রক্ষাকবচ
রাজু বামুন পাড়ার ছেলে। পৈতে হয়েছে
বৈশাখ মাসে। উপনয়নের পর উপবীত ধারণ করতে হয়। এই উপবীতের চলতি নাম পৈতে। পৈতে কথাটি
সমাজে বহুপ্রচলিত। বাহুতে গুরুদেব বেঁধে দিয়েছেন কবচ। রাজুদের বংশের
গুরুদেব বলেছেন, সমস্ত
বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করবে এই কবচ আর পৈতে। সব কাজে সফল হবে নিশ্চিতভাবে আর
সারাজীবন রক্ষাকবচের মত আগলে রাখবে জীবন।
রাজু গরীব বামুনের ছেলে। দুবিঘে
জমি, দুটো গরু আর
গোটা দশেক ছাগল তাদের সম্পত্তি। রাজুর পৈতেটা একটু দেরী করেই হয়েছে। তার ফলে
গুরুদেবের আদেশ অনুযায়ী প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়েছে তার
ফর্দমত। তার ফলে খরচ অনেকটা বেড়ে গেছে।
এখন তার বয়স উনিশ। বাবা মরে গেছেন
অনেক আগেই। তার মা অই গুরুদেবের কথামত সংসার চালান। পুজো, উপবাসে মেতে থাকেন মা। আর গুরুদেবের ফলাহার রাজু তাকিয়ে দেখে। মা গুরুদেবের
খাওয়ার শেষে তার উচ্ছিষ্ট খান। এটাই মায়ের গুরুর প্রসাদ।
গুরুদেব মাঝে মাঝে রাতে রাজুদের বাড়িতে থাকেন। রাজু
বোঝে সবকিছু কিন্তু চুপ করে থাকে। গুরুদেব মা কে বলেন, আমার কথামত চললে তোমাদের ভাল হবে।
এই ভাল হওয়ার লোভে রাজুর মা গুরুদেবের সব কথা মেনে নেন। রাজুর মায়ের মিথ্যে
রক্ষাকবচ হলেন গুরুদেব। এক অদৃশ্য দেওয়া নেওয়ার খেলা তিনি খেলেন নিষ্ঠুর হৃদয়ে।
রাজু সকালবেলা মাঠে যায়। সে বামুন হলেও লাঙল ধ'রে চাষ করে। ছোট থেকেই করে আসছে। বেশ
গাঁট্টাগোঁট্টা চেহারা তার। সকলে বেশ সমীহ করে চলে তাকে। পড়াশুনা বেশিদূর গড়ায় নি।
বাবা মরে যাওয়ার পর থেকে সংসারের দায়ীত্ব তার
উপরেই ন্যস্ত।
সকালে গরু ছাগল নিয়ে মাঠে যায়। হাতে পাঁচন গলায় গামছা।
লুঙ্গি পরে আলের উপর বসে থাকে। গরু ছাগল পালিয়ে গেলে ডাকিয়ে নিয়ে আসে ঘাসের বনে।
পরের ফসল খেলে লোকে ছাড়বে না। এ নিয়ে অনেকবার ঝগড়া হয়েছে রাজুর সঙ্গে জমির
মালিকদের। একদিন রমেন মোড়ল লাঠি নিয়ে এসে বলল, তোর ছাগলে আমার জমির ফসল খেয়েছে। খবরদার বলছি
আমি কিন্তু ছাড়ব না। এই লাঠি মেরে মাথা ফাটিয়ে দোব। রাজু বললো, বেশ কাকা আর হবে না এই ভুল। আমি নজর রাখব। সঙ্গে সঙ্গে মোড়ল নরম সুরে
বলল, তোমরা হলে গিয়ে বামুনের ছেলে। বলতে খারাপ লাগে।
বুঝলে তোমার বাবাকে আমি দাদা বলে ডাকতাম। রাজু বলল,মায়ের
কাছে শুনেছি সব। তবে আপনার ফসলের ক্ষতি হলে তো রাগ হবেই। আমি এবার ভাল করে লক্ষ্য
রাখব। মোড়ল বললেন, বেশ বাবা বেশ। বেঁচে থাক।
রাজু ভাবে ফসলের মাঠে গরু, ছাগল চড়ানো খুব কঠিন। কখন যে কার
মাঠে নেমে যায় বোঝা মুস্কিল। সে ভাবল, কাল থেকে অই পাকা
রাস্তার ধার ঘেঁষে বারেন্দা গ্রামের কাছাকাছি জঙ্গলে যাবে গরু চড়াতে। ওখানে ফসলের
জমি নাই। নিশ্চিন্তে বসতে পারবে। মাকে বলে, জলখাবার সঙ্গে
নিয়ে যাবে।
পরের দিন রাজুর মা সকাল থেকে আলুভেজে দিল আখের গুড় দিল
আর এক জামবাটি ভরতি করে মুড়ি দিল। রাজু গামছায় বেঁধে গরু, ছাগলের দড়ি খুলে পাঁচন হাতে চলে
গেল জঙ্গলে। সেখানে গিয়ে দেখল ঘাস আছে পাতা আছে। আর ভিড় কম। পাশে ক্যানেলের পরিষ্কার
জল। সেখানে মাছ ধরছে হাজরাদের একটা মেয়ে। রাজু ভাবল, কি
সুন্দর দেখতে মেয়েটা। উবু হয়ে মাছ ধরছে। মেয়েটা রাজুকে দেখতে পায় নি। একটু পরে রাজু
ডাকল, ও মেয়ে, তোর নাম শ্যামলী
নয়? শ্যামলী বলল, হুঁ।
----- তুই রোজ এখানে আসিস মাছ ধরতে?
--- হুঁ
--- আমাকে চিনিস?
---- হুঁ
আয় এখানে আয়। দুজনে মুড়ি খাই। তোর মাছ নেব না। আয়।
শ্যামলী হাত, পা ভাল করে ধুয়ে চলে এল রাজুর কাছে। রাজু
গামছায় মুড়ি ঢেলে দিল। দুজনে গল্প করতে করতে খেল। তারপর দুপুর হলে দুজনে চলে এল
নিজের বাড়ি।
রাজু গোয়ালে গরু বেঁধে, হাত পা ধুয়ে স্নান সেরে নিল। তারপর দরজার কাছে
এসে দেখল দরজা বন্ধ। দরজায় একটা ফুটো আছে। চোখ লাগিয়ে দেখল, গুরুদেব মা কে নিজের উলঙ্গ দেহ দিয়ে ঢেকে ফেলেছে। মাকে দেখা যাচ্ছে না।
তাহলে কি মাকে বশ করেছে কবচ পরিয়ে? আমাকেও দিয়েছে কবচ। রাজুর রাগ
হল। কিন্তু কোন আওয়াজ না করে চলে গেল গোয়ালে।
প্রায় কুড়ি মিনিট পরে রাজুর মা রাজুকে দেখতে গোয়ালে
এল। রাজুর মা বলল, আমি তোকে না দেখে একটু শুয়েছিলাম। আজকে তোর দেরী হল কেন? রাজু বলল, মা আমার খিদে পেয়েছে। খেতে দাও। আমি এখানে বসে খাব।
তারপর বর্ষা এল। নদী, পুকুর, খাল, বিল সব কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেল। শুধু পূর্ণ হল না রাজুর মন।
গুরুদেবের প্রতি ঘৃণায় তার মন খারাপ ছিল। কিন্তু এখনও সেই ঘটনা ঘটে চলেছে। রাজু
জানে, মানুষের জীবনে কিছু ঘটনা মনের কোণে থেকে যায়। তার প্রতিকার
হয় না কোনোদিন।
রাজু এবার চাষ করেছিল সময়ে। কিন্তু বন্যায় ধানের চারা
ডুবে থাকল দশদিন। সব পচে গেল। পচে গেল সমস্ত কৃষকের আশা আকাঙ্খা সবকিছু। আর কদিন
পরেই শরৎকালের দুর্গাপুজো। সবাই নতুন জামা, কাপড় কিনবে। কিন্তু এই গ্রামের লোকগুলো খালি গায়ে
গামছা কাঁধে ঘুরবে। রাজু শ্যামলীকে এইসব কথা বলে। রাজু বলে, তোকে একটা শাড়ি দোব ভেবেছিলাম, কিন্তু কি করে
দোব?
শ্যামলি বলে, দিতে হবে না গো। তুমি শুধু এমনি করে আমাকে
জড়িয়ে থেক।
রাজু আর শ্যামলী দুজনে দুজনকে ভালবাসে। তারা বিয়ে
করবে। কিন্তু বামুনের সঙ্গে হাজরা বা হাড়ি জাতের বিয়ে সমাজের সেনাপতিরা মেনে নেবে
না। ওরা ঠিক করল, পালিয়ে গিয়ে ওরা বিয়ে করবে পরে। ততদিনে রাজু ভাবে, একটু গুছিয়ে নেব নিজেকে। টাকা,
পয়সা জমিয়ে রাখব। তারপর বিয়ে,সংসার।
প্রায় দুবছর পরে রাজু আর শ্যামলী ঠিক করল দুদিন পরে
তারা শিবলুন স্টেশনে ট্রেন ধরবে। তারপর বহরমপুরে চলে যাবে। ওখানে নিশ্চয় কাজ পেয়ে
যাবে। তা না হলে কুলিগিরি করবে। ওদের ঠিক চলে যাবে।
রাজু আজ বাড়ি গিয়ে গুরুদেব আর মা কে দেখতে পেল।
গুরুদেবের দয়ায় মায়ের খাওয়া পরার অভাব নেই। মেয়ের বয়সী রাজুর মা। গুরুদেব এই মেয়ের বয়সী অসহায় বিধবার সঙ্গে
যে খারাপ দৃষ্টি দিতে পারে, এই ধারণা গ্রামের সরল মানুষের ছিল না। আর রাজুর দেখা সেদিনের ঘটনা
একমাত্র শ্যামলী বিশ্বাস করে। আর কাকে বলবে সে। এই ঘটনার সঙ্গে যে মা জড়িত। মা যদি
লজ্জায় গলায় দড়ি দিয়ে বসে তাহলে রাজু তো মাতৃহারা হবে। তাই নিজের পায়ে কোপ রাজু
মারতে চায় না। নিজের মত করে পরবর্তী জীবন সে আনন্দে কাটাতে চায়।
হঠাৎ একদিন গুরুদেব রাজুকে কাছে বসালেন। বললেন, তুই নিজেকে খুব চালাক মনে করিস নয়?
রাজুর মা বললেন, কেন কি করেছে রাজু?
গুরুদেব বললেন, তোমার ছেলে হাড়িদের মেয়ের সঙ্গে ঘোরে।মাখামাখি
করে। ওদের পাড়ার অনেকে দেখেছে। আমাকে বলেছে। রাজু বলল, হ্যাঁ,
আমি ওকে বিয়ে করতে চাই।
গুরুদেব বললেন, আমি হতে দেব না। তুই বামুনদের ছেলে। সমাজ মানবি
তো হতভাগা। রাজু বলল, আপনার মুখোশপরা সমাজ আমি মানি না।
আমি জাতপাত মানি না। এই বিয়ে হবেই। কোনো শক্তি এই বিয়ে আটকাতে পারবে না। প্রয়োজনে
প্রাণ দিয়ে দেব।
রাজুর মা চিৎকার করে বললেন, কাকে কি
বলছিস তুই? এই বিয়ে হলে আমার মরা মুখ দেখবি।
আমি গলায় দড়ি দেব।
গুরুদেব বললেন, ছি ছি রাজু। মায়ের কথা চিন্তা না করে তুই দেহের
কথা চিন্তা করছিস। ছি ছি।
রাজু মা কে বলল, মা হয়ে তুমি ছেলেকে সাজা দেবে?
রাজু ছুটতে ছুটতে নতুন পুকুরের পাড়ে গেল। রাজুর মা ও
ছেলেকে ডাকছেন, রাজু
ফিরে আয়। রাজু ফিরে আয়।
রাজু দূর থেকে দেখল শ্যামলী ছুটতে ছুটতে শিবলুন
স্টেশনে যাচ্ছে। এখন তাকে কোনো বাধা আটকাতে পারবে না।
আজ তাদের পালিয়ে বিয়ে করার দিন। রাজু অবাক চোখে দেখে, শ্যামলী খোলামাঠে হৃদয় মেলে আনন্দে
মেঘ হয়ে ভাসছে।
রাজু ভাবল, এই আনন্দ ম্লান হয়ে যেতে পারে না।সে ও হাওয়ায়
উড়তে চায়।
রাজু অসহায় । সে ভেবে পাচ্ছে না কি করবে? একদিকে শ্যামলী তার প্রাণের
বাঁশি আর একদিকে মা, রাজুর শ্রেষ্ঠ দেবী।
গুরুদেবের সমস্ত মিথ্যা কথা রাজুর মনে পড়ছে। কবচ পরলে
নিশ্চিতভাবে সকল কাজে সফল হওয়া যায়। পৈতে থাকলে সিদ্ধিলাভ হয়। কই রাজুর জীবন তাহলে
ব্যর্থতায় ভরা কেন? রাজু ভাবে, এইসবকিছু গুরুদেবের বানানো কথা। শাস্ত্র কখনও জাতিগত ভেদাভেদ করে নি।
পৃথিবীর কোন ধর্ম কোন মানুষকে ছোট করে নি।শুধুমাত্র গুরুদেবের মত স্বার্থপর লোকেরা
নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এইসব নিয়ম চালু রাখেন সমাজে।
রাজু এই মুখোশ একা খুলতে পারবে না। তবু নিজের জীবনে তো নিজের ইচ্ছেমত থাকতে পারবে। সে
মা কে বুঝিয়ে বলবে। মা নিশ্চয়ই বুঝবে।
রাজু অনেক আশা নিয়ে পৈতে খুলে ফেলল। কবচ খুলে ফেলল।
দুটো বিষফলের মত, কুসংস্কারের বোঝা ছুঁড়ে ফেলে দিল পুকুরের জলে। আর
কখনও বিষফল দুটো রাজুর ভাবনার বাধা হতে পারবে না। রাজুর মনটা হাল্কা হল।
তারপর দৃপ্ত পদক্ষেপে হাঁটা শুরু করল মানুষের মনের কুসংস্কার মুছে ফেলার সংকল্প
নিয়ে।