গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ২ আগস্ট, ২০১৬

দেবাশিস কোনার

নাগর কানাইয়া

      বিশ্বাস করিতে কষ্ট হইলেও ইহা সত্য যে ইখানে যে কাহিনীটি বর্ণনা করিতেছি তাহা ধ্রুব সত্য বটে । পুকুরের পাঁক গুলা যেমন কাল আর আঠা পারা আমার কথা গুলাও তেমন তালগোল পাকানো । আমি সাধুচণ্ডালী বুঝি না । আমার নাম মাখন খাঁ । খাঁয়ের খাঁ নই , তবে বাক্যের দম আছে । ই তল্লাটে মুকে কেউ ঘাঁটাইতে আসে না । জানে আমাকে চটাইলে মুশকিল আছে । আমি আপন কাজ নিয়ে থাকি । কারোর পিছনে কাঠি দি না ।তবে কেউ কাঠি দিতে এলে ছাড়ি না । ছাড়বটা কেনে ?

     জানেন , আমার বাবাটো হটাত যখন মরে চলে গেল তখন আমার বয়স সাকুল্যে দশ বছর । ঘরে চাল নেই । লোকের লাথি ঝাঁটা খ্যায়ে দিন কাটাইছিলাম। এক দেড় করে ছোট বড় সাত জন ভাই বোন । একটি আবার জন্মায়নি । সিটি তখন ছিল মায়ের পেটে ।শ্যালো , বাবাটি ছিল একটি গোমুখ্যু । পেটে ভাত নেই আর বছরের পর বছর ছেলে বিইয়ে গেছে । যেন কুকুরের জেবন ।ঘেন্না করে । ভীষণ ঘেন্না করে ।তা বলে তো আমি দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারি না । বাপ কিছু দে যায়নি বলে আমি মা , ভাই আর বুন গুলাকে ফেলে পালায়ে যাব ? না হে সে জীব আমি নই ।

    আমি মাখন । ছোট জাতের লোক বটি ।ফুরাইতে চাইলেও ফুরাইয়া যাই না । অত্যেচার কাহাকে বলে আমি দেখেছি । আখন ফিরতি মার । বাবুদের তাল পুকুরে যখন তখন ছিপ ফেললেও কেউ টুঁ শব্দটি করে না । করবার জো টুকু নেই । কিছু বললে বেপদ । কোথা থেকে কি হয়ে জাবেক কেউ জানে না ? তাই বাবুরা দেখেও না দেখার ভান করে ।আগে হলে চাবকে সোজা করে দিত হে । আমি সে সব দিন গুলা দেখেছি । আমি জানি সব । 
 
    সব জান্তা মাখনলাল বলে ছেলে ছোকরা গুলা আমাকে গাল পারে । তা পাড়ুক গে ! উহাদের কথা কে গায়ে মাখছে ? দেখেছেন ধান ভানতে শিবের গীত গাইছি আমি । শুধু ফালতু কথা । আসল কথাটো বলে ফেলি । বাবা গত হতেই আমাদের পরিবারে নেমে এল বেপদ । ভাই বোন গুলান খাবার জন্য কান্না কাটি করে । মায়ের পেটের মধ্যে একটা বাচ্ছা কিলবিল করছে ।আমি শ্যালা তখন স্কুলে পড়ি । সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে কাজে লেগে পরলুম । আমার বয়স অল্প । কে কাজ দেবে আমাকে ? হন্যে হয়ে ঘুরেই মলুম । কেউ কাজ দেয় না । শেষে অঘোর মাষ্টারের দয়া হল । দু টাকা মাস মাইনের বাগালির কাজ পেলুম । হাতে চাঁদ পাওয়া আর কি ?

      কোনদিন চুরি করিনি । তাই গরিব হলেও মানুষ আমাকে শ্রদ্ধা করে । চুরি কি কোনদিন করি নি ? আমার বিবেক বলে , ' ওরে মাখন বুকে হাত রেখে বল ?' আমি সত্যিই ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির নই । তাহলে খুলেই বলে ফেলি সব কথা । বোশেখের চড়া রোদে গা পুড়ে যাওয়ার সময় তখন । আমার ছোট ভাইটো তখন সবে জন্মাইছে । অভাবে স্বভাব নষ্ট । মাটো এর ওর বাড়ি বাসন মাজে ছেলে কোলে করে । উহাকে কেউ কাজ দিতে চায় না । গৃহস্থের বাড়িতে চুরি চামারি করে খায় । তাই সকলেই মা টো কে সন্দেহ করে । কাজ থেকে তাড়িয়ে দেয় । অভাব আরও বাড়ে । আমন এক সময়ে  একবার চুরি করতে গেছিলাম ।

     মাখন আবার চুরি না করে নাকি ? কথায় বলে মাখন চোর । আমি সেই প্রখর গ্রীষ্মে আদুল গায়ে চুরি করিতে গেলাম । বলে রাখা অনুচিত হইবে না যে , আমি সে সময় অঘোর মাষ্টারের কাজ ছাড়িয়া আরও বেশি অর্থ পাইবার আশায় অমাপদ সাধুর গৃহে বাগালের কাজ গ্রহণ করিয়াছি ।আমাকে অঘোর মাস্টার কয়েকটি কিতাব দিয়াছিলেন পড়িবার জন্য । সেই কিতাব গুলি পড়িয়া আমি সামান্য জ্ঞান লাভ করিয়াছিলাম । সেজন্য অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী হইয়া দেখা দিয়াছে । উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে উমাপদকে আমি অমাপদ বলিয়াছি ।

       যে কথা না বলিলে আমি চিরজীবন অকৃতজ্ঞ থাকিব এমন ধারনা নিশ্চিত তাহা হইল , আমি খরার ধান অর্থাৎ বোরো ধান চুরি করিতে যাইয়াছিলাম আমার পুরাতন মনিব অঘোর মাস্টারের খামারবাড়িতে । পূর্বে কাজ করিবার সুবাদে আমার কিঞ্চিৎ ধারনা ছিল কোথায় কি থাকিতে পারে । তাই আমি ওই কাজ করিতে উদ্যত হইলাম । কিন্তুক বামাল ধরা পরিয়া গেলাম । ধানের বস্তাটি লইয়া সবে বেরা টপকাতে উদ্যত ,সে সময় মাস্টার আসিয়া পরিল । আমি ভীষণ লজ্জায় পরিলাম । ভাবিলাম এই বার আমার কেশাগ্র ধরিয়া লাঠি পেটা করা হইবে । সে কালে চোর ধরিলে অমন ব্যবস্থাই নির্দিষ্ট হইত । আমি চক্ষু মুদিয়া ইষ্টনাম জপ করিতে লাগিলাম ।

     কিন্তু কি আশ্চর্য । মাস্টার আমাকে মারিল না । আমাকে বকিল না । আমাকে গালি দিল না । আমাকে গ্রাম ষোলোআনার সম্মুখে পেশ করিল না । আমাকে চোর সব্যস্ত না করিয়া বলিল , ' মাখন তোর পাওনা ধান কাল নিস বাবা । এই ভর সন্ধ্যা বেলা আর ধান নিস না !'

    আমি বাধ্য বালকের মত ঘাড় নাড়িলাম । গ্রামের আর যারা চোর ধরা পরিয়াছে বলিয়া জুতপাত করিয়া লাঠি লইয়া আসিয়াছিল , তাহারা বিফল মনোরথ হইয়া ফিরিয়া গেল । গ্রামের সকলে বলিল , ' অঘোর মাস্টার ঠিক কাজ করিল না ।'

   কিন্তু আমি জানি ওই একটা ঘটনাই আমার চক্ষু খুলিয়া দিয়াছিল । আমি আর কখনও চুরি করিবার কথা ভাবি নাই । আমাকে স্যার পরের দিন সত্যিই এক বস্তা বোরো ধান দিয়েছিল । আমরা ভাই বোন মিলিয়া প্রথম বোরো চালের ভাত খাইয়া আহ্লাদে আটখানা হইয়াছিলাম । সে কি আনন্দ ! ভাষায় প্রকাশ করা যাইবে এমন সাহস আমার নাই ।

     আমার একটি ভাই পাগল প্রতিপন্ন হইল ।তাহাকে চিকিৎসা করিবার মত অবস্থা আমার ছিল না । তাই বিনা চিকিৎসায় তাহার ব্যাধি বৃদ্ধি পাইতে লাগিল । পর বৎসর আমি কৃতজ্ঞতার কারনে অঘোর স্যারের কাছে কাজ লইলাম । তিনি আমাকে বাগাল হইতে মাহিন্দারে পরিণত করিলেন । আমার মাহিনা বৃদ্ধি পাইল ।

     মাখন কে চুরি করে খাইত ? কানাই । মানে কৃষ্ণ । আমি মাখন । আমাকে লোকে নাগর কানাই বলে কি কারনে ? আগেই বলিয়াছি আমার এক ভাই বিকৃত মস্তিষ্ক প্রতিপন্ন হইল । তাহাকে শহরে লইয়া যাইতাম চিকিৎসার জন্য । অঘোর মাস্টারের কন্যা সবিতা কলেজে পড়িতে যাইত । আমার পাগল ভাইটি তাহাকে বউদি বলিয়া ডাকিয়া থাকিবে । আমি সবিতা দেবীর অনেক ফাই ফরমাস খাটিতাম । ক্রমে ক্রমে প্রেম হইয়া থাকিবে । আমি জানিতাম না । আমার ভাইটি জানিত । সবিতা তাহাকে হয়তো কিছু বলিয়া থাকিবে ।

     আমি ধীরে ধীরে যেন উহাদের পরিবারের একজন হইয়া গেলাম । আমাকে স্যার প্রলেতেরিয়ত কাহাকে বলে শিখাইল । বুর্জোয়া কেমন করিয়া শোষণ করে বুঝাইল । আমি নেতা হইলাম । ১৯৭৫ সনে স্যার জেল গেলেন । স্যারের স্ত্রী গত হইলেন । আমি সবিতার মন জয় করিয়া তাহাকে বিবাহ করিলাম । আমার পরিবার বাঁচিল । কালক্রমে আমি নাগর কানাই হইয়া গেলাম ।