গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ১১ মে, ২০১৮

নীহার চক্রবর্তী

অঞ্জলি শঙ্খ ভাণ্ডার 


অঞ্জলি শঙ্খ ভাণ্ডার বেশ চলছিলো । 
দোকানের মালিক শশধর শাঁখারি তার বাবার ব্যবসা বেশ চুটিয়ে করছিলো । কিন্তু একদিন হঠাৎ সে হৃদরোগে মারা গেলো । তারপর মাস দুয়েক দোকান বন্ধ । এলাকার বৌরা শাঁখা পরতে অন্যদিকে ঘুরে গেলো ।
কিন্তু সইল না শশধরের বিধবা স্ত্রী অঞ্জলির ।
সে তার একমাত্র ছেকে শিবেনকে বলল,''অনেক হল । এবার দোকান খোল ।''
কিন্তু শিবেন তাকে বলল,''এ ব্যবসা আমি ঠিক বুঝি না । বাবাও তো আমাকে কিছু বলতে চায়নি । তাই না ? বরং অন্য ব্যবসা করা যাক । তুমি ভাবো । আমিও ভাবছি ।''
সঙ্গে-সঙ্গে মা বলল শিবেনকে,''এ ব্যবসা হতে পারে না । এ ব্যবসাই চলবে । আমার হাতে শাঁখা নেই তো কি আছে । আগের শাঁখার বুঝি জোর নেই ? তুই না পারিস । আমিই বসবো কাল থেকে ।''
মার কথা শুনে শিবেন বেশ অবাক হল ।
শেষে বিরক্তির সুরে মাকে বলল,''পারলে ভালো । তবে বেশ কঠিন মনে হচ্ছে । আমি কিন্তু এর মধ্যে নেই ।''
বলেই সরে গেলো শিবেন । একা-একা খুব হাসল অঞ্জলি । দু'চোখ ছলছল করে উঠলো তার স্বামী শশধরের কথা মনে করে বুঝি ।

ঠিক তার পরেরদিন অঞ্জলি শঙ্খ ভাণ্ডার খুলে গেলো । আর সাত-সকালেই । দেখে অনেকে বেশ অবাক । কেউ-কেউ অঞ্জলির কাছে এগিয়ে এলো ।
কেউ বলল,''আমরা ভেবেছিলাম ব্যবসা গেলো । শিবেন বুঝি অন্যকিছু ভাবছে ।''
একমুখ হেসে অঞ্জলি উত্তর দিলো,''সে ভেবেছিলো । কিন্তু আমি আমার স্বামীর ব্যবসা চোখের সামনে বন্ধ হয়ে যাক ভাবতে পারিনি । শিবেন বসবে না । আমিই বসবো এখন থেকে ।''
কেউ আবার বলল,''অনেকেই অন্য দোকান ধরেছে ।''
সেই হাসি মুখে নিয়ে অঞ্জলি বলল,''আবার পথ চিনে এদিকেই আসবে । আমার চেয়ে আর কে বোঝে শাঁখার কদর ? আদর করে পরিয়ে দিতে হয় । আমার ব্যবসার সঙ্গে স্মৃতিও থাকবে । সে কি ভোলার ?''

সত্যিই তাই । 
সপ্তাহ খানেকের মধ্যে অনেক সধবা অঞ্জলি শঙ্খ ভাণ্ডারে ফিরে এলো ।
এক তরুণী সধবা অঞ্জলিকে তৃপ্তির হাসি হেসে বলল,''এ দোকান ছাড়া আমার আবার পোষায় না,দিদি । বেশ করেছেন আবার দোকান খুলে । দাদা কর ভালোমানুষ ছিল । বেশ নরম করে হাতে শাঁখা পরিয়ে দিতো ।''
তখন হাসতে হাসতে অঞ্জলি তাকে বলল,''আমি তার থেকেও নরম করে পরিয়ে দেবো না হয় । আসলে আমি তো নারী । নারীর কোমলতা যায় কোথায় ? আর তোমার দাদার থেকেও বেশ শিখে নিয়েছি আমি ।''
সবাই খুশী । সবাই । শুধু একজন বাদে । ছেলে শিবেন ।

শিবেন একদিন সরোষে মাকে বলল,''আমার লজ্জা লাগে খুব । তুমি কেন দোকানে বসবে ? লোক রাখো না হয় । পয়সার তো অভাব নেই ।''
সাথে-সাথে অঞ্জলি সারা মুখে হাসি নিয়ে শিবেনকে বলল,''পয়সার অভাব নেই সত্যি । কিন্তু ঘরে মানুষের বড্ড অভাব । যে একজন আছে সেই আমার লজ্জার কারণ । ঘরে বসে আর কতদিন রে ?''
অঞ্জলি এমন কথা বলতেই শিবেন সাথে-সাথে রাগে জ্বলতে জ্বলতে হাওয়া । ওর পালানো দেখে অঞ্জলির তখন একা-একা সেকি হাসি ! হাসতে হাসতে তার দু'চোখ জলে ভরে গেলো ।
বসন্তের শুরুরতেদূর কোন বাগান থেকে কোকিলের ডাক শুনে অঞ্জলি নিমেষে আবার হেসে উঠলো । সেই হাসি । ফুলশয্যা রাতের সলাজ-হাসি ।