সকালটা
আজ অন্য রকম ভাবে শুরু হোল মানসীর। গতকাল রাত থেকে এখন দিন সাতেক মানসী এই
ফ্ল্যাটে পুরো একা, অনেকদিন পরে নিজের মতো
করে একটু হাত পা ছড়িয়ে থাকা। ছেলে রুমন, বৌমা রঞ্জাবতী আর
বছর আটেকের নাতনী তিন্নি গেছে দারজিলিং, কালিম্পং হয়ে
লাভা লোলেগাঁও।বরাবরই মানসীর ভোরে ওঠা অভ্যাস। ব্যাল্কনির টবে জল দেওয়া দিয়ে দিনের
শুরু।সকাল বেলা স্নান সেরে নেওয়াও একটা পুরনো অভ্যাস। একা একা নিজের জন্য রান্না
করতে ভালো লাগেনা। ডালিয়াতে যাহোক কিছু সব্জি দিয়ে আজ দুপুরের খাওয়া সেরে
নেবে।বাতাসে হিমেল ভাব শীত আসার বার্তা দিচ্ছে।শীত আসার আগে আলমারি থেকে গরম জামা
কাপড় গুলো রোদ্দুরে দেওয়াটাও মানসীর বহুদিনের অভ্যাস। একটু লিকার চা আর দুটো
বিস্কুট নিয়ে শোয়ার ঘরে এলো মানসী, আলমারিটা খুলল।ওপরের
তাক থেকে এক এক করে গরম জামা কাপড় গুলো নামাতে গিয়ে দু চোখ আটকে গেল, বুকের মধ্যে এক ঝলক ফাগুনি হাওয়া যেন উদাস দোলা দিয়ে গেল। এক পলকের
জন্য নিথর হয়ে গেলো মানসী- অর্জুনের সেই শাল। ভুলেই গিয়েছিল। ধীর হাতে শালটা তুলে
নিল, নরম করে একবার হাত বোলাল শালটার গায়ে।শুধু তো একটা
শাল নয়, ওটার সাথে যে অনেক মায়াময় মুহূর্ত জড়ানো আছে। কেমন
যেন আনমনা হয়ে গেল মানসী।
রিটায়ারমেন্টের
বছর তিনেকের মাথায় অনির্বাণের অসময়ে চলে যাবার পরে বিধ্বস্ত অসহায় হয়ে পড়েছিল
মানসী। রুমন তখন সবে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে একটা নামী ফার্মে জয়েন করেছে। জয়েন করার
মাস কয়েক পরেই ওকে চেন্নাই পাঠানো হোল এম বি এ করতে। মানসী আরও একা হয়ে পড়ল। রুমন
যাবার আগে মাকে শুধু একটা ভাল অ্যানড্রয়েড ফোন কিনেই দেয়নি,
ফেসবুকে একটা অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়ে তার কায়দা কানুন বেশ যত্ন করে
শিখিয়ে দিয়েছিল।প্রথম দিকে বেশ ভয় ভয় করত মানসীর।তবে কোন অসুবিধা হলে চেন্নাইতে
থাকা রুমানের থেকে জেনে নিত।
এইভাবে
বেশ কিছু বন্ধু হয়ে গেছিল, এইভাবেই অর্জুনের সাথে
পরিচয়, বন্ধুত্ত্ব। বেশ কবিতা, ছোট ছোট গল্প লিখে পোস্ট
করত। মানসী খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ত। মানুষটার মধ্যে একটা সহজ সরল আন্তরিকতা ছিল। সময়ের
সাথে সাথে কখন যে বন্ধুত্বের গণ্ডী অতিক্রম করে দুটো প্রাপ্ত বয়স্ক মন অনেক
কাছাকাছি চলে এসেছিল, দুজনের কেউই টের পায়নি। কোনদিন খুব
বেশী পারিবারিক ব্যাপার জানতেও চায়নি, বলতেও চায়নি অর্জুন।
ভালবাসি না বলেও যে কতো সুন্দর করে ভালোবাসার স্পর্শ হৃদয়ের গভীর থেকে গভীরে পৌঁছে
দেওয়া যায় সেটা মানসী অর্জুনের কাছ থেকে শিখেছিল। একাকীত্বের খোলস ছেড়ে এক অজানা
স্বপ্নের গ্রহের বাসিন্দা হয়ে পড়েছিল মানসী। অদ্ভুত এক মাদকতা ছিল অর্জুনের। ঘনিষ্ঠতায়
শরীরকে প্রাধান্য না দিয়ে তার থেকে অনেক বেশী যেন নিরভরতা দিয়েছিল মানসীকে ও। কোন
দিন শালীনতার মাত্রা অতিক্রম করেনি অর্জুন। সৌম্য চেহারার সাথে ওর ব্যাক্তিত্ব,
আচার আচরণ যেন খাপ খেয়ে গেছিল। শেষের দিকে ফোনেও কথা হতো। মানসী
মাঝে মাঝে অবাক হত, এ কেমন পুরুষ? কোন দিন দেখা করতে চেয়ে নিজে অস্থির হয়নি, মানসীকেও
বিব্রত করেনি। বরংচ মধ্য বয়েসি বিধবা মানসীরই মনের কন্দরে মানুষটার সাথে দেখা করার
সুপ্ত সাধ ছিল, একবারের তরে হলেও। ইতিমধ্যে রঞ্জাবতী এলো,
তিন্নি এলো, বাড়ী বদল হোল।মাঝে মাঝেই নানা আকারের ছেদ পড়ত সংযোগে উভয়ের তরফ
থেকে।তারপরে তো দীর্ঘ বছর তিনেক বেমালুম উধাও হয়ে গেল মানুষটা।ইন বক্সে উত্তর না
পেয়ে, ফোন করেছিল মানসী। অদ্ভুত এক অজানা কণ্ঠ জানান দিল সেটা তার নাম্বার, কোন
অর্জুন বাবুর নাম্বার নয়।গরু যেমন গোধূলি শেষে গোয়ালে ফিরে জাবর কাটে, রোজকার জীবন
যাপনের মাঝে মাঝে নিরালা দুপুরে অথবা রাতের নিস্তব্ধতার মাঝে মানসী স্মৃতির জাবর
কেটে যায় পরম মমতায়।নিসৃত দীর্ঘশ্বাস শোয়ার ঘরের দেওয়ালে আছড়ে পড়ে।
পাহাড়
থেকে সমুদ্র বরাবরই বেশী টানে মানসীকে।সমুদ্র যেন অনেক গভীর, অর্জুনের মতো-পাহাড়
যেন উদ্ধত, অহংকারী বড়।তাই সেবার যখন রুমন, রঞ্জাবতীরা
পুরী যাবার জন্য পীড়াপীড়ি করল, মানসী রাজি হয়ে গেছিল।
সেদিন
ওরা সাইট সিয়িংএ গেলো, ফিরবে সেই রাত আঁটটা নটার সময়।বিকেলের দিকে হোটেলের ঘরে
তালা মেরে গুটি গুটি পায়ে সমুদ্রের ধারে নিজের মনে হেঁটে যাচ্ছিল মানসী, বিচের ভিড়
ছাড়িয়ে অনেকটা দূরে- যেখানে জেলেদের নৌকাগুলো রাত জাগার শেষে বিশ্রাম নেয়
সেইদিকে।হঠাৎ একটা উদাত্ত কণ্ঠের কবিতা শুনে সচকিত হয়ে উঠল মানসী, বড় চেনা সে গলা।
বুকের
মধ্যে একটা উথালি পাথালি নিয়ে দ্রুত পায়ে নৌকা গুলো ছাড়িয়ে এগুতেই দেখতে পেল একটা
নৌকার আড়ালে সাদা শাল গায়ে পাঞ্জাবী পায়জামা পড়া এক শালপ্রাংশু অবয়ব দুহাত মেলে সব
চরাচর ভুলে নিজের লেখা কবিতা আবৃত্তি করে চলেছে।
“অর্জুন”-
এক আকুল স্বতঃস্ফুর্ত চিৎকার মানসীর বুক চিরে বেরিয়ে এলো।কবিতা থেমে গেছিল।গোধুলীর
রঙ দুজনের মুখেই মাখামাখি হয়েছিল।
তারপরে
সময় কোথা দিয়ে চলে গেছিল, ওরা টের পায়নি।পাশাপাশি বসে কথার কলকাকলি, মানসীর
রবীন্দ্র সঙ্গীতে, অর্জুনের আবৃত্তি দুই প্রাচীন মনকে নবীন করেছিল।অভিমানও ভর
করেছিল মানসীর গলায় ওকে না জানিয়ে অর্জুনের হারিয়ে যাওয়ায়।বিষাদ মাখা হাসি মুখে
এনে অর্জুন বলেছিল, “আমারও কি কষ্ট হয় নি তোমায় না জানিয়ে সরে যেতে? থাক সেসব
কথা।তুমি ছিলে তো আমার কাছে যেমন আমি ছিলাম তোমার অন্তরে”। মানসী আর কথা বাড়ায় নি।
কখন
সূর্যটা তার ডিউটি চাঁদের হাতে সঁপে দিয়ে বিদায় নিয়েছিল, গায়ে গায়ে বসে থাকা
অর্জুন মানসী টের পায়নি।একটু খুশখুশে কাশি হয়েছিল মানসীর, গায়ের শালটা খুলে পরম
মমতায় মানসীর গায়ে ভালো করে জড়িয়ে দিয়েছিল।আপত্তি করেনি মানসী, হরিণের কোমল চাউনি
মেলে অর্জুনের কাঁধে মাথা রেখেছিল।
“
দাদু, এবার চলুন।দেরী হলে হোমের ম্যানেজার বাবু রাগারাগি করবে”- পেছন থেকে আসা
একটা কণ্ঠস্বরে চমকে উঠে দুজনে সরে বসেছিল। যেন এক জল্লাদ মুহূর্ত গুলোর মৃত্যু
পরোয়ানা নিয়ে হাজির হয়েছিল।বিব্রত চাউনি নিয়ে অর্জুন বলেছিল, “অক্সিজেন নিয়ে গেলাম
ফুসফুস ভরে।তুমিও আর থেকো না এখানে। ভালো থেকো মানসী, শরীরের যত্ন নিও। আসি”
আচমকা
বাকরুদ্ধ হয়ে গেছিল মানসী।ভাঙ্গা গলায় কোন মতে বলেছিল, “ হুম, এসো, তুমিও ভাল
থেকো”।
আলো
আঁধারি মেখে শালপ্রাংশু অবয়বটা মানসীকে একা রেখে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল।শালটা ফেরত
দেবার কথা ভুলে গেছিল, ভুলে গেছিল ফোন নাম্বারটাও নিতে।অবশ্য চাইলেও হয়তো ফোন
নাম্বার পেত না। হোটেলে ফিরে নিজের ব্যাগের তলায় সেই শাল লুকিয়ে রেখেছিল।
একটা
সাইলেন্সার কাটা অটো রিক্সার বিকট আওয়াজে মানসী স্মৃতির পাতা থেকে বর্তমানে ফিরে
এল।শালটা পরম মমতায় গায়ে জড়িয়ে গুটি গুটি পায়ে আলমারির আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল
কিন্তু ঝাপসা দৃষ্টিতে আয়নায় নিজেকে দেখতে পেল না।
বাস্প
রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, "আমার ছোঁয়া টের
পাচ্ছ, অর্জুন?"