গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়


করণিক


কদিন ধরেই একটানা বৃষ্টি হয়েই চলেছে, থামার কোন নাম নেই। আজও অফিস যাবার সময় বিরক্তি বোধ করল অতসী। গত কালকের শাড়ী, সায়া এখনো ভিজে ভিজে হয়ে আছে। কাল ফিরতে রাত হয়েছিল, ভাল করে শুকোবার সময় পায়নি। এখন সাতসকালে উঠেই আবার অফিস যাবার তাড়া। বাইরে পরে যাবার খুব বেশি ভাল শাড়ী, জামা নেই অতসীর । হাত দিয়ে শাড়ীর পায়ের দিকে ফলস পাড় লাগানোর জায়গাটা একবার দেখল, ভিজে রয়েছে অনেকটাই। নিরুপায় হয়ে একটা ধোওয়া শাড়ীর পাট ভাঙল অতসী। অফিস থেকে ফিরে কালকের শাড়ীটা ইস্ত্রি করে রাখতে হবে। সত্যি, তাদের মত মানুষদের কি অবস্থা ! আর ওদের দ্যাখো, মনে মনে মিত্র বাড়ির লিপিদির কথা ভাবল অতসী। গাড়ি করে অফিস যায়, আসে। বৃষ্টিতে ভিজতে হয় না, দেদার জামাকাপড়। এক বুক চাপা নিঃশ্বাস ফেলে বাথরুমে ঢুকল অতসী।

খাওয়া-দাওয়া, সাজপোশাক সব সেরে ব্যাগ গুছিয়ে অফিসে যখন বেরোল তখন ঠিক নটা বেজে দশ ন্মিনিট। আজ পাক্কা পঁচিশ মিনিট লেট। বাস না পেলে কপালে লাল কালি লেখা আছে। বাড়ির সামনের রাস্তাটা পেরিয়ে বাসস্টপে এসে দেখল, লীলা, কণিকা, মানসীদিরা সব দাঁড়িয়ে। কি ব্যাপার, আজ সবাই দাঁড়িয়ে কেন ! ওর নাহয় দেরী হয়েছে, কিন্তু এরা যায় নি কেন? মুখে একটা প্রশ্নচিহ্ন করতেই মুখ ব্যাজার করল মানসীদি। কি ব্যাপার... না বাস এখনো আসেনি, এই রুটে বোধহয় কিছু গোলমাল হয়েছে। এখন থাকো বসে ! সকলেই কাছাকাছি থাকে। একবাসে অফিস পাড়ায় যাবার সুবাদে সকলের সঙ্গেই পরিচয়। সকলে এক অফিসে নয়, কিন্তু একসঙ্গে এক জায়গাতেই নামে, ওঠে- তারপর যে যার অফিসে। সে সূত্রেই বন্ধুত্ব। আজ বসের গোমড়া মুখ, লাল কালির দাগ এই ধরণের আলোচনা চলছে বোঝা গেল। এসে দেখল লীলা ছেলেমানুষের মত এখানে রাস্তাতেও কণিকার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এটাই স্বভাব লীলার। রাস্তা পার হবার সময়েও কারো না কারোর হাত ধরে থাকে। বেশ ছড়িয়ে ছিটিয়েই সকলে দাঁড়িয়ে আছে। একটু দূরে আরো কয়েকটি ছেলে-ছোকরা এবং দুটি উঁচু ক্লাসের ছাত্রীও পিঠে ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে বাসের আশায়। হঠাৎই পিছনে গাড়ির হর্ণ শুনে চমকে কণিকার হাত ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায় লীলা। সকলে একটু সরে দাঁড়াতেই হুস করে পেরিয়ে গেল লাল গাড়িটা। লিপির সঙ্গে চোখাচোখি হল অতসীর। হয়তো হাতছানি দিয়ে ডাকবে ওদের, এমনটাই ভেবেছিল অতসী। গাড়িতে একটিমাত্র প্রাণী, দু-চারজন মেয়ে বা মহিলা কে সঙ্গে নিয়ে যাবার তো কোন অসুবিধে ছিল না, তাছাড়া এখন অফিসের সময়, বৃষ্টিও হয়েছে, বাসের জন্য সবাই দাঁড়িয়ে...কিন্তু মুখের বিস্ময় মুখেই মিলিয়ে গেল‘ইস, হাত তুল্লেই হত...বলে অতসী। ‘ছাড়তো, বড়লোকের ব্যাপার, না থামিয়ে ভালই করেছিস...’-- অতসীর অপ্রস্তুতের হাসি দেখে বলেন মানসীদি। ‘ঠিক বলেছেন মানসীদি, পরে কথা শুনতে হত’-- বলল লীলা। খারাপ লাগছে অতসীর। ঠিক দুটো বাড়ি পরেই থাকে লিপিদিরা। অথচ এমন ভাবে গেল, যেন চেনেই না। অতসী দেখেছে, ওদের ছোট কিন্তু ঝকঝকে বাড়িটাকে। তুলনায় অনেক বড় বাড়িতে থেকেও অতসীদের বাড়ির কোন ছিরিছাঁদ নেই। কবেকার ঠাকুরদাদার আমলের বাড়ি। রঙ চটে গেছে জায়গায়, জায়গায়, পলেস্তরা খসা। সত্যি, রঙ্ করলে এই বাড়িটাই হবে পাড়ার সেরা বাড়ি। অতসীও জানে, এত বড় বাড়ি এ তল্লাটে আর নেই। তার নিজেরও খুব ইচ্ছে, আরো একটু চাকরিটা ভাল হলে, একটা প্রোমোশন হলে সে একটু একটু পয়সা জমিয়ে বাড়িটাকে সুন্দর করে সাজিয়ে তুলবে। ইস, মা যে কি খুশি হবেন...ভাবল অতসী, ভাইও। এই তো সেদিন, নীলাদ্রি, ভাই এর বন্ধু বলছিল--তোদের খাবার ঘরটা কি বড় রে... ফুটবল খেলা যায় ! নীলাদ্রির কথা শুনে দিদির মুখের দিকে তাকিয়ে হেসেছিল টুটুল। অতসীও মুচকি হেসেছিল। কিন্তু এবার খুব বিরক্তি বোধ করছিল অতসী। আর কতক্ষণ এভাবে দাঁড়াতে হবে কে জানে ! এর চেয়ে বাড়ী চলে যাওয়াই ভাল। নাহয় একটা লিভ নষ্ট হবে, কিই বা করার আছে তার! ভাবতেই একটা হই চই...বাস আসছে। ছুটল সবাই, যে ভাবেই হোক, বাসে উঠতেই হবে। টানা, হ্যাঁচড়া করে উঠতে গিয়ে পায়ের কাছে একটা টান অনুভব করল অতসী। গেল নাকি, সেরেছে ! ফ্যাঁস করে কি যেন মনে হল...বাসের পাদানিতে আটকে গেছে তার শাড়ী। টেনে নিয়ে উঠে পড়ল সে। যা হবার হবে, অফিসে গিয়ে দেখা যাবে। কি আর করবে সে, অফিসে গিয়ে নাহয় শাড়ীটা উলটো করে ঘুরিয়ে পরে নেবে। দুঃখে কান্না এসে গেল তার। আজ যেন জানত কিছু একটা হবে। এত ভাল শাড়ীটা গেল। কটাই বা আছে, যে একটা গেলে আরো একটা হবে ! অফিসে গিয়েই বাথরুমে উলটো করে শাড়ীটা পরে নেবে, কেউ দেখার আগেই। নাহলে নিজেই পা জড়িয়ে পড়ে যাবার সম্ভাবনাও আছে। আরো গোটা দুই শাড়ী তার না হলেই নয়। একটা প্রোমোশন হলে আগেই তার কিছু কিছু জিনিস কিনে ফেলতে হবে। অতসীর আগে ধারণাই ছিল না এত কিছু লাগে। কিন্তু বাইরে বেরিয়ে দেখেছে, কিছু কিছু জিনিস না কিনলেই নয়। এতদিন বাড়িতে বসে থাকার জন্য এগুলোর প্রয়োজন সে অনুভব করেনি, আজ বুঝতে পারছে, এর প্রয়োজন। অফিসেও শুনেছে, কয়েকজনের নাকি প্রোমোশন হয়েছে, তারা শিগগির তিনতলায় শিফট করবে। নতুন করে তিনতলা সাজানো হচ্ছে তাও দেখেছে। আজ একবার দোতলার কানুদার কাছে যেতে হবে খবরটা নিতে কানুদা মাঝে মাঝে এমন সব কথা বলেন ! একদিন বললেন...এই করণিক মানে তো কেরাণী, তাহলে মেয়ে কেরাণীদের কি বলে রে, আরে, তোরা তো বাবা সব মেয়ে কেরাণী।
সেদিন মল্লিকা খুব রেগে গিয়েছিল। কেন, আমরা কেরাণী তো কি কানু দা, তারা কি মানুষ নয়! সত্যিই তো, সেও তো কেরাণীই। দুর...কি হবে এসব এত আগে থেকে ভেবে--অফিসের সামনে বাস থেকে নামতে নামতে ভাবল অতসী। তাড়াতাড়ি চোখ এড়িয়ে নিজের জায়গায় ঢুকে পড়তে চায় সে।

ভেতরে ঢুকেই ত্বরিত পায়ে এগিয়ে গেল মেয়েদের সাজঘরের দিকে। সাজঘর না আরো কিছু! দোতলার কানুদা মেয়েদের বাথরুমকে বলেন সাজঘর। ভালো মেজাজে থাকলে হেসে হেসে কথা বলেন কানুদা—‘কি করিস রে তোরা সাজঘরে গিয়ে। এমনিতেই তো ঘটার শেষ নেই, আবার অফিসেও কেন বাবা, পারিস ও তোরা’! মল্লিকা মাঝে মাঝে খুব ঝগড়া করে কানুদার সঙ্গে। না, ঠিক ঝগড়া নয়, খুনসুটি বলাই ভালো। ‘বেশ করি , ঘটা করি ! আহা, আর লুকিয়ে লুকিয়ে মেয়েদের দেখার বেলা, তার তো কমতি নেই’ !! ছদ্ম রাগে বলে মল্লিকা।
‘এ কি রে, কি বলে মেয়েগুলো... রাম বলো ! তোদের দিকে কে তাকাবে বাবা, তোমরা সব এক একটি অসুর-দলনী দুর্গা’...বলেই হো হো করে হেসে ওঠেন কানুদা। বয়স্ক মানুষটির সস্নেহ হাসি ভাল লাগে অতসীর। আজ একবার যাবে কানুদার কাছে, খোঁজ নেবে সেই প্রোমোশন লিস্টের ব্যাপারে  

সাজঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে টেবিলে গুছিয়ে বসতেই না বসতেই হাঁক ‘...অতসী মজুমদার...... বড় সাহেব ডাকছেন’-- বেয়ারা পূরণচাঁদের হাঁক। অতসীর টেবিলের তিনটে টেবিল ওধারে বসেন বাসুদেব দা, কানুদার চেয়েও বড়, আর মাত্র তিনমাস পরেই রিটায়ার করবেন, অতসীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। যার অর্থ...যাও, বড়সাহেবের চাঁদ মুখখানা দেখে এস। আজ তোমার হচ্ছে। যেমন দেরী করে আসা...উপায় কি! মুখে বিরক্তির ভাব করল অতসী। আজ অনেক দেরী হয়েছে, সে জানত এমনই কিছু হবে। রোজ রোজ দেরী হলে বড় সাহেব কি ছেড়ে দেবেন কাউকে, দোষ তো তাদেরই। মনে মনে প্রস্তুত হয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে বড় সাহেবের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল সে। সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এল হাতে একটা বড় সাদা খাম নিয়ে। ভয়ে মুখ সাদা। ভাবতে পারছে না, কি হবে। কোন কথা না বলে নিজের টেবিলে এসে বসল, তারপর ঢকঢক করে এক গেলাস জল খেল। বুঝতে পারছে সামনের টেবিলগুলো থেকে সবাই তার দিকে তাকিয়ে। কারো দিকে তাকাল না অতসী। কেমন যেন লজ্জ্বা, অপমানের মত লাগছে। খামের মুখ ছিঁড়ে একবার, দুবার চিঠিটা পড়ল... আর তারপরই মুখ গুঁজে দিল টেবিলে।
ওপাশ থেকে ছুটে এলেন বাসুদেবদা, মল্লিকা। কানুদার গলাও শোনা গেল।
--
‘কি হয়েছে রে, কি লিখেছে বড় সাহেব, দেখি...’ হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিলেন কানুদা। আর তারপরই চীৎকার করে উঠলেন ‘...মারব একটি থাপ্পড়, বড় দাদাদের সঙ্গে ইয়ার্কি হচ্ছে, না! তুমি ফাজলামো করছ, প্রোমোশন পেয়েছ তুমি, এবার থেকে তোমার অফিস তিনতলায়, বুঝলে করণিক অতসী মজুমদার...না না, সরি, জুনিয়র লেবার অফিসার মিস অতসী মজুমদার। এবার থেকে কোম্পানীর গাড়ি দেওয়া হবে তোমায় অফিস আসা-যাওয়ার জন্য। আরে, তুই তো একই গাড়িতে আমার সঙ্গে আসবি রে !’ -- আনন্দে লাফিয়ে ওঠেন কানুদা।  মুখ তোলে অতসী। চোখে জল... ‘না কানুদা, আমি একা না, ওই লীলা, মানসীদি আর কণিকাকেও সঙ্গে নেবো, ওরা নেমে যাবে আমাদের অফিস মোড়ে। বৃষ্টিতে খুব কষ্ট হয়, আপনি না বলবেন না... বাস না এলে..’ আর বলতে পারে না অতসী। হাসিমুখে অতসীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন বাসুদেবদা। বড় সাহেবের কাছে তিনিই অতসীর নামটা রেকমেণ্ড করেছিলেন  করুক, একজনের জন্যও যদি কিছু করতে পারে অন্যের জন্য,করুক না ! এভাবেই তো শুরু। তিনিও তো চেয়েছিলেন অতসীর জন্য। এগিয়ে যাক অতসীরা। পারবে, ওরাই পারবে এগিয়ে যেতে, স্বপ্নপূরণ করতে একদিন।