গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ৩০ আগস্ট, ২০১৩

ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

ধরণী সামন্ত, আমি এবং ...
     
এটা ধরণী সামন্তর গল্প নয় , হলে শোক সভায় অত লোকের মাঝে আমি অমন চিৎকার করে ব্যাপারটা ঘটাতে পারতাম না , কিছুতেই না ।

          হ্যাঁ, শোকসভায় অনেক লোকের মাঝেই আমি ব্যাপারটা ঘটিয়েছিলাম। তাতে শোক সভার সুরটা হয়তো একটু কেটে গিয়েছিল কিন্তু তার জন্য আমার বিন্দুমাত্র অনুতাপ  ছিল না , কেননা আমার মনে হয়েছিল অনেকেরই সেই শোকসভায় হাজির থাকার অধিকার ছিলনা । কোথা থেকে এতো ক্রোধ আমার ভেতরে জমা হয়েছিল কে জানে ! সেই ঘটনার পর কি হয়েছিল আমার মনে নেই, কেউ আমার বেয়াদবির জন্ত দুএকটা চড় চাপড় কষিয়েছিল কিনা তাও মনে নেই । শুধু মনে ছিল একটা আচ্ছন্ন বিধ্বস্ত মানুষের মত শোকসভা রহেকে চলে এসেহিলাম – যেন এউমাত্র আমার সর্বস্ব লুট হয়ে গেছে কোন দস্যুর হাতে । আমি চসার ঘরে অনেকক্ষণ সেই ছবিটার দিকে তাকিয়েছিলাম। বিসর্জনের গোবিন্দমাণিক্য । আমি যেন শুনতে পাচ্ছিলাম গোবিন্দমাণিক্যর চরিত্রে ধরণীদার সেই অসাধারণ সংলাপ –
দাঁড়াইয়া মুখোমুখি দুইভাই হানে
ভাতৃবক্ষ লক্ষ্য করে মৃত্যুমুখি ছুরি
রাজ্যের মঙ্গল হবে তাহে? রাজ্যেশুধু
সিংহাসন আছে – গৃহস্থের ঘর নেই,
ভাই নেই, ভাতৃবন্ধন নেই হেথা ?

          শোকসভায় কেউ জোরে কথা বলে না । আমি কিন্তু চিৎকার করেই কথাগুলো বলেছিলাম । তখন সবেমাত্র ছবিতে মালা দিয়ে স্মৃতিচারণ সুরু করেছেন এ তল্লাটের বেশ কেউকেটা লোক নটবর মিত্র – যাকে নুটু মিত্তির নামেই লোকে চেনে বেশি । নুটু মিত্তির বলছিল ‘ যখন আমি এই ভাঙা মঞ্চটাকে বাঁচাতে একটা হিল্লে করলাম, ঠিক তখনই ধরণীদা আমাদের ছেড়ে চিলে গেলেন’ । কি হিল্লে করার ব্যবস্থা নুটু মিত্তির করেছিল তা আমি জানতাম, কারণ সেই রাতে নুটুর সঙ্গে সব কথাবার্তার একমাত্র সাক্ষি ছিলাম আমি । পাশের ঘরে বসে সব কথাই আমি শুনেছিলাম ।

          শোক সভাটা ছিল ধরণী সামন্তর স্মৃতিতে । নাটিক ও থিয়েটার বলতে এ তল্লাটে যে মানুষটির নাম একবাক্যে সবাই বলেন, তিনি ধরণী সামন্ত । আজ প্রায় বিশ পঁচিশ বছর তাঁকে মঞ্চে দেখা না গেলে কি হবে – তিনি ধরণী সামন্ত, এ তল্লাটে থিয়েটারের শেষ কথা । সেই ধরণী সামন্ত চলে গেলেন রবিবার ভোর রাতে । সকালে সবে চায়ের কাপটা হাতে নিয়েছি । ধরণীদার বাড়ি থেকে আয়া মেয়েটির ফোন ‘দাদা, জেঠু আর নেই, তাড়াতাড়ি চলে এসো’ ।

          ধরণীদার মৃত্যু অনেকের কাছেই বিচলিত হওয়ার মত কোন খবর ছিল না । একটা থিয়েটারের লোক চলে গেলে কার কি এসে যায় ! ধরণীদা তো সমাজের কেউকেটা ছিল না । আমার এখনই যেতে ইচ্ছে করল না । কেননা আমি তো জানি, এখন ধরণীদার দেহটা নিয়ে কামড়াকামড়ি হবে – কে কত কাছের লোক ছিল সেই নাটকের মহড়া চলবে নকল কান্নায় । এরকম নকল কান্নার সাক্ষি ছিলাম বৌদি চলে যাবার পর । ধরণীদা বলেছিলেন ‘কেউ মনে রাখেনা রে ! তোর বৌদিকে ছাড়া আমি কি ধরণী সামন্ত হতে পারতাম ? হতে পারতো এই ‘অর্ধেন্দু মঞ্চ’টা ?

          সেই কবে কলকাতার হাটখোলা থেকে ঠিলানা বদল করে এই লোহালক্কড় আর সিমেন্ট  কারবারীদের এই মুলুকে বাসা বেঁধেছিলেন ধরণীদা বেশি বেশি থিয়েটার কবেন বলে । এবং কি আশ্চর্য, কলকাতা কর্পোরেশনের একশ’দশ-একশ’আশির কেরাণী তিন চারজন বন্ধু জোগাড় করে, বৌদির গয়নাগাটি বিক্রি করে সস্তায় একখন্ড জমি কিনে একটা নাট্যমঞ্চও বানিয়ে ফেললেন । নাম দিলেন ‘অর্ধেন্দু শেখর মঞ্চ’ । ধরণীদা বলতেন ‘দেখ, রবীন্দ্র – অহিন্দ্র- শিশির- গিরিশ সকলের নামে থিয়েটার হয়েছে, আর যে মানুষটা থিয়েটারকে জমিদারবাবুদের বৈঠকখানা থেকে আমাদের সকলের কাছে নিয়ে এলো তার নামে কোন মঞ্চ হল না’ । থিয়েটার করার জন্য অর্ধেন্দু শেখর মুস্তাফিরা তখনকার ইংরাজ সরকারের কত লাঞ্ছনা ভোগ করেছিলেন সেইসব গল্প, ‘নীলদর্পণ’এর গল্প ধরণীদর কাছ থেকেই শুনেছিলাম । আর ধরণীদাও তো থিয়েটার না করতে পারার যন্ত্রণা নিয়েই চলে গেলেন ! এখন যারা ধরণীদার দেহটাকে নিয়ে কামড়া-কামড়ি করবে তাদের কাছে থিয়েটার মানে নাচন-কোদন ছাড়া আর কি ?

          এইসব ছবি দেখতে দেখতে কখন সেই বাড়িটার সামনে চলে এসেছিলাম – খেয়াল ছিল না । ততক্ষণে ধরণীদার দেহটার দখল নিয়ে নিয়েছে পাড়ার কেষ্ট-বিষ্টুরা । আর আমি কাল সন্ধ্যাতেও ঐ বাড়িটায় এসেছিলাম, এখন একা, ভীষণ একা । একসময় নাটক করতেন, ধরণীদার হাতে গড়া অনেকেই এলেন, একটু দূরে দাঁড়িয়ে মৃদু কথা-বার্তা চালাচ্ছিলেন । আমি নিশ্চিত তাঁরা এখনও সেই কবে ঘী খাওয়া আঙুলের ঘ্রাণ নিচ্ছিলেন । আহা, যদি আমার কাছে একটা আয়না থাকতো ! নুটু মিত্তিরও চলে এসেছিলো এবং যথারীতি কানে মোবাইল গুঁজে চেলা-চামুন্ডা পরিবৃত হয়ে নিজেকে জানান দিচ্ছিলো । দূরে দাঁড়িয়ে থাকা আমি মুখে আসা একদলা থুতু ফেলে দাড়িয়েই থাকলাম ।

          বছর দুয়েক আগে ধরণীদা একবার শেষ চেষ্টা করেছিলেন এই নুটু মিত্তির কে ধরে যদি কিছু সরকারী সাহায্য পাওয়া যায়, মঞ্চটা বাঁচে । বলেছিলেন, ‘নুটু তোমার তো সরকারী মহলে অনেক জানাশোনা । পাড়ার ফুটবল ক্লাবের জন্য অনুদান আদায় করে দিলে আর চল্লিশ বছরের মঞ্চটাকে বাঁচানোর জন্য কিছু করবে না ?

          সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে নুটু বলেছিল ‘ না না ধরণীদা , শুধু নাচন-কোদনের জন্য সরকারী অনুদান পাওয়া যাবে না । আপনাকে তো বলেছিলাম , ওটা দিয়ে দিন , কমিউনিটি হল বানানোর ব্যবস্থা করবো, সভা, সেমিনারও হবে আপনারা নাটক-ফাটকও করবেন । কেন মড়া আগলে বসে আছেন ধরণীদা’ । আর একমুহুর্ত না থেকে ধরণীদা আমাকে নিয়ে চলে এসেছিলেন । সেই নুটু মিত্তির এখন ধরণীদার দেহ আগলে শেষযাত্রার তদারকি করছে । মনে মনে বলেছিলাম ‘নেই তাই খাচ্ছো, থাকলে কোথায় পেতে’ ?

          নুটু মিত্তিররা বোধয় কার দিন শেষ হয়ে আসছে তার একটা আগাম গন্ধ পায় । ধরণীদা মারা যাবার আগের দিন অসুস্থ মানুষটাকে দেখতে ধরণীদার বাড়ি এসেছিল । বলেছিল ‘এবার আপনার অর্ধেব্দু শেখর নঞ্চের একটা হিল্লে হবে ধরণীদা, আপনি শুধু একটা সম্মতি দিন , কাগজপত্র সব রেডি করে রেখেছি’ ।

          এই ছবিটাও সরে গেল নুটু মিত্তিরের গলার শব্দে। কাকে যেন বললো ‘শোন, গাড়ি বলে দিয়েছি, এখনই চলে আসবে, বডি নিয়ে সোজা নীলরতনে চলে যাবে’ । কে একজন বলল, ‘ অর্ধেন্দু মঞ্চের সামনে একটু দাঁড়াবে না নুটুদা’ ? নিজের হাতে গড়া মঞ্চে যেতেও ধরণীদাকে নুটু মিত্তিরের অনুমতি নিতে হচ্ছে । বললো, ‘আবার ওখানে বডি বানাবি ? ঠিক আছে পাঁচ মিনিটের বেশি সময় নিবি না কিন্তু , আর শোন আমি চললাম, আমার আবার থানায় একটা মিটিং আছে’ ।

          চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করছিল ‘ময়লা হাতে লোকটা তোমার পবিত্র দেহ ছুতে চাইছে ধরণীদা, ওকে ছুঁতে দিও না । কিন্তু  বলতে পারলামনা , বলার সাহস পেলাম না ।

          এবং কি আশ্চর্য, সেদিন ধরণীদার শোক সভায় সেই সাহসটা পেয়ে গেলাম । বোধয় আমার ওপর ধরণীদা ভর করেছিল সেদিন ।

          শোকসভা শুরু হয়েছে শোক প্রস্তাব পড়া হয়েছে , আমি কিছুই শুনিনি । সকলের শেষে একটা কোণে দাড়িয়েছিলাম ধরণীদার ছবিটার দিকে নিস্পলক তাকিয়ে । সঞ্চালকের কাঁপা কন্ঠ বললো ‘এবার স্মৃতিচারণ করবেন এলাকার সুপরিচিত সমাজকর্মী ও শিল্প-সংস্কৃতির বিদগ্ধ পৃষ্ঠপোষক মাননীয় নটবর মিত্র মহাশয়’ ।
          ধরণীদার ছবিতে একটা মালা লটকে দিয়ে নুটু মিত্তির বলতে শুরু করলো । জানালো আজকের এই শোকসভাতে আমি একটা আনন্দ সংবাদ দিতে চাই । আমি ভাগ্যবান, কারণ আমার সঙ্গেই ধরণীদা শেষ কথা বলেছেন নাটক আর মঞ্চ নিয়ে । গতকালই উনি সম্মত হয়েছেন । এই অর্ধেন্দু মঞ্চের জমিতে তৈরী হবে একটা কমিউনিটি হল । ধরণীদার স্বপ্ন সার্থক হবে’ । আর এই সময়েই আমি প্রচন্ড জোরে চিৎকার করে উঠলাম ‘মিথ্যে কথা । এই লোকটাই ধরণীদাকে আরো কিছুদিন বাঁচতে দিল না , ধরণীদা গো , কে তোমাকে মাথার দিব্যি দিয়েছিল এই ফেরেববাজ দের মুলুকে এসে থিয়েটার করতে ?’ কে একজন এসে আমাকে টেনে বাইরে নিয়ে গেল, বললো ‘কাকে কি বলছিস খেয়াল আছে ?

          খেয়াল ছিল বৈকি ! কাল রাতে নুটু মিত্তির যখন অর্ধেন্দু মঞ্চের জমিতে কমিউনিটি হল বানানোর সম্মতি চাইছিল তখন ধরণীদা বলেছিলেন, ‘যতক্ষণ আমার নিশ্বাস পড়বে ততক্ষণ তো পারবে না নুটু । নিশ্বাস বন্ধ হলে দেহটাকে নীলরতনে পুরে দিয়ে মঞ্চটাকে খাবলে খুবলে খেয়ো, তার আগে নয়’ । আমি তখন পাশের ঘরে, রাতের আয়া মেয়েটার আসার অপেক্ষায় । চলে আসার আগে ধরণীদা শেষ কথা বলেছিলেন ‘তোরাও আর মঞ্চটাকে বাঁচাতে পারবি না রে, শকুনের দল বড় মরিয়া হয়ে উঠেছে’ ।