গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ১১ মে, ২০১৮

তাপসকিরণ রায়


ধারাবাহিক হ্যান্টেড কাহিনী২৫

কলকাতার বিপ্র কম্পানী অফিসের ভয়াবহতা


আমার এক বন্ধুর ছেলে বাপী কলকাতার সল্টলেকের বিপ্র কম্পানীর অফিসে কাজ করে। তার কাছেই শুনে ছিলাম গল্পটা। বাপির বিপ্র কম্পানীর অফিস বিল্ডিঙের গল্পটা ছিল এই রকম--
আমি তখন হায়দ্রাবাদ বিপ্র কম্পানীর অফিস থেকে ট্রান্সফার হয়ে কলকাতার সল্টলেকের অফিসে বদলী হয়েছি। সেখানে নতুন জয়েন করে দু-চার দিন কিছুই বুঝতে পারিনি। প্রায় এক সপ্তাহ পরের কথা। একদিন কোন কাজে অফিসের চার তলায় পৌঁছে গিয়েছিলাম। আসলে আমার তিন তলায় কোন কাজে যাবার কথা ছিল ভুলে লিফটে চার দাবিয়ে দেওয়াতেই বোধ হয় এমনটা হয়ে গিয়েছিল। চার তলায় গিয়ে আমি বেশ আশ্চর্য-চকিত হয়ে গিয়ে ছিলাম  যখন আমি দেখলাম সেখানকার কাগজ-পত্র, ফাইল, এমন কি চেয়ার টেবিল, দু একটা ল্যাপটপও নিচে মেঝের চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে ! দু-তিনজন স্টাফ হবে সেগুলি গুছিয়ে রাখছিল। আমি কৌতূহলী হয়ে ওদের জিজ্ঞেস করলাম, ব্যাপার কি, এমনটা হল কি ভাবে ?
ওরা কেন যেন নিচু স্বরে আমায় বলল, তুমি জান না ? তুমি কি এখানে নতুন জয়েন করেছো ?
আমি মাথা নাড়িয়ে বলেছিলাম, হ্যাঁ।
এখানকার ঘটনার কথা কি তুমি জান না ? ওদের এক জন আমায় প্রশ্ন করল।
--না তো ? আমি বললাম।
ওদের মধ্যে আর এক জন আমার কাছে এসে কিছুটা গলা নিচু করে বলল, এখানে ভৌতিক ব্যাপার আছে। রাতে প্রায়ই, কখনও সখনও দুপুরেও এমনি ব্যাপার ঘটে যায়। এগুলি কে বা করা করে কেউ তা জানে না। অনেক চেষ্টা করেও জানা যায়নি। তাই ঘটনা অলৌকিক বলেই ধরে নেওয়া হয়েছে।
আমি আশ্চর্য হলাম।
এক জন আমায় ভয় ভয় সুর নিয়ে বলল, তাই তো এই ফ্লোর ছেড়ে আমরা অন্য ফ্লোরে চলে যাচ্ছি। এ ফ্লোর বিপ্র অথোরিটি খালি করে দিচ্ছে।
ভূত তখন আমি মানি না। ব্যাপারটা আমার কাছে কেমন উদ্ভট বলে মনে হল। নতুন বলে এ নিয়ে সে দিন আর কিছু বললাম না।
একদিন আমার পাশের কলীগকে ব্যাপারটা বললাম। সে আশ্চর্য না হয়ে বলল, হ্যাঁ, আমি তো জানি, চার তালায় ফাইল ছোঁড়াছুঁড়ির আওয়াজ আমি দু-দিন নিজে কানে শুনেছি। জানো তো সে রাতে আমরা তিন-চারজন স্টাফ মাত্র ছিলাম। অফিস থেকে ঘরে যেতে সে দিন আমাদের একটু রাত হয়ে গিয়েছিল।
--আচ্ছা, সত্যি ? আমি সামান্য ভীত-চকিত হয়ে চুপচাপ হয়ে ছিলাম। কেন জানি না তখন পর্যন্ত আমি এ রকম ভৌতিক ঘটনা মনে মনে বিশ্বাস করে নিতে পার ছিলাম না।
কলীগ আমার দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা বোধহয় অনুমান করতে পারছিল। সে বলল, তোমার বিশ্বাস না হয় একদিন রাতে এসে পরখ করে দেখতে পারো।
এরপর আরও মাস খানেক কেটে গেলো। আমি সকাল নটায় অফিস যাই আর সন্ধের আগে ঘরে ফিরে আসি। রাতে থেকে ভৌতিক কার্যকলাপগুলি যাচাই করে নেবার অবসর পাচ্ছিলাম না। তবে ইতিমধ্যে জানতে পেরেছিলাম যে বিপ্র অফিসের বিল্ডিং তৈরির আগে নাকি সল্টলেকের এ জাগা ছিল লোকালয়ের অনেক বাইরে। অতীতের ইতিহাসে এখানে নাকি এক সময় ছিল ভয়াবহ জঙ্গল। ছিল মজা ছোট-বড় জলাশয়। আর অনেকটা জাগা নিয়ে ছিল কবরখানা। কেন জানা যায়নি এখানে এসে নাকি বেশ কিছু লোক আত্মহত্যা করেছিল। এমন মনে হত যে এখানে আত্মহত্যা করার একটা আলাদা প্রবণতার হাতছানি কাজ করত ! এও যেন এখানে এক রহস্যময় ব্যাপার ছিল বলা যায়।  এ ছাড়াও এখানে ঘটেছে ধর্ষণ, চুরি, রাহাজানি, লোকের প্রতি নানান  অত্যাচার। এখানে ছিল নেশার ও জুয়ার আড্ডা। অসামাজিক লোকের অবাধ বিচরণ ছিল এখানে।
বিপ্র কম্পানীর মূল অফিসের ইমারত তৈরি হয়েছিল এখানকার কবরখানার ওপরেই। এ সব নানা কাহিনী শুনেও আমি যেন এখানকার অলৌকিকতাকে সম্পূর্ণ ভাবে বিশ্বাস করে উঠতে পারছিলাম না। কিন্তু একদিন আমার সুযোগ এলো, ইয়ার এন্ডিঙের কাজ সারতে রাতে অনেকটা সময় তখন আমাদের কাজ করতে হচ্ছিল। দু দিন রাতে ডিউটি দেবার পরও যখন অলৌকিক কিছু আঁচ করতে পারলাম না তখন আমার ভৌতিক ব্যাপারটা সম্বন্ধে কেমন যেন সন্দেহ হতে লাগল।
সেটা তৃতীয় দিন রাতের কথা ছিল, আমি বসে একটু ঘুম-ঝিম ভাব নিচ্ছিলাম। হঠাৎ একটা মেয়েলী সুরের কান্নার আওয়াজে আমি চমকে সোজা হয়ে বসলাম। আমার সে দিনের কলীগ ছুটে আমার কাছে এসে আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলল, ওই দেখো, চার তালায় কেউ কান্না করছে। বেশ কয়েক বার কান্নার সুর ধ্বনিত হয়ে থেমে গেল। আমার আশপাশের স্টাফরা এক জাগায় জড়ো হয়ে চুপচাপ ভয় ভয় মুখে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বোঝা গেল সবাই ভীত-সন্ত্রস্ত।
এমনি আরও একদিনের ঘটনা। সে দিনও একটু রাত হয়ে গিয়ে ছিল। হঠাৎ দুজন নাইট গার্ড ছুটে আমাদের হল ঘরে প্রবেশ করল। ওদের চোখে মুখে  আতঙ্কের ছায়া দেখলাম। ওদের মধ্যে থেকে একজন চাপা চীৎকার দিয়ে উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো, স্যার, ওই দেখুন চীৎকার শোনা যাচ্ছে ! আমরা সবাই স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম, কয়েক জনের চীৎকার, শোরগোল, ফাইল, কাগজ-পত্র ফেলার শব্দ, চেয়ার টেবিল মেঝেতে ফেলে দেবার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল।
স্পষ্ট আমার কানে সব আওয়াজ, হট্টগোল আসছিল। স্তব্ধ হয়ে আমরা সবাই শুনছিলাম। এক সময় অলৌকিক উৎপাত থেমে গেলো, চারদিকে তখন পিন ড্রপ সাইলেন্স !
এরপর এক গার্ডের বিপ্র অফিসের চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে যাবার কথা জানিয়ে ছিল এখানকার অন্য এক গার্ড। সে বলে ছিল, সেই গার্ড নাকি সে দিন রাতে ভীষণ ভয় পেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তার নাম ছিল সুশীল। সে লিফট নিয়ে তিন তলায় কিছু ওয়াচ করতে গিয়েছিল। লিফ্ট নাকি তিন তলায় না থেমে একেবারে চার তলায় এসে থেমে ছিল। তারপর লিফটের দরজা যখন আপনি আপনি খুলল তখন সে তার চোখে সামনে এক ভয়াবহ দৃশ্য দেখতে পেয়েছিল। সে দেখে ছিল, তার থেকে হাত দশ দূর দিয়ে একটা মেয়ে আধ-ছায়া আধ-আলোর মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। মুহূর্ত কয়েক পরেই সে দেখতে পেলো, মেয়েটার ঈষৎ উজ্জ্বল মুখমণ্ডল, সে মুখ ছিল রক্তাক্ত ও বীভৎস।