বড় ছেলে অনেক আগেই মারা গেছে। বিরক্ত না করলে খুশী হব।
দাদু মরা হাতি । তবু কথা রেখেছিল প্রশাসন। দলের লোকেরাই জানাজা পড়িয়ে দাফন করেছিল।
শুধু বাবার বিয়ে করা সেই মহিলা বাড়ির গেটের সামনে জলস্পর্শহীন একঠায় বসেছিল দুই
দিন। কেউ কেউ হল্লা জুড়েছিল। অসন্মানের সুরে বলেছিল, আপনি এই অন্যায় করতে পারেন
না। ঘরে তুলে নিন নইলে কিছু সম্পত্তি দিয়ে দিন। বেচারি তো অসহায়। নাকি কি ভাবছেন আপনি ?”
সেই সময় বিজুচাচি সামাল দিয়েছিল সব। ছোটকার বউ। তোতনকে কিছুই জানানো হয়নি। তার পরীক্ষা চলছিল ক্লাশ
নাইনের। মঞ্জুগুন্ডাই সরিয়ে নিয়ে গেছিল মহিলাকে। দল থেকে বেশ কিছু টাকাপয়সা দিয়েছিল।
কেউ জানে না মহিলা কোথায় চলে গেল। আজ এতদূর এই পাহাড়ি দেশে মঞ্জুগুন্ডার সাথে দেখা
হয়ে গেলো। তাকে চেনেনি। কিন্তু তোতন চিনে নিয়েছে। এই লোককে কি ভোলা যায়! ডিভিশনাল
ইঞ্জিনিয়ারের গাড়ির ইঞ্জিন তেতে উঠতে যে দোকানী জল নিয়ে ছুটে এসেছিল সেই মঞ্জুগুন্ডা।
বৃদ্ধ । টুপি মাথায়। তেলতেলা হাসি নিয়ে বলেছিল, স্যার আমার ভাগ্না আপনার প্রজেক্টে
কাজ করে। দেখবেন স্যার।”
মনের ভেতর বিদ্বেষ নিয়েই ডেকে পাঠিয়েছিল সাইট ইঞ্জিনিয়ার মিনহাজ ইসলামকে।
না ডাকলেই বুঝি ভাল ছিল। যে হাসিখুশি যুবকটি সুইংডোর খুলে সালাম দিয়ে দাঁড়াল সে কে
? কে সে? চমকে উঠে তাকিয়ে থাকে কামরুল আলম।
একেবারে বাবার চেহারা। সেই টগবগ তেজ। দুরন্ত কাজের নেশা। বাবার মতই কথায় তীব্র
হাসিমাখা শ্লেষ। কথা এগোয় না। মিনহাজই জানায় এ বছরের শেষে সে চলে যাচ্ছে
অস্ট্রেলিয়া। মাঝে মাঝে আসবে। বুড়ো অই মামা ছাড়া তার ত কেউ নেই। ঋণশোধ বলে তো কিছু
আছে তাই না স্যার?