গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ২০ মার্চ, ২০১৭

অলভ্য ঘোষ

ভাগ
                                                                                                           

চ্যানডোবার মাটিতে এত বড় কোনো ঘটনা নয়। সামন্তদের বড় ছেলেটা জুট মিলে কাজ পেয়ে যখন কলকাতা থেকে বউ নিয়ে এলো; জমি ভাগ বসিয়ে বাপ মা মরা অসহায় ছোট ভাইকে একা করে রাত পোহাতে পোহাতে ভিটেমাটি বেঁচে পালালো কলকাতায়। কয়েকদিন বটতলায় চায়ের দোকানে মুরব্বিরা চায়ের কাপ মুখে ধরে হুঁকোয় টান মেরে এ ঘটনার সমালোচনা করল বটে; তবে কিছুদিনের মধ্যেই জল থিতল । নুরুলের নিকাকে আলোচনার বিষয় করে নিলো । খাল পাড়ের এক চিলতে এঁদো জমিটা জুটল খাদিজা বিবির নসিবে । কালে কালে এ জলো গড়িয়ে গেল এদের মন থেকে। গাঙে আবার নতুন ঢেউ এসে জমা হল

আজ সুবল ও বিমলের ভাগবাটোয়ারার দিন। এরা কাকা ও ভাইপো হলেও নাড়ির টান ছিল সহোদরের মত। গ্রামের লোকেরা অনেকেই এদের সম্পর্কের প্রগাঢ়তায় জ্বলে পুড়ে মরত। পরশ্রীকাতরতা ও পরচ্ছিদ্র অন্বেষণে বাঙালির জুড়ি মেলা ভার । তবে প্রিয় পাঠক সুবল-বিমলের সম্পর্কের মাঝে প্রতিবেশীর কান ভাঙানি,
 আত্মীয়ের উস্কানি কতটা মোটা বিভেদের পাঁচিল গেঁথে ছিল সেটা এ গল্পের উপজীব্য নয় । এই সংসারের বৈষয়িক সম্পত্তির কঠিন গরাদে আটকে পড়া নিকট হৃদয়গুলো কক্ষচ্যুত ধূমকেতুর মত হঠাৎ  আলোক বর্ষ দূরে বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েও; কোন মাধ্যাকর্ষণের টানে তারা আবার ফিরে আসে আপন আপন কক্ষপথে তারা একে অপরকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকে । কেমন করে কোনটা বা পৃথিবীর বুকেই আছড়ে পড়ে আবেগে। এই গল্পে তার অনুসন্ধানের চেষ্টা করতে চলেছি ।

জানি না আজ সে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি এ সংসারের কতটা প্রবল। তবে সে শক্তি একেবারে না থাকলে আমরা এ পৃথিবীতে এঁটুলির মত আটকে থাকতাম না । কেন হঠাৎ
 শরৎ চাটুজ্যে মার্কা সংসারের গল্প লিখতে বসলাম বলুন তো ? কারণ আজকের সংসারগুলো পিতৃতান্ত্রিক পারিবারিক ব্যবস্থা থেকে ক্রমশ ব্যক্তিকেন্দ্রিক গণতান্ত্রিক পরিবার বা যৌথ পরিবার ব্যবস্থা থেকে একক বা নিউক্লিয়ার পরিবার; ম্যায় তুম অর মেরা বেটা তেও দাঁড়িয়ে নেই। ম্যায় তুম অর ও। আরো ত্রিকোণ সম্পর্ক এসে ভিড় করছে । সম্পর্কের টানাপোড়নে ভৌগলিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, নৈতিক, ব্যক্তিক জীবনে বিভাজিত হতে হতে আরো বিচ্ছিন্ন আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে মানুষ। অথচ বনের পশুরাও সংঘবদ্ধ জীবন যাপন করেন। বানরের দল দেখেছেন তো । অ্যানিমেল প্লানেট খুলে দেখুন সিংহ পরিবার কি রকম একটা শিকার ধরে ভাগ ঝোঁক করে ভোজ সারছে । অথচ আমরা মানুষেরা কেবল নিজেরা খেতে ব্যস্ত। বনের পশুরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত শিকার মারে না। আমরা প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে ভবিষ্যতের সংগ্রহে শিকারে লিপ্ত । নিজেরাই শিকার হয়ে পড়ছি অমানবিকতার। পশুর চেয়েও ভয়ঙ্কর আমরা । সেই অমানবিকতা থেকে মানবিকতার আলোর উৎসের সন্ধানে এই গল্প ।

পর্ব-১
কায়স্থ বোস । এক কাঠি নিচে নেমে সুবল যেদিন বেরার মেয়ের সাথে ভাব জমাল ; পাঁচ কান হয়ে কথাটা পৌঁছেছিল বৌদিমণির কানে ।
অনেকে খোঁচা মেরে বলেছিল;
-"ওতো তোমার পেটের ছেলে নয় ।"
কারো কথা কানে না তুলে অনাথ বন্ধু বেরার বাড়ি নিজেই গিয়েছিল বৌদিমণি সুবলের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে । লোকে ছিঃ ছিঃ করলে বলেছিল;
-"জাত ধুয়ে কি জল খাব। জল খাব মেয়ের হাতের।  সুবলের যে মেয়ে পছন্দ; সে তো আমার পরিবারের অযোগ্য হতে পারে না।"
বাড়িতে সুবলকে বলেছিল;
-"হ্যাঁরে সবিতার সাথে ভালবাসা করলি কই আমাকে তো বললিনে !"
সুবল বৌদিমণিকে জড়িয়ে ধরে বুকের উপর মাথা রেখে বলেছিল;
-"ভয়ে যদি তুমি মেনে না নাও ।"
মনিমালা একগাল হেসে সুবলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেছিল;
-"দুর পাগল! তুই আর বিমল আমার প্রাণ। প্রাণ ছাড়া এই দেহের কি কোন অস্তিত্ব আছেরে ।"
সুবল বৌদি মণির কোলে মাথা রেখে চোখ বুজে শুয়ে ছিল । তার একমাত্র আশ্রয়স্থল এই বৌদিমণি। মায়ের স্নেহ; বন্ধুর সাহচর্য পেয়েছে সে তার কাছ থেকে ।

পর্ব-২
পনের বছর বয়সে মনিমালা এই পরিবারের বউ হয়ে এসেছে । সতের বছর বয়সে মা হয়েছে। তিরিশ বছর বয়সে বিধবা একের পর এক মৃত্যু গ্রাস করেছে এই ভিটেকে। সংসারের একের পর এক হাল ধরতে হয়েছে মনিমালাকে । নিজের হাতে তিলে তিলে গড়েছে সে এই সংসার । শাশুড়ি মা মারা যাওয়ার সময় মনিমালার হাতে তুলে দিয়ে গিয়েছে তার জীবিত শেষ সন্তানটি। মৃত্যুর পথযাত্রী শাশুড়িকে মনিমালা কথা দিয়েছিল সুবলের সে অযত্ন করবে না কোনদিন । কথা রেখেছে মনিমালা; নিজের সন্তানের চেয়েও বেশি সুবল তার কাছে । মনিমালার স্তনে সেদিন দুধ ছিল না । সদ্যজাত সুবলের কাজের মাসির বুকের দুধ খেয়ে প্রাণ রক্ষা হয়েছিল ।

সুবল আর বিমলের বয়সের ফারাক মাত্র কয়েক বছরের । বিমল যখন আতুর ঘরে বোয়াল মাছের মত মাতৃদুগ্ধ পানে লিপ্ত থাকতো । আঁতুড় ঘরের চৌকাঠে হামা দিয়ে এসে হাজির হতো সুবল। কাঙালের মতো একটা শিশু আরেকটা শিশুর দুগ্ধ পানের দৃশ্য দেখত বিস্ময় দৃষ্টিতে । মনিমালার মা সেসময় মেয়ের যত্নআত্তির জন্য এ বাড়িতে এসেছিল দীর্ঘদিন । তার কড়া নিষেধ ছিল; চৌকাঠ পেরিয়ে আঁতুড় ঘরে ঢোকা যাবে না সুবলের। সুবলকে সেখান থেকে তুলে নিয়ে যেতো মনিমালার মা। সুবল কাঁদত! আর উঠানে খেলতে খেলতে আবার হাজির হতো । উঠানের পাশের তাদের গোয়াল ঘর ঘিরে নির্মিত অস্থায়ী আঁতুড় ঘরে। এ আঁতুড় ঘরের সুবল ও একদিন অংশীদার ছিল। সদ্য বিয়ানো শিশুর আস্তানা গোয়াল ঘরে। এটা এ বাড়ির পরম্পরা। গোয়াল ঘরে সুবলের জন্মের পর মনিমালার শ্বশুর মশাই এসে সুবলকে দেখে বলেছিলেন;
 
-"এঁড়ে বাছুর। মাটাকে খেলি। এবার বাঁচবি কেমনে ?"
শেষ রক্ষা হয়েছিল ।
সে যাই হোক। আঁতুড় ঘরে মনিমালার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠতো । নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হতো তার। সে যে এক মৃত্যু পথগামী মানুষকে কথা 
দিয়েছে;  সুবলকে পরিপূর্ণ মায়ের স্নেহ দিয়ে বড় করে তুলবে।মাতৃ দুগ্ধ সন্তান কে না খাইয়ে মা হওয়া যায় ?
মনিমালার মা তার মেয়েকে উপদেশ দিয়েছিল ।
-"সন্তানের কাছে মায়ের দুধ হল অমৃত। কথায় বলে দুধের ঋণ শোধ হয় না। সে দুধ তুই নিজের সন্তানকে না খাইয়ে ওই পোড়ার মুখটাকে ভাগ দিবি না মনি ।"
মায়ের কথা রাখতে পারেনি মনিমালা। সুবলের প্রতি বঞ্চনা তার ধর্মে সইবে না । কয়েকদিনের মধ্যেই মনিমালা সুবলকে টেনে নিয়েছিল বুকের উপর। সুবল ও বিমলের সাথে ভাগ বসিয়ে ছিল মাতৃদুগ্ধে ।

কোন স্তনে ঠুনকো হলেও মনিমালা কখনো তার স্তনসুধা থেকে বঞ্চিত করেনি তার সন্তানদের । সকল যন্ত্রণা সহ্য করে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে বিলিয়ে দেওয়ার মধ্যে যে এদেশের মায়েদের আত্মগৌরব ছিল একদা; তা পুনরুদ্ধারের কথা বললে জানি প্রবল নারীবাদীরা বলবেন; কেন মনিমালাদের সম্পূর্ণ বিলতে হবে এত অমানবিক । মায়ের মানবিকতা কেবল সন্তানদের জুড়ে । আর নারীর পূর্ণতা মায়ে। প্রকৃতি সে শক্তি পুরুষকে দেয়নি ।  এ সংসার সৃজন বন্ধন মায়ের হাতে ।  মা নারীর উচ্চাঙ্গের রূপ। জানি এতেও এক অংশের নারীবাদীরা বলবেন নারীকে পেল্লাই দিয়ে পুরুষ তুমি আখের গোছাতে চাইছ। তাকে মুক্তি দাও! নারীর মুক্তি মাতৃত্বে। একবিংশ শতাব্দীর মায়েরা যদি মা হতে না চান; টেস্ট টিউবে সমাজ টিকবে তো ? মাকড়সার মধ্যে যেমন সঙ্গমের পর পুরুষ মাকড়সাটাকে নারী মাকড়সা খেয়ে ফেলে; আমরা তেমনি নারীকেও সংসারে সুখ ভোগের পর ছিবড়ে করে দীর্ঘদিন হত্যা করেছি । তবুও বলি আজ যে স্বাধীনতা নারী কিঞ্চিত হলেও পেয়েছে; সেটা কি আদায়কৃত ? না পুরুষের দেওয়া ? 

সেটা ভেবে দেখবেন দয়া করে। বিদ্যাসাগর একজন পুরুষ ছিলেন।নারীবাদী ছিলেন কিনা আমার জানা নাই; তবে নারী শিক্ষা ও বিধবা বিবাহের জন্য তার উদ্দাম
ছিল। নারী পুরুষের সমতা বা সামঞ্জস্য এক উন্নত সমাজের পরিকাঠামো স্থাপন করতে পারে এ ব্যাপারে কোনো সংশয় নেই।

এ দেশে নারী চিরকাল পুরুষের মুখাপেক্ষী হয়ে থেকেছে। স্বাধীনতা আত্মার নিজেকে জাগিয়ে তোলার। নিজের অধিকারটা বুঝে নেওয়ার। পাওনাদারের মত না হলেও তাকে তার নিজের সম্মান অবশ্যই আদায় করে নিতে হবে। পুরুষের করুণার অপেক্ষায় নয়। পুরুষ তার সংসারের প্রয়োজনেই নারীকে হেঁশেল থেকে আজ ঘরের বাইরে ছেড়েছে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা মানেও স্বাধীনতা নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অফিসের বস ঘরের স্বামীর মতই ব্যবহার করে কর্মস্থলে নারীর সাথে।

পর্ব-৩
ব্যাপারটা বেশ গোলমেলে স্বাধীনতা মানে আধুনিকতা মানে বাইরের কিছু নয় ভেতরের। আবার দেখি স্বাধীনতা আধুনিকতার নামে স্বেচ্ছাচারিতা। নারী এমন পোশাকে রাস্তা মেট্রো স্টেশনকে ফ্যাশন র‍্যাম্প ভাবতে শুরু করেছে যে আসলে সে একদল পুরুষ তাকে যে ভাবে দেখতে চায় সেই ইচ্ছা পূরণ করে নিজেকে সাজিয়ে চলেছে। যুগ যুগ ধরে নারীকে পণ্য ভাবা হয়েছে। এখন নারী পণ্য বলেই নিজেকে বিশ্বাস করতে শিখে গেছে। তাদের জন্ম যে অপরের মনোরঞ্জনের জন্য নয়; সংসারের লালন পালনের জন্য তাদের জন্ম; এটা যেদিন তারা বুঝতে পারবে সেদিনই নারীর মুক্তি সম্ভব। নারীকে দশ হাত দিয়ে পূজা করা হচ্ছে সংসারে খাটিয়ে নেবার জন্য নয় সংসার রক্ষার জন্য ! কু কে দমন করে সু এর প্রতিষ্ঠার পূজা তো দুর্গা পূজা বলে জানি।

সে ভাগ ছিল স্নেহের ভাগ। বিমলের সাথে সুবল যতই ভাগ বসিয়েছে মনিমালার বুকে; মনিমালার বুকের স্নেহ বেড়েছে ততই। আসলে সুবল ও বিমলকে মনিমালা কখনো পৃথকভাবে দেখেনি।
কিন্তু আজকের ভাগ অখণ্ড একটা হৃদয়কে দু’টুকরো করে বখরা নেওয়া। এ হৃদয় মনিমালার।
প্রতিবেশীর কানভাঙানি; সর্বোপরি মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত সুবলের শ্বশুর শাশুড়ি; জামাইকে সচেতন করে দিতে গিয়ে সুবলের তরফের কোনরূপ হৃদয়
অনুকূলতা না দেখে; বশীকরণ কবজে বশীভূত করার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করে মেয়েকে পাঠাল শ্বশুর বাড়ি।

সন্তান সম্ভবা সবিতা রাতে কাঁদতে কাঁদতে লুটিয়ে পড়েছিল সুবলের পায়ে। সুবল দুই হাতে সবিতার মুখখানা তুলে ধরে বলেছিল;  -কি হলো, ঘোষদের বউ বুঝি নতুন কোন গয়না গড়িয়েছে? নাকি বেনারসি শাড়ি কিনেছে?  তোমারও চাই?
সুবল জানে সবিতার আবদারগুলোর আদায়ের প্রক্রিয়া।
সবিতা নাকে কেঁদেছিল;
- তুমি কি আমাকে সব সময় শাড়ি আর গয়না চাইতে দেখছো?
সুবল আদুরে গলায় মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেছিল;
-যতবারই তুমি কেঁদেছ ওই আবদারই তুমি করেছ কিনা ।
এ সংসারের নারী সংসর্গে যে বোধ জন্মেছে তা থেকে সুবল মনে মনে একটা ভাব পোষণ করে। সেটি হল; স্ত্রী লোকের চাওয়া পাওয়া খুব সীমিত । পুরুষের মতো বাড়ি গাড়ি, দেশ বিদেশ ভ্রমণ, উচ্চপদে চাকরি, প্রচুর উপার্জন এইসব কিছুতে বিশেষ কোন আগ্রহ নেই । স্বামী, সন্তান, আর সাত হাত শাড়ি, পুঁতির মালা, গুটি কয় গিলটি করা হলেও গহনা এটুকু হলেই তাদের চলে । চ্যানডোবার প্রত্যন্ত গ্রামে বসে সুবল আজও জানে না চাঁদেও মহিলারা গিয়ে হাজির হয়েছে । আজকের এই টেলিভিশন আর ইন্টারনেটের যুগে ভাবতেই অবাক লাগে। আসলে এ গ্রাম সভ্যতা থেকে অনেক দূরে। টেলিভিশন দুটি একটি বাড়িতে আছে-তা চলে সোলারে মিটমিট করে; মোবাইল ফোন আছে তবে ঠিকঠাক টাওয়ার মেলে না। অনেকেই ঠিকঠাক ব্যবহার করতে জানে না। সুন্দরবনের একটি দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে এই গ্রাম্য সরল মানুষগুলোর মাটির গল্প আঁকড়িয়ে যে ভালবাসার অনুক্রমণিকা ঘেঁটে খাদহীন একটি নিরেট সম্পর্কের অনুসন্ধান করছি শহরে তা মূল্যহীন তুচ্ছ। এ সম্পর্ক মিলবেও না। যা মিলবে তা দগদগে লাল ঘায়ের মত একটু মরচে পড়া নেই। কিন্তু মাটির যে প্রান্তে এখনো সভ্যতার হিংস্র ছোবল মানুষের সারল্য পবিত্রতা গ্রাস করতে পারেনি; সেখানের আঁচলা ভরে দুই ঢোক জল খেলেও বড় শান্তি পায় আজকের অস্থির কঠিন অসহিষ্ণু তৃষ্ণার্ত মানুষ । এই গল্প লিখতে গিয়ে আমি সেই শান্তি অনুভব করছি ।
অভিমানের ভঙ্গিতে সবিতা বলেছিল;
-এমন ভাব করছো যেন কত শাড়ি গয়না কিনে দিয়েছ আমায় ।
সবিতাকে পা থেকে তুলে বুকে নিয়েছিল সুবল । 
-কি করি বলো বৌদিমনি অহেতুক বিলাসিতা পছন্দ করেন না। অনেক কষ্ট করে আমরা বড় হয়েছি ........সহসা তড়িৎ পিষ্ট হবার মত সুবলের বুক থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিল সবিতা ।
-বৌদিমনি--বৌদিমনি-- বৌদিমনি---আচ্ছা তুমি কি আর কিছুই জানো না। তোমার নিজের কিছু নেই। কেন ভুলে যাও তুমি বিমলের মত এ পরিবারের আর
একজন শরিক। তুমি তোমার টাকায় তোমার বউকে কিছু দিলে এতে কার আপত্তি? কিসের আপত্তি? সবকিছু বিমলের। আর তোমার ভাগে শুধু কাঁচকলা।
সবিতার রাগের আত্মপ্রকাশ সপ্তমে পৌঁছালে সুবলের কেবল চিন্তা হচ্ছিল বৌদিমনি শুনলে কি ভাববে। সবিতা রেগে গেলে মা চণ্ডী আবার মাথা ঠাণ্ডা হলে মাটির
কলসির মত শীতল। সবিতা বকেই চলেছিল; তাকে যে মন্ত্রপূত করে শ্বশুর বাড়িতে পাঠিয়েছিল; সুবলের শ্বশুর শাশুড়ি তাতো সুবলের জানা ছিল না। সে সবিতাকে প্রশমিত করার চেষ্টা করেছিল;

-ছিঃ সবিতা এভাবে বলতে নেই। বৌদিমনি শুনলে কি ভাববে বলতো। সে তো আমার শুধু বৌঠান নয়। সে আমার মা। আর মায়ের কি কখনো ভাগ হয়।
সবিতা আরো চটে গিয়েছিল;
-বুঝবে বুঝবে। একটা তিল টুকরো সম্পত্তিও তোমার কপালে জুটবে না। হাঁদা কোথাকার। নিজের ভালো পাগলেও বোঝে।
সহসা দরজার ওপারে কড়া নেড়ে মনিমালা হাঁক পেরেছিল;
-ছোট ঘরে আছিস!
পর্ব-৪
সুবল গিয়ে দরজা খোলে। লজ্জায় তার মুখ খানা লাল হয়ে উঠেছিল।
-"বৌদিমনি তাহলে কি সবিতার কথা শুনে ফেলেছে ।"
এই আশঙ্কায় ভুগছিল যখন সুবল। মনিমালা ঘরে ঢুকে বলল;-
-হ্যাঁরে ছোট....! হারুর মায়ের কাছে তুই সিন্ধুকের চাবিটা চেয়েছিস ?
সবিতার জিব আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিল । আড়ষ্ট জিবটাকে ভেতরের সব শক্তি দিয়ে চালিত করার চেষ্টা করলেও সে একটু তুতলে ছিল;
-হ্যাঁ—মানে---আমার বিয়ের জাম বাটি টা নেওয়ার জন্য। বাবাকে কাতলা মাছের মুড়ো রেঁধে পাঠানোর ইচ্ছে হল। খুব ভালবাসে খেতে । অথচ বাড়িতে একটা ভাল বাটি নেই ।
মনিমালা কপাল কুচকে বলেছিল;
-সেকি গত মাসেই তো কাঁসারির কাছ থেকে কতগুলো বড় বাটি নিলাম। সেগুলো কি হলো ?
মনিমালার কথার জবাব দিতে ইচ্ছে না করলেও; সবিতাকে উত্তরে বলতে হয়েছিল;
-সেগুলো আছে। হারুর মা ঘাটে মাজতে নিয়ে গেলো তাই আর কি ?
মনিমালার বুঝতে বাকি ছিল না আসলে সবিতা সিন্ধুকের অধিকার চাইছে । দরজার ওপারে সুবল সবিতার বাক্যালাপে প্রথমটা সে চলে যাবে স্থির করেছিল তাদের না ডেকে; কিন্তু তারপর মনে করলেন এই যথার্থ ক্লাইম্যাক্সে তার প্রবেশ না ঘটলে নাটকের ছন্দ পতন ঘটবে। মনিমালা কিছুই জানেন না; এমন একটা ভাব করে বলেছিলেন;
-শোন ছোট; হারুর মায়ের কাছে সব কিছু বলিস না। ও সারা পাড়া রটিয়ে বেড়ায়। আমাদের ঘরের কথা লোকে জানবে কেন বল ।
মনিমালার কথায় সবিতার গা জ্বালা করছিল। উপযাচক হয়ে এমন জ্ঞান না দিলেই কি নয়। কোনও ভণিতা আর না করেই সবিতা বলেছিল;
-লোকে ছিঃ ছিঃ করার মতো আমি তো কিছু বলিনি। আমি তো কেবল সিন্ধুকের চাবি টা তোমার কাছে চাইতে বলেছি দিদি ।
মনিমালা স্বাভাবিকভাবে বলেছিল;
-"সেটা তুই চাইলেই পারতিস ছোট।"
আঁচল থেকে চাবিটা খুলে সবিতার হাতে গুঁজে দিয়েছিল। সবিতা দাঁড়িয়েছিল পাথরের মূর্তির মতো। সুবল সবিতার হঠাৎ উগ্র ব্যবহারে অপ্রস্তুত হয়ে; আরো লজ্জায় পড়ে গিয়ে বলেছিল;
-বৌদিমনি তুমি চাবিটা নিয়ে যাও। ও ছেলেমানুষ দুম করে কি না কি বলে বসেছে; তাবলে তুমি রাগ করে চাবিটা ওর কাছে দিয়ে যাবে ।
মনিমালা আরো শীতল স্বাভাবিকভাবে বলে গিয়েছিল ;
-রাগ তো আমি করিনি সুবল। সেই কোন ছোটবেলা থেকে তোদের বাড়ির ভার বয়ে চলেছি। আমার কি রেহাই নেই। তোরা বড় হয়েছিস। এবার নিজেরাই এক একটা দায়িত্ব নে না বাপু।
মনিমালা চলে যেতেই সবিতা সুবলের দিকে মুখ বাঁকিয়ে বলেছিল;
-ঢং—ঢং—ঢং--- ঢং দেখলে আর বাঁচি না! বৌদির কাছে একেবারে সোহাগ উথলে উঠল। অত ন্যাকামো না দেখালে চলছিল না ।
গায়ের জামাটা খুলে বিছানার উপর সজোরে ছুড়ে ফেলে রাগ প্রকাশ করে; এলো গায়ে সেদিন দুপুরে না খেয়ে নির্জন পুকুর ঘাটে একাকী বসে ছিল সুবল। এ তার ছোটবেলার অভ্যাস। কতবার ইস্কুল থেকে অংকের মাষ্টার মশাই বাড়ি বয়ে রিপোর্ট করে গিয়েছে। এ ছেলের পড়াশোনা হবে না মাথা ভর্তি গোবর ! এত বড়
দামড়া ছেলে এখনও অবধি ল.সা.গু----গ.সা.গু কষতে জানে না। বিমল দশম শ্রেণীতে উঠে গিয়েছিল আর সুবোল তখনো অষ্টম শ্রেণিতে পাছা ঘষে
চলেছে। তিরিক্ষি মেজাজে জ্বলে উঠতেন সুবলের বড়দা। গালিগালাজ তারপর বেতের লাঠির ঘা পড়তো সুবলের পিঠে।বৌদি হাউ মাউ করে ছুটে এসে হেঁশেল ফেলে সুবল কে বাঁচাত ।
সেই সব দিনগুলো তে ঠিক এমনি করে পুকুর পাড়ে এসে স্নান খাওয়া না করে বসে থাকতো সুবল
বৌদিমনি তার পেছন থেকে পা টিপে এসে বসতো পাশে। আর আলতো করে মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করতেই সুবলের চোখের জল অভিমানে টপটপ করে গড়িয়ে পড়তো চিবুক বেয়ে। মনিমালা সুবলকে বুকে টেনে নিয়ে বলতো;
-চ খাবি চ !
এই পৃথিবীতে হঠাৎ হারিয়ে যাওয়া অবলম্বন আবার ফিরে পেয়েও নিজের অভিমানের আভিজাত্য বজায় রাখতে আরো অপত্য স্নেহের লোভে সুবল বলতো;-না-যাও-যাব না ।
মনিমালা সুবলকে আরো জাপটিয়ে ধরত বুকে।
-এমনটা বলতে নেই! দাদা তোর ভালো চান তাই না বকেন! তুই না খেলে আমিও যে কিছু মুখে তুলতে পারবো না । আমি মরলে তুই বুঝবি কতটা ভালবাসি তোকে । বৌদিমনির মুখ চেপে ধরত সুবল। তাকে আর একটি কথাও বলতে দিত না। হাউ মাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলতো;
-কি করবো! কত চেষ্টা করি তবুও অংকগুলো মাথায় ঢোকে না। আমার স্মৃতিশক্তি খারাপ বলো? সেবার মেলা থেকে গাজনের গান একবারটি শুনে এসে তোমায় কেমন পুরোটা শুনিয়ে ছিলাম—
মনিমালা মাস্টারদের গাল পাড়তেন।
-পোড়ার মুখো মাস্টার গুলোও হয়েছে সেরকম। পুরুষ মানুষ রোদে পুড়ে ঘরে ফিরতে না ফিরতেই ওনারা নালিশ করতে হাজির হবেন।
বাৎসল্য মাখানো অপত্য স্নেহে সুবলের চোখের জল মুছে; গালে হাত বুলাতে বুলাতে মনিমালা বলতো;
-থাক তোর আর স্কুলে গিয়ে কাজ নেই।
এভাবেই একদিন সুবলের পড়াশোনার ইতি হয়েছিল ।


(পরের অংশ আগামী সংখ্যায় )