আমাবস্যার রাত । চারিদিকে অন্ধকার । সামনে
একটা কালো রঙের স্করপিও খ্যাঁচ্ করে ব্রেক কসলো ।
গাড়ি থেকে চারজন নামলো । পরনে জিন্স আর কালো টি শার্ট । চোখে কালো চশমা । হাতে গ্লাভস্
আর পিস্তল মনে হচ্ছে । মুখটা ঢাকা সাদা মাস্কে। মাথায় সাদা ফেল্ট্ ক্যাপ্ । চারজন চার দিকে গেলো । এ টি
এম্ কাউন্টারের ভেতর আমি একা বসে। রাতের ডিউটি । একটু চোখটা ধরে এসেছিল ঘুমের
আমেজে । সামনের দৃশ্য দেখে ঘুমের বারোটা বেজে গেল । কিছু একটা অঘটন ঘটবে বলে মনে
হচ্ছিল । তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখটা খুলতেই,.. “এই
শালা ঘুমচ্ছিস কি ওঠ শালা রাত জাগা প্যাঁচা ঘুমচ্ছিস কিরে ?”
কথাটা শুনে
মেজাজ টা চটে গেল । নিজেকে সামলে নিলাম । আমার হাতে একটা লাঠি ছাডা আর কিছু নেই ।
পরনে শুধু সিকিউরিটি গার্ডের ড্রেস্ । হাতে দুমডোন একটা গত কালের আনন্দ বাজার
পত্রিকা কালই খবরটা চোখে পডেছিল,“কলকাতার এ টি এম লুটেরারা গডি নিয়ে ডাকাতি করছে,
সিসি টিভি ফুটেজে ধরা পডছেনা, ওরা দলে বলে আসছে সঙ্গে মারণাস্ত্র ।” ভয় লাগলো আবার রাগ ও হল! তোরা গরীবের পেটে লাথি মেরে
চিট্ ফান্ড এর টাকা লুটলি এখন ব্যাঙ্কের এ টি এম লুটছিস!! আলু পিঁয়াজের দাম ও
বাডালি । দুমুঠো যে নুন ভাত খাবো তাও তোরা শান্তিতে খেতে দিবি না। কি চাস তোরা ?
আমরা গরীবরা না খেয়ে মরি আর তোরা দেশ লুটে মস্তি করবি । কথাটা মনে মনে ভাবছিলাম
.......
..হঠাৎ
“এই শালা আমার সামনে দাঁড়া নইলে মাথার খুলি উডিয়ে দেব! টুঁ শব্দ করবিনা” সামনের ছেলেটা বলল ।
আমি
কেন সামনে দাঁড়াবো ?
ন্যাকা জানিস না ! দাঁডা বে জান প্যারি হ্যায় তো !!একটু
ইতস্তত বোধ করে পকেট হাতডে কি বার কোরতে চেষ্টা করছিল (নিশ্চই এ লাইনে নতুন মানে
প্রফেসনাল নয়)
... ঠিক সেই সময় আমি ওর মাথায় আমার ডান্ডা দিয়ে এক ঘা
বসিয়ে দিলাম। দিয়ে দৌড়ে ওখান থেকে পালালাম । ওই ছেলেটা আচমকা এটা হবে আশা করেনি ।
ও চিৎকার করে তলায় পডে গেল। আমি প্রাণপনে ছুটলাম মোবাইলে মেসেজ্ দিতে । মেসেজ বক্স
থেকে সেভ করা মেসেজ টা আমার ব্যাঙ্কের বি এম কে পাঠিয়ে দিলাম । সেন্ট হল
দেখলাম...ঠিক সেই সময় গুলির শব্দ হল। হঠাৎ আমার বাঁ হাতে কি একটা অগ্নিস্ফুলিংগ র মতন ঢুকে গেল । আমি
যন্ত্রণায় পডেগেলাম। জ্ঞান ছিলোনা কারণ জ্ঞান ফিরতে দেখি আমি হস্পিটালে। কাছে আমার
স্ত্রী পুত্র বসে।
ডাক্তার বাবু জিঙ্গাসা করলেন “কেমন লাগছে? যন্ত্রণা হচ্ছে
? আপনার অপারেশন হয়েছে , ভয় নেই গুলি বার করে দিয়েছি। আপনার ছেলেই আপনাকে রক্ত
দিয়েছে। ব্লাড গ্রুপ এক; ও পসিটিভ্ । ওসুধ ইঞ্জেক্সন সব ব্যাঙ্কের ম্যানেজার
দিয়েছেন। ভয়ের কিছু নেই। আপনি সুস্থ বোধ করলে পুলিস আসবে আপনার স্টেটমেন্ট নিতে ।
আপনি যা যা ঘটেছে মনে করে বলতে পারবেন তো?”মাথা নাডিয়ে বললাম , হ্যাঁ স্যার পারবো।
পুলিস অফিসার এলেন সেই সময় ।
-
কি ব্যাপার কেমন আছেন ?
-
ভালো ।
-
কে কে ছিল কেমন দেখতে একটু আন্দাজ করতে পারবেন।
-
হ্যাঁ স্যার । আমি একা কাউন্টারের ভেতর ছিলাম । এমনিতেই জায়গাটা
ফাঁকা তাতে রাতে কেউ আসে পাসে থাকে না । তখন পুলিসের মোবাইল পেট্রলিং এ কাউকে কাছে
দেখি নি স্যার।
-
আমি সে কথা আপনাকে জিঙ্গাসা করি নি ; কে ছিল কে না ছিল ! যা
জিঙ্গাসা করছি তার উত্তর দিন। একটু গম্ভীর ভাবে বললেন।
-
আমি একা কাউন্টারের ভেতর ছিলাম একটা কালো রঙের স্করপিও ....
-
স্করপিও বলে কি করে জানলেন ? তখন ত অন্ধকার ছিল বলছেন !
-
হ্যাঁ স্যার্ , কিন্তু এ টী এম এর আলো ছিল সেই আলোতে গাডিটা
দেখে বুঝতে পারি । তা ছাডা আমি গাডি চিনি সার । আমি আগে গাডি চালাতাম ।
-
ও আচ্ছা ! নাম্বার দেখেছিলেন ?
-
না স্যার ওটা দেখতে পারিনি কারণ গাড়িটা সাইড করা ছিল একটু দূরে।
-
হুঁ আর কিছু ?
ওই
গাডিথেকে চারটে লোক কালো পোসাকে বেরুলো।
-
কালো বলে কি করে জানলেন?
-
আমি রাত কানা নই স্যার। একটু আলো পডেছিল ওতেই দেখেছি ওরা কি
পরেছিল।
-
হুঁ তা বটে ।
-
কথা বলতে একটু কষ্ট হচ্ছে সার । ডাক্তার বললেন,“পেসেন্ট কে একটু
রেস্ট দিন” ।
-
ঠিক আছে পরে আসবো । ঠিক ঠিক বলবেন ।
মাথা নাডিয়ে
সম্মতি দিলাম।
বৌ
কাছেই ছিল । বলল আমরা না খেয়ে থাকবো তাও আচ্ছা তোমাকে এ চাকরি আর করতে হবে না।
-
সংসার কি করে চলবে ?
-
সে আমি বুঝবো এখন ।
এখানে বলে রাখি ,আমার বৌ যমুনা একটি
বাচ্চা মেয়েকে সারা দিন রাখে। ঘরের রান্না বান্না যাবতীয় কাজ ওই করে । মেয়েটির
বাবা মা দুজনেই সকাল থেকে অফিসে যায়। জমুনা মেয়েটিকে ছোট থেকে বড করেছে। ওরা মাস
গেলে ৫০০০ টাকা মাইনে দেয় । আমার ছেলে মন্টু কলেজের খরচ নিজেই চালায় টিউসনি করে।
পার্ট টাইমে ডিটিপি করে শ্যাম বাজারে । বেচারা সাইকেলে যায় । বাস ভাডা বেডে
যাওয়াতে সাইকেল ই ওর এক মাত্র ভরসা । টিউসনি থেকে হাজার দুএক পায় বাকি ডিটিপি করে
কিছু পায়। আমি ৬০০০ টাকা পাই । রাত দিন এক করে খাটতে হয়। এই
কটা সামান্য টাকায় আমাদের কষ্টেমষ্টে চলে যায়। তবে এই দুর্দিনে আর সংসার টান্তে
পারছিনা । দেশে মা বোন আছে তাদের টাকা পাঠাতে হয়। তারা না হলে না খেয়ে মরবে। মা,
বি পি এল এর চাল পায়। বোন ক্ষেতখামারে কাজ করে। বিয়ে করেছিল স্বামি ছেডে দিয়েছে ।
হঠাৎ যমুনা বলে উঠলো “কি ভাবছো ? আমি ত
আছি” । কি করে যে
কি করি বুঝে উঠতে পারছিনা । আমি কবে হাসপাতাল থেকে যাবো । পুলিসের চক্কর আমার খুব
বাজে লাগে । জল তেষ্টা পাচ্ছে । যমুনা একটা মিনারেল ওয়াটারের বোতল
কিনেছে দেখলাম। সত্যি ও আমার অনেক খেয়াল রাখে। ছেলেটাও মন মরা হয়ে গিয়েছে । যমুনা
বলল “তুমি চিন্তা করনা । আমার মালকিন বলেছেন উনি ৫০০০ টাকা আগাম দেবেন বলে । পূজোতে
যে বোনাস পাই সেটা আগে থেকে দেবেন উনি”।
-
তোকে আমি অনেক দুঃখ দিলাম যমুনা” বলতে বলতে চোখে জল এলো ।
-
ও মা এই সময় আমি থাকবোনা ত কে থাকবে শুনি ? তোমার বোন ? ও ত
স্বামীর ঘর করতে পারলনিকো , তোমাকে কি দেখবে শুনি!
-
আমি এখানে আছি , খেটে খাচ্ছি ও কাজ করতে পারে না ? সোহাগ্ । বলি
কোথা থেকে আসবে শুনি ? গা জ্বলে যায় আদিখ্যেতা দেখলে ! মরন !!
-
আমি ঘরে ফিরে আমার আগের মালিকের ট্যাক্সি চালাবো । দেখিস ঠিক
চলে যাবে ।
-
রক্ষে কর ।
ডাক্তার
এসে বললেন ওনাকে রেস্ট দিন। পরের দিন সকাল বেলাতে ব্যাঙ্কের ম্যানেজার এলেন পুলিস
অফিসার এলেন ।
- আজ কেমন আছেন ?
- ভালো ।
- কথা বলতে কষ্ট হবেনা ?
- না ।
- আচ্ছা আপনি কালো রঙের স্করপিও
বলছিলেন না !
- হ্যাঁ স্যার । লোকটাকে কেমন
দেখতে বলতে পারবেন ?
- ও লোক নয় সার একটা কম বয়েসের
ছেলে ।
- কি করে জানলেন ?
- ও আমাকে থ্রেট করছিল । যানে মেরে
ফেলবে বলছিল যদি আমি ওকে এ টি এম ভাঙ্গা তে সাহায্য না করি ত ।
- ও আচ্ছা । কেমন দেখতে ওকে?
- রোগা লম্বা আর কিছু দেখা
যাচ্ছিল না। নন বেঙ্গলি মনে হল সার । গলার স্বর চিনতে পারবো । সি সি টি ভি ফুটেজে
সব কভার করে থাকবে সার ।
- কি হয়েছে না হয়েছে সেটা আপনার
জানার প্রয়োজন নেই । যা জিঙ্গাসা করছি তাই বলুন।
- মুখ কেন দেখেন নি?
- মুখে মাস্ক ছিল সার ।
- হুঁ। নন বেঙ্গলি কেন বললেন ?
- কথা শুনে তাই মনে হল স্যার।
- ও । আপনি গাডি চালাতেন না ?
- হ্যাঁ সার।
- আপনি কি করলেন ও আসাতে ?
-
ও এসেই আমাকে বাজে গালা গালি দিয়ে উঠতে বলে । আমাকে সামনে
দাঁড়াতে বললো । আমি মানা করাতে পকেট খোঁজে । আমি বুঝলাম মেশিন খুঁজছে ।
সঙ্গে সঙ্গে মাথায় লাঠি মেরে ওখান থেকে দৌড়ে পালালাম জান বাঁচাতে ।
- ও যদি মরে যেত ?
- ব্যাংঙ্কের এ টি এম ভাঙ্গবে ,
আমি ছেডে দেব স্যার ! আমি কি করতে আছি তাহলে ?
- কিন্তু ও যদি মরে যায় ! এমনত
হতে পারে !!
একটু
ভেবে বললাম, আমার আত্মরক্ষার জন্য এবং ব্যাঙ্কের লক্ষ লক্ষ টাকা যা এ টি এম এ আছে
তার সুরক্ষার জন্য আমি ওটা করতে বাধ্য হয়েছি স্যার । যদি এই কারনে আমাকে দোষি সাব্যস্ত করা হয় তবে
আমার কিছু বলার নেই ।
পুলিস
অফিসার সমস্ত বয়ান নথিভুক্ত করেন ।
আমি
সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরে এলাম। ব্যাঙ্ক , আমার সাহসিকতাতে খুশি হয়ে আমাকে মেন ব্রেঞ্চের সিকিউরিটি গার্ড করে । মাইনে বেডে 9০০০ টাকা হয়
। বৌ বললো গুলি খাওয়ার পর মাইনে বাডলো । সবকটা ছেলে ধরাপড়েছে ।
আমি
বলি, “সততা নিয়ে কাজ করলে ভগবান সহায় হন । ”
আমাদের সংসার এখন স্বচ্ছল ।