মনুভাই বৃত্তান্ত
নামের পোস্টমর্টেম
মনু উভলিঙ্গ নাম, যদিও আমাদের মনুভাই
পাঁচ ফুট এগার ইঞ্চির এক তাগড়া জওয়ান পুরুষ । সে ভালো ফুটবল এবং কাবাডি খেলতে পারে
। মনু ভাই ভোজনবিলাসী, এ বিষয়ে সে কখনও আপত্তি তোলে না । গ্রামের
তাবৎ লোকের উপকার করে বেড়ানো তার নেশা । সে কখনো কোন মেয়ের দিকে খারাপ নজরে তাকায়
না । তার কাছে মেয়েরা হয় মা নয়তো বুইন । এটা নিয়ে গ্রামে মিশ্র প্রতিক্রিয়া
বিরাজমান, মায়েরা বোঝে, তাদের মেয়েরা মনুর
হাত থেকে নিরাপদ । যুবতী মেয়েরা মনু ভাইয়ের দৃষ্টি আকর্ষণে ব্যর্থ হয়ে বিরক্ত ।
কেউ কেউ আড়ালে আবডালে বলে সে নাকি ধ্বজভঙ্গ । বিবাহযোগ্য কন্যার মায়েরা একথা ভেবে
হতাশ, মনু ভাইকে তারা মেয়ে জামাই হিসেবে পাবে না । সে
প্রকাশ্যেই ব্রহ্মাচার্যের ঘোষণা দিয়েছে ।
মনুভাইয়ের
বিদ্যাশিক্ষা ।
মনুভাই প্রথম স্কুলে পদধূলি দিলেন আট বছর বয়সে ।
ক্লাসের সবচেয়ে জ্যাঠা বালক । পদধূলি শব্দ ব্যবহার কি যথাযোগ্য হলো? তিনটে বছর লেগেছে তার স্কুল প্রবেশের প্রস্তুতিতে
। অতঃপর তিনি নিজেকে তৈরী করলেন, মালুচি সরকারী
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হলেন । প্রথম ঘন্টা, বাংলা ক্লাস, রতন স্যার স্বরবর্ণ
শেখাচ্ছেন, ব্ল্যাকবোর্ডে লেখা হচ্ছে, ছেলেমেয়েরা তুলছে কিন্তু মনুভাই কিছুতেই যুত করে
উঠতে পারছেন না । একটা গোল পুটুলি তো বসালেন আগে কিন্তু স্বরে অ টানতে গিয়ে
বিকিতিচ্ছিরী অবস্থা! যতই ডানে টানেন ততই বামে বেঁকে যায় । তার ওপর কিরকম বাঁশের
কঞ্চির মত একটা হাত লাগানোর ঝামেলা! স্বরে আ লিখতে গিয়ে তার টেঁশে যাওয়ার দশা হলো, একি হ্যাপা? একসপ্তাহের মাথায়
খেলেন পিটুনি । ব্যাস, হয়ে গেলো, সারেরা পড়াইবার পারে
না উল্টা পিটায়!
মনুভাইয়ের
মাদ্রাসাগমন
ছাওয়ালের বয়স দশ হইয়া গেলো, এহনও তারে নমাজ শিখাইলা না মনুর মা? কোন এক অমুক পড়শীর কথায় টনক নড়ে মনুভাইর মায়ের ।
মনু তার একমাত্র সন্তান নয়, উপরওয়ালা দিয়েছিলেন
এগার জন, তারই কৃপায় টিকে আছে ছয় জন । দুটি আবার মেয়ে । এই
আকালের গোষ্ঠীদের নিয়ে বেচারী অবিরাম পেরেশান থাকেন । সেইসব পেরেশানির মধ্যেই
সৃষ্টিকর্তার ভয় তাকে কাঁপিয়ে গেলো । তিনি মনুভাইকে ইনসান হুজুরের মাদ্রাসায় পাঠিয়ে
দিলেন । ইনসান হুজুর মানুষটা যথেষ্ট ভালো কিন্তু রাগটা একটু বেশী । তা হতেই পারে, গোটা আটেক সন্তান আর দুই বিবি নিয়ে তারও টানের
সংসার । এই আক্রার বাজারে হলে হুজুর কি করতেন বলা মুশকিল, গল্পটা উনিশ শ আটষট্টি সালের । ধান ভানতে শিবের
গীত হচ্ছে । বলছিলাম মনুভাইয়ের ধর্মীয় শিক্ষা নিয়ে । হুজুর তাকে বেশ কায়দা করে অজু
করতে শেখালেন । শুরু হলো জনাবিশেক ছেলের সাথে সুর করে পড়া আলিফ - বে - তে...
প্রথমে হুজুর খেয়াল করে উঠতে পারেননি, পরে তার কমজোর শ্রবণ
শক্তিতে ধরা পড়লো। তিনি মনুভাইকে ডাকলেন, ওই মনু, এদারে আয়। মনুভাই গেলেন। বল, লাম। মনুভাই বললেন, রাম……..।হুজুর আঁতকে উঠলেন, তার কি জানা ছিলো না যে মনুভাই ল কে র উচ্চারন
করে? তিনি আবার বললেন, ক লাআআআম, মনুভাই বললেন, রাআআআম। হুজুরের আর
সহ্য হলো না, বিকট গর্জন করে বেত চালিয়ে দিলেন পিঠে, মনুভাইয়ের ধর্মীয় শিক্ষার ইতি ঘটলো।
উনিশ শ একাত্তর
যুদ্ধ কি জিনিস সে বিষয়ে রেডিওর নাটক শুনে যা
অভিজ্ঞতা। পলাশীর যুদ্ধ কিংবা সিপাহী বিদ্রোহ কি জিনিস সেটা তার জানা ছিলো না।
নবাব সিরাজউদ্দৌলার পালা দেখে কেঁদেছেন অনেকবার। সেই মনুভাইর জীবনে এলো উনিশ শ
একাত্তর সাল। মানিকগঞ্জ শহর থেকে সতের মাইল ভিতরের গ্রামটার মানুষজন প্রথমে কিছুই
টের পেলো না। তারা রেডিও মারফত জানলো, ঢাকা শহরে গণ্ডগোল
লেগেছে। গণ্ডগোলের রেশটা গ্রামে লাগলো মে মাসের মাঝামাঝি, ততদিনে রূপসা মাচাইনের অনেক যুবক সীমান্ত পাড়ি
দিয়ে চলে গেছে আগরতলা ট্রেনিং ক্যাম্পে। পাকিস্তানী সৈন্যরা এলো খুব ভোরে, নৌকা ও ঘোড়ার গাড়ীতো কয়েকদল এলো টেপরা হয়ে নৌ
পথে, কয়েকদল বালিকান্দি ঝিটকা হয়ে ঘোড়ার গাড়ীতে।
মালুচী স্কুলে তাদের ক্যাম্প বসলো। সুবিধাবাদীদের আনাগোনা শুরু হলো মিলিটারী
জওয়ানদের ক্যাম্পে। গ্রামের নীরব পথগুলো ঢেকে যেতে লাগলো বারুদের গন্ধে। মনুভাইও
ঘোরেন মিলিটারীদের আশেপাশে। এদের কর্মকাণ্ড দেখেন, একদিন পালপাড়ার
রূপসী তরুণী জবাকে দেখলেন সেখানে, তার চৌদ্দ বছরের
প্রায় শেষ হয়ে আসা কৈশোর এক অশণিসংকেতের ছায়া দেখলো। গ্রাম ছাড়ছে মানুষ, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়। তরুণী যুবতী মায়
কিশোরী কন্যাদের বাবামায়েরা তীব্র আতংকের মধ্যে দিনগুলি পার করতে থাকে। যেসব
পরিবারের সন্তানেরা যুদ্ধে গেছে, তারা গা ঢাকা দিলো।
নুরুদ্দিন বেপারী পালালো না, তার আশা ছিলো সে
মোছলমান, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, বৃদ্ধ মানুষ, মিলিটারীরা তাকে
কিছু বলবে না। পরদিন আসরের নামাজরত অবস্থায় নুরুদ্দিন বেপারীকে গুলি করে হত্যা করে
পাকিস্তানী মিলিটারী সঙ্গে মদদদাতা রাজাকার বাহিনী। এই দৃশ্যে স্তম্ভিত মনু ভাই
হাসেম সিকান্দারের সাথে ঘর ছেড়ে ট্রেনিং ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।মনুভাইদের
দিশেহারা পরিবারটি ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালায়। রাজাকারের দল কাউকে না পেয়ে তাদের তিনটে
ঘর পুড়িয়ে দেয়।
মনুভাইয়ের ভ্রমণ কেচ্ছা
মনুভাই একটু পা টেনে হাঁটেন, সহসা বোঝা যায় না, আগে ক্রাচ নিয়ে
হাঁটতেন, পরে সরকারী অনুদানে নকল এই পা তৈরী করে দেয়া হয়
তাকে । ব-কলম মনুভাই নামস্বাক্ষর শিখেছেন কিছুদিন আগে । ক্যাপ্টেন আশীষ সরকার যখন
তাকে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার কোটায় এই সরকারী দপ্তরে পিয়নের চাকরিটা পাইয়ে দিলেন, আনন্দের সীমা ছিলো না তার । আসলে সে অফিস বয়, যদিও পিয়ন মনুমিয়া নামেই পরিচিত । উনিশ শ
চুয়াত্তর সাল, বঙ্গবন্ধু বেঁচে, দেশের অস্থিতিশীল
অবস্থা নিয়ে চলছে আরেক লড়াই, মনুভাইয়ের তখন চাকরি
হলো । জয়েনিং লেটারে প্রথম বারের মত নাম স্বাক্ষর করলেন, 'মনু মিয়া ।' তারপর হাজিরা খাতায়
অসংখ্যবার করতে হয়েছে বটে । মনুভাই তখন পূর্ণ যুবক, একটা যুদ্ধ বয়সের
চাইতেও বেশী পূর্ণতা দিয়েছে তাকে । মুখভর্তি দাঁড়ি মনুভাইয়ের, তা প্রায় বুক ছুঁই ছুঁই । কি খেয়ালে একমাসের ছুটি
নিয়ে বের হয়ে পড়লেন ভ্রমণে । গৃহত্যাগী পোষাক, আজানুলম্বা এক ফকিরী
লেবাস । এই জেলা,
ঐ মফস্বল, সেই গ্রাম, অমুক পাহাড় ঘুরছেন, মসজিদ - মন্দির -
গীর্জা - প্যাগোডা - গৃহস্তের বাড়ি - উপজাতিদের টংঘর, যেখানে আশ্রয় মিলছে, পার করে দিচ্ছেন রাত । উপরওয়ালার দয়ায় চারটে দানা
পানিও জুটে যাচ্ছে । এই নশ্বর জীবনটাকে নিয়ে তিনি খুশি । হয়তো বিদ্যের জোর নেই তার, এখনো ল কে র বলেন, জীবনে ধর্মকর্ম
করেননি তিনি, বোঝেনও না; একটা জিনিস বোঝেন, ভালো মানুষ এবং মন্দ মানুষ ।
বোধ ও চীৎকার
বিবেকের কাছে হেরে যাওয়া কি রকম লজ্জার? আগে কোনদিন এসব ভাবতেন না মনুভাই । একটা যুদ্ধে
ডান পা উড়ে গেলো,
এটা নিয়ে কষ্ট ছিলো না তার যখন জানতে
পারলেন প্রিয় বোন রোশনী ক্যাম্পের আলোহীন ঘরটায় পশুদের নির্যাতন সইতে না পেরে মরে
গেছে, মেজভাই লাবুর বুক ঝাঁঝরা করে দিয়ে গেছে
মিলিটারীরা, বুড়ি মা স্বাধীনতা দেখার আগেই মুক্ত হয়ে গেছেন; শোকের ভার বইতে না পেরে । তিন গ্রাম দুরে এক
বেদেবহরে ওরা লুকিয়েছিলো ।আধপেটা কিংবা উপবাসে ভঙুর মানুষগুলোকে ধরিয়ে দিলো কে? কারা! ফকিরের পুত পান্নু মিয়া । না এখন সে ফকির
নয়, কয়েক একর জমির মালিক, জিতেন চৌধুরীর তিনমহলা প্রাসাদোপম বাড়িটা এখন তার
। স্বাধীনতার পর দীর্ঘদিন পালিয়ে ছিলো পান্নু মিয়া । এখন সে জাঁকিয়ে বসেছে গ্রামে
।বড়ভাই মালেক একটা পেপার মিলের ম্যানেজার, তার কাছেই থাকে ছোট
ভাইবোন দুটি । আরেকটা ভাই অল্প বয়সে পাক্কা চোর হয়ে উঠেছিলো, হাত মিলিয়েছিলো চিরশত্রু পান্নু মিয়ার সাথে ।
একারণে চানুকে তারা বের করে দেয় । মনুভাই শুনেছে, বখরা নিয়ে গণ্ডগোল
হওয়ায় চানুর লাশ ফেলে দেয় পান্নু মিয়া । আজ মনুভাই প্রচণ্ড বিক্ষিপ্ত, যুদ্ধের সময়ের বড় আরেক লুটবাজ লেকু আলির নাকি
মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট আছে ।পান্নু মিয়া মাত্র দশ হাজার টাকার বিনিময়ে
মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট বেঁচে । তার নিজেরও বীর উপাধি ধারী সার্টিফিকেট আছে ।
কথাটা শুনে একরকম তাজ্জব চোখে নিজের সার্টিফিকেট টা দেখে সে । তার প্রায় ছয়ফুট
শরীরটা কুঁকড়ে আসে লজ্জা, অপমান আর ঘৃণায় ।
একটা ক্রোধ আকাশভাঙ্গা চীৎকার হয়ে কাঁপতে থাকে । এই প্রথম তার মনে হয়, স্বাধীনতার পর অস্ত্রগুলো জমা দিয়ে সে ক্ষমার
অযোগ্য অপরাধ করে ফেলেছে ।