গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ১ জুন, ২০১৩

সাঈদা মিমি


পাপ হে

বেশ কিছুদিন থেকেই কুয়াশা ঝরছে বৃষ্টির মত গরুর পালগুলোকে বের করা যাচ্ছেনা। খড় বিঁচালী সব স্যাঁতসেতে। চোরা হাকী আকাশে বসা ঈশ্বরকে শাপ শাপান্ত করে যাচ্ছে হাকী আমাদের রাখাল, এককালে দূর্ধর্ষ চোর ছিলো এখনও মাঝেমাঝে আমাদের ডেমো দেখায় আর কি দূর্দান্ত শীত বাপু, বড়দের মেজাজ সারাক্ষণই ঝলসাচ্ছে তাতে আমাদের মজায় ব্যাঘাত ঘটছে না। শীতবৃষ্টির কারণে স্নানের হাত থেকে বেঁচেছি, সন্ধ্যায় পোনা ভাই হুক্কা টানার অবকাশে সাংঘাতিক সব গান শোনাচ্ছেনে । স্কুল ফাইনাল শেষ তাই বইপত্তর এর সাথে সংযোগ স্থগিত।

সাঝঁবাতি জ্বলার আগেই উানান থেকে মালসা ভরে আগুন তুলে রাখা হয়। আঁচ কমে এলে শিককাঠি দিয়ে নেড়ে খানিক কয়লা ছেড়ে দেই, গনগনে কাঠকয়লা বেশ ওম ছড়ায়। মুরুব্বীরা ওখানে হাত পা সেঁকে নেন। তখন আমাদের মত অকর্মারা আর একচোট পালিশ হয়। রোজ বিকেলে আনু গাছী শাসিঁয়ে যায় যেন গাছ থেকে কেউ রস চুরি না করি। ওসব ধমকির তোয়াক্কা না করে এই কাজটা আমরা নিষ্ঠার সাথে করে যাই। আমরা হচ্ছি আমরা, আট দশজন মামাতো খালাতো  ভাইবোন এবং রাণু রাণু আনু গাছীর মেয়ে, আমাদের দলনেত্রী মায়া খালাম্মা বলতেন, " বাঘের ঘরে ঘোঘের বাসা"ঘোঘ কি জিনিস জানিনা, চাক্ষুস করি দুর্ধর্ষ কিশোরী রাণুর মাঝে

সেবার এসএসসি দিয়ে গেলাম অথৈ গরমকাল, মধুফলের সুবাসে মৌ মৌ করছে ততদিনে নিজের মাঝে এক ভারিক্কি ভাব চলে এসেছে, তার ওপর হাই পাওয়ারের চশমা, বিশেষত্বে ভরপুর রঙিন জীবন রাণুর সাথে দ্যাখা, মাগো কি সুন্দর হয়েছে মেয়েটা কোনকালের ঘোঘ নামের উদ্ভট রাণু বদলে  গিয়ে হয়েছে হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ানের রাজহাঁস আনু গাছী বুড়ো হয়েছে, সারাক্ষণ তড়পাচ্ছে রাণুর বিয়ের জন্য এটা কি বিয়ের বয়স ? বিরক্ত লাগে গেলো বছর যেগুলোর নাক দিয়ে শিকনি ঝরতে দেখে গেছি, সেগুলো এখন ছেলেপুলের মা গ্রামের এই জিনিসটা ভালো লাগে না এখানে প্রকৃতির মত জীবন উদার নয়, বড় বেশী ঝাপসা

রাণুকে নিয়ে চষে ফেললাম বহুবার দেখা জনপদ প্রতিবার নতুন, নেশা ধরে যায় রুপসা জমিদার বাড়ীর হাতিকূয়া আর রক্তদীঘিও দেখলাম। সেই দূরকালে এই কূয়ার জলে ভেসে উঠেছিলো যকের ধন। মানুষ নামতে সাহস পায়নি তাই শেকলে বেঁধে হাতি নামিয়ে দেয়া হয়েছিলো অভিশপ্ত মোহরের ঘড়া শেকল ছিঁড়ে হাতিকে টেনে নিয়ে গেলো শীতল খাদে ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি, না চাইলেও ভয় লাগে গল্পটা যাই হোক, ধনরত্ন পাহারা দিতে যক বানানোটা কিন্তু সত্যি খুব নির্মম আর রক্ত  হিম করা গল্প

গল্পের সত্যমিথ্যা আমি বুঝতে পারিনা। খুব মুশকিল কিছু সত্য থেকে মিথ্যাকে আলাদা করা যেমন রাণু যখন বলেছিলো ওর আর মেঘা মাতবরের ছেলের প্রণয়ের কথা, আঁতকে উঠেছিলাম রাণু যখন গভীর বিশ্বাস নিয়ে বললো, শাহআলম তাকেই বিয়ে করবে, ঘাবড়ে গেলাম বিশ্বাস হতে মন চাইলো না অথচ ওদের ভালোবাসা তো সত্য!

ক্লাস এইটে পড়ার সময় আমাকে আলাদা রুম দেয়া হয়েছে প্রথম প্রথম অশরীরির ভয়ে কাবু হয়ে থাকতাম পরে তো ওই ছোট্ট কামরাটা আমার স্বর্গ হয়ে গেলো যথার্থ বড় হওয়ার কাল শুরু হয়েছে, কলেজ পড়ুয়া চশমশ। হতচ্ছাড়া ছেলেগুলো এই দিয়েছে আমার নাম এক ফাজিল বলেছিলো, দেড়ব্যাটারী বিস্ফোরনের পর টের পেলাম সেটাকে উপুর্যপরি চড় মেরে ঠোঁট ফাটিয়ে দিয়েছি প্রিন্সিপাল স্যার কিঞ্চিৎ হতভম্ব, বিমূঢ় ভাব নিয়ে বিষয়টা মীমাংসা করছেন সম্ভবত তিনি তার কলেজে এমন দাঙ্গা ফ্যসাদ করা জাহাঁবাজ মেয়ে আশা করেননি হতভাগা বলে হজম করতে পারলো না, অহতুক লজ্জায় কলেজ থেকে টিসি নিয়ে পালালো  কোন মেয়ের হাতে মার খাওয়াটা লজ্জার হবে নিশ্চই। যাওয়ার আগে আমাকে ফাঁসিয়ে দিয়ে গেলো বাবার কাছে মেয়ে প্রেম করে বদনাম কামায়নি, ছেলে পিটিয়ে মেডেল জিতেছে ভেবে বাবা মা ভয়ে কাঠ হয়ে থাকলেন নিশ্চিত করে বোধকরি তাদের ধারনা হয়ে গেলো যে আমি বিয়ের পরে স্বামী পিটিয়ে স্বর্নপদক জিতবো

মাঘের শেষ দিনগুলোও শেষ, পড়ার চাপ ক্রমশ ভূত হয়ে নৃত্য করছে। সত্যি ভয় পাচ্ছি এবার রাতে খাবার টেবিলে শুনলাম রাণু মারা গেছে কিভাবে ? মা নিরুত্তর, বাবা রাগী চেহারা নিয়ে খাচ্ছন আপা ভাইয়ারা মাথানীচু করে খেয়ে উঠে গেলো আমি কারণটা জানতে পারলাম না বড়রা আসলে সাংঘাতিক ভড়ং করে, সোজা প্রশ্নের জবাব দেয় না কিংবা এড়িয়ে যায় খেতে পারলাম না, স্বপ্নচারী রাণুর মুখটা বারবার সামনে চলে আসছিলো ঘুম আসছে না, মার কাছে শোবো আজ বড় আপার করিডোর পেরিয়ে হলরুমে এসেছি, বাবা মার কামরা এখান থেকে বেরিয়ে ডানে হঠাৎ বাবার চাপা আর ক্ষুদ্ধ কন্ঠস্বর, " কি দরকার ছিলো রাণুর কথা ওঠানোর ? ভ্রষ্টা মেয়ে একটা মাতবরের ছেলের সাথে ফষ্টিনষ্টি করে পেট বাধিয়েছিলো তো নিজের ইচ্ছায়।...................." আমার কান ঝাঁ ঝাঁ করছে কিভাবে মরে গেলো ও ? আত্মহত্যা ?

না সেটা আত্মহত্যা ছিলোনা, গ্রাম্য দাই ভ্রুনহত্যার সাথে জননীকেও খুন করেছে আরও পরে জেনেছি, ক্রমাগত রক্তক্ষরণে মারা যায় রাণু কেউ ওকে বাঁচাতে চেষ্টা করেনি, কেউ না সবাই ওর মৃত্যুর অপেক্ষায় প্রহর পার করে কাফন কিনে ফিরেছে, কিছু কান্নার ভড়ংও ছিলো সাপে কেটেছিলো ওকে, ভালোবাসার সাপ এর পরপরই আনু গাছী পাগল হয়ে যায় যে যাই বলুক, মেয়ে তার বড় আদরের ছিলো 
সেই বসন্তে জানলাম, ভালোবাসা এক আশ্চর্য পাপের নাম এবং এই পাপটা করবো ভেবে স্বর্গত্যাগে প্রস্তুত হই।