গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ১১ মে, ২০১৮

সুবর্ণা রায়

খিচুড়ি 

ঘরটার দুটো জানালা। একটা হাট খোলা, মানে কাঠের ফ্রেমটা শুধু আছে, পাল্লা নেই। আর একটাতে পাল্লা আছে। তবে দুটোই খুলে ঝুলে পড়েছে। হাট খোলার সামনে একটা পাম্প স্টোভ। ভসভস করে আগুণ আর আওয়াজ বেরোচ্ছে।
চেয়ারে বসে ফাটা জিনস আর স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে বড় হাঁড়িতে হাতা ঘুরাচ্ছে শিবদাস।
খিচুড়ির সুগন্ধে জানালা দিয়ে মাঝেমাঝেই হামলে পড়ছে কয়েকটা ছোট মাথা। ফিসফিস হাসি শুনে তাড়া মারছে শিবদাস।
"যা পালা এখান থেকে!"
"ও স্যার, আমাদের দেবে না?"
"না, আজ তোরা বাদ।"
"ও স্যার, ও স্যার, শোনো না!"
"অ্যাই তোরা যাবি নাকি আমি যাব?"
অতটাও রাগে নি শিবদাস, কিন্তু ভান করতে গিয়ে হাঁটুর ধাক্কায় টাল খেয়ে গেল হাঁড়ি। প্রায় শ'খানেক জনের রান্না!
বড় সাধ করে রাঁধছে। সন্তানের মতো আগলাতে গিয়ে খালি হাতেই ধরে ফেলল ফুটন্তগরম কানা। চলকেও পড়ল খানিক। হাতের ওপরেই।

সস্তার সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে তিতকুটে থুতু ফেলল উমেশ, "হাজার টাকা জলে দিলো সালা! এতো করে বললাম, বিজনেস করব, দাও! দিলো না!"
লালটু বলল, "দোস্ত, আজ বালদিবস। শিবুদা তো ভালোই করছে।"
"সালা! বাল দিবস! ঘর যাব না আজকে। সালা খুঁজে মরুক!"
শিবদাস আঠাশ। উমেশ পনেরো। তেরো বছরের বড় দাদাকে আরো অনেকভাবে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করছিল উমেশ। রাগের কারণ আগেই বলেছি।
"হা-ঘর হা-ভাতেগুলো আমার চেয়ে বেশী, না? তোর ভাতে, তোর ঘরে আমি পেচ্ছাপ করি!"

রুক্ষসুক্ষ বসতিটার একদিকে, হাইওয়েতে ওঠার রাস্তার পাশে বটগাছটার নীচে লালটুদের গুমটি দোকান। তার থেকে কয়েক পা এগোলে হালকা জঙ্গল মতো জায়গাটায় পঞ্চাশ-ষাট জন উদ্বাস্তু এসে জুটেছে। মাছি ভনভন করে বাচ্চাগুলোর গায়ে। কতদিন কিছু খায় না ভালো করে, জানা নেই। কিন্তু উৎপাত করে না বসতিতে গিয়ে। দু-দশ টাকাও সাথে আছে কি না সন্দেহ, কিন্তু মানইজ্জত ষোলআনা।
এইলোকগুলো আর তাদের বাচ্চাদের জন্য খিচুড়ি বানাচ্ছে শিবদাস, তার তিনঘরের স্কুলে। নিজেদের অবস্থা ভালো না হলেও, বসতির বাকি লোকেরা বেশ মজা পেয়েছে। হাতে হাতে সাহায্যও করছে। জুলজুল করে হাঁড়ির দিকে দেখতেও ছাড়ছে না। বিগড়েছে শুধু উমেশ। ভাইকে বইমুখো তো দূর, অক্ষর অবধি চেনাতে পারে নি শিবদাস। বাবা-মা থাকলে হয়ত শাসন হত কিছু, শিবদাস পারে না একদম। দু'জনের মধ্যে ফারাক যেন আসমান-জমিন!

খড়খড়ে রাস্তা দিয়ে দৌড়ে হাঁফাতে হাঁফাতে জমিল এসে প্রায় গায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল উমেশের।
"ওই... ওই... স্যারের..."
উমেশ ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল জমিলকে। "ভাগ, স্লা!"
"স্যারের দু'হাত পুড়ে গেছে উমেশদা! দু হাত!" নিজের দুহাত উল্টে দেখাল জমিল। বয়স সাত, তাও গুরুত্ব বোঝানোর চেষ্টা করল নিজের মতো করে।
আকাশ ফাটিয়ে বাজ পড়ল কোথাও।
"এই লাল্টু! চলে আয়!"
খড়খড়ে রাস্তার ওপর দিয়ে সাইকেলটা নিয়ে উড়ে চলে গেল উমেশ।

লোক জমে গেছে একমাত্র স্কুলঘরটার চাতালে। সঙ্গে সঙ্গে জল দিয়েও লাভ হয় নি। বড় বড় ফোস্কা পড়ে গেছে শিবদাসের হাতে। ফোস্কাওয়ালা মাস্টার চোখের জলে ভাসছে খিচুড়ির হাঁড়ির সামনে বসে- এ দৃশ্যে বেশিরভাগটাই আমোদ বাকিদের কাছে। "আহারে" "উহুরে"র সাথে "দেখ কেমন লাগে" "বেশী পয়সা হয়েছিল, না?" ইত্যাদি মন্তব্যও উড়ে আসছিল। আর শিবদাসের ব্যথাটা হু হু করে বেড়ে যাচ্ছিল।

বেলা বেড়ে সূর্য মাথার উপরে উঠে মজা দেখছিল, কালো মেঘ ঘনিয়ে এলো। উমেশ হুড়মুড় করে ঢুকে ভিড় ঠেলে ঘরটার মধ্যে এসে দাঁড়াল। স্টোভটায় পাম্প করে আগুণ উসকে দিয়ে বড় হাতাটা দিয়ে খিচুড়ির মধ্যে ঘোরাতে ঘোরাতে হাঁকডাকে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। লাল্টু, কালু, বিশু, লক্ষণ, জগাদের দলটা সামান্য আয়োজনটাকে অসামান্য করে তুলল।

সারসার পাত পড়ে গেল, ক্ষুধার্ত লোকগুলো হাপুসহুপুস করে অমৃত গিলতে লাগল, বসতির লোক ভেঙ্গে পড়ে মজা দেখতে লাগল, শিবদাস ওই চেয়ারটাতেই বসে হাসিমুখে দেখছিল সব, মলম পড়ে জ্বালা কিছুটা কমেছে তার। শুধু একজন তখনও অনড় তার জেদে। বাড়ি সে কিছুতেই ফিরবে না।



--