গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১৬ জুন, ২০১৩

রাণা আলম

ইস্কুলের গল্প

নাম হাসমত আলি ক্লাস সিক্স  বয়স মেরেকেটে বারো পৃথিবী যাবতীয় সমস্যা নিয়ে কথা বলতে পারে আমাদের কো-এড স্কুল হাসমত কিছুতেই মেয়েদের পাশে বসেনা, পারতপক্ষে কথাও বলেনা আমার এক সহ-শিক্ষক একদিন হাসমতকে পাকড়াও করে আমার অফিসে নিয়ে এলেন হাসমত নাকি কোন সহপাঠিনী পাশে বসতে চায়নি কিছুতেই একটু আধটু বকা ঝকার পর, আমি জিজ্ঞেস করলামহ্যাঁরে,তুই মেয়েদের পাশে বসিস না ক্যানো ?’ হাসমত উত্তর দিল, ‘বুলবো,আপনি মারবেন নাতো ?’ কথা দিতে হল হাসমত উত্তর দিল, ‘সার,মেয়্যাছেল্যার ভরসা নাই,আজ যদি একটুখান চাহে (তাকিয়ে) দেখি, তো কাল আমার হাত ধরবে আর পর্শু (পরশু) লেঙ্গি ম্যারা (মেরে) ফেইলা যাবে, তখুন যে আমার বুকটা ফ্যাট্টা (ফেটে) যাবে...’ আমি হাঁ করে চেয়ে রইলামএই বয়সে এই দার্শনিক বোধ ? কলেজে পড়ার সময় আমার বোধ থাকলে আজ অন্তত ইশকুল মাস্টারি করতে হতনা এদিকে আমাকে আনমনা হতে দেখে হাসমত একদৌড়ে পগারপার হাসমতের ভাই পাশের প্রাইমারী স্কুলে পড়ে তার নাম দিয়েছিমিনি-হাসমত একদিন টিফিনের ঠিক আগে, ক্লাসে এক সহশিক্ষক পড়াচ্ছেন, হাসমতকে পড়া ধরেছেন, এদিকে মহিলা-চরিত্র সম্পর্কে  ইমরান হাসমি মত জ্ঞান থাকলেও, কেতাবি  বিদ্যায় হাসমত আলি দখল ছিল বড় অল্প অবশ্য, নারী চরিত্রের রহস্যভেদ যে করে ফেলেছে, তার ভারতের রাজধানী কোথায় তা জানার দরকার কি? হাসমত পড়া না পেরে দাঁড়িয়ে আছে এমন সময়মিনি-হাসমতবাড়ি থেকে কি দরকারে দাদাকে ডাকতে এসেছে ক্লাসে শিক্ষক তখন মজা করে সেই প্রশ্নটাইমিনি-হাসমতকে করেছেন, সাধারণ জ্ঞানের প্রশ্ন,হাসমতের ক্লাস ফোরে পড়ুয়া ভাই, ঘটনাচক্রে উত্তরটা দিয়ে ফেলেছে এরপর যা হয়, ক্লাসের শিক্ষক ভাই কে দৃষ্টান্ত-স্বরূপ দেখিয়ে হাসমত কে বকেছেন এরপরেই টিফিনের ঘন্টা পড়লো আমি তখন স্কুল-কমিটি এক মেম্বারের সাথে মাঠে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম এক ছাত্র এসে খবর দিল যে মাঠের মধ্যেই হাসমত ওর ভাইকে পেটাচ্ছে আমি ছুটে গেলাম দেখি হাসমত ওর ভাইকে কান ধরে পিছনে চপেটাঘাত করে যাচ্ছে আর চেল্লাচ্ছে  ‘শালার ব্যাটা শালা, তুই ইশকুলে আলি ক্যানে ? আর আলি তো উত্তর দিলি ক্যানে ? আমার পেসটিজ টা কোথায় গেলো বে ?’ আগেই বলেছি, প্রাইমারী এবং আমাদের স্কুলটা একই মাঠে অবস্থিততাই,প্রাথমিকের ছাত্র-ছাত্রীরা দুটো স্কুলকে আলাদা করেনা প্রায়শই, নানা বক্তব্য নিয়ে এস্কুলে হাজির হয়
একদিন টিফিনে প্রাইমারী একটি মেয়ে জনা তিনেক ছাত্রী সমেত এলো, তাদের মধ্যে দুজন আমার স্কুলের প্রাইমারী মেয়েটিকে দেখে মনে হল, ক্লাস থ্রি বা ফোর, চেহারা বড়সড়, চোখমুখ বিস্ফারিত আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি হয়েছে রে ?’ মেয়েটি হাত-পা ছুঁড়ে উত্তেজিত স্বরে বললো, ‘আপনার ইস্কুলের ***ছুঁড়া আমাকে আই লাভিউ  বুল্যাছে আমি এবং আমার পাশে বসা সহশিক্ষক পরস্পরের দিকে তাকিয়ে নিলাম গ্রামের ব্যাপার এটাকে এখানেই থামিয়ে দেওয়া দরকার সহশিক্ষক মেয়েটিকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে ব্যাপারটা লঘু করার চেষ্টা করলেন, ‘আরে পাগলি,আই লাভিউ মানে তো ভালোবাসা তুই তো ওর ছোটো বোন,আমরা আমাদের দাদা-দিদি, ভাই-বোন কে ভালোবাসিনা ? তেমনি তোকে ছোটবোন হিসেবে ভালোবাসে, তাই কথা বলেছেশিক্ষকের কথা শেষ না হতেই মেয়েটি আরো উত্তেজিত হয়ে ডানহাতটা ঠোঁটের কাছে নিয়ে গিয়ে ফ্লাইং কিস ছোঁড়ার ভঙ্গি করে বললো, ‘আপনি বুঝতে পারছেন না সার,ওরকম ভালোবাসা নয়, এটা এরকম ভালোবাসা
এবার আসি, কিরণ-দেবরাজের কথায় সেদিন কিরণের শরীর খারাপ পেট কামড়াচ্ছে জিজ্ঞেস করে জানা গেল বাড়িতে কাঁচা দুধ খেয়ে এসেছে স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্র বন্ধ, তাই ঠিক করা হল,যে কাউকে দিয়ে সাইকেলে করে ওকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হবে দেবরাজ এসে হাজির,সাথে আর্জি, ‘সার,আমারো মুনে হচ্ছে যে প্যাট কামড়াচ্ছেধমক দিলাম, ‘ঠিক করে বল কিরণের পাশে বসছিলাম সার, তাই হাওয়া লেগি গেলছে,আমারো প্যাট কুনকুন কোরছেহাসি চেপে জিজ্ঞেস করলাম,  তা কি করলে সারবে ?’ ‘ঘর গেলেই সারিং যাবে এখানেই শেষ নয়,পরেরদিন আমি কি একটা কাজে অফিস হয়ে দুপুর নাগাদ ইস্কুলে পৌঁছেছি গিয়ে শুনলাম, দেবরাজ নাকি, পেটচেপে বেশ কয়েকবার অফিসে হানা দিয়েছে, তার সাথে বার্তা, ‘সার,মাঠ যাবো শহুরে শিক্ষকরা বক্তব্যের মর্মার্থ বুঝতে না পেরে নতুন দুষ্টুমি ভেবে তাকে ভাগিয়ে দিয়েছেন আমি যখন গেলাম, তখন দেবরাজের বেশ করুণ অবস্থা পেট কুঁকড়ে চোখমুখ করুণ করে বসে আছে আমাকে দেখে বললো, ‘আমাকে যেতি দেন, নাহলে ইখানেই হেগে দিবো আমি তো গ্রাম থেকে উঠে আসা, কাজেইমাঠে যাওয়া মানে আমি বুঝি, বললামযা,জলদি যা আমাদের স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীর আলাদা টয়লেট আছে, কিন্তু দেবরাজকে কোনদিনই তা ব্যবহার করাতে পারলাম না
সরস্বতী দাস বয়স এগারো ক্লাস সিক্স মেরেকেটে চার ফুট শ্যামলা আজ্ঞে,হারানো প্রাপ্তি বিজ্ঞাপন দিচ্ছিনা,আমার স্কুলের এক ছাত্রী বিবরণ নাম সরস্বতী হলেও,বই পত্তরের সাথে বিশেষ সদ্ভাব আছে,এমন দাবী সরস্বতী প্রবল শত্রুও করবেনা আমিও করছিনা স্কুলের পাশেই যদি বাড়ি হয়,আর আমার মত ছ্যাঁচড়া স্কুল মাস্টার হলে যা যা বিপদ হতে পারে তা সবই সরস্বতী হয়েছে মাসে দশদিন আমি বা অন্য কোন শিক্ষক ওকে বাড়ি থেকে স্কুলে ধরে আনে সরস্বতী হয়ত তখন স্কুলে যাওয়ার মত তুচ্ছ কাজ বাদ দিয়ে অমুকের গাছে ফল পাড়া বা সাইকেল চালানোর মত অত্যাবশ্যকীয় কাজে ব্যস্ত ছিল,সেসময় ভগ্ন দূতের মত স্কুলের কোন মাস্টারমশাই বা সর্দার পোড়ো হাজির হয়ে ওকে স্কুলে টেনে নিয়ে আসেকাজটা যে মোটেই ভালো হয়না,তা সরস্বতী চোখমুখ দেখেই বোঝা যায় গতকাল ক্লাসে গ্রামার থেকে কটা টাস্ক দিয়ে আমি অফিসে কাজ করছিলাম কাজের চাপ বেড়ে যাওয়াতে পিওনকে দিয়ে ক্লাসে বলে পাঠালাম খাতাগুলো যেন অফিসে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, আমি টিফিনে দেখে দেবো টিফিনে খাতাগুলো দেখছিলাম একটা নতুন খাতা,প্রায় সবপাতা অকলঙ্কিত,নামটাম নেই মাঝের একটা পাতায় বড় বড় করে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা, আমার ইস্কুলে আসতে ভালো লাগেনা হাতের লেখা আমার চেনা খাতার মালিক,থুড়ি মালকিনকেও আমি চিনি খানিক চুপ করে রইলাম সরস্বতীকে ডেকে পাঠালাম নাজোর করে পড়ানো যায়নাস্কুলটাকে যদ্দিন না আমরা ছাত্র-ছাত্রীদের ভালো লাগাতে পারবো,তদ্দিন তারা মন থেকে স্কুলে আসবেনা শিক্ষক হিসেবে ব্যর্থতার দায় আমার
নূপূর মাঝি নামটা একটি ছেলের ছেলের যিনি নাম নূপূর রেখেছেন তিনি নিশ্চয় জেন্ডার বায়াসনেস বিরোধী আন্দোলনে ছিলেন ক্লাস সিক্স শান্তশিষ্ট আগেরদিন স্কুল পালিয়েছিল সেটা রিপোর্ট হয়েছে ক্লাসে দাঁড় করিয়ে ধমক দিয়ে কারণ জানতে চাইলাম এক ধমকেই নূপূরের হাল খারাপ আরেকটা ধমক দিতে যাবো,নূপূর ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেললো,আমি কাছে ডেকে কান্না থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম কি করতে গেছিলি ক্লাস পালিয়ে?’ নূপূর ফোঁপাতে ফোঁপাতে উত্তর দিল, ‘মাছ ধরতে গেছিলাম আমি বললাম, ‘বেশ করেছিলি, মাছ ধরতে আবার পালাস, কিন্তু আমাকে নিয়ে যাবি, নইলে পেটাবো
চুমকি খাতুন,ক্লাস সেভেন একটু বড়সড় চেহারা, বয়স তেরো দেখতে সুন্দর খুব হাসি-খুশি মোটামুটি আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠিত বাড়ি কন্যাখবর পেলাম,চুমকি বিয়ে হবেওর গার্জেন কল করলাম দাদা এলো তাকে খুব করে বোঝালাম চোখমুখ দেখে মনে হলনা বুঝেছে এবার বাবাকে ডাকলাম অনুরোধ করলাম যে চুমকি কে অন্তত ক্লাস এইটটা পাশ করতে দিন অপরিণত বয়সে বিয়ে দেওয়া আইনত অপরাধ এবং এতে মেয়ের ক্ষতি হয় তাও বোঝালাম পরের দিন থেকে চুমকি স্কুলে আসা বন্ধ হয়ে গেল ডেকে পাঠালাম লোকাল নেতা এসে বললেন এসব গ্রামের ব্যাপারে মাথা না গলালেই আমার মঙ্গল বাকি ছাত্রীদের কাছে জানতে পারলাম, চুমকি নিজেও পড়তে চেয়েছিল মাধ্যমিক পাশ করে বিয়ের কথা বলেছিল তাতে পাড়া-পড়শী মেয়ের ইচ্ছে চরিত্র নিয়ে কানাঘুঁষো শুরু করে দেয়,কারণ এরকম যোগ্য মোটর পার্টসের দোকানদার পাত্র তো রোজ জুটবেনা পাড়া-পড়শী বাবা-মায়ের চাপে চুমকি বিয়েতে মত দিয়েছে বিয়ের কদিন আগে চুমকি স্কুলে নিমন্ত্রণ করতে এলো, সাথে আরেকটি মেয়ে হাসিখুশি চুমকী চেহারা পাথরের মত সহশিক্ষক মজা করে জিজ্ঞেস করলেনকিরে,বিয়ের পর তো আমাদের ভুলেই যাবিচুমকি হাসলো,বড় ম্লান সে হাসি আমি বিয়েতে যাইনি স্কুলের কাছেই প্যান্ডেল বাঁধা হয়েছিল বক্সে গান বাজছিল আমি মন্দিরে বলির সময় ঢাকের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম তেরো বছরের একটি মেয়ে আজ এক ক্ষুধার্ত পুরুষের খাদ্য হতে চলেছে বছর না ঘুরতেই অপরিণত শরীরে সে অপুষ্ট সন্তানের জন্ম দেবে রান্নাঘরে আর বিছানায় অতিবাহিত হবে তার জীবন আর শিক্ষক হিসেবে অসহায়ের মত সব মেনে নিলাম আমি
তাসলিমা খাতুন ক্লাস সিক্স ফার্স্ট গার্ল খুব মেধাবী সব শিক্ষকের মতে যদি পড়াশোনা করে,তাহলে এই মেয়ে অনেকদূর যাবে তাসলিমার বড় চেহারা লম্বায় পাঁচ দুই চুমকি বিয়ের কিছুদিন পরে খবর এলো,তাসলিমা বিয়ে লেগেছে পড়িমরি করে তাসলিমা দাদাকে ডেকে পাঠালাম বোঝালাম তাসলিমারা নিম্নবিত্ত এদিকে বিয়ের সম্পর্কটা ভালো আমার কথায় তাসলিমার দাদা দোটানায় পড়লো কদিনপরে জানা গেল,তাসলিমা বাড়ি থেকে বিয়ের পক্ষেই মত দিয়েছে তাসলিমা স্কুলে আসা বন্ধ হয়ে গেল গোটা স্কুলের সবার মন খারাপ কি একটা লোকাল ছুটি ছিল তারপরের দিন রবিবার দুদিন ছুটি কাটিয়ে স্কুলে যাচ্ছি প্রাইমারী স্কুলের মাঠ পেরিয়ে আমাদের স্কুলে যেতে হয় রাস্তার ঢাল বেয়ে নামছি পিছন থেকে চিৎ কার, চেনা গলা... ‘স্যার,স্যার পিছনে তাকিয়ে দেখি,সাইকেলে স্কুল ড্রেসে তাসলিমা আর ওর ছোট ভাই (আমাদের স্কুলে ক্লাস ফাইভে পড়ে), দাঁড়ালাম খানিক অবাক হলাম কাছে আসার পর জিজ্ঞেস করলামকিরে,তুই স্কুলে?’ সূর্যকে ম্লান করে দেওয়ার মত উজ্জ্বলমুখে তাসলিমা বললো, ‘স্যার,আমি বিয়ে করবোনা, বাড়িতে বলে দিয়েছি দাদাও বাবাকে মানা করে দিয়েছেআমাদের সকলের কাছেই এখবর খুব খুশির সাইকেলে করে আমাদের পেরিয়ে তাসলিমা স্কুলের পথে চললো আশেপাশের সবাই দেখছিল যে একটি বারো-তেরো বছরের উজ্জ্বল কিশোরী সাইকেলে করে স্কুলের পথে চলছে,আমি দেখছিলাম একটা সুতো কাটা বেলাগাম ঘুড়ি,নিজের দমকে বেহিসেবী হাওয়াতে খেয়ালী উড়ান দিচ্ছে কতক্ষণ উড়বে জানিনা... আচ্ছা,এই ঘুড়িটাকে আমরা ওড়ার জন্য আকাশ দিতে পারি না ?