গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ১১ মে, ২০১৮

ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

শাড়ি 

আমি তখন সবে শাড়ি ধরেছি। বাড়িতে পুরনো ফ্রকগুলো মাঝে মাঝে পরলেও বাইরে কোথাও যেতে হলে শাড়িই পরি। এক একটা দিন বেশ আনন্দে কেটে যায়, যেদিন বাইরে কোথাও যাবার থাকে। সেদিন সকাল থেকেই মায়ের শাড়ি বাছতে শুরু করি।  আমার নিজের শাড়ি তখনও বিশেষ নেই। ঠিক এমনি সময় খবর এল, শিবুমামার বিয়ে। দারুণ আনন্দ হল, মায়ের বেনারসী পরব বিয়েতে এই ভেবে।   
শিবুমামা আমার আপন মামা নয়, আমার দিদিমায়ের মানুষ করা ছেলে। এতদিনে কলেজ পাশ করে  চাকরি পেয়েছে  দেখে দিদিমাই বললে একদিনএবার বিয়ে-থা করে থিতু হয়ে বস, শিবু। আমি আর কদিন! 

মামীরাই শিবুমামার পাত্রী যোগাড় করল। পাত্রী নাকি একসময় বড়মামীদের কোয়ার্টারের কাছাকাছিই থাকত। ওরা পাঁচ বোন, ভাই নেই। আমরাও দেখেছি তাকে। মামার কাছে বেড়াতে গেলে ওদের সঙ্গে খেলা করেছি। হবু মামীর তিন নম্বর বোন ছিল আমাদের সমবয়সী,বন্ধু। ওদেরই বড় বোনের সঙ্গে মামী শিবুমামার বিয়ে ঠিক করে এলো। হবু মামীর নামশিলু,শীলা। আমাদের বন্ধুর নাম ছিল বুলটি।
 

শিলুদিদির বাবা খুব সামান্য একটা চাকরি করতেন, মেয়েদের খুব বেশিদুর লেখাপড়া শেখাতে পারেননি, স্কুলের গন্ডিটা মেয়েরা কোনরকমে পার করেছিল। কিন্তু মেয়েরা নিজেরাই প্রত্যেকে কিছু না কিছু কাজ করে নিজেদের হাত খরচ, বাড়ির ওষুধপত্র, এটা-সেটা কিনে সাহায্য করত। কেউ সেলাইয়ের কাজ, কেউ বাচ্চাদের পড়ানোর কাজ এমনিভাবে টুকটাক কাজ করত সকলেই। বুলটি, আমাদের সেই বন্ধু কোথাও কোন কাজ না পেয়ে একজনের বাড়িতে বালতি করে জল তুলে দিত। এতে তার কোন দুঃখ ছিল না। বালতি পিছু টাকা পেত। ঐ সামান্য টাকা দিয়েই বুলটি কখনও বাড়ির ওষুধ, কোনদিন বিকেলের পাঁউরুটি এসব কিনে নিয়ে আসত। পাড়ায় একডাকে ওদের বাড়ির নাম জানত, তার কারণ ও বাড়ির মেয়েরা সকলেই ছিল অসাধারণ সুন্দরী। শিবুমামার সঙ্গে শিলুদিদির বিয়ে হবার কারণও ছিল শিলুদিদির রূপ। শিলুদিদি দেখতে খুবই সুন্দরী।  আর  মামীরা নিজেরাও সুন্দরী ছিল বলে শিলুদিদিকেই পছন্দ  করেছিল। ঠিক হল বিয়ে হবে বড়মামীর কোয়ার্টার থেকেই। এতে মেয়ের বাড়ির খরচ কিছু বাঁচবে। আমাদেরও একটু অন্য জায়গায় বিয়ে বাড়ি হলে মুখ পাল্টাবে। সেইমত আমরা বিয়ের কয়েকদিন আগেই বড়মামার কাছে এসে হাজির।

বিয়ের আগের দিন একটু বেলার দিকে বুলটি আমাদের বাড়ি এল। আমাকে জিজ্ঞেস করল, আমরা তো শিলুদির বিয়েতে কিছু দেব, সেটা কি? আমি অবাক! এভাবে কেউ জিজ্ঞেস করে নাকি? আমার জানার কথাও নয়, মা-মামীরাই জানে। আমি বোকার মত বুলটিকে নিয়ে মামীর কাছে এলাম। মামী শুনে অপ্রস্তুতে পড়েছে বোঝা গেল। কিন্তু তাও আলমারি থেকে একটা গোলাপী রঙের সিল্কের শাড়ি বার করে বুলটীকে দেখাতে গেল, অমনি বুলটি শাড়িটা একরকম টেনেই নিল মামীর হাত থেকে। বেশ দেখতে শাড়িটা! শিলুদিদি খুব ফর্সা, ফর্সা গায়ে গোলাপী রং মানাবে ভাল। বুলটী হাতে নিয়ে বলল, তার বাবার প্রায় চারমাস চাকরি নেই, কাউকে বলেনি। কয়েকদিন আগে জানা গেছে। দিদির বিয়ের কিছুই কেনা হয়নি। এক কাকা এসে দুটো ছাপা শাড়ি দিয়ে গেছে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে পরার জন্য। এই শাড়িটা পরেই তাহলে বিয়ে হবে।
মামী খুব অবাক। তাহলে এতো লোকজন, খরচ-খরচা কে করছে?
-করবে আবার কে? কিছু তো হয়নি, সব লোক দেখানো!
--সে কি! এত যে নিমন্ত্রিত.....’.মামীর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বুলটি যা জানালো তা এই---কাউকে প্রায় নেমতন্ন করাই হয়নি। পাড়ার যে দু-একজনকে বলা হয়েছে, তারা তো অবস্থা জানে, কেউ খেতে চাইবে না। মামী স্তম্ভিত! বুলটী শাড়িটা হাতে নিয়ে চলে গেল। মামী আবার কিছু একটা হাতে নিয়ে যেতে হবে বিয়ের দিন এই ভেবে একটু বিরক্ত হল। বুলটির ব্যবহারে মামী কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছে, ঠিক এমনটা যেন আশা করেনি। এখনই এইরকম, বিয়ের পর কেমন কুটুম্ব হবে কে জানে! পরের দিন বিয়ে। ঠিক ছিল, শিবুমামারা দুপুর পর্য্যন্ত মামীর বাড়িতেই বন্ধুবান্ধব নিয়ে চলে আসবে। সামান্য কয়েকজন বরযাত্রী আসবেন, সেইরকমই কথা ছিল, যাতে মেয়ের বাড়ির উপর চাপ না পড়ে। সন্ধ্যে নাগাদ শিলুদিদির বাড়িতে বিয়ে করতে যাবে এই বাড়ি থেকেই।

বিয়ের দিন সকালের দিকে দেখি ওদের বাড়িতে বেশ কয়েকজন লোকজন দাঁড়িয়ে।  মামী বলল-- বুলটির যেমন কথা! মেয়ের বিয়েতে লোকজন আসবে না, এ কখনও হয় নাকি? মেয়েটা বড্ড পাকা !!
বেলার দিকে একটা গোলমাল কানে এল। আমাদের বাড়ি থেকেও কেউ কেউ বারান্দা থেকে উঁকি দিল। দুপুরের দিকে গোলমালটা আর শোনা গেল না, কিন্তু একটা পুলিশের জিপ গাড়ি আর একটা এম্বুলেন্স দেখা গেল। শিবুমামারা তখনও এসে পৌঁছয়নি। বাড়িতে তো এসময় কাউকে থাকতেও হবে, নানারকম নিয়ম  আছে। তবু, মামী আর আমাদের বাড়ির কয়েকজন ছুটে গেল ওবাড়ি। একে প্রতিবেশী, তায় আবার নতুন  কুটুম্ব, যাওয়াই স্বাভাবিক। আমরাও ছুটলাম। যখন গেলাম তখন শিলুদিদিকে ধরাধরি করে  স্ট্রেচারে করে এম্বুলেন্সে তোলা হচ্ছে। শিলুদিদি চা করতে গিয়ে আগুনে পুড়ে গেছে। বাঁচার আশা কম। সমস্ত লোক হাঁ করে দাঁড়িয়ে। শিলুদিদির মা ঘরের ভিতর কি যেন ফিসফিস করে বলছেন আর মুখে কাপড় গুঁজছেন যাতে কেউ কান্না না শুনতে পায়। শুধু বুলটীকেই দেখলাম সেই গোলাপী শাড়ীটা তার ছোট বোনের হাত থেকে কেড়ে নিতে। ছোট বোনটা কেমন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাচ্ছিল চারিদিকে । বাবাকে কোথাও দেখতে পাইনি।  

একটা চিন্তা নিয়ে সবাই ঘরে ফিরল। প্রায় আধঘন্টা পরে শিবুমামারাও এসে হাজির। বেলার দিকে পাড়ার  কে যেন খবর দিল, শিলুদিদি মারা গেছে। ঠিক কি কারণে শিলুদিদি পুড়ে মারা গেল গেল জানি না। এক একজন এক রকম কথা বলে। বুলটিরা তো কেউ বাইরেই বেরোচ্ছে না, কথা বন্ধ। ওদের বাড়ির সঙ্গে সেই যে দেখাশোনা, কথা বন্ধ হল, আর কখনও শুরু হয়নি।
বিয়ে বাড়িতে যাতে  আতিথেয়তা করতে নাহয় সেই কারণে, নাকি শাড়ির কারণে, নাকি অন্য কোন কারণে, ঠিক কি কারণে শিলুদিদিকেই চা করতে হল জানি না। বাড়িতে তো আরো চারটে বোন ছিল, মা ছিলেন...কেন বিয়ের কনে স্টোভে চা করতে যাবে? সেটা কোনদিন যানা যায়নি।

না, শিবুমামা এই ঘটনার পর আর কোনদিন বিয়ে করেনি। কে জানে, শিলুদিদিকে হয়ত মামার খুব ভাল লেগেছিল। কার কাকে, কখন ভাললাগে, বলা যায়!