গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ২২ জুন, ২০২০

শম্পা চক্রবর্তী

লঙ ড্রাইভ


 অর্চিন হঠাৎ একদিন ফেসবুকে আবিষ্কার করল রেবতীকে। তারপর যেমনটা হয় আর কি! প্রথমে রিকোয়েস্ট। তারপর কমেন্ট। তারপর নম্বর চেয়ে নেওয়া—হোয়াটস্ অ্যাপ্ ও ইনবক্সে মেসেজ— কথা বলতে চাওয়া. ইত্যাদি ইত্যাদি।
রেবতী কথা বলেনি। কেন বলবে? 
প্রায় তিন যুগ পেরিয়ে গেছে। কোন যোগাযোগ তো ছিল না।  তাছাড়া সত্যি বলতে কি ওদের মধ্যে তেমন ভালোবাসাবাসি কোনদিনই হয়নি। তবু অর্চিন উত্যক্ত করে রেবতীকে। রুমার সাথে সেই এক সাপলুডো জীবন কাটাতে কাটাতে ক্লান্ত অর্চিন পুরোনো প্রসঙ্গ তুলে রেবতীর সাথে নতুন ভাবে মিশতে চায়।

    রেবতীর মোবাইলে টুংটাং শব্দ তুলে ছুটে আসে অক্ষরের দল— 

"তোমার জীবনে আমি আগন্তুক
 আকস্মিক উৎসব কৌতুক
কিম্বা এক উপহার, জন্ম কিম্বা মৃত্যুদিনে
এনে দাও যত্নে তুমি কিনে
 মহার্ঘ্য যৌতুক,
তারপরে মুছে যাই সময়ের ভিড়ে……"

       অবাক হয়ে ভাবতে বসল কি এমন ঘটেছিল অর্চিনের সাথে ! না, তেমন কিছুই তো না। তাহলে এতবছর পর হঠাৎ…….. !! সেই বোকা বোকা প্রেমিকের মতো..!! না,এই বয়সে এসে অষ্টাদশীর প্রেম ভালোলাগছে না কল্যাণপুর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধানা শিক্ষিকা রেবতী সরকারের। 
     পরেরদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে আবার অর্চিনের মেসেজ—" কতকালের স্মৃতি খোদাই করে রেখেছি বুকের মধ্যে। সব মিথ্যে?"
     
        জবাব দেয় না রেবতী। বাড়ি ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল। ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে, টুকটাক কাজ সেরে এসে বসল বেতের চেয়ারে। গেটের উপর ঝাঁপানো মাধবীলতার গন্ধে উথালপাথাল রেবতীর ড্রয়িংরুম। আরতি চা নিয়ে এলো। কাপে চুমুক দিতে দিতে সে ডুবে গেল সীমানাহীন আলো-অন্ধকারের গল্পবলা জ্যোৎস্নারঙের নদীপথে।

           বিকেলে আঁকাবাঁকা পথ ভেঙে ধীর গতিতে গাড়ি চলছিল। দুদিকে ফাঁকা ধানমাঠ পেরিয়ে বড় রাস্তায় কিছুটা যেতেই চোখে পড়ল শালবনের শরীরে বাতাসের আলিঙ্গন। অর্চিনের হাতদুটো স্টিয়ারিংয়ে। মাঝে মাঝে স্টিয়ারিং ছেড়ে ওর বাম হাত উঠে আসছে জড়সড় রেবতীর পিঠে।লাজুক লাজুক দীর্ঘশ্বাস। ফুলে উঠছে পালকের শরীর, ছড়িয়ে পড়ছে ওম। রেবতী সেদিন ভালোলাগায় মরে যাচ্ছিল।

         মেঘেজলে মেশা পাখি হয়ে উড়বার জন্য সদ্য একুশে পা রাখা রেবতীর তখন প্রয়োজন ছিল একটা স্বচ্ছ নীলআকাশ। পেয়েও গেল। অর্চিনের বুকে মেলে দিল তার রঙীন ডানা। ঝাপটে ঝাপটে খসে পড়ল হলুদ সবুজ বেগুনী আসমানী পালক। 
          অসমবয়সী ওরা দুজন গিয়েছিল ময়ূরাক্ষীর কাছে। রেবতী মুঠো মুঠো জল তুলে সাজিয়েছিল দুচোখে নেমে আসা গোধূলিবিকেল। পিছুটান ভুলে ঠিকানাবিহীন স্রোতে ভেসে গিয়েছিল অর্চিন। নদীতীর ছুঁয়ে কে যেন লিখে রেখেছিল ওদের না-বলা সম্পর্ক আর অকথিত শব্দের সংলাপ। 

          "দিদি, আমি ফুল আনতে যাচ্ছি। টাকা দিন।"— আরতির ডাকে ঘোর কাটলো রেবতীর।
বলল—" ওওওও, কিছু বললি?"
  ফুল আনব না?আটটা বাজতে চললো।
  দরকার নেই আজ।
 প্রতিদিন সন্ধ্যায় নিজের হাতে ফুলদানিতে ফুল সাজানো রেবতীর সখ।আজ আসার সময় সেবন্তীর বাড়ি থেকে ফুলেভরা কতকগুলো কামিনীর ডাল নিয়ে এসেছিল।যত্ন করে সেগুলোকে সাজালো সোকেস্ এর উপর রাখা ফুলদানিতে। পাশেই স্বামী ও দুই মেয়ের সঙ্গে রেবতীর ছবি। প্রাণখোলা হাসিতে ভরে আছে মুখ। কোথাও কোন খেদ নেই ওর জীবনে।

          গভীর রাত। তখনো অর্চিনের মোবাইলে সবুজ আলো জ্বলছে। রেবতী লিখল—" অনেক ভাবলাম তোমাকে নিয়ে। আচ্ছা, আমাদের মধ্যে কখনো ভালোবাসা হয়েছিল কি? আমার তো মনে হয় যা হয়েছিল সেটা ভালোলাগা। কমবয়সে আবেগের তোড়ে ভেসে যাওয়া ছাড়া আর কিছু নয়। তা নাহলে এত দীর্ঘ স্তব্ধতা কেন?"
    ওপার থেকে উত্তর এলো—" তুমি কি ভাবছো? স্তব্ধতায় সেতু ভেঙে যায়? চলাচল থেমে যায়?"
 —" যায়।" 
— তোমার কখনো মনে পড়েনি আমাকে?"
  সংসারের ব্যস্ততা ও ভালোবাসা আমাকে পূর্ণ করে দিয়েছিল। সেভাবে কখনো ভাবিনি তোমাকে, মানে হারানো প্রেমিকের মতো।"
  আমি কিন্তু শান্ত প্রেমিক হয়ে  মনের মধ্যে অক্ষত নদীকে জাগিয়ে রেখেছি। অবেলার বুকে পালকের প্রেম  গেঁথে রেখেছি।এখনো পাতাঝরা শালবনে তোমাকেই মনে পড়ে।"
  আমি মনে রাখিনি। ওসব কাব্যকথা রাখো। টান থাকলে নিষেধের বেড়া ভেঙে ছুটে আসতেই। সবাই তাই আসে।"
— তোমার বোঝা উচিত ছিল যে আমার তখন দায়িত্বে কর্তব্যে ভরা সাজানো সংসার। সম্ভব ছিল না। তুমি হলে পারতে ইচ্ছেমতো ছুটে আসতে?"
  আমি তো ভালোবাসিনি।তাই অসম্ভবের পাঁচিল ডিঙিয়ে ছুটে যাবার চেষ্টা করিনি।ভালোবাসলে ঠিক পৌঁছে যেতাম।"
— তাহলে এতদিন ধরে যে মূর্তি আমি গড়েছি... !!! "
  ভাঙো। ভেঙে ফেলো তোমার খোদাই করা স্মৃতি। তছনছ করে দাও ভাস্কর্যবাহার। কে বারণ করেছে?"
  তুমি।
— আমি? কবে? কখন?
— জানিনা।তবে কোন একদিন ম্যাপল পাতায় লিখে পাঠিয়েছিলে—
     "ভেবেছিলাম বসন্তে দেখা হবে কোনো একদিন,
      পাথরে পাথরে ফের জেগে উঠবে
      নির্ভুল একতারা কোনো,অফুরান ভালোবাসবার.."

— বাজে কথা। মিথ্যে কথা। এসব তোমার মনগড়া। 
  তবে তাই।

         রেবতী চুপ করে থাকে। দুজনের মোবাইলেই  সবুজ আলো জ্বলছে।খানিক আগে বৃষ্টি থেমে গেছে। দ্বাদশীর ভেজাচাঁদ চুপিচুপি নেমে আসে নদীর কিনারে। ছলাৎছল শব্দে ডিঙিতে দোল লাগে। চকোরের ডাক শোনা যায়। কি লিখবে ভেবে পায় না সে। ভালোলাগাকে অর্চিন যে এভাবে গভীর ভালোবাসার সুতোয় বাঁধবে তা রেবতীর কল্পনাতেও আসেনি। সময় এগিয়ে চলে। চোখ জুড়ে ঘুম আসে। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে লেখে— আগের মতো ছবি তোলার নেশা আছে?
— আছে।
— কি ছবি তোল ?
— হৃদয়ের।
  সে আবার তোলা যায় নাকি?
— কেন যাবে না? গতকালই তো বিষণ্ণ বৃষ্টির হৃদয়ের ছবি তুললাম। পাঠিয়ে দেব।
— দিও। (কয়েক সেকেন্ডের বিরতি) ও হ্যাঁ, শোন, তুমি আগের মতো লঙড্রাইভে যাও?
— পুরোদমে। এখনো চলছি। গাড়ি থামিয়ে তোমার সঙ্গে চ্যাটিং…….
— সে কি!! এত রাতে!! কোথায় চলেছ?
— শত শত আলোকবর্ষ দূরে যেখানে নক্ষত্রবৃত্তে তোমাকে পাব। আমাকে যেতে হবে। তেত্রিশ বছর ধরে ড্রাইভ করছি। আরো কত পথ বাকি আছে জানিনা। লঙড্রাইভ রেবতী। ল-অ-অ-ঙ্  ড্রাইভ।

রেবতীর চোখে ভেসে ওঠে স্টিয়ারিং হাতে কোন এক যুবকের ছবি।



* কবিতা ঋণ—কবি বিষ্ণু দে এবং কবি রেহান কৌশিক।