গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ২২ আগস্ট, ২০১৯

নীহার চক্রবর্তী

বিদ্রোহিণী


সবিতা ভেবেছিলো তিনমাসের বাচ্চা নিয়ে সাহাবাড়িতে কাজে যাবে । কতক্ষণই বা সময় । কাজ করেই বাচ্চাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসবে । 
সাহাবাড়ির কর্তা শুনে কিছু না বললেও তার স্ত্রী শুনে খুশি নয় ।
সে মুখভার করে বলল,'সে হয় ? বাচ্চা কাজ করতে দেবে বুঝি ? তুমি বরং তোমার মেয়ের কাছে বাচ্চাকে রেখে এসো ।'
তখুনি সবিতা বুঝে গেলো,এ বাড়িতে বাচ্চা আনা সম্ভব নয় ।
তাই স্মিত হেসে তাকে বলল,'তাই হবে গো,বৌদি ।'
তা সবিতা মনের ভাষা না বুঝিয়ে কাজ শুরু করলো । বারবার মনে পড়তে থাকলো ওর একরত্তি বাচ্চার মুখটা । কিন্তু বুঝলে দিলে হবে না । বাচ্চার ব্যাপারে বলাও যাবে না কিছু ।
তা এদিকে একদিন মালকিন ব্যস্তসমস্ত হয়ে এসে সবিতাকে বলল,'আমার বাচ্চাটাকে একটু ধর তো । আমি একটু পরে ওপর থেকে নামছি ।'
শুনে বেশ অবাক সবিতা ।
একটু চুপ করে থেকে বলল,'তা যান । তাড়াতাড়ি আসুন । মেলা কাজ পড়ে আছে কিন্তু । আমার মেয়ে কীভাবে সামলাবে ওর কুট্টি ভাইকে ?'
এদিকে মালকিনের ছমাসের বাচ্চাটা সবিতার কোলে কাঁদতে থাকলো । অনেক ভেবে সবিতা ওর বুকের স্নেহধারা পুরে দিলো বাচ্চাটার মুখে । তাতে শান্ত হল সে ।
কিন্তু সেই যে মালকিন বলে গেলো নামছি । তা কোথায় সে ? প্রায় আধঘণ্টা কেটে গেলো । তবু নীচে নামার নামটি নেই তার ।
 
এদিকে বাচ্চাটা সবিতার কোলে স্নেহধারা পান করে অকাতরে ঘুমোচ্ছে তখন ।
প্রায় পৌনে একঘণ্টা পরে মালকিন নীচে নামলো প্রায় হাঁফাতে হাঁফাতে । পিছনে তার কর্তা । সারা মুখে তার বেশ তৃপ্তির হাসি ।
সহসা সবিতা মালকিনকে বলে উঠলো,'সেই গেলেন আর এই এলেন,বৌদি ? আমার বাচ্চাটা কি করছে কে জানে । আমার আজ আর কাজ করা সম্ভব হবে না ।'
বলেই ও বাচ্চাটাকে তার কোলে তুলে দিলো ।
 
তারপর সেখানে আর না দাঁড়িয়ে বাড়ির গেটের দিকে পা বাড়াল সবিতা ।
পিছন থেকে মালকিন সরোষে বলে উঠলো,'এমন করলে আর কাজে নিতে পারবো না কিন্তু তোমাকে ।'
তার কথা শুনেই সবিতা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে মাজায় হাত রেখে বলল,'আমি নিজেই আসতাম না । আপ্দনার মতো লোককে বলার কি আছে ?'
 
কর্তা ততক্ষণে মাথা নিচু করে ঘরের মধ্যে সেঁধিয়ে গেছে ।
তা মালকিন শুনে কয়েক পা এগিয়ে এসে ভ্রূ-কুঁচকে বলল,'এ কথার মানে ? এত বড় মুখ তোমার ?'
এবার সবিতা উঠোনে নেমে একচোট হেসে বলে উঠলো,'আপনার লজ্জা বলে কিছু নেই,বৌদি ? এক বাচ্চা-ভরা বুকে নিজের বাচ্চাকে দিয়ে দেহের সুখ মিটাতে যাওয়া হল । তাই না? আমি বুঝি বুঝিনি বলতে চান ? বেশী কথা বলবে তো কথা ছড়িয়ে দেবো চারদিকে । অসভ্য মহিলা কোথাকারে ।'
কথা শেষ হতেই সবিতা প্রায় দ্দে-দৌড়... 
খানিক সময়ের মধ্যে পথে নেমে গেলো । ওর খুব হাসি পাচ্ছিলো তখন । কিন্তু মুখে হাসি এলো না নিজের বাচ্চার কথা ভেবে । খুব চিন্তা । খুব চিন্তা তখন ওর । পাঁচ বছরের মেয়ে কীভাবে বাচ্চাকে রেখেছে কে জানে ।
 
এদিকে মালকিন রাগে ফেটে পড়ে সবিতার উদ্দেশ্যে নানা কুকথা বলতে থাকলো । অভিশাপও দিলো বেশ ।
 
তখন ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে এসে তার কর্তা ঠোঁটে আঙুল দিয়ে প্রায় আঁতকে উঠে বলল,'চুপ.. এখনো বুঝি বাড়ি পেরোয়নি । কিংবা লুকিয়ে শুনছে কোথাও । এ নিয়ে আর কথা নয় । সমস্যা আমাদেরই হবে । সকালে কি যে ইচ্ছে হল দুজনের । ধুর..'
বাচ্চাকে তার কোলে দিয়ে মালকিন সহসা দাপাতে দাপাতে আবার ওপরে উঠে গেলো । বুঝি এলোমেলো বিছানায় সে তার সদ্য ভুল বা পাপ খুঁজতে চলল ।
ততক্ষণে সবিতা পৌঁছে গেছে বাড়িতে । ওকে দেখে শুরুতে কেঁদে ওঠে মেয়েটা ।
চোখের জল ফেলতে ফেলতে বলে,'কতক্ষণ যে খাইনি । ভাইও দুধের জন্য খুব কাঁদছিল । আর তুমি এখন এলে ?'
সহসা সবিতার দু'চোখ জলে ভরে গেলো । তিনমাসের বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বড় স্নেহে মেয়েটাকে একপাশে চেপে ধরল ।
মেয়েকে বলল,'এবার সব হবে,মা । প্রতিদিন সব হবে । আমি অন্ধকার পেরিয়ে আলোয় চলে এসেছি চিরদিনের মতো ।'
মেয়েটা মার কথা না বুঝে আবার কেঁদে উঠলো । বাচ্চাটা কাঁদল বুঝি দিদির দেখাদেখি ।