গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ১৩ আগস্ট, ২০১৩

ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী.

ওরাও বাঁচতে চায়


আমাবস্যার রাত । চারিদিকে অন্ধকার । সামনে একটা কালো রঙের স্করপিও খ্যাঁচ্ করে ব্রেক কসলো ।  গাড়ি থেকে চারজন নামলো । পরনে জিন্স আর কালো টি শার্ট চোখে কালো চশমা । হাতে গ্লাভস্ আর পিস্তল মনে হচ্ছে । মুখটা ঢাকা সাদা মাস্কে। মাথায় সাদা ফেল্ট্ ক্যাপ্চারজন চার দিকে গেলো । এ টি এম্ কাউন্টারের ভেতর আমি একা বসে। রাতের ডিউটি । একটু চোখটা ধরে এসেছিল ঘুমের আমেজে । সামনের দৃশ্য দেখে ঘুমের বারোটা বেজে গেল কিছু একটা অঘটন ঘটবে বলে মনে হচ্ছিল । তন্দ্রাচ্ছন্ন  চোখটা খুলতেই,.. “এই শালা ঘুমচ্ছিস কি ওঠ শালা রাত জাগা প্যাঁচা ঘুমচ্ছিস কিরে ?”  
কথাটা শুনে মেজাজ টা চটে গেল । নিজেকে সামলে নিলাম । আমার হাতে একটা লাঠি ছাডা আর কিছু নেই । পরনে শুধু সিকিউরিটি গার্ডের ড্রেস্ । হাতে দুমডোন একটা গত কালের আনন্দ বাজার পত্রিকা কালই খবরটা চোখে পডেছিল,“কলকাতার এ টি এম লুটেরারা গডি নিয়ে ডাকাতি করছে, সিসি টিভি ফুটেজে ধরা পডছেনা, ওরা দলে বলে আসছে সঙ্গে মারণাস্ত্র ভয় লাগলো  আবার রাগ ও হল! তোরা গরীবের পেটে লাথি মেরে চিট্ ফান্ড এর টাকা লুটলি এখন ব্যাঙ্কের এ টি এম লুটছিস!! আলু পিঁয়াজের দাম ও বাডালি । দুমুঠো যে নুন ভাত খাবো তাও তোরা শান্তিতে খেতে দিবি না। কি চাস তোরা ? আমরা গরীবরা না খেয়ে মরি আর তোরা দেশ লুটে মস্তি করবি । কথাটা মনে মনে ভাবছিলাম .......
..হঠাৎ “এই শালা আমার সামনে দাঁড়া নইলে মাথার খুলি উডিয়ে দেব! টুঁ শব্দ করবিনা”  সামনের ছেলেটা বলল ।
আমি কেন সামনে দাঁড়াবো ?
ন্যাকা জানিস না ! দাঁডা বে জান প্যারি হ্যায় তো !!একটু ইতস্তত বোধ করে পকেট হাতডে কি বার কোরতে চেষ্টা করছিল (নিশ্চই এ লাইনে নতুন মানে প্রফেসনাল নয়)   
... ঠিক সেই সময় আমি ওর মাথায় আমার ডান্ডা দিয়ে এক ঘা বসিয়ে দিলাম। দিয়ে দৌড়ে ওখান থেকে পালালাম । ওই ছেলেটা আচমকা এটা হবে আশা করেনি । ও চিৎকার করে তলায় পডে গেল। আমি প্রাণপনে ছুটলাম মোবাইলে মেসেজ্ দিতে । মেসেজ বক্স থেকে সেভ করা মেসেজ টা আমার ব্যাঙ্কের বি এম কে পাঠিয়ে দিলাম । সেন্ট হল দেখলাম...ঠিক সেই সময় গুলির শব্দ হল। হঠাৎ আমার বাঁ হাতে  কি একটা অগ্নিস্ফুলিংগ র মতন ঢুকে গেল । আমি যন্ত্রণায় পডেগেলাম। জ্ঞান ছিলোনা কারণ জ্ঞান ফিরতে দেখি আমি হস্পিটালে। কাছে আমার স্ত্রী পুত্র বসে।
ডাক্তার বাবু জিঙ্গাসা করলেন “কেমন লাগছে? যন্ত্রণা হচ্ছে ? আপনার অপারেশন হয়েছে , ভয় নেই গুলি বার করে দিয়েছি। আপনার ছেলেই আপনাকে রক্ত দিয়েছে। ব্লাড গ্রুপ এক; ও পসিটিভ্ । ওসুধ ইঞ্জেক্সন সব ব্যাঙ্কের ম্যানেজার দিয়েছেন। ভয়ের কিছু নেই। আপনি সুস্থ বোধ করলে পুলিস আসবে আপনার স্টেটমেন্ট নিতে । আপনি যা যা ঘটেছে মনে করে বলতে পারবেন তো?”মাথা নাডিয়ে বললাম , হ্যাঁ স্যার পারবো।  পুলিস অফিসার এলেন সেই সময় ।
-      কি ব্যাপার কেমন আছেন ?
-      ভালো ।
-      কে কে ছিল কেমন দেখতে একটু আন্দাজ করতে পারবেন।
-      হ্যাঁ স্যার । আমি একা কাউন্টারের ভেতর ছিলাম । এমনিতেই জায়গাটা ফাঁকা তাতে রাতে কেউ আসে পাসে থাকে না । তখন পুলিসের মোবাইল পেট্রলিং এ কাউকে কাছে দেখি নি স্যার।
-      আমি সে কথা আপনাকে জিঙ্গাসা করি নি ; কে ছিল কে না ছিল ! যা জিঙ্গাসা করছি তার উত্তর দিন। একটু গম্ভীর ভাবে বললেন।
-      আমি একা কাউন্টারের ভেতর ছিলাম একটা কালো রঙের স্করপিও ....
-      স্করপিও বলে কি করে জানলেন ? তখন ত অন্ধকার ছিল বলছেন !
-      হ্যাঁ স্যার্ , কিন্তু এ টী এম এর আলো ছিল সেই আলোতে গাডিটা দেখে বুঝতে পারি । তা ছাডা আমি গাডি চিনি সার আমি আগে গাডি চালাতাম
-      ও আচ্ছা ! নাম্বার দেখেছিলেন ?
-      না স্যার ওটা দেখতে পারিনি কারণ গাড়িটা সাইড করা ছিল একটু দূরে
-      হুঁ আর কিছু ?
ওই গাডিথেকে চারটে লোক কালো পোসাকে বেরুলো।
-      কালো বলে কি করে জানলেন?
-      আমি রাত কানা নই স্যার। একটু আলো পডেছিল ওতেই দেখেছি ওরা কি পরেছিল।
-      হুঁ তা বটে ।
-      কথা বলতে একটু কষ্ট হচ্ছে সার । ডাক্তার বললেন,“পেসেন্ট কে একটু রেস্ট দিন” ।
-      ঠিক আছে পরে আসবো ঠিক ঠিক বলবেন মাথা নাডিয়ে সম্মতি দিলাম।
বৌ কাছেই ছিল । বলল আমরা না খেয়ে থাকবো তাও আচ্ছা তোমাকে এ চাকরি আর করতে হবে না।
-      সংসার কি করে চলবে ?
-      সে আমি বুঝবো এখন ।
এখানে বলে রাখি ,আমার বৌ যমুনা একটি বাচ্চা মেয়েকে সারা দিন রাখে। ঘরের রান্না বান্না যাবতীয় কাজ ওই করে । মেয়েটির বাবা মা দুজনেই সকাল থেকে অফিসে যায়। জমুনা মেয়েটিকে ছোট থেকে বড করেছে। ওরা মাস গেলে ৫০০০ টাকা মাইনে দেয় । আমার ছেলে মন্টু কলেজের খরচ নিজেই চালায় টিউসনি করে। পার্ট টাইমে ডিটিপি করে শ্যাম বাজারে । বেচারা সাইকেলে যায় । বাস ভাডা বেডে যাওয়াতে সাইকেল ই ওর এক মাত্র ভরসা । টিউসনি থেকে হাজার দুএক পায় বাকি ডিটিপি করে কিছু পায়। আমি ৬০০০ টাকা পাই রাত দিন এক করে খাটতে হয়। এই কটা সামান্য টাকায় আমাদের কষ্টেমষ্টে চলে যায়। তবে এই দুর্দিনে আর সংসার টান্তে পারছিনা । দেশে মা বোন আছে তাদের টাকা পাঠাতে হয়। তারা না হলে না খেয়ে মরবে। মা, বি পি এল এর চাল পায়। বোন ক্ষেতখামারে কাজ করে। বিয়ে করেছিল স্বামি ছেডে দিয়েছে ।
হঠাৎ যমুনা বলে উঠলো “কি ভাবছো ? আমি ত আছি” কি করে যে কি করি বুঝে উঠতে পারছিনা । আমি কবে হাসপাতাল থেকে যাবো । পুলিসের চক্কর আমার খুব বাজে লাগে জল তেষ্টা পাচ্ছে । যমুনা একটা মিনারেল ওয়াটারের বোতল কিনেছে দেখলাম। সত্যি ও আমার অনেক খেয়াল রাখে। ছেলেটাও মন মরা হয়ে গিয়েছে । যমুনা বলল “তুমি চিন্তা করনা । আমার মালকিন বলেছেন উনি ৫০০০ টাকা আগাম দেবেন বলে । পূজোতে যে বোনাস পাই সেটা আগে থেকে দেবেন উনি”
-      তোকে আমি অনেক দুঃখ দিলাম যমুনা” বলতে বলতে চোখে জল এলো ।
-      ও মা এই সময় আমি থাকবোনা ত কে থাকবে শুনি ? তোমার বোন ? ও ত স্বামীর ঘর করতে পারলনিকো , তোমাকে কি দেখবে শুনি!
-      আমি এখানে আছি , খেটে খাচ্ছি ও কাজ করতে পারে না ? সোহাগ্ । বলি কোথা থেকে আসবে শুনি ? গা জ্বলে যায় আদিখ্যেতা দেখলে ! মরন !! 
-      আমি ঘরে ফিরে আমার আগের মালিকের ট্যাক্সি চালাবো । দেখিস ঠিক চলে যাবে ।
-      রক্ষে কর ।
ডাক্তার এসে বললেন ওনাকে রেস্ট দিন। পরের দিন সকাল বেলাতে ব্যাঙ্কের ম্যানেজার এলেন পুলিস অফিসার এলেন ।
-     আজ কেমন আছেন ?
-     ভালো ।
-     কথা বলতে কষ্ট হবেনা ?
-     না ।
-     আচ্ছা আপনি কালো রঙের স্করপিও বলছিলেন না !
-     হ্যাঁ স্যার । লোকটাকে কেমন দেখতে বলতে পারবেন ?
-     ও লোক নয় সার একটা কম বয়েসের ছেলে ।
-     কি করে জানলেন ?
-     ও আমাকে থ্রেট করছিল । যানে মেরে ফেলবে বলছিল যদি আমি ওকে এ টি এম ভাঙ্গা তে সাহায্য না করি ত
-     ও আচ্ছা । কেমন দেখতে ওকে?
-     রোগা লম্বা আর কিছু দেখা যাচ্ছিল না। নন বেঙ্গলি মনে হল সার । গলার স্বর চিনতে পারবো । সি সি টি ভি ফুটেজে সব কভার করে থাকবে সার ।
-     কি হয়েছে না হয়েছে সেটা আপনার জানার প্রয়োজন নেই । যা জিঙ্গাসা করছি তাই বলুন
-     মুখ কেন দেখেন নি?
-     মুখে মাস্ক ছিল সার ।
-     হুঁ। নন বেঙ্গলি কেন বললেন ?
-     কথা শুনে তাই মনে হল স্যার।
-     ও । আপনি গাডি চালাতেন না ?
-     হ্যাঁ সার।
-     আপনি কি করলেন ও আসাতে ?
-     ও এসেই আমাকে বাজে গালা গালি দিয়ে উঠতে বলে । আমাকে সামনে দাঁড়াতে বললো আমি মানা করাতে পকেট খোঁজে । আমি বুঝলাম মেশিন খুঁজছে । সঙ্গে সঙ্গে মাথায় লাঠি মেরে ওখান থেকে দৌড়ে পালালাম জান বাঁচাতে ।
-     ও যদি মরে যেত ?
-     ব্যাংঙ্কের এ টি এম ভাঙ্গবে , আমি ছেডে দেব স্যার ! আমি কি করতে আছি তাহলে ?
-     কিন্তু ও যদি মরে যায় ! এমনত হতে পারে !!
একটু ভেবে বললাম, আমার আত্মরক্ষার জন্য এবং ব্যাঙ্কের লক্ষ লক্ষ টাকা যা  এ টি এম এ আছে  তার সুরক্ষার জন্য আমি ওটা করতে বাধ্য হয়েছি স্যার ।   যদি এই কারনে আমাকে দোষি সাব্যস্ত করা হয় তবে আমার কিছু বলার নেই ।
পুলিস অফিসার সমস্ত বয়ান নথিভুক্ত করেন ।
আমি সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরে এলাম। ব্যাঙ্ক , আমার সাহসিকতাতে  খুশি হয়ে আমাকে মেন ব্রেঞ্চের  সিকিউরিটি গার্ড করে । মাইনে বেডে 9০০০ টাকা হয় । বৌ বললো গুলি খাওয়ার পর মাইনে বাডলো । সবকটা ছেলে ধরাপড়েছে ।    
আমি বলি, “সততা নিয়ে কাজ করলে ভগবান সহায় হন । ”  আমাদের সংসার এখন স্বচ্ছল ।