অনুপান
নুশার সাথে আমার দেখা হলো পাক্কা নয় বছর পরে, সেবার শীতে আমি খেপুপাড়া গেলাম যখন, ঠিক নয় বছর। নুশার বিয়ের আগেই আমি খুব তাড়াহুড়ায় পাততাড়ি গুটিয়ে নিজেকে ভিটেছাড়া করলাম ।
সত্যি বলতে কি পিছুটানও ছিলো না আর । বাবা মা বিগত, ভাইবোনও নেই, একমাত্র পিছুটান নুশারও বিয়ে হয়ে যাচ্ছে । সেই বছরটায় তিনটে শোক পরপর এসেছিলো, বাবা মারা গেলেন ঠিক আটদিন পরে মা ।
শোকের তীব্র দহণ, এই অবস্থায় নাসির কাকা একটা চিঠি এনে দিলেন, আমার পুলিশে চাকরি হয়েছে, ট্রেনিং খাগড়াছড়িতে ।
আমি কখনই পুলিশ হতে চাইনি, বাবা খুব চাইতেন, তার জোরাজুরিতেই সাব ইনসপেক্টর পদের জন্য আবেদন করেছিলাম, তারপর এই টেস্ট, সেই পরীক্ষা, ঐ হেনস্থা, এই নাকাল.. আমি একরকম নিশ্চিত ছিলাম খেপুপাড়া বাজারে বাবার
মুদির দোকানেই
বসবো, নুশাকে ছেড়ে থাকা সম্ভব না আমার পক্ষে ।তৃতীয় ঘটনাটি আত্মঘাতী, নুশার বিয়ে ঠিক হলো । হবেই তো, ওর বিয়ের বয়স হয়েছে, কিন্তু অন্য কোথাও কেন ! নুশা আমার ।
ছুটলাম ওদের বাড়ীর দিকে, এখুনি কথা বলতে হবে নুশার সাথে ।
সালু খালাদের আমবাগানে দাঁড়িয়ে কথা বলছি, আমাকে না জানিয়ে তোমার বিয়ে কিভাবে ঠিক হলো? উত্তেজনা আর রাগে মাথা কাজ করছে না, বাক্য গুছিয়ে বলতে পারছি না । নুশা একটু অপ্রস্তুত, হ্যাঁ জানানো হয়নি, সবকিছু এত তাড়াতাড়ি হয়ে গেলো ।
এবার সত্যি ক্ষেপে উঠি, অন্যের সাথে কিভাবে বিয়ে ঠিক হচ্ছে তোমার? তুমি কি ন্যাকা সাজছো? আমরা পরস্পরকে ভালোবাসি ।
সরি! নুশা একটা রোবটের মত বলে ওঠে আমি তোমাকে ভালোবাসি এমন কথা কোনদিন বলেছি বলে তো মনে পড়ে না! কলজের ভিতর চাকুর আঘাত টের পাই, তাহলে হাসি আনন্দের এতগুলো বছর! শীতলাখোলার পোড়োবাড়িতে আমাদের নিষিদ্ধ দিন গোপন অভিসার! নুশা অসহিষ্ণু হয়ে পড়ে, তার মানে এই নয় আমি তোমাকে ভালোবাসি ।
এটা সময়ের একটা চাহিদা, অভিজ্ঞতার খেলা । তোমাদের নিয়ে এই এক সমস্যা, দেহগত কিছু ঘটলেই সেটাকে প্রেম ভেবে বসো । একরাশ বিরক্তি নিয়ে সে চলে যায় । কেউ করাত দিয়ে কাটছে আমার হৃদপিণ্ড । নুশা ! আমার প্রেম । সেই প্রথম সিদ্ধান্ত নিলাম পালাবো ।
নয় বছর ! ভাবিইনি ! শিউলি আর বাচ্চারাও সঙ্গে এসেছে ।
শিউলি আমার বৌ, ভারী সুন্দর, অবিরাম এক ভোরের শিউলি । কাল খেপুপাড়া পৌঁছুতে বেশ রাত হয়ে গেল, নাসির কাকা আর কাকিমা তেমনি গুছিয়ে রেখেছেন সব, হঠাৎ মনে হয়েছিল পশুর নদীতে ডুব দিয়ে এই ফিরেছি ঘরে । আমার শৈশব কৈশোর আর প্রথম যৌবনের দিনগুলি দেয়ালে দেয়ালে, ঈশ্বরের তুলিতে আঁকা ।
বুঝি এই এখুনি পর্দা ঠেলে ঢুকবেন বাবা, অ লিটু জলদি একটু ওষুধের দোকানে যা, তোর মায়ের হাপানির টান বেড়ে গেছে । ঐ তো মা আসছেন, ইস মা, তোমার সাথে ইলিশ মাছের গন্ধ! মাছ কেটেছি রে, হাত ঠিকমত ধুইনি ।
গন্ধ গন্ধ করছিস খাবার সময় তো আঙুল ডুবিয়ে খাবি! বসার ঘরে বাবা মা ছবি হয়ে ঝুলে আছেন ।নাসির কাকা হাত রেখেছেন পিঠে, তোমার কাকি বাথরুমে গরম জল দিয়েছেন বাজান । যাও, গোসল করে খাও । সারাদিন জার্নি করে আসছো, খেয়েদেয়ে জলদি ঘুমিয়ে পড়ো । আমি জল আড়াল করে পা রাখি স্নানঘরে ।
সকালটা উপভোগ করতে করতে চা খাচ্ছি, নুশার আগমন, আমি কিঞ্চিৎ হতভম্ভ, সামলে নিয়েছি পরক্ষণেই ।
নুশার এ কি রূপ! ময়ূর ফাৎনার মত দেহে শুয়োরের মেদ, খুব চর্চিত মুখে সেইরকম ধূর্ত অভিব্যাক্তি ।
সাথে বছর পাঁচেকের একটা ছেলে, মায়াবি এবং সুন্দর । শিউলিকে ডেকে পরিচয় করিয়ে দিলাম, শিলু সবই জানে, বলেছি অকপটে ।
মা গো কি সুন্দর বৌ তোমার! নুশার চোখে কি ঈর্ষা? আমি তরল কন্ঠে জবাব দেই, তুমি ফেলে দিয়েছো বলে কি আর কেউ কুঁড়িয়ে নেবে না? নুশার চেহারা অপমানে কালো হয়ে ওঠে । বোধহয় পরিস্থিতী ঘুরছে বুঝতে পেরেই শিলু ওকে ভিতরে নিয়ে যায় ।
আমাকে এখন কথা বলতে হবে কাকার সাথে, তার জরুরী তলব পেয়েই খেপুপাড়া আসা ।
আর যে সামাল দিতে পারি না বাউজি, এই ঘর, তোমার বাবার দোকান, বয়স হইছে, বুইরা হাড্ডি বিশ্রাম চায় । আমাদের তো কোন সন্তানও নাই, নিজের জিনিস নিজে বুঝে নেও । সে কি! এমন তো কোনদিন ভাবিনি! নাসির কাকা আমার রক্ত সম্পর্কের কেউ না, কিসের এই রক্ত সম্পর্কের তত্ত্ব? এসব কিছুর উর্ধ্বে কাকা কাকিমা ।
রোহিঙ্গা এক নারীকে বিয়ে করে নিগৃহীত হয়েছিলেন তিনি, কতকাল আগের কথা, আমার বয়স তখন আট যখন বাবা এঁদের নিয়ে এসেছিলেন, ভাগ্যের হাত ধরে আমাদের ঘরের সদস্য হয়ে উঠলেন তাঁরা । সেই থেকে আজ অব্দি কাকা কাকিমা অন্য প্রদেশের কেউ, ভাবার জন্য চিন্তা তৈরি হয়নি মাথায়, আজও হচ্ছে না, কিন্তু চিন্তা একটা হচ্ছে, কাকা কাকিমার বয়স হয়েছে, তাদের দেখার কেউ নেই, একটা ব্যাবস্থা তো করতে হবে । রাতে শিলুর সাথে আলাপ করলাম, সে ও চায় মানুষদু’টো আমাদের সঙ্গে থাকুক ।
কাকা কে বললাম, স্বিদ্ধান্ত হয়েছে বাজারের মুদি দোকানটা বেঁচে দেয়া হবে, বাড়ীটা নয় । এখানে আমার একটা জীবন অ্যালবাম হয়ে আছে, আছে বাবা মায়ের কবর, এটা পাহারা দেবে আমার বাল্যবন্ধু সোনাই হালদার, আপনারা আমাদের সঙ্গে যাবেন। আমি সন্তানের কর্তব্য করতে চাই।
হতে পারতো এই জীবনটা আমার, আমি বাবার গঞ্জের দোকানটায় বসতাম, নুশা আমার হতো, আমাদের অনেকগুলি না হোক দুটি বাচ্চা থাকতে পারতো, আমরা একটা মায়াচ্ছন্ন জীবন আকড়ে থাকতাম, হয়নি ।
এসব কি ভাবছি! পাশে শিউলি নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে আমার একটা হাত আঁকড়ে । এই মেয়েটার সাথে দেখা এক অস্থির দিনে, যখন আমি জানি না কি করছি, বুঝি না কি ভাবছি! ট্রেনিংয়ের কষ্টকর দিনগুলিতে আরো বেশী কায়িক শ্রমে ডুবিয়ে রাখি নিজেকে । আমাদের ক্যাম্পের সাথে সি টাইপ যেসব কোয়ার্টার, সেখানে থাকতো ওরা । অনেক পরে সে বলেছিলো, আমাকে তার মনে হত বইতে চেষ্টা করছি নিয়তির বিষাদ, শূন্যতার ঝড় ।
শিউলি তখন আমার হাত ধরেছিলো যখন ভালোবাসা আমাকে সামান্য খড়কুটো ছাড়াই ঠেলে দিয়েছিলো জীবন সাগরে ।আশ্চর্য এক বদগন্ধী রসায়ন! নুশা কোনদিনই বলেনি ভালোবাসি, অথচ প্রগাঢ় মেলামেশা ছিলো আমাদের, সেই বালকবেলা থেকেই । উঠতি বয়সের ঘ্রাণগুলি সে চিনিয়েছে কিম্বা যখন তার পনের এবং আমি সতেরোয়, পোড়া বাড়িটায় আরেক জীবনের স্বাদ, ঘরটার নাম দিয়েছিলাম খেলাঘর । এমনটা মনে হতে পারেনা যে ওর আচরণ আমাকে বলেছিলো, সে আমার! মুখে ভালোবাসি না বললেও তো ভালোবাসা রেণু ছড়ায়? পাশ ফিরে শুই, শিউলি পিটপিট করে তাকাচ্ছে, লিটন যা কোনদিনই তোমার ছিলো না, তা নিয়ে কি ভাবছো? কষ্ট পাচ্ছ অকারণ! না, আমি কষ্ট পাচ্ছি না রে বৌ, একজাতীয় নিকৃষ্ট ঘৃণা ব্যাঙাচির মত থিকথিক করছে ।
শিউলি আমাকে আড়াল করে, প্রথম দিনের মত আজও এবং অবিরাম আমার যন্ত্রণাগুলিকে সে আড়ালে ঠেলে দেয় ।
হ্যাঁ, আমি সম্পদ দেখেছি, আমার প্রয়োজন ছিলো, আমি ধনাঢ্য মহিলা হতে চেয়েছি… নুশা গড়গড় করেই বলে গেলো ।
সে ছিলো নির্বিকার এবং নিস্পৃ, কন্ঠে নয় বছর আগের সেই দিনটির মত কাঠিন্য ছিলো না, ছিলো এক বিমর্ষ মানুষের হতাশাক্লান্তি ।
বিকেলে পশুর নদীর জঙলা ধারটায় বসেছি, যেমন বসতাম ন’বছর আগে, হঠাৎ নুশার গলার আওয়াজ, এখানটাতেই বসেছো? আমি সরে যেতে পারছি না, নুশার উপস্থিতীতে অস্বস্তি হচ্ছে,
আমি কোন বিশেষ রোমন্থন হেতু এখানে বসিনি নুশা । সে অবশ্য প্রসঙ্গ পাল্টে কেমন আছি জিজ্ঞাসায় এলো । নিঃসন্দেহে অনেকের চেয়ে ভালো আছি । শিউলির মত স্ত্রী আছে যে আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু, আমার বাচ্চাদের মা । নুশা এসব কথায় বিরক্ত হয়ে ওঠে, স্ত্রৈন! কেন? তুমি স্বামী সোহাগিনী নও? শরীরে গয়নার জারক, দেহে সুখের মেদ । শুনেছি অনেক বড়লোক তোমরা! বড় বড় বাড়ি, মাথাপিছু গাড়ী ।
অনেক আদর করে বুঝি কর্তা ? নুশা মুখরা হয়, সম্পদ চেয়েছি, পেয়েছি,
আমার স্বামী নারীদেহে আগ্রহী নয় । সে কি ! আমি ভড়কাই।
হ্যাঁ , সে একজন সমকামী । আমি সত্যি সত্যিই আউলে যাই, এসব পাশ্চাত্ব্যে
হয় শুনেছি! প্রাচ্যেও হয়, লোকে আড়াল করে ।
তবু তিনি নির্বীজ নন, সন্তান তো দিয়েছেন তোমায় ।
নির্বোধ এক উম্মাদিনীর মত হাসতে থাকে নুশা, হাসতেই থাকে… মাসে কত পার্টি জমে আমার বাসায় জানো? কত জনের সাথে নিত্য ওঠাবসা,
কার সন্তান ধারণ করেছি নিজেও জানি না ! স্তম্ভিত হই, নিস্তব্ধ হয়ে ওঠে নদীপাড় ।
তোমার স্বামী………!! কিছু বলে না ! ওর মুখটা কি এক ঘেন্নায় বেঁকে যায়, কোন মুখে কি বলবে ? তার কথা আমি গোপন করিনি ! আর, তার বংশ রক্ষা করেছি ।
নদীর সেই সর্বগ্রাসি রূপ আগের মত নেই । অনেক জায়গায় বয়া বসিয়ে রাখা, বয়ার মাথায় একটা বাতি । স্টিমারগুলিকে সামলে চলতে হয় বয়ার পাশ দিয়ে, গেলেই ডুবোচরে আটকে যাবে ।