বিশ্বাস করিতে কষ্ট
হইলেও ইহা সত্য যে ইখানে যে কাহিনীটি বর্ণনা করিতেছি তাহা ধ্রুব সত্য বটে ।
পুকুরের পাঁক গুলা যেমন কাল আর আঠা পারা আমার কথা গুলাও তেমন তালগোল পাকানো । আমি
সাধুচণ্ডালী বুঝি না । আমার নাম মাখন খাঁ । খাঁয়ের খাঁ নই , তবে বাক্যের দম আছে । ই তল্লাটে মুকে
কেউ ঘাঁটাইতে আসে না । জানে আমাকে চটাইলে মুশকিল আছে । আমি আপন কাজ নিয়ে থাকি ।
কারোর পিছনে কাঠি দি না ।তবে কেউ কাঠি দিতে এলে ছাড়ি না । ছাড়বটা কেনে ?
জানেন , আমার বাবাটো হটাত যখন মরে
চলে গেল তখন আমার বয়স সাকুল্যে দশ বছর । ঘরে চাল নেই । লোকের লাথি ঝাঁটা খ্যায়ে
দিন কাটাইছিলাম। এক দেড় করে ছোট বড় সাত জন ভাই বোন । একটি আবার জন্মায়নি । সিটি
তখন ছিল মায়ের পেটে ।শ্যালো , বাবাটি ছিল একটি গোমুখ্যু ।
পেটে ভাত নেই আর বছরের পর বছর ছেলে বিইয়ে গেছে । যেন কুকুরের জেবন ।ঘেন্না করে ।
ভীষণ ঘেন্না করে ।তা বলে তো আমি দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারি না । বাপ কিছু দে যায়নি
বলে আমি মা , ভাই আর বুন গুলাকে ফেলে পালায়ে যাব ?
না হে সে জীব আমি নই ।
আমি মাখন । ছোট জাতের লোক বটি ।ফুরাইতে চাইলেও ফুরাইয়া যাই না । অত্যেচার কাহাকে
বলে আমি দেখেছি । আখন ফিরতি মার । বাবুদের তাল পুকুরে যখন তখন ছিপ ফেললেও কেউ টুঁ
শব্দটি করে না । করবার জো টুকু নেই । কিছু বললে বেপদ । কোথা থেকে কি হয়ে জাবেক কেউ
জানে না ? তাই বাবুরা দেখেও না
দেখার ভান করে ।আগে হলে চাবকে সোজা করে দিত হে । আমি সে সব দিন গুলা দেখেছি । আমি
জানি সব ।
সব জান্তা মাখনলাল বলে ছেলে ছোকরা গুলা আমাকে গাল পারে । তা পাড়ুক গে ! উহাদের কথা
কে গায়ে মাখছে ? দেখেছেন ধান
ভানতে শিবের গীত গাইছি আমি । শুধু ফালতু কথা । আসল কথাটো বলে ফেলি । বাবা গত হতেই
আমাদের পরিবারে নেমে এল বেপদ । ভাই বোন গুলান খাবার জন্য কান্না কাটি করে । মায়ের
পেটের মধ্যে একটা বাচ্ছা কিলবিল করছে ।আমি শ্যালা তখন স্কুলে পড়ি । সব ছেড়ে ছুড়ে
দিয়ে কাজে লেগে পরলুম । আমার বয়স অল্প । কে কাজ দেবে আমাকে ? হন্যে হয়ে ঘুরেই মলুম । কেউ কাজ দেয় না । শেষে অঘোর মাষ্টারের দয়া হল ।
দু টাকা মাস মাইনের বাগালির কাজ পেলুম । হাতে চাঁদ পাওয়া আর কি ?
কোনদিন চুরি করিনি । তাই গরিব হলেও মানুষ আমাকে শ্রদ্ধা করে । চুরি কি
কোনদিন করি নি ? আমার বিবেক
বলে , ' ওরে মাখন বুকে হাত রেখে বল ?' আমি সত্যিই ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির নই । তাহলে খুলেই বলে ফেলি সব কথা ।
বোশেখের চড়া রোদে গা পুড়ে যাওয়ার সময় তখন । আমার ছোট ভাইটো তখন সবে জন্মাইছে ।
অভাবে স্বভাব নষ্ট । মাটো এর ওর বাড়ি বাসন মাজে ছেলে কোলে করে । উহাকে কেউ কাজ
দিতে চায় না । গৃহস্থের বাড়িতে চুরি চামারি করে খায় । তাই সকলেই মা টো কে সন্দেহ
করে । কাজ থেকে তাড়িয়ে দেয় । অভাব আরও বাড়ে । আমন এক সময়ে একবার চুরি করতে গেছিলাম ।
মাখন আবার চুরি না করে নাকি ? কথায় বলে মাখন চোর । আমি সেই প্রখর গ্রীষ্মে আদুল গায়ে চুরি করিতে
গেলাম । বলে রাখা অনুচিত হইবে না যে , আমি সে সময় অঘোর
মাষ্টারের কাজ ছাড়িয়া আরও বেশি অর্থ পাইবার আশায় অমাপদ সাধুর গৃহে বাগালের কাজ
গ্রহণ করিয়াছি ।আমাকে অঘোর মাস্টার কয়েকটি কিতাব দিয়াছিলেন পড়িবার জন্য । সেই
কিতাব গুলি পড়িয়া আমি সামান্য জ্ঞান লাভ করিয়াছিলাম । সেজন্য অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী
হইয়া দেখা দিয়াছে । উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে উমাপদকে আমি অমাপদ বলিয়াছি ।
যে কথা না বলিলে আমি চিরজীবন অকৃতজ্ঞ থাকিব এমন ধারনা
নিশ্চিত তাহা হইল , আমি
খরার ধান অর্থাৎ বোরো ধান চুরি করিতে যাইয়াছিলাম আমার পুরাতন মনিব অঘোর মাস্টারের
খামারবাড়িতে । পূর্বে কাজ করিবার সুবাদে আমার কিঞ্চিৎ ধারনা ছিল কোথায় কি থাকিতে
পারে । তাই আমি ওই কাজ করিতে উদ্যত হইলাম । কিন্তুক বামাল ধরা পরিয়া গেলাম । ধানের
বস্তাটি লইয়া সবে বেরা টপকাতে উদ্যত ,সে সময় মাস্টার
আসিয়া পরিল । আমি ভীষণ লজ্জায় পরিলাম । ভাবিলাম এই বার আমার কেশাগ্র ধরিয়া লাঠি
পেটা করা হইবে । সে কালে চোর ধরিলে অমন ব্যবস্থাই নির্দিষ্ট হইত । আমি চক্ষু
মুদিয়া ইষ্টনাম জপ করিতে লাগিলাম ।
কিন্তু কি আশ্চর্য । মাস্টার আমাকে মারিল না । আমাকে বকিল না । আমাকে গালি দিল না
। আমাকে গ্রাম ষোলোআনার সম্মুখে পেশ করিল না । আমাকে চোর সব্যস্ত না করিয়া বলিল , ' মাখন তোর পাওনা ধান কাল নিস বাবা । এই
ভর সন্ধ্যা বেলা আর ধান নিস না !'
আমি বাধ্য বালকের মত ঘাড় নাড়িলাম । গ্রামের আর যারা চোর ধরা পরিয়াছে বলিয়া জুতপাত
করিয়া লাঠি লইয়া আসিয়াছিল , তাহারা
বিফল মনোরথ হইয়া ফিরিয়া গেল । গ্রামের সকলে বলিল , ' অঘোর
মাস্টার ঠিক কাজ করিল না ।'
কিন্তু আমি
জানি ওই একটা ঘটনাই আমার চক্ষু খুলিয়া দিয়াছিল । আমি আর কখনও চুরি করিবার কথা ভাবি
নাই । আমাকে স্যার পরের দিন সত্যিই এক বস্তা বোরো ধান দিয়েছিল । আমরা ভাই বোন
মিলিয়া প্রথম বোরো চালের ভাত খাইয়া আহ্লাদে আটখানা হইয়াছিলাম । সে কি আনন্দ !
ভাষায় প্রকাশ করা যাইবে এমন সাহস আমার নাই ।
আমার একটি ভাই পাগল প্রতিপন্ন হইল ।তাহাকে চিকিৎসা করিবার মত অবস্থা আমার ছিল না ।
তাই বিনা চিকিৎসায় তাহার ব্যাধি বৃদ্ধি পাইতে লাগিল । পর বৎসর আমি কৃতজ্ঞতার কারনে
অঘোর স্যারের কাছে কাজ লইলাম । তিনি আমাকে বাগাল হইতে মাহিন্দারে পরিণত করিলেন ।
আমার মাহিনা বৃদ্ধি পাইল ।
মাখন কে চুরি করে খাইত ? কানাই
। মানে কৃষ্ণ । আমি মাখন । আমাকে লোকে নাগর কানাই বলে কি কারনে ? আগেই বলিয়াছি আমার এক ভাই বিকৃত মস্তিষ্ক প্রতিপন্ন হইল । তাহাকে শহরে
লইয়া যাইতাম চিকিৎসার জন্য । অঘোর মাস্টারের কন্যা সবিতা কলেজে পড়িতে যাইত । আমার
পাগল ভাইটি তাহাকে বউদি বলিয়া ডাকিয়া থাকিবে । আমি সবিতা দেবীর অনেক ফাই ফরমাস
খাটিতাম । ক্রমে ক্রমে প্রেম হইয়া থাকিবে । আমি জানিতাম না । আমার ভাইটি জানিত ।
সবিতা তাহাকে হয়তো কিছু বলিয়া থাকিবে ।
আমি ধীরে ধীরে যেন উহাদের পরিবারের একজন হইয়া গেলাম । আমাকে স্যার প্রলেতেরিয়ত
কাহাকে বলে শিখাইল । বুর্জোয়া কেমন করিয়া শোষণ করে বুঝাইল । আমি নেতা হইলাম । ১৯৭৫
সনে স্যার জেল গেলেন । স্যারের স্ত্রী গত হইলেন । আমি সবিতার মন জয় করিয়া তাহাকে
বিবাহ করিলাম । আমার পরিবার বাঁচিল । কালক্রমে আমি নাগর কানাই হইয়া গেলাম ।