পাগল
বিকল কলের নীচে
ফোঁটা ফোঁটা জল।
সেইস্থল ঘন শ্যামল।
তৃণ তো বলে না তাকে
লোকে।
সেই সব প্রশস্ত ফার্ন
খেয়ে বেড়ে ওঠা গরু
তার জিভে ঘাসের প্রকৃত স্বাদ
ভুভুজেলায় আড় বাঁশির
উপরিপাত
কোনো ভাবে নয় ঘাস।
সেই সব গবাদিরা
শৈবালজীবি না পাগল
না কী সঙ্গত ভাবে কবি?
ফোঁটা ফোঁটা জল।
সেইস্থল ঘন শ্যামল।
তৃণ তো বলে না তাকে
লোকে।
সেই সব প্রশস্ত ফার্ন
খেয়ে বেড়ে ওঠা গরু
তার জিভে ঘাসের প্রকৃত স্বাদ
ভুভুজেলায় আড় বাঁশির
উপরিপাত
কোনো ভাবে নয় ঘাস।
সেই সব গবাদিরা
শৈবালজীবি না পাগল
না কী সঙ্গত ভাবে কবি?
পাড়ার জীবনদাকে আমার কৈশোরে দেখা। ওঁকে সম্বোধন করতে কারোকে শুনিনি। অনুপস্থিতিতে প্রসঙ্গোত্থাপন হলে সবাই অবশ্য জীবন
পাগলাই বলত। খ্যাত ও কুখ্যাতদের যেটা হয়-
বাবাও যে সম্পর্ক ধরে ডাকেন- ছেলেও তাই। তা
জীবনদা ছিলেন পাড়ার ছেলে বুড়ো সবারই দাদা। মার্জিত ভাষী। মৃদু কন্ঠী। চৌধুরী বংশ
জমিদার বংশ সেই কুল জাত। সিঁদুরে আমের মত গায়ের রং। মধ্যম উচ্চতা দীর্ঘ নাসা। দীঘল
চোখ। কিন্তু পাগল। জ্ঞাতিরা ওঁর পৈতৃক সম্পত্তি হাতিয়ে নিয়ে
প্রায় গৃহচ্যুত
করেছিল। বিশাল প্রাসাদপ্রম বাড়ি। বারবাড়ির একতলায় দরজা জানলাহীন এক
প্রাচীন প্রকোষ্ঠে রাত কাটাতেন তিনি। আর দিনের বেলা পাড়ার
অলিতে গলিতে। খিদে পেলে, চেনা বাড়ির ফটকে
দাঁড়িয়ে ডাক পারতেন। আমার ঠাকুমা গ্রামসম্পর্কে ওঁর বৌদি। কত শুনেছি বিরল
কম্পাঙ্কের সেই ডাক- যেন চক্কররত বোলতার পাখার আওয়াজ- বৌদি...ই...ই...ই খেতে দিন...ন...ন...ন। কখনও হয়ত
দিদিয়া, আমরা ঠাকুমাকে ওই নামে ডাকতাম,
বলতেন- জীবন চান করেছ ?
যাও করে এস । অমনি জীবনদা শানেরঘাট,
মানে সামনের পুকুর থেকে একটা ডুব গেলে আসতেন । মোছামুছির বালাই নেই, আর কী
করেই বা গা মোছা যায়, কাপাস বলতে তো
উর্দ্ধাঙ্গ নিরাভরণ, নিম্নাঙ্গে প্রলম্বিত
ছেঁড়া শার্ট, যার হাতা দুটি কোমরে বেল্টের মত করে
বাঁধা। সেটা তো প্রকাশ্যে উন্মোচন করার নয়। তাই গা মোছারও ব্যাপার নেই। ভাইপো
ভাইপোবৌরা আছে, পাড়ার ভেতর সর্বদা ঘুরছে ফিরছে।
অগত্যা সিক্ত তনু রৌদ্র কর বিচ্ছুরিত মাণিকদ্যোত জীবনদা হাজির। হাতে এক
বিশাল মানকচু পাতা, ভাত খাওয়ার জন্য
পুকুরপাড় থেকে সংগৃহীত।
এই জীবনদা দেখি একদিন,
রাণুদের বাড়ির সামনে দিয়ে যাচ্ছেন, হাতে এক
পরত শুকনো রুটি। রাণুদের রোয়াকে শুয়ে আছে এক পশ্চিমাগত মুটে। হয়তো
আজ কাজ জোটেনি, উপোস থাকাও অসম্ভব নয়। নয়তো
খেটেখুটে এসে হাত-পা চাড়িয়ে নিচ্ছে। জীবনদা হঠাৎ করে তাকে জিজ্ঞেস করলেন- খেয়েছিস? খা
না একটা রুটি...রুটি...রুটি...রুটি। এই ছিল জীবন পাগলা ।
আমার জানা নেই অমন্ত্রিত সেদিন রুটি
খেয়েছিল কি না । কাল্দার
ভালো নাম কি হতে পারে একটু অনুমান লাগাই ...ধরুন কালাচাঁদ। তবে আলাপন কালে
মেজজ্যেঠু ওকে কাল্দা বলেই সম্বোধন করতেন। বিশেষ ভ্রাম্যমান ছিলেন না । বিশাল এক পোড়ো বাড়ি- ওঁকে
ছাদে দেখতাম পায়চারী রত। আমার জন্মের এগারো বছর এক মাস এগারো দিন আগে দেশ ভাগ
হয়েছিল। সুতরাং এ পাড়ায় তাঁর সপরিবার পত্তনের সময়টা সঙ্গত ভাবেই দেখিনি,
তবে অনেক শুনেছি মেজজ্যেঠুর কাছে । একহারা গড়ন। ছ ফুটের বেশী উচ্চতা। চামড়ার রঙ ঘোর কালো । একদিন দেখি শানেরঘাটের ভাঙ্গা ঘাটের সিঁড়ির প্রথম ধাপে। পূর্ণ নিরাভরণ। সেটা বড় অসাধারণ নয়। কেন
না চান করে ওঠার পর ধুতিটা শুকোতে দিতেন ঘাটের পাশেই,
আমদের বেহাত হয়ে যাওয়া জমিটাতে। শুকোলে,
পরে বাড়ি যেতেন। সেদিন দেখি বারবার নতজানু হয়ে বসছেন,
সূর্য প্রণামের মুদ্রায় প্রণাম করছেন, পূব পানে।
অথচ সূর্য তখন মধ্য গগনে। আঁজলা ভরে জল নিয়ে পুকুর পাড়ের লতাগুল্ম আগাছাগুলোকে
দিচ্ছেন। যেন পিতৃ তর্পণ । গণ্ডুষ ভর জল নিয়ে আচমন
করছেন। যেন স্বপিণ্ডকরণ। কাছে গিয়ে শুনি মন্ত্র পড়ছেন- নীল যমুনার জল/ ওপারে রাজশাহীর আলো/ আমারে লয়া চল/।
অন্ধের মতন পাগলেরও কী বা রাত কী বা
দিন! সতুদার পোশাকি নাম পাড়ায় যাঁরা
জানতেন তাঁরা ইহলোকে নেই। ওনাকে দাদা ডাকার বিষয়টাও জীবনদার আখ্যানের অনুরূপ। ওঁর
পাগলামির অশেষ নমুনা। তখন নতুন গুড়ের সময়ে সত্যি সত্যি দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা থেকে
বাঁকে বয়ে নাগড়ি, মাটির কেঁড়েতে কোরে চাষীরা নলেন গুড়, পাটালি নিয়ে আসত। সহরতলির অলিগলিতে ফেরি করত। সে রকম এক জনকে
ডাকলেন সতুদা । গুড় চাখলেন। স্ত্রীকে
চাখালেন। ছেলে মেয়ে কুল্লে আট। সব্বাইকে চাখালেন। সবাই হাতের
তালুতে নিয়ে চেখেটেখে এ ওর মুখ চাওয়া-চায়ি করছে। অবশেষে রায় দিলেন সতুদা
স্বয়ং- জল ভাগ বেশি...জল ভাগ বেশি । গুড় বিক্রেতা কালক্ষেপ না করে সেখান থেকে বিদায় হল। সতুদার
পদবী মৈত্র ছিল। অঞ্চলের খাঁড়া বা রক্ষিতদের চোখে ওরকম
পদবীধারীরা পূব বাংলার, সে অভিমত আজও
প্রতিষ্ঠিত। যেমন আমি। পদবীতে বয়ে চলেছি সেই পরিচিতি,
যদিও অভিবাস ঘটেছিল, সে রকম প্রতিপাদন
পারিবারিক নথি সুত্রে কোথাও পাইনি। বরং যে টুকু জানি,
হয়ে থাকলেও সে বাংলায় ব্রিটিশ গেড়ে বসার আগের ইতিহাস।
তা দেশ ভাগের পর ওপার থেকে আগত
সংবিগ্ন পরিবারকুল যখন এ পারের বিভিন্ন অঞ্চলে বসত অভিপ্রায়ে ছড়িয়ে পড়ছিলেন,
সে সময়ই আমাদের পাড়ায় আসেন দত্ত পরিবার। দত্তরা জীবিকা পরম্পরায় স্বর্ণবণিক।
সৌভাগ্যক্রমে ডামাডোলের ভেতর পারিবারিক ঐশ্বর্যের অনেকটাই সঙ্গে আনতে পেরেছিলেন। এ
দিকে সতুদা ও ওনার স্ত্রী চামেলিদি, পাড়ারই
ছেলে মেয়ে। হলে কি
হয়, ওনারা নাকি অপ্রকৃতিস্থ যুগল। অন্তত চৌধুরীদের জমিদারী সেরেস্তা
থেকে সে কথাই প্রোথিত করা হয়েছে আবাসীদের কানে ও মনে। ফলত তাঁরা গ্রামে,
মানে আমার সময় অবশ্য পাড়া, একঘরে।
আমাদের পাড়ার লোকেদের তদানীন্তন পেশা, যেমনটা
বিদ্যাসাগরের রচনায় উল্লেখ আছে, 'সওদাগরী
হৌস'-এ চাকরি। ব্রিটিশ রাজের সেই গোলামির
তকমা পেতে গেলেও সুপারিশ দরকার, সেই
সুপারিশ গ্রামের কোন প্রভাবশালী ব্যক্তির থেকেই আসত। কিন্তু সতুদার ক্ষেত্রে
উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে সে রাস্তা বন্ধ। সতুদা বাপ মা মরা ছেলে,
ছেলেবেলায় প্রতিবেশীর অনুগ্রহ উচ্ছৃষ্ট ও স্নেহে পালিত। থাকার মধ্যে বড়সর একটা
দ্বিতল কোঠা।
চামেলিদির জন্ম আখ্যান শকুন্তলা প্রম। যদিও মাতৃহারা হওয়ার আগে বেড়ালিনীর মত তাঁর মা তাঁকে পড়ারই মধ্যে এ ঘরের আনাচে সে ঘরের কোনায় রেখে লালন করেছেন, আর চামেলিদিও মালিনীর মত নির্ভয়ে বেড়ে উঠতে থেকেছেন। সেই বাড়ন্ত বয়েসে তেরো বা চোদ্দ যাই হোক, সতুদার সতেরো বছর বয়েস সতেরটি প্রমোদ পোতের ঝাঁক হয়ে ভিড়েছিল চামেলিদির জীবনে, কে জানে ভ্রমে না জাগরণে। শোনা যায় গ্রামের এক ধনী তিলি পরিবারের ছেলের নজর থেকে বাঁচাতেই সতুদাকে সক্রিয় হতে হয়েছিল।
পাড়ায় প্রথম এসে দত্তরা এক পোড়ো বাড়ির
একটি মাত্র কামরায় সপরিবার ভাড়া থাকতেন। ওঁদের বড় পরিবার। সঙ্গতিও আছে। কেনার জন্য
বাড়ি খুঁজছিলেন। এদিকে দত্তদের ছেলের সাথে সতুদার সখ্যতা ধীরে ধীরে গভীর হচ্ছে।
প্রতি দিনই তাদের বাসস্থানের অসংকুলান সতুদা শুনছেন । পবিত্র দত্ত শুনছেন সতুদার প্রবল অনটন। নাম মাত্র ভাড়ায়
সতুদা বন্ধুর পরিবারকে তাঁর বাড়িতে থাকতে দিলেন। সময়ের সঙ্গে বাড়িটা বিক্রি হয়ে
গেল। অর্থের বিনিময় সতুদা দত্তদেরই বেচে দিলেন। পাড়াতেই পৈতৃক এক চিলতে জমি। টালির
চালা বানিয়ে সপরিবার। কিন্তু প্রবল আক্রোশ তৈরি হোলো দত্ত
পরিবারের প্রতি। যেমন ধরুন, পবিত্র দত্তর দিদিকে
পাত্র পক্ষ দেখতে এসছে, বাড়ি খুঁজতে খুঁজতে সতুদার
কাছে অন্বেষা চক্রে পৌঁছে গেছে। সতুদা প্রকাশ্যে তারস্বরে ভাঙচি দিতে শুরু করলেন।
বলুন, পাগলামি ছাড়া কী! এ সব ঘটনা আমার জন্মের আগের। আমি পরবর্তী কালে সংগ্রহকৃত তথ্য থেকে বলছি ।
সতুদার বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ,
গিনিপিগ জ্ঞানে পর্যবেক্ষণ চালানোর প্রেরণা ছিল একটা ঘটনা। ১৯৭১ সাল। আমার
বয়েস বারো ও তেরোর মাঝখানে। একদিন ভোরবেলা ঘুম ভাঙলো বড়োদের চাপা গুঞ্জনে। উঠে
দেখি সতুদা আর চামেলিদিকে পেটে পাটের দড়ি বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে,
নীল উর্দি ইংলিশ টুপি পরা পুলিশ। জানা গেল পবিত্র দত্তকে পাওয়া গেছে সতুদার
বাড়ি থেকে। কিছুদিন হল সন্দেহমূলক রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। পুলিশ খুঁজছিল। ফেরার
ছিলেন। পাড়ার ভেতর কানাকানি- আশ্চর্য! পবিত্র আর সতুদা যে দীর্ঘকাল অহি-নকুল!
গতবছরেও আনন্দবাজার পত্রিকার ওয়েবসাইটে
প্রত্যেক ব্লগের নীচে পাঠকদের লেখার জন্য মেসেজ বক্স ছিল। মন্তব্য লিখলে প্রকাশিত
হত। পাঠকদের মন্তব্য পড়া যেত। সদ্য প্রয়াত সাহিত্যিক শ্রদ্ধেয়
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ব্লগটা দেখি এখনও দৃশ্যমান। ওনার একটি ব্লগে পাগলদের বিষয়ে
একটা লেখা ছিল। আমি ওতে মন্তব্যও লিখেছিলাম, অনেকদিন
সেটা সাধারণ-গোচর ছিল। তা পাগলদের ব্যাপারে আমার একটু বিশেষ আকর্ষণ হয়ত সঙ্গতই। আমার
ঘনিষ্ঠরা, আত্মীয়রা
এখনও আমাকে পাগল অভিধা দেন।
মিত্রপক্ষ সাই
মিত্রপক্ষ সাই
শাইনিং ইন্ডিয়া
বিড়ি জ্বালাইলে জিগর সে পিয়া... কি সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার ভায়া। ঐ কন্যার জিগর থেইক্যা নাকি আগুন জ্বলে ! সেই আগুনে আবার বিড়ি ধরে ! খারাপ না ব্যাপারটা । মনটা খারাপ হইয়া গেল সকাল বেলাতেই গানটা শুনে। ‘আমার প্রিয়ার জিগরে শুধু জল ক্যানে !’
মুম্বইয়ে কি মেয়েদের জিগর থিক্যা আগুন জ্বলে নাকি! আবার কলকাতা কয়, শূন্য এ বুকে...। বাংলাদেশ রেডিও আরও একটু সেন্টু সেন্টু সুরে বাজায়, ‘পাখী মোর আয়, ফিরে আয়, ফিরে আয়...’।
দূর আজকাল এতো সেন্টু নিয়ে ডাকলে পাখীও পালায়! শুরুটাই করতে হবে আমাকে আমার মতো থাকতে দাও, দিয়ে। মানে কোন অবস্থাতেই বলা বারন, তোমার মনের কন্ডিশান। মুখে দাঁড়ি থাকতে হবেই। না হলে সিকোয়েন্স টা ঠিকঠাক জমবে না। বিড়ি টাইপের কালার হতে হবে শরীরের। কিন্তু ওয়াইল্ড স্টোন রাখতে হবে। পকেটে না বুকে ধরে রাখতে হবে পাথর, বুঝলে ভায়া! পাত্থরেরও নাকি আবার গন্ধ থাকে!
বিড়ি বেশ সেন্টিমেন্টাল টাইপের হয়। মানে জ্বলে দুমদাম করে। কিন্তু একটু না টানলেই নিভে যায়। একটু অবজ্ঞা মানেই লেপের তলে সিটিয়ে থাকা নতুন বউয়ের নাক ডাকা। সিগারেটের কিন্তু সেই অর্থে এতো সেন্টু নেই। জীবন দিয়ে জ্বলবে। নিঃশেষে প্রান যে করিবে দান, ক্ষয় নাই, তার ক্ষয় নাই... টাইপ। হৃদয় একদম জ্বালাইয়া ছাই কইরা তবে তবে ছাড়ব। একদম কর্পোরেট দের মতো বিহেভ। রিফাইন্ তামাকের গুন নেই। একদম খাটি নেপালি তামাকের সাথে সিগারেটের তামাকের তুলনা চলে! আমার হৃদয় ঐ নেপালী বিড়ির পাতার মতো। সর্বদা শূন্য এ বুকের মতো খাঁ খাঁ করে।
সকাল সকাল এই গানটা কানে আসতেই কত স্বপ্ন যে দেখে ফেললাম, লেপের তলায় ! সেটা সেন্সর করা। বলা বারন। স্যরি উসখুস কইরা কোন লাভ নেই। এমন কিছুই ঘটেনি। এটা হিন্দি ফিল্ম জিসম পার্ট ফোর নয় ভায়া ।
মনটা শান্ত থাকা ভীষণ জরুরী পরবর্তী অংশ সহ্য করতে। আজকাল কথায় কথায় গান। সোনালী গানের এই এক সুবিধে সিকোয়েন্স বুঝে বোতাম টিপলেই হলো। সব রঙ্গিন, সব উত্তর হাতের কাছে, সব কিছু চোখের সামনে একদম ফকফকা। এরবেশী বলা বারণ...।
সেদিন আমি আমার প্রেমিকাকে বললাম আমায় সত্যিই ভালবাস! কেন ভালোবাস? শেষ দু'বছরে প্রেমের এই চতুর্থ অধ্যায়ে এটাই সবচেয়ে বড় সময়ের ইনভেস্টমেন্ট আমার। মানে গোটা দশেক বই, ক্যাডবেরি, সিনেমা, আইসক্রিম খায় না গলায় ব্যাথা আছে, আর প্রেমের অভারঅল অপারেটিং কস্ট সর্বসাকুল্যে হাজার দুয়েক টেনেটুনে। মেয়েরা ভালবাসলে সব মেনে নেয়, তাই আমাদের কপালে প্রেম জোটে। দেখি পাত্তাই দেয়না আমার কথার। কানে মোবাইল ফোনের হেডফোন গুজে দিয়ে চোখ বন্ধ করলো। আবার শুধোলাম, ‘সত্যি বলোনা ভালবাস আমায় ! কেন ভালবাস’ ! কেমন জানি একবার চোখ টানটান করে তাকিয়ে আমার ডান কানে হেডফোন গুজে দিল। আবার চোখ বন্ধ করলো। মুখে বলল, ‘চুপ শোন শুধু, কথা বলোনা...’
ইয়ার্কি পেয়েছে, অনিন্দ্য অনিন্দ্য বলে সকাল সন্ধ্যা কাৎরাচ্ছে আমার সামনে, আর এখন আবার কানেও কালা করে দেয়ার প্রয়াস। কিছুতেই হতে দেব না। আজ জবাব চাই। হেস্তনেস্ত করবোই আজ আমি। রাগে আমি কান থেকে হেড ফোন ছুড়ে ফেলে দিয়ে গাছের পাতা গুনছি। কোন ভ্রূক্ষেপ নেই তার। গাছের গায়ে একপায়ে হেলান দিয়ে থাকতে থাকতে পা ধরে গেছে। সিগারেট শেষ। চোখ আর খোলেনা আমার দু'বছরের প্রেমিকা।
রাগে উল্টোমুখো হয়ে পালাবো ভাবছি বিড়ি টানতে। কারণ মেয়েদের সামনে আর যাই হোক বিড়ি টানা যায়না। পকেট ফুটো ধোসার টাকা মিটিয়ে। চোখ খুলেছেন তিনি কাছে না পেয়ে। মেয়েরা বড্ড বেশী ভরসা করে তাদের সঙ্গীকে। আর তাই বোধহয় মেয়েরাও প্রেমে পড়ে কোন কোন সময়। শেষে পেছন থেকে এসে বলল, এতো রেগে যাও কেন! গানটা শুনেও রেগে গেলে!
- আমি কোন গানটান শুনিনি। আমার মন ভালো নেই। যা বলার তা তো বলেই দিয়েছ, আর গান শুনে কি হবে!
- আরে শোন না, অনিন্দ্য...
- মানে তোমার নতুন প্রেমিক!! বাহ কি করে ! ইঞ্জিনীয়ার না ডাক্তার!
- আরে তোমার প্রিয়...
- হ্যাঁ, তোমার যে প্রিয়, তাকে আমাকেও গিলতে হবে ! কেন ! হোম টোম নাকি তোমার অনিন্দ্য!
- আরে শোন না... বলা বারন... অনিন্দ্য'র গানটা শুনতে বলেছিলাম। মেয়েরা সব কথা মুখে বলতে পারেনা।
- হুম, তা বলবে তো তুমি অনিন্দ্যর গানে আমার কথার উত্তর দিচ্ছ। বেবাট টাইপ হয়ে গেলাম। হাসলে আমায় সত্যিই বেবাট টাইপ লাগে। আমি জানি । ইশ, দুমদাম মন খারাপ করে ফেললাম। তবে এটাও ঠিক, শেষ তিন অধ্যায়ে দেখেছি,
চলে যাওয়ার সময় ওড়নায় নখ প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে বেশ বলে যেতে পারে মুখেই, বিদায় বন্ধু, ভাগ্যে নেই, তাই তুমি নেই। কি করবো
তুমি তো একটা কিছুই করে উঠতে পারোনি এখনও ।
না বলে এসেছি, বাড়িতে প্রচুর মানুষ। রেন কোট টাইপ ভাগ্য আমার। ভাবি, এই অধ্যায় যদি ভাগ্যে থাকতো, কি যে হতো আমার অবস্থা ! এরচেয়ে অনেক ভালো আমার এই চার অধ্যায়। এই নিয়ে দশবার গেছেন উনি, আর আজ নিয়ে এগারো বার আবার এন্ট্রি নিয়েছেন। উনি এলেই আমি শেষের কবিতার পাতা চোখে দেখি। চলে গেলে পড়ি জীবনানন্দ।
আমি যে একটু পাগল টাইপের তা আমি জানি। মানে কবি কবি ভাব, কিন্তু কবিতার অভাব। কস্মিনকালেও একটি কবিতা লিখতে পারিনি। তবে সে চলে গেলে কাব্য ভর করে মাথায়। একবার লিখেছিলাম । ক্লাশ টেন এ লিখেছিলাম -
'মাথার উপর নীল আকাশ,
পায়ের
নিচে দূর্বাঘাস,
তোমার
আমার পেছনে বরাক বাঁশ।'
মানে, বরাক বাশের উপর বসে ছিল মিষ্টি দিদিমণি আর নতুন স্যার। এই স্যারকে দেখলেই আমার পিত্তি জ্বলে যায়। মিষ্টি দিদিমণিকে দেখলেই, আমার মন ভালো হয়ে যেত। মোটেই 'ম্যারা নাম জোঁকার টাইপের' গল্প নয়। সবকিছুতে ঐ গন্ধ না খোঁজাই ভালো ! কি সুন্দর করে হাসতেন, নরম করে কথা বলতেন। ইস্কুলের রবীন্দ্রজয়ন্তীতে দিদিমণির পাশে দাড়িয়ে গান গাইতাম। কি মিষ্টি গন্ধ পেতাম। সারাটা মাস রিহার্সাল চলতো, আমরা সবাই রাজা...
আমি ভাবতাম একবার যদি দিদিমণির হাতটা ছুঁতে পারতাম! তাই লিখে ফেলেছিলাম ঐ কাব্য। আমার এই কবিতা পড়ে আর মুখ দর্শন করেননি আমার। আমায় দেখলেই ট্যারা করে তাকাতেন। সেই প্রথম ধাক্কা। আমার প্রেমের চার অধ্যায়ের মধ্যে অবশ্য এই দিদিমণিকে আমি ধরি না হাতে। এরপর থেকে আর সেই ছন্দের চেষ্টা করিনি। বাকিটা বলা বারন। কি করে বুঝবো বল ? তুমি আমার হৃদয়ে সঙ্গীত ফিরিয়ে দিচ্ছ ! দেখুন এই আমার বদ অভ্যাস। সুযোগ পেলেই কাব্য করি। প্রেক্টিকেল হতে হবে, জানি কন্যা, দু'চার দিন বাদে কোন ডাক্তারের বুক জ্বালাইবা তুমি সক্কাল সক্কাল। বিড়ির মতো সেন্টু সেন্টু মুখ করে।
বিড়ি নিয়ে দৌড়াচ্ছি
নদী পারের দিকে (হাসির কোন কারণ নাই, এই দেশের ষাট শতাংশ মানুষ এখনও ট্রেন লাইন, ফাঁকা মাঠ আর নদীর পাড়ে প্রাকৃতিক কর্ম সারেন)। এরপরেও 'সাইনিং ইন্ডিয়া' ডুবে না। আমি তাই আপাতত ভাবছি কম পয়সায় পাকা ল্যাট্রিন বানানোর ব্যাবসা করবো। ব্যাঙ্কে গিয়েছিলাম লোন চাইতে। দেখে বলে দিল ব্যাঙ্ক ম্যানেজার, ‘ওইটা বাকিতে হইব না’। কষ্ট হবে বুঝলেন ! কোষ্ঠকাঠিন্য ব্যাবসায় ওয়ালমার্ট লগ্নী করবে না। কাগজের তিন নম্বর পেইজটা পড়বেন। বুঝলেন ! ব্যাবসার পাতা ।
আপানাদের মতো তরুণ ব্যাবসায়ীদের জন্য কতো বড় বাজার ! ব্যাঙ্ক গ্যারান্টি চায়। কিছু গ্যারান্টি দিতে পারবেন !
- আপনি কি বিবাহিত ! আমার এই প্রশ্নে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন ব্যাঙ্ক ম্যানেজার।
- হুম বিবাহিত।
- মেয়ে আছে ! কোন কলেজে পড়ে !
- সুরেন্দ্রনাথে ! ইংলিশ নিয়ে পড়ছে !
- হ্যাঁ তো কেন ! আমার মেয়েকে চেনেন আপনি !
- হ্যাঁ আমার প্রেমিকা ।
আপনি উনার বাবা। মানে আমার পরবর্তী শ্বশুর।
চিৎকার করছেন ভদ্রলোক। অবস্থা ভালো নয় বুঝতে পারছি। চা তখনো শেষ হয়নি। এক চুমুকে শেষ করলাম। নিজের মেয়ের কথা অধস্থনদের কাছে ফলাও করে বলবে না জানি। চেয়ার থেকে উঠে গিয়েও আবার বসে পড়েছেন। খুব শান্ত হয়ে বললাম, ‘আমার সঙ্গে ক্লাশ টুয়েলভ থেকে প্রেম করছে ।
লাস্ট টু ইয়ারে আমার সব ইনভেস্টমেন্ট আপনার ঐ মেয়ের কাছে । সেই আমার সিকিউরিটি আপাতত। চলবে’ ?
ভদ্রলোক ঘামছেন । বললেন,
‘তুমি বাড়ি এসো, পরে কথা হবে। গার্ড...’
- লোনটা দেবেন, সিকিউরিটি আমার আপনার ঘরে গচ্ছিত। সত্যি বলছি রিটার্ন পাবেই ব্যাঙ্ক
- তুমি যাবে !
‘না’ স্পষ্ট জানিয়ে দিলাম। ‘লোনটা না পেলে আমি যাবো না। আর বের করে দিলে সবাইকে জানিয়ে যাবো, আপনি আমার পরবর্তী হবু শ্বশুর হয়েও আমাকে বিশ্বাস করেন না। আপনার মেয়ের কাছে আমার সব জমানো গচ্ছিত। এখন সে অনুপমের সঙ্গে প্রেম করছে ।
আমায় ছেড়ে দিয়েছে ।
বলেছে আমি নাকি কোন কাজের না। প্রমাণ আছে
সব। চিঠি, ইনবক্সে মেসেজ, ফোন কল, ছবি...’।
- তুমি কি পাগল ! ইয়ার্কি মারছো সাত সক্কাল বেলা ।
কত ইনভেস্ট করেছো টু ইয়ার্সে !
- মানে এমাউন্ট টা কতো ! কেন দিয়েছ !
- টু ইয়ার্সে চারবার। তেত্রিশ লক্ষ ইন্টু চার, মানে ওয়ান ক্রোড়ের কাছাকাছি।
ভদ্রলোকের কপাল থেকে ঘাম এবার দুম করে ঝরে পড়ল আমার প্রজেক্টের উপর। ঘামছে, শুধু ঘামছে ।
- ইয়ার্কি পেয়েছ ! চুরি করো নাকি !
- হ্যাঁ চুরি করেই, আপনার ফ্ল্যাটে দু'বার। আর বন্ধুর ঘরে দু'বার।
- মানে ! আমার ঘরে তো চুরি হয়নি কোনদিন ! তুমি কি পাগল ! উন্মাদ ! যাও বেরিয়ে যাও এখুনি।
- থাক সেই হিসেব করবেন না । লোনটা
সেংশান করে দিন । চলে যাচ্ছি ।
- কোনমতেই না ।
- ঠিক আছে । তাহলে ডাকাতিটা আজ সেরেই ফেলি বলুন !
- মানে ? কি ডাকাতি । ভয় দেখাচ্ছ ! গার্ড...
- মানে আজ আমরা পালাবো। আমি আর আপনার মেয়ে ।
আমার শেষ দুবছরের ইনভেস্টমেন্ট আর আপনার একুশ বছরের...।
- আমি পুলিশে জানাচ্ছি ।
- জানান, আমরা লিগ্যাল মেরেজ সেরে নিয়েছি। শুধু টাকা নেই তাই লোন চাইতে এসেছি । দেখুন এটা একটা ব্যাবসা শুধু নয়, মানুষের জন্যেও কাজ হবে এতে। কত মানুষ বাঁচবে বলুন। এই যেখানে সেখানে...
- থাক। আর বলতে হবে না । আমার একুশ বছরের ইনভেস্টমেন্ট চুরি করেছ । লোনটা
হয়ে যাবে। নেক্সট উইকে এসে একবার দেখা করো। এখানে নয় বাড়িতে আসবে । তোমার বাবাকে নিয়ে আসবে সঙ্গে।
- এই রে। কেন বাবাকে দিয়ে কি হবে?
- আমার মেয়ের গ্যারেন্টার।
ব্যাঙ্ক থেকে যখন বেরিয়ে
এলাম, তখন দেখি রাইজিং ইন্ডিয়ার বিজ্ঞাপনটা সত্যিই ঝকঝক করছে। ও দাঁড়িয়েছিল নিচেই। ভয়ে চোখমুখ ফ্যাকাসে। জানতে চাইলো কি বলল বাবা !
বলা
বারণ... ইন্ডিয়া শাইনিং ।
কিন্তু আকাশে মেঘ আজও । জানিনা কপালে কি আছে। মেঘ না রোদ্দুর ! যাই থাক থাক, তুই থাক, শূন্য এ বুকে থেকেই যা তুই ।