গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ১১ মে, ২০১৮

সুবীর কুমার রায়

বৃদ্ধাশ্রম

বৃদ্ধাশ্রমটি বেশ বড় ও পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। ‘নিরালা’ নামটি সার্থক। শহরের একপ্রান্তে নিরিবিলি দোতলা বাড়িটির একদিকে পরপর মহিলাদের ঘর, কোনটাতে দু’জন, কোনটাতে তিন বা চারজনের থাকার ব্যবস্থা। একজনের জন্য থাকার ঘরের সংখ্যা নিতান্তই অল্প। অপর দিকে একই রকম ঘরগুলোয় পুরুষদের থাকার ব্যবস্থা, মাঝখানে বেশ চওড়া প্যাসেজ। বেশ বড় ডাইনিং হল্। এখানে বেশ বড় একটি টিভি ও অনেকগুলো চারজন বসার টেবিল ও চেয়ার। এখানেও সাধারণত বৃদ্ধরা একদিকে, বৃদ্ধারা অপর দিকে বসে টিভি দেখেন, আহার করেন।

এই আশ্রমেরই একতলার কোনার ঘরটিতে অনিতা মল্লিক একাই থাকেন। অবসরপ্রাপ্তা পঁচাত্তর বছর বয়স্কা অবিবাহিতা এই স্কুল শিক্ষিকাটি আজ প্রায় পাঁচ বছর এই আশ্রমের এই ঘরটিতেই বসবাস করছেন। আগে তিনি এই শহরেই নিজের একটি ছোট ফ্ল্যাটে বসবাস করতেন। এখন তিনি অসুস্থ হলেও, কোনদিনই তাঁকে খুব একটা মিশুকে স্বভাবের বলা যায় না, বরং  শামুকের খোলে ঢুকে থাকার মতো নিজেকে তিনি গুটিয়ে রাখতেই পছন্দ করতেন। বিকেলের গুলতানিতে, সন্ধ্যায় টিভি সিরিয়াল দেখার ফাঁকে, বা রাতে খাবার টেবিলে আর সকলের অতীত দুঃখের খবর পাওয়া যেত। অন্যান্য সকলেরই প্রায় এখানে আসার কারণ ছেলে বা মেয়ের দুর্ব্যবহার, মানসিক বা শারীরিক অত্যাচার। অনিতা দেবী অবিবাহিতা, অবসরপ্রাপ্তা স্কুল শিক্ষিকা, নিজের ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিয়ে এখানে এসে থাকেন ছাড়া, তাঁর অতীত সকলের কাছেই প্রায় অজানা ছিল। ইদানিং তো আবার অসুস্থতার জন্য মাঝেমাঝেই তাঁর খাবার, ঘরেই দিয়ে আসা হয়।

মাস খানেক আগে এক বৃদ্ধ আবাসিকের মৃত্যু হওয়ার পরেও তাঁর ছেলে মেয়েরা না আসায়, আশ্রম কর্তৃপক্ষ নিজেরাই তাঁর সৎকারের ব্যবস্থা করেন। সেই থেকে ঐ ঘরটি ফাঁকাই পড়ে ছিল। আজ কয়েকজন যুবক রতন চৌধুরী নামে এক অশীতিপর বৃদ্ধকে সঙ্গে করে নিয়ে এসে ঐ ঘরটিতে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়ে যান। জানা গেল অবিবাহিত এই বৃদ্ধটিকে শেষ বয়সে দেখাশোনা করার কেউ নেই। ভদ্রলোক কোন প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিলেন, টাকা পয়সাও যথেষ্টই আছে, তাই শেষ বয়সটা এখানে কাটানোই শ্রেয় বলে মনে করেছেন।

পরদিন দুপুরে ডাইনিং হলের খাওয়ার টেবিলে যে যার মতো গল্প করতে করতে খাবার খাচ্ছেন। কয়েকজন বৃদ্ধ আবাসিক রতন বাবুর সাথে আলাপ পর্ব সারছেন। একটু পরেই অনিতা দেবী হল্ ঘরে এসে উপস্থিত হলেন। খাবারের থালা নিয়ে টেবিলে বসার আগে উপস্থিত সকলের দিকে তাকিয়ে একটু কুশল বিনিময়ের মাঝখানেই তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে, ভাতের থালা নিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। উপস্থিত অনেকেই অবস্থার গুরুত্ব উপলব্ধি করে তাঁকে তুলবার চেষ্টা করলেন। অনিতা দেবী সম্ভবত অজ্ঞান হয়ে গেছিলেন তার উপর সকলেই বৃদ্ধ, তাই কাজটা খুব সহজ হলো না। রতন বাবু এতক্ষণ আলাপচারীতায় ব্যস্ত ছিলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় তিনিও ব্যস্ত হয়ে অনিতা দেবীকে তুলবার চেষ্টা করতে এসেও চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর নীচু হয়ে মাটিতে বসে অনিতা দেবীর মাথাটা কোলে তুলে নিয়ে মুখে চোখে বেশ কিছুক্ষণ জলের ঝাপটা দিলেন, মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর জ্ঞান ফিরে এলে, সকলকে আশ্রমের কর্মচারীদের ডাকার পরামর্শ দিয়ে ধীরে ধীরে নিজের ঘরে ফিরে গেলেন। 

অনিতা দেবীকে তাঁর ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। ডাক্তার এসে তাঁকে দেখে প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র লিখে দিয়ে পরামর্শ দিয়ে গেলেন যে, কোন কারণেই যেন তিনি উত্তেজিত না হন। জানা গেল তার হৃৎপিন্ডের অবস্থা মোটেই ভালো নয়, যে কোন উত্তেজনা তাঁর পক্ষে চরম ক্ষতিকারক হতে পারে।

সন্ধ্যার পরে রতন বাবু সামান্য সান্ধ্যভ্রমণ সেরে আশ্রমে ফিরে দেখেন হই হই কান্ড। শ্বাস কষ্টে অনিতা দেবীর শরীর আবার খুবই খারাপ হয়েছে, তাঁর ঘরে বেশ কয়েকজন মহিলা ও পুরুষ আবাসিক তাঁকে ঘিরে ভিড় করে আছেন। তিনি ঘরের বাইরে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে, নিঃশব্দে অনিতা দেবীর ঘরে ঢুকে তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন।

অনিতা দেবী অস্ফুট স্বরে বললেন “কাল তোমায় দেখেই আমার নিজেকে বড় অপরাধী বলে মনে হচ্ছিল। আমাদের সম্পর্কটা আমার বাড়িতে মেনে নিতে পারে নি বলে আমার অমতে আমাকে কাকার বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। যাওয়ার আগে তোমার মা-ও আমাকে দিয়ে তোমার দিব্যি করে শপথ করিয়ে নিয়েছিলেন, যে এ জীবনে আমি আর তোমার সাথে দেখা করবো না, মুখ পর্যন্ত দেখাবো না। কাকার বাড়ি থেকে পাশ করে স্কুলে চাকরি। পাছে তোমার সাথে দেখা হয়ে যায়, তাই   একটা দিনের জন্যেও আর বাড়িতে যাই নি। অবসর গ্রহণের পরও বছর দশেক নিজের ফ্ল্যাটেই ছিলাম। তারপর শরীর আর দিলো না, সব বেচে দিয়ে এখানে চলে এলাম। ভালোই ছিলাম, ইদানিং শরীরটা আর ভালো যাচ্ছে না, দিন বোধহয় শেষই হয়ে গেল। তোমার মঙ্গলের জন্য সেই সতেরো বছর বয়স থেকে যে সত্য আমি এতদিন পালন করে এসেছি, আজ পঁচাত্তর বছর বয়সে আমি তা ভেঙ্গে ফেললাম। কিন্তু এতে আমার দোষটা কোথায় বলো”?

“দোষ তোমার নয়, দোষ আমারও নয়, দোষ আমাদের ভাগ্যের। আমি তোমাকে কোথায় না খুঁজেছি। খুঁজতে খুঁজতে কখন বুড়ো হয়ে গেলাম। বাউন্ডুলে জীবনে মাথাগোঁজার আশ্রয় থাকলেও, খাওয়ার কোন ঠিক ছিল না। আজ আলুর দম পাঁউরুটি, কাল কোন ঝুপড়িতে মাছ ভাত। শরীর কত সহ্য করবে? বয়সও তো আশি অতিক্রম করে গেল। পাড়ার কয়েকজন যুবকের পরামর্শে এখানে চলে এলাম। এসে ভাবছিলাম ভুল করলাম কী না। তোমায় দেখেই চিনতে পারি। বুঝলাম  ভুল করি নি, দেরিতে হলেও ভগবান আমাদের আবার একই জায়গায় এনে ফেলেছেন”।

এরকম একটা মিলনান্তক বাস্তব নাটক দেখার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিলেন না। উপস্থিত সবাই রতন বাবু ও অনিতা দেবীকে বললেন, “এতগুলো বছর পরে যখন আপনারা আবার একই ছাদের নীচে এসে উপস্থিত হয়েছেন, তখন ভগবানের বোধহয় ইচ্ছা, বাকি জীবনটা আপনাদের একসাথে একই ছাদের নীচে কাটিয়ে দেবার”। রতনবাবু চুপ করে রইলেন, অনিতা দেবী শ্বাস কষ্টে কাহিল। এক বৃদ্ধা ছুটলেন তাঁর ঘর থেকে সিঁদুরের কৌটো ও শাঁখটা নিয়ে আসতে। দু’জন গেলেন ফুলের মালা কিনতে। শাঁখ ও সিঁদুর এলো, মালাও এলো, কিন্তু ঘরে তখন উলুধ্বনির পরিবর্তে ক্রন্দনরোল শোনা গেল। অনিতা দেবীর নিষ্প্রাণ দেহটি ততক্ষণে রতন বাবুর কোলে ঢলে পড়েছে। ডাক্তার ডাকা হলো, তিনি নাড়ি দেখে জানালেন ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক, সব শেষ। চার ঘন্টা পড়ে কেউ গিয়ে যেন ডেথ্ সার্টিফিকেটটা নিয়ে আসেন। রতন বাবু সজল চোখে অনিতা দেবীর সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দিলেন।

সমস্ত ঘটনা শুনে পরিচিত ডাক্তারটি বললেন,“ইচ্ছে করছে অনিতা চৌধুরী নামেই ডেথ সার্টিফিকেটটা লিখি, কিন্তু তাতে ভবিষ্যতে অসুবিধা দেখা দিতে পারে”। তিনি অনিতা মল্লিকের নামেই ডেথ্ সার্টিফিকেট লিখে দিলেন।