গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ২০ মার্চ, ২০১৭

তাপসকিরণ রায়

ধারাবাহিক

মান্ডলার হান্টেড কাহিনী
                                                           

বিশ্বাস অবিশ্বাস  কি শুধু মনের ব্যাপার ? অনেকে তাই মনে করেন বটে। এমনটাও দেখা যায় কেউ কেউ অলৌকিকতায় বিশ্বাস করেন কিন্তু প্রকাশ করে সবার সমক্ষে নিজেকে দুর্বল করতে চান না। আরও একটা দিক আছে--আমাদের স্বাভাবিক জীবন যাত্রাতে অবিশ্বাস্য কিছু ঢুকে গেলে তা ব্যাহত হয়। আমরা সবাই চাই জীবনের একটা সুষ্টু ধারাপ্রবাহ। চাইলেই সব কিছু হয় না, কিছু কিছু অস্তিত্ব আছে যা জীবনকে আচমকা নাড়া দিয়ে যায়। লৌকিকতার মাঝে অলৌকিকতা ঢুকে যায়। আমরা হতবাক হই, বিস্মিত ও ভীত হয়ে পড়ি। সে সব অবুঝ অস্তিত্বগুলি নিয়ে লক্ষ লক্ষ প্রশ্ন ও তার উত্তর খুঁজে ফিরি। ভূত, ভৌতিক, রহস্য, অলৌকিকতা এ সব শব্দগুলি আমরা যেভাবেই উচ্চারণ করি না কেন আখির তা বিশ্বাস অবিশ্বাস পর্যায়ে এসে ঠেকতেই পারে। এ প্রসঙ্গ নিয়ে আমি কিন্তু কোন রকম তর্ক বিতর্কে যেতে চাই না। আমি শুধু কিছু নির্দিষ্ট নির্বাচিত হান্টেড ঘটনাকে নতুন ভাবে নিজের মত করে সাজিয়ে পাঠকের কাছে তুলে ধরতে চাই। এ সব ঘটনাগুলির বেশ কিছু ঘটনা কিন্তু স্থান কাল পাত্র আগে ভাগেই চিহ্নিত হয়ে আছে। মিডিয়ার মাধ্যমে সে সব ঘটনা সারা বিশ্বে আজ ছড়িয়ে পড়েছে। এমনি বহু ঘটনার মাঝে বর্তমান পর্বে মধ্যপ্রদেশের মান্ডলা জেলার ভৌতিক, অলৌকিক বা হান্টেড কিছু ঘটনা গল্পাকারে প্রকাশ করছি--          
                                                                   
                                                                  

                                                                 সিগারেট

আমি তখন সবে মাত্র মান্ডলার না গ্রাম না শহর ধরণের একটাজাগায় সরকারি স্তরের চাকরিতে জয়েন করেছি। মান্ডলা মধ্যপ্রদেশের এক অরণ্য প্রধান জেলা। এ খানেও দিনে চহল পহল লাগা থাকলেও সামান্য রাতেই নির্জনতা ঘিরে যায়। একটু দূরে হলেও এর চার পাশ গভীর জঙ্গলাকীর্ণ। এতটা ইন্টেরিয়রে যাবার ইচ্ছে না থাকলেও আর্থিক দিক বিবেচনা করে আমায় আসতেই হয়েছিল এখানে। ছোট একটা তৌশীল অফিস। আমার বাসস্থান থেকে আধ কিলোমিটার দূরে হবে। অনেকটা খাপছাড়া ধরনের লোকালয়ে আমায় থাকতে হতো। প্ল্যান করে এখানে ঘর বাড়ি রাস্তাঘাট বানানো হয় নি।
মোটামুটি পছন্দ মত ভাড়ায় একটা বাড়ি পেয়ে গিয়ে ছিলাম। সেখান থেকে জঙ্গল দু শ মিটার দূরত্ব হালকা বনের সীমানা শুরু হয়ে গেছে। পাশেই ছিল একটা সরু নদী। গ্রীষ্মে হাঁটুজল কোথাও কোথাও পায়ের পাতা জল থেকে যায়। তবে বর্ষায় তার রূপ একেবারে পাল্টে যায়--ফুলে ফেঁপে কলকল ছলছল শব্দ করতে করতে সশব্দে সে বয়ে যায়। ঘর থেকে সামান্য কিছুটা গেলেই পরে নদীর পুল। স্থামীয় লোকেরা এ পুল একেবাই ব্যবহার করে না। এই পুল নিয়েই ইয়ের ভীতি জড়িয়ে আছে। কিসের ভয় বা ভয়ের কোন ঘটনার কথা কেউ বলতে পারে না।
আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনারা এ পুল দিয়ে যাতায়াত করেন না কেন ?
আমি বলতে পারবো না,তবে স্হানেছি এ পুলের বড় নাম আছে। অনেকে ভয় পেয়েছে রাতে পুলের ওপর পা রাখলেই নাকি গা ভারী ভারী লাগে। শরীর ছমছম করে ওঠে। ব্যাস এই পর্যন্ত ভয়ের ইতিহাস শুনে ছিলাম। আমি আমার নিজের মন থেকে,ফুঁ বলে অবিশ্বাসে মন থেকে ও সব ভয় ভাবনা দূরে সরিয়ে রেখে ছিলাম।   
ঘর থেকে অফিসের দূরত্ব আধ কিলো মিটার থেকে একটু বেশী হবে। আমি কিন্তু নির্ভয় ছিলাম দিব্বি পুল পার করে শর্টকাট পথ ধরে প্রতিদিন পৌঁছে যেতাম আমার অফিসে। পুলের বদনামের কথা বেমালুম ভুলেও গেলাম। দিনের বেলায় রোজ যাই আসি এতে ভয়ের আছেটা কি ?শুরুতে দু একজন আমায় সতর্ক বার্তা দিয়েছিলো বটে,কিন্তু আমি ছিলাম ডোন্ট কেয়ার--
একদিন হঠাৎই অফিসে ইমার্জেন্সী কাজ এসে পড়ল। বস আমাকে ডে র বদলে নাইটে কাজে জয়েন করতে বললেন। এই প্রথম বার রাতে আমায় অফার করতে যেতে হবে। ঘর থেকে বেরিয়ে অভ্যাস মত নদীর ধারে পুল পার করবো বলে এসে দাঁড়ালাম। না মনে ভয় ছিল না। রোজি তো পারাপার করছি পুল,তবে আর ভয় কিসের ? রাত বলে ? মনে মনে ধুস,বলে পুলে পা রাখলাম। অন্য্ দিনের মত আমি রাতেও স্বাভাবিক পা ফেলে ফেলে পুল পার হচ্ছিলাম। আর কয়েক স্টেপ দিলেই পুল পার হবো,ঠিক এমনি সময় আমি পেছন থেকে স্পষ্ট একটা ডাক শুনতে পেলাম,কেউ যেন বেশ গভীর আওয়াজ নিয়ে আমায় ডাক দিয়ে উঠলো,কি আশ্চর্য আমার নাম ধরেই কেউ যেন আমায় ডাকলো, এই প্রদীপ শোন--
আমি চকিত হলাম,মনে মনে ভেবে নিলাম না আমার নাম জানার মত এখানে কেউ তো নেই !
পেছন ফায়ার দেখলাম একটা মাঝ বয়সী লোকের চেহারা--এই আমার থেকে হাত আট দশ দূরে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটার চেহারা তত স্পষ্ট নয়,নরমাল সাদাটে পোশাক পরা। ওর হাত দুটির ওপর আমার নজর এলো, দেখলাম গাঢ় কালো ছায়ার মত তার দুটি হাত। ঈষৎ হাত বাড়িয়ে সে আমায় বলল, এই একটা সিগারেট দেও তো--
গলার আওয়াজ বেশ ভারী। তার হাতদুটি তার শরীরের তুলনায় বেশ লম্বা বলে মনে হল। আমি স্মোক করি না, তখনও কিছু ভাবতে পারছিলাম না,খানিক চুপ থেকে বললাম,আমার কাছে সিগারেট নেই--
লোকটা যেন হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। অফিসে যাবো বলে নিজের তাড়নায় থাকার কারণেই হবে বোধ হয় আমি নির্দ্বিধায় আবার অফিসের দিকে পা বাড়ালাম। আর দু পা বাড়িয়ে পুল পার করতে যাচ্ছিল,ঠিক সেই মুহূর্তে বেশ জোর গলায় পেছন থেকে লোকটা বলে উঠলো, প্রদীপ,কালকে মনে করে আমার জন্যে সিগারেট আনিস কিন্তু ! এবার আমি চমকে উঠলাম গলার আওয়াজে বুকের মাঝখানটা যেন আমার একবারের জন্যে কেঁপে উঠলো। 
--মনে করে এমনি সময় পুলের ওপরে এসে আমায় দিয়ে যাস, কঠোর ও গম্ভীর শুরে লোকটা আবার বলে উঠল।
আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম,ভয়ে আমার মুখ থেকে কোন কথা সরছিল না। দ্রুত অফিসে গিয়ে পৌঁছালাম। অফিসে আমনের সঙ্গে ইতিমধ্যে আমার বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিলো। তাকে সব কথা খুলে বললাম। সে বলল,ওই পুলের বদনামের কথা অনেকবার শুনেছি,তুই আর ওই পথে আসিস না।
পরদিন আমিনকে আমার ঘরে ডাকলাম। ওকে জানিয়ে ছিলাম যে আজ রাতে আমি ওই লোকটার হাতে সিগারেট তুলে দেব। ও ভয়ে ভয়ে বলে ছিল,কি পাগলামী করছিস ?তবু আমার ইচ্ছা বেশ দৃঢ় ছিল।রাতে আমলকে পুল থেকে একটু দূরে দাঁড় করিয়ে আমি ধীরে ধীরে পুলের ওপর চড়লাম।আমি তখন মাঝ পুড়ে দাঁড়িয়ে ভয়ে ভয়ে এপাশ ওপাশ মুখ ফিরিয়ে কাউকে দেখতে পেলাম না। আমি তবু মুখ তুলে বলে উঠলাম,আপনার সিগারেট এনেছি--আমি হাত বাড়িয়ে একটা নয় গোটা এক প্যাকেট সিগারেট শূন্যে তুলে ধরলাম--
যেন দূর থেকে মহাকালের গম্ভীর আওয়াজ ভেসে এলো, হ্যা, প্রদীপ, এই যে আমি নিচ্ছি--কেউ আমার হাত থেকে সিগারেটের প্যাকেট তুলে নিলো বুঝতে পারলাম। পরক্ষনেই একটা কালো অবয়ব আমার সামনে ভেসে উঠলো, উচ্চারিত হল,থ্যাংকস--
তারপর আর কিছু নেই।