বিদেশিনী এখন সুন্দরবনের বধূ
যে ডুবেছে সে পার হয়েছে !
নোবেলজয়ী এক সাহিত্যিকের হাত ধরে সূদুর দক্ষিণ কোরিয়ার সিওল থেকে আসা এক ১১ বছর বয়সি কিশোরী ভালোবেসেছিল শালুক ফুলে ভরা নোনা জলে ঘেরা বাংলার নদী মাঠকে। সে যে রবীন্দ্রনাথের “চন্ডালিনী”-র মধ্যে নিজেকে দেখেছে । খুঁজেছে সেই মন পাগলকরা সন্ন্যাসী-কে । হঠাত করে সুন্দরবনের গ্রাম্য এক কিশোরের সারল্য মুগ্ধ করেছিল তাকে । মনে মনে ঢুকে গিয়েছিল সেই
কিশোরের হৃদয়ে। কেটেছে মাঝে ১২ বছর। শিউলি ঝরা হেমন্তের শিশিরের মতো নিভৃতে প্রেম এসেছিল বিদেশিনীর হৃদয়ে।
জানাজানি হতেই সুদূর কোরিয়া থেকে এসেছিল পাহাড় প্রমাণ পারিবারিক বাধা । ঘোরতর বেড়াজালে আটকে রেখেছিলেন মা বাবা সেই কিশোরী-কে। কিন্তু সেই কিশোরীর প্রেমের সাধনার জেরে সমস্ত প্রতিবন্ধকতা জয় করে সিওল প্রবাসী বাবা-মা সম্মত হলেন। ছুটে এলেন সুন্দরবনে। ঘুরে দেখলেন নদী-জঙ্গলভরা বাসিন্দাদের। পেরিয়ে এলেন বাধা টোপের ওপারে। এবং অবশেষে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন সেই প্রেমিক-প্রেমিকা।
পাত্রের
নাম মুকুল হাসান। বয়স ৩২। বাড়ি ভাঙরের
পদ্মপুকুরে। পাত্রী দক্ষিণ কোরিয়ার সিওলের বাসিন্দা জিনি-ইয়া-ইয়ং। বয়স ২৩। এদিন সকাল থেকেই
বিয়ে বাড়িকে কেন্দ্র করে তুমুল আগ্রহ ছিল সুন্দরবন লাগোয়া গোটা ভাঙড় জুড়ে। কয়েকশ মানুষ আমন্ত্রিত ছিলেন বিয়ে বাড়িতে।
বড় বড় গাছের
ছায়ায় ভিয়েন বসেছিল আর ভাত-ডাল-মাছ-মাংস-রসগোল্লা কবজি ডুবিয়ে খেয়েছেন কোরিয়া থেকে আসা কনেযাত্রিরাও । বেজেছে সানাই। কনের আবদার মেটাতে বাজাতে হয়েছে রবীন্দ্রসংগীত। হবে নাই বা কেন ? কোরিয়ার কনে যে রবীন্দ্রনাথে ডুবে থাকেন । গুরুদেবের দেখানো পথে হেঁটেই তো তিনি আজ থেকে নিজের করে পাচ্ছেন মুকুলকে । রবীন্দ্রনাথের মনেও তো বারে বারে উঁকি দিয়েছেন ভিনদেশি বিদুষীরা ।
বিয়ের
আসরে দাঁড়িয়ে এদিন ঝরঝরে বাংলায় জিনি-ইয়া-ইয়ং-এর উত্তর, “ তা জানি না। মুকুল আমার জীবনে আসে সেই কিশোরীবেলায়। তারপর জানি না কবে আমাদের প্রেম হল। প্রথম থেকেই জানতাম বাধা আসবে । কিন্তু মুকুলের জন্য আমি ধৈর্য্য ধরেছি, অপেক্ষা করেছি। কারণ, একদিন না একদিন আমার ভালবাসার কাছে সবাইকে হার মানতেই হবে। তাই, আজ আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মেয়ে।” ধর্ম কিংবা ভাষাগত তফাত কখনই তাঁদের মধ্যে প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায়নি।দমিনিক-লা-পিয়েরের হাত ধরে ১২ বছর বয়সে এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে এদেশে আসেন জিনি। মুক্ত আকাশ, বাতাসের লবনাক্ত গন্ধ, মানুষের সারল্য তাকে মুগ্ধ করেছিল। দু'জন প্রেমে পড়েছিল। জানানো
হয়েছিল কোরিয়ান এবং ভারতীয় অভিভাবকদের । প্রথমে রাজি না হলেও পরে যুগলের প্রেমকে স্বী্কার করে নেন দুই পরিবারের সদস্যরা ।
কোরিয়া থেকে কনেযাত্রী হিসেবে ২৮ জনের একটি দল আসে। সারাদিন গোটা দল-ই ঘুরেছেন সুন্দরবনে। নোনা
জলের হাওয়া দেখে কেন যে মেয়ে এত ব্যাকুল তা বুঝে নিয়েছেন বাবা মা। মুকুলের বাবা এম এ ওহাব, মা বেগম সাজেদা ওহাব রাতে দেখভাল করেছেন অতিথিদের। ছিলেন দমিনিক-লা-পিয়ের। এসেছেন জিনির বাবা ও-ই-কিং এবং মা ই-ইউ-চুং। ভাষা কোনও বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে না তাঁদের কথোপকথনে। রাতে জিনি-মুকুলের বিয়ে শেষে আনন্দে মেতেছিলেন সকলে। ওদিকে কোরিয়ান আর ভারতীয় মিলেমিশে এক অদ্ভুত রাবিন্দ্রীক নাচ। জিনিও কোমরে আঁচল গুঁজে মুকুলের দিকে হাত বাড়িয়ে তার প্রিয় রবীন্দ্রসংগীত “আজ দখিন দুয়ার খোলা/এসো হে এসো হে এসো হে” নাচে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল সবাইকে ।
এই কি সেই
মেয়ে যাকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, নয়ত এরকম নিখুঁত নাচ নাচছিল সে কিভাবে। জিনির মা বাবার চোখে আনন্দাশ্রুতে চিক চিক ভাব।
'