গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ২০ মার্চ, ২০১৭

সুবীর কুমার রায়।

   উপহার

তপনের বিয়েতে গিয়ে সেদিন রতনের সাথে দেখা। তপন যে তার অনেক দিনের পরিচিত জানা ছিল, কিন্তু সে যে নিমন্ত্রিত জানা ছিল না। সেও বউ নিয়ে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গেছে। দামি বেনারসি শাড়ি, গলায় হাতে ঝলমলে জড়োয়ায় অপর্নাকে খুব সুন্দর লাগছে। রতন আমার বাড়ির কাছেই থাকে। তিনতলা মার্বেল মোড়া বাড়িতে সে আর অপর্না, না ভুল বললাম, অনেক ডাক্তার, অনেক জ্যোতিষী, মাদুলি তাবিজ করে বিয়ের পনেরো বছর পরে, মাস চারেক আগে তাদের একটি পুত্রসন্তান হয়েছে। এতকিছু আমার জানার কথা নয়, কিন্তু ওদের ও আমাদের, উভয়ের বাড়িতেই শুক্লা কাজ করে। আর মেয়েদের এরকম একটা বার্তাবাহিকা শুক্লা পেলে হাঁড়ির খবর জানবার আগ্রহ শতগুণ বেড়ে যায়।
আমার স্ত্রীর হাতে একটা কাপড়ের প্যাকেট, অপর্নার হাতে রঙিন কাগজে মোড়া কিছু একটা উপহার। অপর্না তার মা’র কাছে বাচ্চাটাকে রেখে এখানে এসেছে, তাই আর দেরি না করে নতুন বউকে উপহার দিয়ে খেতে যাবে। আমার স্ত্রীও ওর সাথে উপহার দিতে যাবে, এমন সময় রতন জিজ্ঞাসা করলো আমরা কি উপহার দিচ্ছি। আমার স্ত্রী জানালো শাড়ি। সাথে সাথে দ্বিতীয় প্রশ্ন, কত দাম নিলো? তপনের সাথে সম্পর্কটা আমাদের খুব ভালো, তাই একটু দাম দিয়েই একটা শাড়ি কেনা হয়েছে। শাড়ির দাম শুনে রতন বললো, “তপনের অবস্থা তো খুবই ভালো, তাছাড়া তোরা দু’জনে আর কতো খাবি যে এতো দামি শাড়ি দিচ্ছিস? আমরাতো একটা বই দিচ্ছি, আমি আর কতো খাবো, অপর্নার কোলে ছোট বাচ্চা, ও তো অর্ধেক আইটেম ছোঁবেই না। অবশ্য বইয়েরও যা দাম হয়েছে, অনামী লেখকের পাতলা একটা বইয়ের দামও ভালোই পড়ে গেল”।
নতুন বউয়ের সাথে আলাপ করে, উপহার দিয়ে আমরা খাওয়া দাওয়া সেরে বাড়ি ফিরে এলাম। রতন যথেষ্টই খেলো, তবে বাচ্চা এখনও বুকের দুধ খায় বলে অপর্না কিছু কম খেলো।
মাস দুয়েক পরে রতন এসে বহু কষ্টার্জিত পুত্রসন্তানের অন্নপ্রাশনের নেমন্তন্ন করে গেল। কয়েকদিন পরে বাড়ির কাজের মেয়ে শুক্লা হঠাৎ বেশ কিছু টাকা ধার চাইলো। মেয়েটা খুব ভালো, তাছাড়া আজ পর্যন্ত কোনদিন সে একটা পয়সাও ধার চায় নি। তাই কোন কথা না বলে তাকে টাকাটা দিয়েই দিলাম। সে মাসে মাসে কিছু কিছু করে শোধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে খুশি হয়ে চলে গেল।
অন্নপ্রাশনের দিন তিনেক আগে শুক্লা কাজ করতে এসে একটা ছোট রূপোর থালা, বাটি, ও চামচ দেখিয়ে বললো যে সে রতনের ছেলের জন্য কিনেছে। আমি একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম “তুই গরিব মানুষ এতো টাকা খরচ করতে গেলি কেন”? সে একটু চুপ করে থেকে বললো “বাচ্চাটাকে জন্মাতে দেখেছি, চোখের ওপর বড় হলো। আমি এতো টাকা কোথায় পাবো বলো? তোমাদের মতো আর সব বাড়ি থেকে কিছু কিছু ধার নিয়ে কিনে ফেললাম। ও তুমি ভেবো না, কয়েক মাস একটু কষ্ট হবে, আমি ঠিক ধার শোধ করে দেব”।