গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ২২ জুন, ২০২০

তাপসকিরণ রায়

ধারাবাহিক ভৌতিক কাহিনী--৫১

  
রাত শেষের দুর্ঘটনা 

অপূর্ব জল থেকে উঠে আসছিল। এখন সব চিৎকার-চেঁচামেচি- কান্না থেমে গেছে। অপূর্বর ধীরে ধীরে সব কিছু মনে পড়ে যাচ্ছে--সে গতকাল রাতে কালনা ঘাট থেকে রানাঘাটের বাসে বসে ছিল। সে বাস রাত প্রায় সাড়ে বারটায় রানাঘাটে পৌঁছাবার ছাবার ছাবার কথা ছিল কিন্তু পথেই এই দুর্ঘটনা। অপূর্বর মন এখনও কেমন যেন কোন স্বপ্নের ভাবঘোরে আচ্ছন্ন রয়েছে। রাতে কালনা ঘাট থেকে সময় করেই বাস ছেড়েছিল। পথে অপূর্বর খুব ঘুম পাচ্ছিল। অন্ধকার বাসে তখন প্রায় সব যাত্রী ঘুমোচ্ছিল। বাসের স্পিডে চলার শব্দ আর তার হেড লাইটের হালকা আলো ছাড়া বাইরের দৃশ্য প্রায় অন্ধকার বললেই চলে। একটা হাই তুলে নিয়ে অপূর্ব জানালার বাইরের দিকে তাকালো। রাস্তার ধারে কোথাও ঘন আবার কোথাও আবছা অন্ধকার, তার মাঝে মাঝে বড় বড় গাছপালা ও তার ঝাপটানো ডালপালার ছায়া অনেকখানি আকাশ ঘের দিয়ে রয়েছে। আবার কোথাও লোকালয়, অকস্মাৎ জেগে উঠছিল। সে সব লোকালয়ের কোন ঘর থেকে অস্পষ্ট আলোক শিখা অপূর্বর চোখে এসে ফোকাস ফেলেছিল। তার কিছু সময় পরই অপূর্বর চোখে ঘুম এঁটে এলো, আর এক সময় সে ঘুমিয়ে পড়ল। 
বেশ কিছু সময় সে ঘুমিয়ে ছিল, হঠাৎ জোরে ঘট-ঘটাং একটা শব্দে তার ঘুম ভেঙে গেল। 
--ব্রেক ফেল, ব্রেক ফেল, বলে ড্রাইভার চীৎকার দিয়ে উঠলো। বাসের যাত্রীদের ঘুম ভেঙে গেছে, ওদের মুখ থেকে ভয়ার্ত শব্দ বেরিয়ে আসতে লাগল। দু'চারজন উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে লাগলো। কন্ডাক্টার চিৎকার করে সবাইকে থামাবার চেষ্টা করলো। বাসের গতি কিন্তু কমেনি, প্রায় ষাট কিলোমিটার বেগে ছুটে চলেছে বাস। ড্রাইভার স্টিয়ারিং এদিক ওদিক ঘুরিয়ে চলেছে। তারই মধ্যে অপূর্ব উৎকন্ঠা নিয়ে মোবাইল বের করে সময় দেখল, রাত পৌনে বারোটা। নির্জন রাস্তার মাঝরাতে স্তব্ধতার মাঝে অন্ধকার চিরে একটা শব্দভেদী জন্তু যেন লাগাম ছেড়ে ছুটে চলেছে। যাত্রীরা দিশাহারা হয়ে সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। অপূর্বও দাঁড়িয়ে গেল। রাস্তার ভাঙাচোরা জায়গায় ঝাঁকুনি খেতে খেতে শব্দ করতে করতে ছুটে চলেছে বাস। ঘোঁত-ঘোঁতানি দিয়ে যেন মাঝে মাঝে ওটা নেচে উঠছে। বাসের ভিতর থেকে একজন চিৎকার দিয়ে উঠলো, স্লো করো, স্লো করো-- 
আর স্লো করো, ব্রেক নেই তো স্লো নেই, যত সময় ওর পেটে পেট্রোল থাকবে তত সময় সে এমনি গতিতে চলতেই থাকবে। এবার ড্রাইভার ভয়ার্ত চিৎকারে বলে উঠলো, আর পারতাছি না-- 
কন্ডাক্টর কাঁপা গলায় বললো, কোন জলাশয়ে নামিয়ে দাও-- 
সে তো আরও পাঁচ ছয় কিলোমিটার দূরে, ড্রাইভার ভয়ের গলায় বলে উঠল। 
হ্যাঁ, পুকুর আছে, সেটা কোথায় ? ওই তাল দীঘির কথা কচ্ছো? 
--হা চলো চলো, ওখানেই গাড়ি নামাও, কন্ডাকটার বলে। 
বাস তখন তাল খেতে খেতে  উপর নিচ হতে হতে নাচতে নাচতে পাগলের মত এগিয়ে চলেছে। যাত্রীরা কেউ চিৎকার মেরে উঠছে,  কেউ আবার কেঁদে উঠছে। 
এর পরে মিনিট কিছু সময় পার হয়ে গেল। বাস এদিক-ওদিক টাল খেতে খেতে পুকুর পার ধরে নেমে যেতে লাগল। যাত্রীরা শোরগোল করছিল। ওরা মৃত্যুকে ওদের বড় কাছাকাছি দেখতে পাচ্ছে। কান্নাকাটি চিৎকার-চেঁচামেচির মধ্যে বাস তালদীঘিতে নেমে গেছে। বর্ষাকাল গেছে বেশিদিন হয়নি--পুকুর এখনও টইটুম্বুর। জলের ভিতরে বাসের স্পিড নেই, এক সময়  সেটা গোঁ গোঁ শব্দ করে থেমে গেল। বেশ জল ছিল, বাস ভাসছে। দুলছে প্রচন্ড। চিৎকার-চেঁচামেচি চলছে, মরণ চিৎকার যাকে বলে, এক মা তার ছেলেকে জাপ্টে ধরে আছে। ঠিক এমনি ভাবেই বাস খানিক ভেসেই তারপর পাল্টে গেল জলের তলে। একটু পরে সব শব্দ থেমে গেল, বাসের জানালা দিয়ে বের হবার জো নেই, কাঁচ খুললেও লোহার পাত ঘেরা জানালা দিয়ে কেউ বেরোতে পারল না।
অপূর্ব তারপর বাড়ি চলে এসে ছিল। সে সংবাদ পত্রে পড়েছে, সেই দিঘির বাস দুর্ঘটনার সংবাদ। সেখানে অনেক লোকের ভিড় জমেছিল। এসে ছিল পত্রিকার সাংবাদিকরাও। অপূর্ব রানাঘাটের ছেলে। সে নাসরা কলোনিতে থাকে। দুর্ঘটনার স্থান ওদের বাড়ি থেকে সাত কিলোমিটারের মত দূরে হবে। বাড়িতে তাকে দেখার জন্য তার অনেক বন্ধুদের ভিড় হয়েছিল। 
মনে পড়ছে তার বাসের দরজা খোলা যায়নি, দরজার দিকে কাত হয়ে পড়েছিল বাসটা। যাত্রীরা বাসের জানালার কাঁচ ধরে অনেক টানাটানির চেষ্টা করেছিল। জালনার লোহার পাত লাগানো থাকায় কেউ বের হতে পারেনি। কেবল অপূর্বকে নিয়ে সর্বসাকুল্যে চারজন লোক ড্রাইভারের দরজা দিয়ে বের হতে পেরে ছিল। অপূর্ব ইচ্ছে থাকলেও কাউকে বাঁচাতে পারেনি। ওর পাশের সিটে একটা ছোট ছেলে বসে ছিল। বাস ডুবে যাবার পরও তার দু-তিনবার চীৎকার ওর কানে এসেছিল বটে কিন্তু কিছু করার ছিল না তার। ড্রাইভারের দরজা গলিয়ে এক সাথে তিন জন লোক প্রচন্ড ঠেলাঠেলি করে বের হবার চেষ্টা করছিল। তিন জনের পেছনে ছিল ও। ওর পেছনে এক গাদা লোক একই জাগায় দাঁড়িয়ে এ ওকে জড়িয়ে বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। এদিকে ড্রাইভারের দরজা দিয়ে কেউ বেরোতে পারছিল না, এক জায়গায় দরজায় ওদের শরীর আটকে গিয়েছিল। শেষে অপূর্ব প্রাণপণ ঠেলে ওদের বের করে দিতে পেরেছিল, তখন তার নিজের দম নেই বললেই চলে। কোন মত বাসের বাইরে বেরিয়ে ভাসতে ভাসতে ও চীৎ থেকে হাত-পা নাড়াতে নাড়াতে অনেক কষ্টে দিঘির পারে উঠে আসতে পেরেছিল। তখন অন্ধকারের মধ্যে দু-চারজনের কথার আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। একটা দুঃস্বপ্নের ঘোর চলছিল অপূর্বর মনের ভেতরে। যাত্রীদের চার পাঁচ জন ছাড়া সবাই প্রায় ডুবে মরেছে। সে জানে, তা কুড়ি জন কম করে ডুবে মরেছে হবে। 
এ দুর্ঘটনার পর অপূর্বর তিন দিন ঘরে কেটে গেছে। তিন দিন পর কয়েকজন বন্ধু নিয়ে অপূর্ব সেই বাস দুর্ঘটনার খবর নিতে গেল। সে দিন দুর্ঘটনার সময় তার নিজের কাছেও ছিল একটা সুটকেস। তাতে তার নিজের  পোশাক ছাড়াও ক্লাসের দু একটা বইও ছিল। তার হদিস না পাওয়ারই কথা, তবু খোঁজ নিয়ে দেখতে ক্ষতি কি? দুর্ঘটনাস্থল দেখে নেবার একটা উৎসাহ তার মনে আসছিল বারবার। দুর্ঘটনাস্থল থেকে চার কিলোমিটার দূরে ছিল পুলিশ থানা। দুর্ঘটনাস্থলের নিকটবর্তী লোকালয় যে গ্রাম  সেটারও দূরত্ব ছিল প্রায় তিন কিলোমিটার। অপূর্ব খবরের কাগজে পড়েছে পুলিশ স্টেশনে নাকি যাত্রীদের কিছু জিনিসপত্র রাখা আছে। পুলিশি রিপোর্টে জানা গেছে ঐদিন রাতের দুর্ঘটনায় পনের জন বাস যাত্রীর মৃত্যু ঘটেছে। মৃত যাত্রীদের মধ্যে তিনজন অল্প বয়সের ছেলে মেয়ে ছিল। অপূর্বর তার পাশে বসা ছেলেটার মুখটা মনে পড়ল। আহা রে, সে ঐ বাচ্চাটাকে বাঁচাতে পারল না? 
বন্ধুদের নিয়ে অপূর্ব সেই দুর্ঘটনাস্থলের নিকটবর্তী গ্রামে গিয়ে হাজির হল। ওদের মনে হয়েছিল গ্রামবাসীরা নিশ্চয়ই প্রত্যক্ষদর্শী হবে। ওরা ভালভাবে বলতে পারবে এ ব্যাপারে। 
তখন বিকেল পড়ে আসছিল, গোধূলির আলো এসে পড়েছে ওদের উপর। গ্রামের কিছু লোক একটা দোকান ঘরের সামনে জটলা করছিল। অপূর্ব ও তার বন্ধুরা সেখানে গিয়ে বাস দুর্ঘটনার কথা জানতে চাইল। গ্রামের লোকেরা যখন অপূর্ব সেই দুর্ঘটনার বাসের যাত্রী ছিল জানতে পারল তখন সবাই বিস্মিত চোখে তার দিকেই কিছু সময় তাকিয়ে থাকলো। 
একজন বয়স্ক লোক বলল, তুমি কেমনে বাচলা ? 
অপূর্ব দুর্ঘটনার কথা সবাইকে খুলে বলল। মনোযোগ দিয়ে সবাই শোনার পর গ্রামের এক জন অপূর্বকে বলল, তুমি একবার থানায় যাইও, সেখানে তোমার ব্যাকট্যগ পাইতে পারো। 
বাস কি এখনও জলের তলায় আছে? পরেশ, অপূর্বর বন্ধু, প্রশ্ন করল। 
গ্রামের বয়স্ক একজন লোক একটু থেমে ভীত চোখ নিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে নিল, তারপর অপেক্ষাকৃত নিচু স্বরে বলে উঠলো, ওই বাস পুকুরে ডুবার পর থেকে রাত হইলে পুকুর পারে আজগুবি সব ঘটনা ঘটতাছে । বেশি রাইতে এই গ্রাম থেও আমরা শুনতে পাই, যেন বাসে ডুবা যাত্রীরা ‘বাঁচাও বাঁচাও’ কইরা চিৎকার দিয়া ওঠে, এই তো সে দিন রাইতে ওই ওরা মাছ ধরতে গেছিল পুকুরে, দুই দিন আগের ঘটনা--
এবার পরান নামের এক জন অপূর্বদের সামনে এগিয়ে এসে বলল, আমরা মাঝে মাঝে মাছ ধরতে যাই। কাইল রাইতের কথা, জাল ফেলাইয়া মাছ তো পাইলাম--তারপর কানে আইল গোঁ গোঁ শব্দ, আমরা চার জন ছিলাম। মনে হইল শব্দ মাঝ পুকুর থে আসতাছে। স্পষ্ট শুনলাম বাসের আওয়াজের মত শব্দ। তারপর জলের ভিতর থে কেমন যেন থপথপানির মত আওয়াজ আইতে শুরু করলো। হঠাৎ চাপা চীৎকারের মত আওয়াজ কানে আইতে লাগল,  বাঁচাও, বাঁচাও, অস্পষ্ট আওয়াজ। 
প্রাণের মুখের গল্প শুনে উপস্থিত সবাই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। গ্রামের গদাধর এবার সামনে এসে বলল, তহন আমিও ছিলাম সেখানে--এই সব শুইনা সঙ্গে সঙ্গে আমরা ঘরের দিকে ছুটতে লাগলাম কিন্তু আমাগ পিছনে পিছনে যেন অদ্ভুত একটা আওয়াজ ধাওয়া কইরা আইতে ছিল। আমরা দৌড়াইতে দৌড়াইতে একবার পেছনে তাকাইতেই ভয়ে শিউরাইয়া উঠলাম। দেখলাম, মাঝ পুকুর থে যেন একটা বাসের ছায়া গোঁ গোঁ শব্দ কইরতে কইরতে উপরে উইঠা আইতাছে। আমরা গ্রামে পৌঁছাতে মনে হইল যেন প্রাণে বাঁচলাম। 
গ্রামের মোড়ল গোছের লোকটা এবার মুখ খুলল, কথা সত্য --বাসের যাত্রীদের মরার আগের বাঁচার আওয়াজ আমরা এই গ্রাম থেও শুনতে পাই। আমরা বুড়া, আমাগ রাইতে তাড়াতাড়ি ঘুম আসে না। তাই আমাগো মত বুড়া লুকের কানে এই সব ভূত-প্রেতের শব্দ আইসা পৌঁছায়। 
এবার গ্রামের লোকদের মধ্যে থেকে আর এক জন বৃদ্ধ লোক অপূর্বদের সামনে এসে বলে ওঠে, ঠিক কয়েছ তুমি, আমিও দুই দিন শুনছি, তবে আমি যেন বাচ্চার আওয়াজও শুনতে পাইছি। 
অপূর্ব ও তার বন্ধুরা সব গল্প শুনতে থাকে। ওদের খুব আশ্চর্য লাগে, ওরা শুনেছে অপঘাতে মরলে মানুষ ভূত হয়ে ভয় দেখাতে পারে কিন্তু প্রাণহীন বস্তু, বাস কি ভাবে অশরীরী হয়ে শব্দ করবে ? জল থেকে উঠে আসতে পারবে ? বলে রাখা ভালো, এ গ্রাম থেকে বাস রাস্তা প্রায় ছয় সাত কিলোমিটার দূরত্বে রয়েছে। হয়ত সেই রাস্তা থেকেই বাসের শব্দ গ্রামের লোকেরা শুনে থাকবে। মাঝরাতে জলে ডুবে মরা লোকদের বাঁচও, বাঁচাও আওয়াজ গ্রামের লোকেদের কানে আসলেও আসতে পারে। কিন্তু অলৌকিক বাসের আওয়াজ শোনার মত অলৌকিক কথা অমৃত বা তার বন্ধুরা এর আগে কখনও শোনেনি। 
সমাপ্ত