গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ৩০ জুন, ২০১৩

ইন্দ্রাণী সেনগুপ্ত

মাধু ও মাধবী

                     [পূর্ব প্রকাশিতের পর]
[আগের কথা – হৃদয়হীন পিতা চাননি , মাধু চেয়েছিল পরাশুনা করতে মা আগলে রাখতেন মাধুকে, চেয়েছিলেন সে পড়াশুনা করুক । বাবাই মাকে খু্ন করে, মাধু নিঃস্ব হয়, পুলিশের দুয়ারে গিয়েও ব্যর্থ হয় সে  । মাধুর পড়াশুনা বন্ধ করে বাবা তার বিয়ের ঠিক করে । এর পর...]

লাল টুকটুকে বেনারসি, চন্দনচর্চিত মুখ,গন্ধরাজের মালা, আতরের গন্ধে মোড়া মাধু বসে আছে খাটের উপর। কিছুক্ষণ আগেও একদল মহিলা ঘিরে ছিল মাধুকে। ঠিক এই মুহূর্তে সবাই ছুটে বেরিয়ে গেল বাইরে, মাধুর বর এসে গেছে দেখতে ছুটল সবাই। মাধু হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। এতগুলো ঘিরে থাকা মুখ দেখতে দেখতে মাধু ক্লান্ত হয়ে পড়ছিল। ঘুম পাচ্ছে মাধুর, চোখ বুজে আসছে। সেই কোন ভোরবেলায় সবাই মিলে উঠিয়ে দিয়েছে মাধুকে, সেই থেকে চলছে অত্যাচার। কেউ কেউ বলছে মাধুর বর নাকি বেশ বয়স্ক। তা হোক, কিছুই এসে যায় না মাধুর। এই বাড়িটা থেকে যে বেরতে পারবে সেটাই বড় কথা। মায়ের স্মৃতিমাখা বাড়িটা চতুর্দিক থেকে যেন গিলে খেতে আসে মাধুকে। তাছাড়া জীবন সম্পর্কে জন্মেছে মাধুর চূড়ান্ত অনাগ্রহ। কোন কিছুই মাধুকে আর স্পর্শ করতে পারে না তেমনভাবে। আশেপাশে যা ঘটছে সবই দেখছে মাধু। অথচ,বুঝছে না বা বোঝার চেষ্টাও করছে না। জীবনটার ওপর যেন আর কোন অধিকার নেই মাধুর। মাধুর অবচেতন যেন মেনেই নিয়েছে, এই জীবনটা নিয়ে তার আর কিছু করার নেই। মায়ের চলে যাওয়ার সাথে সাথে চলে গেছে তার জীবনটাওবেঁচে থাকা এই শরীরটা আর আয়ত্বে নেই মাধুর। এটাকে নিয়ে এখন যে যা খুশি করতে পারে। মা আগলে রেখেছিল এতদিন, আজ আর কেউ নেই। বাবার সাথে মায়ের কথা কাটাকাটির কারনও নাকি তার বিয়ে। মা চায়নি এই বিয়ে হোক, বাবা বদ্ধপরিকর। সেই থেকেই বাবার পুরুষালী রোষের ঘৃণ্য শিকার মা। অবাক হয়ে ভেবেছিল মাধু, মা তো কখনো কোন প্রতিবাদ করে নি বাবার কথার। শুধু মাধুর ব্যাপারেই মা আপোষ করতে চায়নি কখনো। কিন্তু, শেষ রক্ষা হল কি মায়ের স্বপ্নের! মাধু তো হতে পারল না দশজনের মধ্যে একজন। স্বাভাবিক বুদ্ধিতে মাধু জানে, তার পড়াশোনার ইতি এখানেই। বইখাতা সব মাধু দিয়ে দিয়েছে ছোট বোনেদের।

একা একা বসে মাধু ঢুলে পড়ছিল ঘুমে। রাজ্যের ঘুম যেন এসে জমা হয়েছে তার চোখে। হঠাৎ একদল মানুষ এসে হৈ-হৈ করে মাধুকে তুলে নিয়ে চলল পিড়িতে করে। শুভদৃষ্টি-মালাবদল-সিঁদুরদান-হাজারএকটা মন্ত্রোচ্চারণ। ‘মাধুকে ছাড়াই’ মাধুর বিয়ে হয়ে গেল সমাজের নিয়মে। সপ্তম শ্রেনির নাবালিকা কিশোরী কয়েকঘন্টার আচার-অনুষ্ঠানে পরিণত হয়ে যায় একটি অচেনা বাড়ির নববধূতে। বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়ে যায় নির্বিঘ্নে। হরিদাস হাঁফ ছেড়ে বাঁচে ঘাড় থেকে এই বোঝা নামাতে পেরে। মাধুর শ্বশুড়মশাই অতিশয় আনন্দিত এরকম এক সুলক্ষণা অল্পবয়স্কা পুত্রবধূ পেয়ে। আর মাধুর স্বামী! তার কথা না হয় পরেই বলা যাক। 

পরের দিন বিকেলবেলায় শুভলগ্ন দেখে বরকনেসহ বরযাত্রীর দল বিদায় নেয় হরিদাসের ভিটে থেকে। বরকনেকে আশীর্বাদ করে বিদায় দেয় এ বাড়ির গুরুজনেরা। মাধু চলে যায় নিঃশব্দে, মাধু চলে যায় এ পাপের সংসারে তার আরো চারটে বোনকে ফেলে রেখে। দিদির জন্য কেঁদে ভাসায় তিন বোন, ঠাকমাও কাঁদে হাউহাউ করে, শুধু মাধুর চোখে জল নেই, নেই ভাষা, নেই কথা, নেই দুঃখ, কোন চেতনাই হয়ত নেই। মাধু যেন এই ক’টাদিনে হঠাৎ করে বুঝে ফেলেছে নিরর্থক জীবনের সংজ্ঞা। 
 
বৌভাতের আচার-অনুষ্ঠান সব মিটে যেতে বেশ রাত হয়ে গেল। একদঙ্গল মেয়ে এসে বেনারসি মোড়া মাধুকে রেখে দিয়ে গেল একটা অচেনা ঘরের ফুলে সজ্জিত খাটের ওপর। মাধু বসে রইল জড়োসড়ো হয়ে। মিনিট দশেক কাটতে না কাটতেই ভেজান দরজা খুলে ঢুকল সেই মানুষটা। মানুষটাকে মাধু সামনাসামনি আজ সকালেই দেখল প্রথম। তখনো কোনরকম অনুভূতি জাগেনি মাধুর। কিন্তু, এই মুহূর্তে কেঁপে উঠল মাধুর সর্বাঙ্গ, এক অচেনা আশঙ্কায়। মানুষটা ঘরের দরজা বন্ধ করে একবার তাকাল মাধুর দিকে। মাধু স্থির বসে রয়েছে, যেন চিন্ময়ী প্রতিমা। মানুষটার নাম জেনেছে মাধু আজ সকালেই,সবাই ডাকছিল সন্দীপ নামে। সন্দীপ মাধুর থেকে বছর পনেরর বড় তো হবেই। বেশ রাশভারি মানুষটা, আর স্বল্পভাষীও।সন্দীপ ঘরের লাগোয়া বারান্দায় চলে গেল একটাও কথা না বলে। মাধু ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, মানুষটা ধূমপান করছে সেখানে। মাধু একটু নিশ্চিন্ত হল, প্রাথমিক আশঙ্কাটা কেটে গেছে আপাতত। একটু বাদে ফিরে এল সন্দীপ। দাঁড়াল মাধুর সামনে। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ – ‘তুমি এই বিয়েতে খুশি হয়েছ?’ এ কি অদ্ভুত প্রশ্ন! এর উত্তর মাধু দেবে কি করে! ও কি কোনদিনও ভেবেও দেখেছে এসব! নিরুত্তর মাধু মাথা নিচু করে রইল। সন্দীপ আবার বলল- ‘ঠিক আছে, পরে ভেবে নিয়ে উত্তর দিও। তোমাকে কয়েকটা কথা স্পষ্টভাবেই বলে রাখি। এই বিয়েতে আমার মত ছিল না একেবারেই। না করলে বাবা সম্পত্তিচ্যুত করতেন, সেই কারনেই বিয়েটা করতে হল। এটা সমাজস্বীকৃত বিয়ে, সামাজিকভাবে স্বামী–স্ত্রীর মতই থাকব আমরা। কিন্তু, মানসিকভাবে আমরা আলাদাই থেকে যাব চিরকাল। আমার জীবনে অন্য নারী বর্তমান। তার সম্পর্কে আর কিছুই আমি তোমাকে বলতে পারব না। নিজের মত থাকবে, সংসার-সন্তান-টাকাপয়সা সব পাবে। শুধু আমার ব্যাপারে কোন কথা বলবে না’। মাধু বসে রইল একইভাবে। সন্দীপ কথাগুলো বলতে পেরে বোধহয় কিছুটা নিশ্চিন্ত হল, বাইরের বারান্দায় চলে গেল আবারমাধু ঠিক বুঝে উঠতে পারল না এটা তার জন্য আনন্দের না দুঃখের খবর। তবু, কেউ যেন এসে তাকে এটুকু বুঝিয়ে দিয়ে গেল, কলকাতার এই মানুষগুলো গ্রাম থেকে তাকে নিয়ে এসেছে, কার, তারা জানে গ্রামের মেয়ে মাধু প্রতিবাদ করতে পারবে না। 
                                                                      প্রথম পর্ব সমাপ্ত