গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১৬ জুন, ২০১৩

সাঈদা মিমি

পিছু ফেরা

বনেদী রাত রাজরানীর মত ঘুমিয়ে গ্যালো কিন্তু আমি জেগে রইলাম কি অদ্ভুত কথা, এমন কথা স্বঘোষিত পাগলেরাই বলে জেগে রইলাম কেন ? জীবাত্মা পরমাত্মার কথোপকথন চলছে……………..একটা স্বপ্ন দেখব বলে, জোনাকীরা জ্বলছে লক্ষ তারাবাতির মতন, বাতাসেরা কাঁপছে মাতাল জ্যোসনার গানে কিংবা এসব কিছুই নয় চৈত্রের রাত গভীর হলে আয়েশী মানুষেরা যখন মৃদু নাক ডাকে, তখন আমি দখিনের বারান্দায় এসে রেলিং টপকে ছাদে নামি। তারপর লিচু গাছ বেয়ে নীচে। কি অলুম্বুষে দস্যিপনা! ভূতে খাবে দেখিস…………..ধুরররর, আমার চেবড় ভূত আর কে আছে? পুকুর ঘাটে এসে দাঁড়াই। তারায় ছাওয়া আকাশের সাথে মসৃন কালো জলের সঙ্গম। অপার্থিব…………..’ তখন কিছুতেই আর নিবৃত্ত করতে পারিনা নিজেকে। হাওয়ায় বসন ওড়াই, লোকলজ্জা ভুলে নিজেকে ছড়িয়ে দেই জলে; নির্জন মুগ্ধতায় জলকন্যা ও আকাশ ঈশ্বর তাঁর ক্যানভাসে আঁকেন, আমি মরনশীল চোখে ফ্রেমবন্দী করি এক চিত্রের দিকে তাকিয়ে হয়তো একটা জীবন পার করে দেয়া সম্ভব।
মনজিলা কুমারীত্ব হারিয়েছিল এগার বছর বয়সে,পুতুল খেলার যাই যাই বেলায় নগ্ন রাত্তিরে বড়বোনের হেঁসেলের পাশে, প্রাকৃতিক কর্মটি করে ফেরার পথে।তীব্র যন্ত্রনায় মূর্চ্ছে পড়া মনজিলা বুঝতেই পারলো না আসছে সকাল তার জন্য কি বার্তা বয়ে আনতে পারে! আত্মদহনের বয়স তখন তার নয়। কিন্তু দূর্জন জামাইবাবুটি? তাকে কোনদিন গ্লানিবোধ স্পর্শ করেনি লোকলজ্জা এড়াতে ওকে নাদের আলীর হাতে তুলে দিলেন বাবা মা নাদের আলীর যশ ছিল বটে যাত্রাপালার নটীদের গড়তে।দি নিউ মহামায়া অপেরা’- বলিহারী নামের কি বাহার! তারচে বাহারী তার সজ্জা আর উজ্জল আলোর নীচে ঝলমলে নৃত্য গীত শৈশবের চোখে পলক পড়েনা, আহা মরি কি অপরুপা ঐ পুতুল সাজের মেয়েগুলো। প্রতিদিন ছই তোলা নৌকায় মাইকিং হয়…….. ‘ এলো দি নিউ মহামায়ার যাত্রাপালা রিক্তের বেদন”…………..আপনাদের আনন্দ দিতে নাঁচে গানে ভরপুর….বৈজয়ন্তীমালা আর কুমার নাদের। আরও রয়েছে একঝাঁক ডানাকাটা পরী……………’মনজিলা ততদিনে বৈজয়ন্তীমালা ভেবে আকুল আমি হিন্দী চলচ্চিত্রের তুখোড় এ রমণী এই অজগাঁয়ের যাত্রাপালায় ! বোকাসোকা মেয়েটার সুগন্ধি শৈশবভাবনা…………. সেই কুমার আর পরীদের দেখব বলে আমি উতলা, স্বজনদের চোখ এড়িয়ে সমবয়সী দস্যুদল নিয়ে হানা দেই এক নিশীথে মহুয়ার সুগন্ধিস্নাত রাত,হ্যাজাক বাতির রঙ ঝলসানো রাত, একঝাঁক ডানাকাটা পরীর রাত, মনজিলা আর কুমার নাদের এর রাত
দুবছরে দুবার চশমার পাওয়ার বেড়েছে চুল ঝরে যাওয়ার গতিবিধি আন্দাজ করে ববকাট দিয়েছি আসলে ওইটা আছিলা মাত্র,  চুল কাটার ফন্দী ধুর, সায়েন্স পড়া উচিৎ হয়নি পড়তে পড়তে হাঁড়ে জং ধরে গেল আমাকে উদ্ধারে কেউ নেই, রাজকুমার লাগবে না, রাখালবালক এলেও হত কেউ এলো না এবং অনেক কায়ক্লেশে কলেজ ফাইনালে বসতেই হল।ভাইয়া রোজ মোটর বাইকে করে দিয়ে যায় আবার নিয়েও যায় কঠোর আইন পাস করে বন্ধুসঙ্গ নিষিদ্ধ…………… কোন এক বিমর্ষ দুপুরে ঝুল বারান্দায় বসে আছি, মে মাসের গরমে জারক হচ্ছি। পরীক্ষা শেষের অবসর ক্যামনে কাটাই? সেই বিকেলে মেজ মামার আগমন কুয়াশার ঋতু হয়ে এলো। অবশেষে কাপড় গুছিয়ে চলরে নবাবজাদী। উপমাটা যাই হোক, বন্দীদশা কেটে যাওয়ার আসন্ন আনন্দটাই মুখ্য পদ্মা যতবারই পাঁড়ি দেই, ততবারই রক্তে এক বানভাসি নেশা জাগে। নৌকার গলুইয়ে শুয়ে জলের সাথে প্রেম করি, মাঝেমধ্যে শুশুকেরা মসৃন পিঠ দেখিয়ে যায় দুরের জেলেনৌকা দেখে স্বপ্ন বুনি আবার কাছেপিঠে থাকা জেলেদের থেকে খলবলে মাছও কিনি এভাবে দৌলতদিয়া পেরিয়ে পাটুরিয়া পৌঁছে যাই পথ আরও রয়ে যায়………….হাঁটা পথ একসময় দুই শাখায় ভাগ হয়ে যাওয়া কৃষ্ণচূঁড়ার ঝাপসা দেহটা স্পষ্ট হয়। শৈশবের সুঘ্রান ভেসে আসে।বাবলার কুমারী ফুলগুলো নুয়ে আসে, পাম গাছগুলোর ফাঁকে আপন বাতাস। আহা, কতকাল ওরা আমার অপেক্ষায় আছে !
বন্যা এলো অসময়ে ঝলমলে সকালেও বুঝিনি এলোমেলো বাতাস বইছিলো, হেকমতের বৌ বলেছিল বটে বান আইসপোজোয়ারে বাতাসের লবনাক্ত গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। বিকেল নাগাদ বোরো ধানের ক্ষেত ডুবে গেলো উঁচু সড়কে চিন্তিত মানুষগুলো……ব্যাস্ত গ্রামে সন্ধ্যা পেরোতে না পেরোতেই রাত।আজ সেরকম কিছু ঘটছে না।পশ্চিমের জানালার শিক ধরে বসে আছি, মিহিন সুরে ফুঁসছে জলের গান।চারদিকে স্ফটিকের মত স্বচ্ছ পানি; ধবল জ্যোসনায় ছাওয়া অতিপ্রাকৃত এক রাত। লুঙ্গিতে কোঁচা মেরে বালির বস্তা ফেলছে ওরা। সবাইকে চিনতে পারছি না। হাশমতকে দেখলাম টর্চ নিয়ে দৌড়ুচ্ছে। গলা চড়িয়ে ডাকছি, হাসু……..হাসু……..জানালার ওপাশ থেকে নদী ভাঙ্গনের কথা বলে যাচ্ছে ও,বললো মহামায়া অপেরার কথাও।একটু চমকেছি, এখন যাত্রাদল ! খুব ভোরে হাশমতের সাথে ডোঙ্গা নিয়ে বেরিয়েছি গঞ্জের দোকানপাট তলিয়েছে কালীবাড়ীর অশত্থ ভিটায় আশ্রয় নিয়েছে যাত্রাদলের মানুষগুলো একটা শো পর্যন্ত হয়নি বড্ড ক্ষতি হয়ে গেলো এই সীজনে ওদের অন্যসময় হলে যাত্রাদলের তাবুতে ঢুকতে পারতাম না আজ পরিস্থিতি অন্য ওদের চিন্তিত মুখগুলোর সাথে চোখের ভাষার সামঞ্জস্য নেই, সম্ভবত ওই চোখগুলো বলতেই ভুলে গেছে ঢলে পড়া মনজিলাকে দেখি, দেখি আর সব ডানাকাটা পরীদের আলোর পিছনের নিস্প্রভ জোম্বি শরীরগুলোকে দেখি। চেয়ারম্যান বাড়ীর উঠোনে খিঁচুরি রান্না হচ্ছে হাশমত খাবার বয়ে এনেছে মহামায়া অপেরার ক্ষুধার্ত মানুষগুলোর জন্য হা ঈশ্বর, কেউ তো ওদের বাঁচিয়ে রাখুক……….. বানের জলের দিকে ঘুরে দাঁড়াই, তোমরা কেউ আমার দিকে তাকিওনা দয়া করে। অনেকদিন পর এক গাঢ় চৈত্রের রাতে কাকজল পুকুরে তারাদের মেলা। জলকুমারী হয়ে ভাসছি। একটা তারা খসে পড়লো কি? আচানক মনজিলার মুখটা ভেসে ওঠে ভারী কিছুর টানে পিছু ফেরার মত স্মৃতিশরীরে দগদগে ফোস্কা পরীদের নেকাববিহীন মুখগুলো আমি সহ্য করতে পারিনা ঈশ্বর তাঁর ক্যানভাসে আঁকেন, আমি মরনশীল চোখে ফ্রেমবন্দী করি বনেদী রাতগুলো রাজরানীর মত ঘুমায়, কখনও কোন রাত আমি ঘুমাতে পারিনা কিছু চিত্র একটা জীবনকে অসহনীয় হাহাকারে প্রতিধ্বনিত করে