উপেক্ষিতা
ফাইলটায়
খানিক চোখ বুলিয়ে চশমার ওপর দিয়ে আমার দিকে একটা অগ্নিদৃষ্টি হেনে রমেনদা বললেন, 'অনেকদিন তো
এ ডিপার্টমেন্টে হল, আর কতো
জ্বালাবেন ভাই ?'
আমি সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলাম। রমেনদা আমাদের
সাথে প্রায়ই বন্ধুর মত ইয়ার্কি-ঠাট্টা করেন বটে, কিন্তু
তিনি এই ডিপার্টমেন্টের হেড। এমনিতে বেশ দিলখোলা মানুষ, কিন্তু আমাদের পাল্লায় পড়ে যখন কোণঠাসা হয়ে যান, তখন ট্যাঁক-ট্যাঁকে বচনামৃত ঝাড়তেও ছাড়েন না। যতই হোক
তিনি আমাদের বস, মানে ওপরওয়ালা। আমি ভয়ে ভয়ে ভাবতে লাগলাম, কি ভুল হয়ে গেল।
-'চেয়েছিলাম
রেভেনিউ ফিগার, আর আমার এখন শিরে সংক্রান্তি, এই সময়ে পুরো সেলস ফিগারটা এনে দিলেন? বলি ট্যাক্সটা বাদ দিয়ে যোগটা করলে হোতো না?'
বুঝলাম একটা মস্ত ভুল হয়ে গেছে, তাড়াতাড়িতে একদম খেয়াল করিনি। এখন এই তিন বছরের সব ক'টা বিলের ট্যাক্সের আগের ফিগারগুলো যোগ করে দেওয়া মানে ঝাড়া
তিনটি ঘন্টার মামলা। তাও মিনমিন করে বললাম, 'দিন স্যার, আমি এখনি ঠিক করে আনছি।'
-'আর থাক, অতোটা উপকার আর নাই করলেন,' রমেনদা বেশ
বিরক্তির সঙ্গে বললেন, 'ওই
ফিগারটাই দশ পারসেন্ট কমিয়ে কাজ চালিয়ে নিতে হবে।' ফাইলটা
অ্যাটাচিতে ফেলে ধড়াম করে সেটা বন্ধ করলেন রমেনদা।
-'সেটা ঠিক
অ্যাক্যুরেট হবে না, স্যার।'
-'আমি জানি
স্যার,' রমেনদা খিঁচিয়ে উঠলেন, 'কিন্তু
আমাকে চাকরিটাও তো রাখতে হবে স্যার।... এডি-র পিএ অলরেডি দু'বার ফোন করেছে, মিটিঙে
সবাই আমার জন্যে ওয়েট করছে...।' দাঁতে দাঁত
চেপে কথা ক'টা বলতে বলতে ঝড়ের বেগে রমেনদা অ্যাটাচিটা
নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
আমি গুম হয়ে নিজের জায়গায় এসে বসলাম।
রমেনদা বেশ মাই ডিয়ার লোক, তাঁর
বকুনিকে এমনিতে খুব আমল না দিলেও চলে। কিন্তু ইদানিং আমার বেশ কয়েকটা কাজে কিছু
কিছু ভুল হচ্ছে। তাইতে তিনি আমার ওপর বেশ চটে আছেন। ওদিকে বাড়ীর আবহাওয়াও খুব সুবিধের
নয়। পিসশ্বশুরের বাই-পাস সার্জারি হয়েছে, বউ সমানে
জিদ ধরেছে একবার যেতেই হবে। আমিও বুঝছি, যাওয়াটা
দরকার। কিন্তু রমেনদার এই মুডে ছুটির কথাটা কি করে বলব, কিছতেই বুঝতে পারছিলাম না।
আসলে লেখকদের অপিসে কাজ করাটাই এক ঝকমারি।
আমি অবশ্য সেরকম খুব বড়সড় লেখক নই। গোটাকয় লেখা কিছু সাময়িক পত্র-পত্রিকায়
বেরিয়েছে। তারপর গতমাসে দেশ-এও যখন একটা গল্প ছাপল, তখন মনে হল, তাহলে সত্যিই বোধহয় খুব খারাপ লিখি না। জানা-অজানা কিছু
লোক চিঠি-পত্রেও কিছু প্রশংসা করেছে। পথে-ঘাটে বেশ কয়েকজন অচেনা ব্যক্তি 'আরে, আপনার
গল্পই দেশে দেখলাম না?' বলে আলাপ
করতে এসেছে। চেনাশোনা কেউ কেউ দেখা হলে বলেছেন, 'তারপর, এখন কি লেখা-টেখা চলছে?' ইত্যাদি।
সত্যি বলতে কি খুব খারাপ লাগে না। নিজেকে
বেশ একটা গণ্যমান্য লোক বলে কল্পনা করতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু অপিসে রমেনদা আর বাড়ীতে
গিন্নি সেই ভাবনাটাকে বেশীক্ষণ টিকতে দেয় না। বউ আমার ইস্কুলে ফিজিক্স পড়ায়, সাহিত্য-টাহিত্য নিয়ে বিশেষ মাথাব্যথা নেই। আমার
লেখা-লিখিকেও তাই তিনি বিশেষ আমল দেন না। এক অর্বাচীনের পাগলামো বিধায় সম্পূর্ণ
অগ্রাহ্য করেন, অবশ্য কোন বিরোধিতাও ছিল না। এখানে বলে
রাখি, তাঁর সাথে আমার আর কোনো ব্যাপারেই কোন বিরোধিতা নেই। কখনো
মতবিরোধ হলে, আমি যেই দেখি দোষটা আমার, আমি তৎক্ষণাৎ মেনে নিই। আর কথা বাড়ে না। আর আমার দোষ না
থাকলে? যাঃ, এরকম কখনো
হয়ই না!
সে যাকগে, কিন্তু
সম্প্রতি হয়েছে আর এক বিপত্তি। একখানা ঐতিহাসিক উপন্যাস ফেঁদে ফেলেছি। রথী-মহারথী
সাহিত্যিকদের সম্বন্ধে শুনেছি, যতক্ষণ কোন
গল্প-উপন্যাস তাঁরা পুরোটা লিখছেন, সেটা
সর্বক্ষণ তাঁদের স্মরণ-মননে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। আমি চুনোপুঁটি, কিন্তু দেখছি এই উপন্যাসখানা আমাকেও বেশ ভাবাচ্ছে। সকালে
প্রাতঃকৃত্যের অবসর থেকে শুরু করে রাতে বিছানায় শুয়ে যতক্ষণ ঘুম না আসে, হাতে কাজ না থাকলেই ওই এক চিন্তা। এমনকি কাহিনীর দু'একটা চমকপ্রদ ঘটনাও আমি পেয়েছি ঘুমিয়ে, স্বপ্নে। কিন্তু মুশকিলটা হয়েছে কাহিনীর শেষটা নিয়ে। একটা
বেশ জুতসই ক্লাইম্যাক্স কিছুতেই মনে আসছে না। গল্পের শুরুতে নায়িকা এক ভীষণ
প্রতিজ্ঞা করে এমন শর্ত রেখেছে, যা নায়কের
পক্ষে সম্ভব হচ্ছেনা। আবার ভিলেন কায়দা করে সেই শর্ত পালন করে দিয়েছে, অথচ তার সাথে বিয়ে হলে নায়িকা আত্মহত্যা করবে। এই অবস্থায়
গল্পটা এমন এক জট পাকিয়ে গেছে যে তা ছাড়িয়ে কি করে যে সুখসমাপ্তি ঘটানো যায় তার
কোন কূলকিনারা করতে পারছিলাম না। এই নিয়েই বাড়ীতে এবং অপিসে নানারকম ছোট ছোট
অশান্তি ঘটছে।
আমার যখন এইরকম নাজেহাল অবস্থা, সেই সময়ে গতকাল সুদীপ্তর এক চিঠি পেলাম। সুদীপ্ত আমার
পুরনো বন্ধু। বিদেশে বড় চাকরী করে। নিজে দিব্যি কবিতা লেখে, নিজের কথায় সুর দিয়ে দারুণ গানও করতে পারে। কিন্তু আমার
লেখার গুণকীর্তন করাটা ও নিজের হবি করে নিয়েছিল। আমার অনেক নিরেস রচনাও সুদীপ্ত
এতই উচ্চাঙ্গের বলে দাবী করতো, আমি বেশ
বিব্রত বোধ করতাম। এই চিঠিতেও অনবদ্য ভাষায় সে আমার সাম্প্রতিকতম প্রকাশিত গল্পটার
ভূয়সী প্রশংসা করেছে। বারবার পড়েও আমার যেন আশ মিটছিল না। গল্পটা আমার যেমনই হোক, সুদীপ্ত ভাষার গুণে সেটাকে এক অসাধারণ সাহিত্যকীর্তিরূপে
প্রতিষ্ঠিত করে শেষে লিখেছে, '...ভাই, কি করে যে তুমি এমন লেখা লিখতে পারো জানি না। বন্ধুত্বের
খাতিরে তোমার এই লেখার ক্ষমতা আমাকে একটু দিতে পারো না?'
আমি অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। রমেনদা বা আমার
বউ না বুঝল তো কি হয়েছে? জহুরী ঠিক
চিনেছে। চিঠিটা আর কাছছাড়া করতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। পকেটে করে অপিসেও নিয়ে
গিয়েছিলাম। কাজের ফাঁকে মাঝে মাঝে দেখছিলাম। সেলস ফিগার যে রেভিনিউএর ঘাড়ে চেপেছে, তা বিনাকারণে নয়।
সেদিন বাড়ীতে এসেও মনটা শান্ত হচ্ছিল না।
লেখাটা এমন এক মোক্ষম জায়গায় আটকে গেছে, আবার সেটা
মাথাজুড়ে বসলো। কিন্তু তার মাঝে সুদীপ্তর চিঠিটাও প্রথম বর্ষার বৃষ্টির মত রিমঝিম
সুরে বাজছিল। শুধু মনে নয়, সন্ধের
মুখটায় সত্যিই মেঘ ঘনিয়ে এসে ঝমঝম করে বৃষ্টি নামলো। বারান্দায় একটা ইজিচেয়ার এতে
আনমনে বৃষ্টি দেখছিলাম। এমন সময়ে দেখি, একটা মেয়ে, বছর বারো-চোদ্দ হবে, এসে
দাঁড়িয়েছে ঘরের দরজায়। সুন্দরী নয়, কিন্তু
মুখটায় একটা মায়াবী টান আছে। শরীরে তার নবযৌবনের আগমনবার্তা, কিন্তু পুষ্টির বেশ অভাব। একহারা শরীরে ময়লার ছাপ। পরনের
পোশাকটা শতছিন্ন, ঠিক করে লজ্জা নিবারণ হচ্ছে না। ছেঁড়া
কাপড়টাই টেনেটুনে কোনরকমে আব্রু বাঁচিয়ে কান্নাভরা গলায় মেয়েটি বললে, 'তুমি কি আমায় তাড়িয়ে দেবে?'
ভালো ল্যাঠা, চিনি না
শুনি না। আমি তাকে তাড়াতে যাবো কেন? বললাম, 'কি বকছিস যা তা? আমি তোকে
রাখলামই বা কখন আর তাড়ালামই বা কোথায়?'
-'তাড়াচ্চই
তো। তুমিই তো আমাকে সুদীপ্তদার কাচে চোলে যেতে বলচ?'
কিছুই বুঝলাম না। ছলছল চোখে মেয়েটা বলে চলল, 'সুদীপ্তদার কাচে তো কবিতাদি আচে, রসিকদা আচে, সুরো আচে।
কবিতাদির এত্ত বড় বড় জড়োযার গয়না, সুরোর কত্ত
দামী দামী শাড়ী! আমি সেখানে গিয়ে কি করব বল?'
আমি ভালো করে আবার মেয়েটাকে দেখলাম। বড় ঘরে
অত লোকজনের কাছে যাবার ভয়ে যেন আরো জড়োসড়ো হয়ে গেছে। বললাম, 'ও, শাড়ী-গয়না
নেই বলে তোর লজ্জা? তা তোর
বাবা-মাকে বললেই পারিস তোকে ভালো করে সাজিয়ে দিতে?'
-'আমার
বাবা-মা কোথায়?' মেয়েটার চোখ দিয়ে এবার জল গড়িয়ে পড়ল, 'তুমিই তো আমাকে যা দেবার দেবে? কিন্তু দোহাই তোমার, আমাকে
তোমার কাচেই থাকতে দাও।'
দেখে ভারী মায়া হলো। জিজ্ঞেস করলাম, 'আমি তোকে মোটেই চলে যেতে বলি নি। কিন্তু তুই কে বল দেখি?'
মেয়েটা যেন আশ্বস্ত হলো, চোখের জল মুছে বললে, 'আমাকে
চিনতে পারলে না? আমিই যে তোমার লেখার ক্ষমতা গো।' বলেই ফিক করে একটু হেসে ঘরের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।
সুদীপ্তকে জানিয়ে দিয়েছি, সুর-তাল-ছন্দের ভান্ডার তো তোমার কাছেই আছে। আমায় মাপ করো
ভাই, এ সামান্য ক্ষমতাটুকু নাহয় আমারই থাক।
তারপরেই আর একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছে। যার
জন্যে এতদিন হাপিত্যেশ করে মাথা খুঁড়ছিলাম, আমার সেই
ঐতিহাসিক কাহিনীটার একটা চমকপ্রদ ক্লাইম্যাক্স মাথায় এসে গেছে!