দিদি
দিদি বাবার সবচেয়ে আদরের ছিল । হয়তো প্রথম সন্তান তাই । মার কথা অনুযায়ী দিদি যাই করুক বাবা কখনই দিদির দোষ দেখতোনা । এই কথা বলে মা বিরক্তি প্রকাশ করতো ।
খেয়ালি ছিল খুব ।
হরদম জিনিষ পত্র হারাত ।
মার বিয়ের সময়
মামারবাড়ী থেকে
অনেক রকম গরম জামা
দিয়েছিল । সুন্দর সুন্দর জ্যাকেট ছিল । কোট ছিল । আমরাও
বড় হয়ে পরেছি ।এর মধ্যে
সবচাইতে
সুন্দর আর দামী
ছিল একটা
ফার কোট ।
মা আবার দিদির
বিয়েতে
ওটা দিদিকে
দিয়েছিল ।
দিদি কাঁধের ওপর সেটা
নিয়ে কোথাও গিয়েছিল , সেটা আর ফিরে এলনা । পড়ে গিয়েও থাকতে পারে । কেউ তুলেও নিতে পারে ।
মা বকাবকি
করাতে
বাবা
বলতে লাগলো “আহা , বোকনা বোকনা ।
আমি আবার করিয়ে দেব ।” এসব
কথা মার কাছে শোনা । এই
রকম আরও ছিল ।
খোলা
দেরাজে
গয়না রেখে
চলে এলো ভাগলপুর ।
বেশ কিছুদিন পর হয়তো
মনে পড়লো । বাড়ীর কারো চোখে পড়লে তুলে রাখতেন ,অনেক সময় হারা ।
ভুলো,
অন্যমনস্ক ।
শুনেছি , খুব
ছোটবেলা
থেকেই
বই ভালবাসতো
খুব ।
যখন
খুব ছোট ছিল, হয়তো
বছর
দুই বয়স
হবে , বাড়ীর
বড়
দাদা
দিদিদের
পড়ানোর
জন্যে
একজন
মাস্টার মশাই
আসতেন । উনি
যতক্ষন
পড়াতেন
সমানে
বসে থাকতো
ওখানে । নিয়ে আসা যেতনা
।
ছোট থেকে একটু বেশী
সাহসী । নিজের খেয়ালে চলার স্বভাব ছিল , যা নিজে ঠিক মনে করতো
তাই করতো ।
সাহসের কথা বলছিলাম ।
একবার
স্কুলে পড়ার
সময় প্রেয়ারের পর একজন
টিচার বললেন “তুমি প্রেয়ারের সময় চোখ বন্ধ করনি কেন ?” দিদি উত্তর দিয়েছিল
“আপনি কি করে জানলেন
মিস্ , আপনিও কি চোখ খুলে রেখেছিলেন ?” এরপরে টিচারের
উত্তরটা
ছিল খুবই
হাস্যকর ।
উনি বলেছিলেন
ঈশ্বর ওঁকে
জানিয়েছেন ।
আমাদের বাড়ীর একটা বেশ ভালো নিয়ম ছিল ।
প্রসব হওয়ার পর
প্রসূতিকে সন্তান ও
বাড়ীর দুএকজন মহিলা ও কাজের লোক দিয়ে আশপাশের কোন স্বাস্থ্যকর যায়গায় পাঠিয়ে দেওয়া হতো বিশ্রাম আর হাওয়া বদলের জন্যে । মাস দুই তিনের জন্যে । বাড়ীর একজন পুরুষ এবং একজন বয়স্ক মহিলা থাকতেন । এরমধ্যে
সুবিধে অসুবিধে অনুযায়ী
কেউ চলে আসতেন
তার জায়গায় অন্য কেউ
যেতেন । বয়স্ক মহিলাদের মধ্যে সাধারণতঃ পিসিমা বা বড়মাসীমা থাকতো ।
এখানে বড়মাসীমার কথা একটু
বলি ।
বড়মাসীমা মায়েদের
সবচেয়ে বড়দিদি । ১৮ বছর বয়েসে একটি পুত্র সন্তান কোলে
করে বিধবা হয়ে
বাপের বাড়ী
ফিরে এসেছিল । তারপর আস্তে আস্তে
সংসারের
সমস্ত
ভার
নিজের
হাতে
তুলে নিয়েছিল ।
বড়মাসীমা ছাড়া সংসার
অচল । সেই ছেলে আমাদের কমলুদার বয়স যখন ২১ কলকাতায় এসেছিল চাকরীর ইন্টারভ্যু দিতে। আর ফিরলনা
।দুদিনের জ্বরে
চলে গেল ।
আমাদের
শোবার
ঘরের
দেওয়ালে
কমলুদার
একটা ছবি টাঙানো থাকতো
। খুব ভালো দেখতে ছিল । ঘাড়টা একটু বাঁদিকে বেঁকিয়ে হাসছে । ডানদিকের মাড়িতে একটা গজদাঁত উঁকি মারছে । কি প্রানবন্ত ছবি !
বড়মাসীমা কিছুদিন পরে শোকতাপ নিজের মধ্যে আড়াল করে আবার সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল । বোনেদের দেখাশোনা করা । তাদের সংসারের প্রয়োজনে কাজেলাগা এছাড়া মা,দাদার
সংসার
তো
ছিলই ।
সমস্ত
কিছু গোছগাছ
করে দিয়ে জীবনের
একটা ইচ্ছে
মেটাতে
তীর্থ
করতে গেল । কাশী , বৃন্দাবন , মথুরা ।
দলের সঙ্গে ।
ঈশ্বরের
বোধহয়
এতো শোকাতাপা
মানুষের এতো স্পর্ধা সহ্য হলনা । পথে কলেরা হয়ে কোন এক স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে মারা গেল ।
যাইহোক , দিদির কথা বলতে গিয়ে
এতো কথা । তো একবার আমার ছোড়দির জন্মের পর
মাকে নিয়ে
হাওয়া বদলের জন্যে
যাওয়া হয়েছে
, কহলগাঁও
বলে একটা জায়গায় ।
যে বাড়ীতে ওঠা হয়েছে
সেটাতে একটা বড় বাগান আর সেই বাগানে আবার একটা কুঁয়ো । দিদি ভীষণ দুরন্ত । একদিন দুপুরে
অনেকক্ষণ
দিদিকে
দেখতেনা পেয়ে
বড়মাসীমা
খুঁজতে
খুঁজতে
বাগানে
এসে
দেখে
দিদি
কুঁয়োর
একদম
ধারে
শুয়ে আছে ।
বড়মাসীমাকে
দেখেই
গান গেয়ে উঠলো “জানি তুমি আসবে প্রিয় /
গভীর যখন হবে রাতি ।।” আট, ন’ বছরের বোনঝির মুখে এই গান শুনে বড়মাসীমা তো রেগে কাঁই । হাত ধরে
হিড়হিড়
করে টেনে নিয়ে
মার কাছে হাজির ।
“দ্যাখ , বাপের আদরে কি সব গান
শিখেছে !”
মা তো বুঝলো
একেবারে না বুঝে গেয়েছে
গায়িকা । তবু একটু বকাবকি করলো মাসিমাকে শান্ত করতে ।
আমাদের মায়ের ধারনা ছিল
আমাদের বাড়ীতে মেয়েদের
বড় বেশী
আদর দিয়ে বড় করা হয় ।
কোন কাজকর্ম
শেখানো
হয়না ।
কোন ডিসিপ্লিনের
ভেতর
থাকতে
শেখেনা তারা ।
এই চিন্তা কিছুটা
যথার্থ ছিল । সত্যি
করেই
কিছু কিছু
সংস্কার
আর নিয়ম
মেনে চলা ছাড়া
মেয়ে আর
ছেলেতে
কোন
তফাৎ
ছিলনা
আমাদের
বাড়ীতে ।
মেয়েরা
সবাই
পড়াশোনা করতো ,
বোনা, সেলাই , খেলা ধুলো করতো । কাউকে কোনদিন সংসারের কাজ করতে দেখিনি । আমরাও করিনি সেভাবে ।
এটা ভালো না মন্দ জানিনা । তবে বিয়ের পর
পিসিমাকে
দেখেছি
দিদিদের
মিষ্টি
তৈরি
করতে
শেখাতে । অনান্য
সাংসারিক
কাজ শেখাতে ।
বাচ্চা জন্মানোর
পর
যত্ন
করতে, স্নান
করাতে শেখাতে ।
পিসিমার আঁতুরের শিশুকে
স্নান করানো ছিল দেখার
মতো । হাঁটু পর্যন্ত থান গুটিয়ে মোটা মোটা পায়ের ওপর বাচ্চাটাকে কখনও চিত করে কখনও উপুড় করে শুইয়ে , কখনও বা অনায়াসে
এক হাতের
তেলোর
ওপর
বাচ্চাটাকে
নিয়ে যেন
একটা
ন্যাকড়ার
পুতুলের
মতো করে নাড়াচাড়া
করতো । স্নান
করাতো । বাচ্চাটাও
বেশ
আরামে
থাকতো
বলেই মনে হতো
।
যাইহোক্ , এই চিন্তা থেকে মা দিদিকে মামারবাড়ী পাঠিয়ে দিল । যাতে দিদিমা আর মামীমার ট্রেনিং এ থেকে ঠিকমতো তৈরি হয় । দিদি ওখানে গিয়ে স্কুলে ভর্তি
হোল ।
কিছুদিন পর দেখা গেল একটি বাড়ীর সামনে এক ভদ্রলোক ও যখন স্কুলে যায় রোজই দাঁড়িয়ে থাকেন । কয়েকদিন পর উনি এগিয়ে এসে দিদির সঙ্গে কথা বললেন । কোথায় থাকে , বাবার নাম কি ইত্যাদি । মামারবাড়ীর ঠিকানা ভালো করে বুঝে নিলেন
উনি ।
সেদিন
স্কুল থেকে বাড়ী
এসে
দিদি দেখে ,
ভদ্রলোক বৈঠকখানায় বসে মামাবাবুর সঙ্গে কথা বলছে ন। দিদিকে ডেকে দুএকটি কথা বলে, উনি ওঁর বড়ছেলের সঙ্গে দিদির বিয়ের প্রস্তাব করলেন । জামাইবাবু ডাক্তারি
পড়ছেন তখন ।
জামাইবাবুর বাবা
বার্মায়
ওকালতি
করতেন । দেশে ফিরে
এসেছেন । কলকাতায় বাড়ী কেনার ব্যবস্থা হচ্ছে । তার আগে চন্দননগরে শ্বশুরবাড়ীতে
কিছুদিন আছেন । ভাগলপুরের
ঠিকানায় চিঠি গেল ।
তারপর যাযা করনীয় করা হোল । মার প্রবল আপত্তিতে বড়রা কান দিলনা । হয়ে গেল বিয়ে ধূমধাম করে । দিদির বয়স
তখন ১৪ ।
কয়েক বছর পর দিদি একবছর
ভাগলপুরে
থেকে
ম্যাট্রিক
দিয়ে ফিরে গেল
কলকাতায় । যেদিন
ম্যাট্রিকের
রেসাল্ট
বেরল , তখন
গেজেট
বেরত । আমাদের জ্যাঠতুত
দাদা কাতুদা স্টেশন থেকে রেসাল্ট দেখে এসে খুব ভোরে আমাদের ঘুম ভাঙালো । ফার্স্ট ডিভিসনে পাস করেছে দিদি । ফার্স্ট ডিভিসন পাওয়া খুব সহজ ছিলনা। বিশেষ করে এতো কিছুর মধ্যে দিয়ে গিয়েছিল দিদি । সকলে
খুশী হোল খুব ।
পাস করে কলেজে ভর্তি
হোল । পরে নামকরা
ইংরেজি মিডিয়াম
স্কুলে
পড়িয়েওছিল ।
কখনও দিদিকে দেখেছি
একদম
সংসারে ডুবে
থাকতে। কখনও সংসার সম্পর্কে একবারে উদাসীন ।
কখনও
সদ্যপরিচিত
কারো
বোনের
বিয়েতে
দরাজ হাতে
সাহায্য করতে দেখেছি কখনও ছোট্ট কোন বিষয়ে এমন একটা আচরণ করলো , মনে হোল এই কি সেই দিদি!
আমাদের
গান শেখাত ,যখন ভাগলপুরে
থাকতো । যত গান শিখেছি
সব
দিদির কাছে ।
সারাবিকেল
ছাদে
বসে
শেখাতো গান ।
কখনও
দাদা
তবলায় ঠেকা দিত। ছোটথেকে দেখে এসেছি আমাদের ফ্রকের
ডিজাইন
দিদি করতো । মনে আছে
বাবা
চলে যাওয়ার আগে
আমাদের দুই
বোনের জন্যে
ফ্রকের
কাপড় কিনে রেখে
গিয়েছিল ।
করিয়ে দেওয়ার সময়
পায়নি ।
দিদি
যখন এলো কলকাতা থেকে,
ফ্রক গুলো তৈরি করালো নিজের ডিজাইনে । ঐ জামাগুলো অনেক দিন রাখাছিল । আমাদের ছোট হয়ে যাওয়ার পরও । আমাদের জন্যে বাবার হাতে করে আনা শেষ উপহার ।
তারপর থেকে
সবসময়ই
দিদি
নিজে আমাদের
ফ্রক তৈরি করাত ।
বাড়ীতে খলিফা আসতো । তার আগে খাতা পেন্সিল নিয়ে বসতো । ডিজাইন করতো । কতো রকম ফ্রক যে পরেছি । প্রত্যেকটাই হতো দারুন । একদম নতুন ধরনের । কেউ
যদি কলকাতা থেকে আসতো
। অনেক কিছু পাঠাতো । বাড়ীতে তৈরী কেক্।
মরটন কোম্পানির
নীল রঙের
লজেন্সের
টিনের গোল
কৌটো ওপরে
মা ,মেয়ের
ছবি । সেই কৌটো ভরে ।
গল্পের বই । সোয়েটার । আমার ছোড়দির রঙ একটু ময়লা ছিল । ওর জন্যে
দিদির
ভালবাসা
ছিল
খুব বেশী ।
রঙ ফর্সা
করার জন্যে
কতো কিছু
পাঠাতো ।
হঠাৎ
হয়তো
এক সকালে
উঠে
দেখলাম
দিদি হাজির ।
আগে থেকে খবর
দেওয়া নেই ।
ছেলেমেয়েরা
সঙ্গে
নেই । হারমনিয়ামের
বাক্স
আর
একটা
ব্যাগ নিয়ে
চলে এলো । আমাদের
কথা খুব মনে পড়ছিল তাই চলে এসেছে ।
ছেলেমেয়েরা ভালোই থাকতো অবশ্য ওদের ঠাকুমা , পিসিদের কাছে । মা বকাবকি করলো এভাবে আসাতে । গম্ভীর হয়ে রইলো দিদি ।
কোন সন্দেহ নেই দিদির
স্বভাব আর পাঁচজনের থেকে একটু অন্যরকম ছিল । কোন কিছু রাখঢাক করার ব্যপারই ছিলনা । যা নিজের ঠিক মনে হতো তা আর সকলের পছন্দ না হলেও ওর কোন পরোয়া ছিলনা । আমদেরও ওর অনেক আচরণ পছন্দ হয়নি । তাতে ওর কিছু যেত আসতনা যা করতো জোরের সঙ্গে । ভয় ডর ছিলনা বলেই হয় । বড় হয়ে অনেক সময়
ওর আচরণের জন্যে
প্রশ্ন
করেছি ।
ওযা বিশ্বাস করে উত্তর দিয়েছে ।
যখন
সংসার
করতো মন দিয়ে ।
সুন্দর করে রান্না করতো
। মাথা থেকে বার করে নতুন রকম । ঘর সাজাত খুব সুন্দর করে । বাতিল জিনিষ
দিয়ে
ঘর সাজানোর
জিনিষ বানাত । মাটি
দিয়ে পুতুল গড়তো । হয়তো কারো বিয়েতে গেছে তত্ত্ব যাবে ।
দিদি বসে গেল।
প্রত্যেক
ট্রে তে একটা করে
চার লাইনের ছড়া লিখে
সঙ্গে
প্যাস্টেল বা ক্রেয়ন
দিয়ে ছবি এঁকে আলপিন দিয়ে আটকে দিল ।
পিঁড়িতে আলপনা দিয়েদিল নিখুঁত করে । তত্ত্বের লিস্ট করলো অভিনব একদম ।এক
বিলেত ফেরত
মাসতুতো দেওর ছিল দিদির
গুণগ্রাহী ।
কতযে ছবি
তুলেছিল
।
সব ছবির
সঙ্গে ক্যাপশন থাকতো
মানানসই ।
‘মন মোর মেঘের সঙ্গী’ , কোথাও আমার হারিয়ে
যাওয়ার নেই মানা পাগলা হাওয়ার বাদলদিনে ।‘’ এমনই সব মানানসই ক্যাপশন । দিদি যেটা পারতোনা সেটা অভিনয় । জীবনের রঙ্গমঞ্চতেও নয় সাজানো
রঙ্গমঞ্চতেও নয়
। যাচ্ছেতাই অভিনয় করতো ।
দিদির শ্বশুরবাড়িতে
আমরা খুব আনন্দ করেছি ।
জামাইবাবুর
বড়দির
দুই মেয়ে আমার কাছাকাছি
বয়স ।
ওদের সঙ্গে খুব ভাব ছিল
। ওরা থাকতো নবদ্বীপে । ওখানেও বেড়াতে যেতাম ।
আর আমাদের জামাইবাবুর
আমাদের সম্পর্কে
বক্তব্য ছিল
“ওরা আমার সন্তানের মতো।”
যখন দিদির বিয়ে হয় , আমি দু’ বছরের ছিলাম ।
লিখতে লিখতে মনে হচ্ছে দিদিকে নিয়ে লেখা
ফুরবেনা ।
কি জানি
কেমন হোল লেখা । একটা
ঘটনা লিখে ইতি করবো ।
কোন একসময় ভাগলপুরে
আমাদের শোবার
ঘরের
মেঝেতে
বসে কিছু করছিল দিদি ।
আমি কাছে বসে । একটা কালো পিঁপড়ে ওখান দিয়ে যাচ্ছিল , আমার কি মনে হোল ওটাকে আঙুলের চাপে মেরে ফেললাম । দিদি মুখ
তুলে আমার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো “মারলি কেন ওকে , কি করেছিল ? ছোট বলে তোর সাত খুন মাফ , না ?’
দিদি
কোনদিনও
বকেনি আগে । আমি একটু
হকচকিয়ে গিয়ে বললাম “হুঁ , মাফই তো !” দিদি বলেছিল " ঠিক আছে মার তুই আরও ছটা , তারপর দেখছি মাফ কিনা "। শুধু
কৌতূহলের বশে অনেক
খুঁজেছিলাম আরও ছ’টা পিঁপড়ে । পাইনি ।
( দিদি একটা প্রশ্ন
মনে রয়েই গেছে,
যদি
সাতটাকেই
মারতাম । কি করতে তুমি
। বড্ড জানতে ইচ্ছে করে! )!
মনে পড়ে
দিদি
চুল বেঁধে দিচ্ছে , বিয়েবাড়ি
যাবার
সময় সাজিয়ে দিচ্ছে , শাড়ী
পরিয়ে
দিচ্ছে ।
২০০১
সালের এক এপ্রিল মাসের
সকালে
দিদির
ঘরে
এসে দেখা গেল । পাখী উড়ে
গেছে
শূন্য
খাঁচাটা পড়ে আছে । তেমন করেই গেছে যেমনটা ওকে মানায় । কাউকে
ভোগায়নি
নিজেও
ভোগেনি
তেমন ।
শিশুতোষ গল্প
ওয়াসিকুজ্জামান অনি
তোমরা কি ইঁদুরগঞ্জের নাম শুনেছো ? ইদুরগঞ্জ শহরের এক পাশে থাকতো ছোট্ট
ইঁদুর কুটুস। তার বাড়িতে তার বাবা মা আর দুই ভাই বোন ছিলো। বড় ভাইয়ের নাম মুটুস আর
বোনের নাম পুটুস। কুটুস ছিলো সবার ছোট আর খুব বুদ্ধিমান। সে সব সব ধাঁধার উত্তর
দিয়ে দিতো খুব সহজেই। আর পড়শোনাতে ছিলো তুখোড়। ক্লাসে সব সময় ফার্স্ট। তার গুনের
শেষ ছিলোনা। কিন্তু তার একটা মারাত্মক বদগুণও ছিলো। সে ছিলো প্রচন্ড রাগী। একটুতেই
যেত রেগে। আর রেগে গেলে তার হিতাহিত জ্ঞ্যান থাকতনা । সে হয় মারামারি করতো না হলে জিনিষপত্র ভাংতো। এ নিয়ে তাকে সব
সময় বকা খেতে হত।
তার এ রাগের কথা খুব ভালো জানতো তার দুই
ভাই বোন মুটুস আর পুটুস। তারা এ জন্য তাকে সব সময় ক্ষেপাত। কুটুস যখন পড়তে বসে
তারা তখন পেছন থেকে এসে তার কান ধরে টান দিত। নাহলে তার চুল ধরে টানত। এমন করলে
কুটুস খুব রেগে যেত আর তারা তাতে মজা পেয়ে খুব হাসতো। তারা ঠি বুঝতে পারতো কুটুস
কখন রেগে যায়। রেগে গেলে সে চুপ হয়ে যেত আর চোখ বড় বড় করে তাকাত। তার একটু পরেই
ঘটতো রাগের বিস্ফোরণ। তখন সে রেগে মেগে তার ভাই বোনকে মারতে যেত। সাথে সাথেই মুটুস
আর পুটুস এক দৌড়ে চলে যেত তাদের মায়ের বা বাবার সামনে। ব্যাস আর যায় কোথা বড় ভাই
বোনকে মারার অপরাধে তাকে অনেক শাস্তি পেতে হত। রেগে গেলে সে খারাপ ব্যবহার করতো
সবার সাথে তাই পেতে হত অনেক শাস্তি। কুটুসের স্কুলের সহপাঠীরাও এ ব্যাপারে খুব মজা
পেত আর যখন তখন কুটুসকে রাগিয়ে দিত। আর কুটুস রাগলে যা হয় আর কি, তাদের সাথেও লাগিয়ে দিত মারামারি বা
ঝগড়া। ব্যাস আর যায় কোথা টিচাররা দিয়ে দিত তাকে শাস্তি না হলে বিশাল হোমোয়ার্ক।
এমনভাবে চলতে থাকায় কুটুস পড়ল মহা চিন্তায়।
একদিন এমনি এক ঘটনার পর অনেক শাস্তি হলো কুটুসের। শাস্তি শেষে কুটুস বাড়ী ফিরছিলো
বনের ধারের রাস্তা দিয়ে । তার খুব কান্না
পাচ্ছিলো । সে তখন একটা
বিশাল গাছের নিচে বসে একা একা কাঁদতে লাগল । সেই গাছে থাকতো
প্রকান্ড এক বৃদ্ধ প্যাঁচা । পাখী সনাজে তার খুব নাম ছিল জ্ঞ্যানের জন্য। কান্না
শুনে সেই প্যাঁচাটা তার বাসা থেকে বেরিয়ে এসে গাছের ডালে বসে নিচে তাকালো । তাকিয়ে
দেখে ছোট্ট কুটুস বসে কাঁদছে। তার কান্না দেখে খুব মায়া লাগল প্যাঁচাটার। সে
কুটুসকে শুধালো কি হয়েছে তোমার ? কাদছো কেন এমন
করে ?
কুটুস বলল - আমার রাগ বেশী, আমি একটুতেই রেগে যাই । এ নিয়ে সবাই আমাকে খ্যাপায় । আর আমি ক্ষেপে গেলে তাদের মারতে যাই তখন বড়রা আমাকে খারাপ বলে
আর আমি শাস্তি পাই অনেক। তখন সবাই আমার দুরবস্থা দেখে হাসে ।
প্যাঁচা যে ছিল জ্ঞ্যানি সে শুনে মুচকি
হেসে বলল - তোমার সমস্যা আমি বুঝতে পেরেছি। দেখো রাগ করে কোন কিছুর
সমাধান হয়না। রেগে গেলে তুমি
ভুল করবে। আর তখন সবাই তোমাকে অপছন্দ করবে। কেউ তোমার সাথে খেলবেনা । বড়রা তোমাকে শাস্তি দেবে।
কুটুস তখন
প্যাচাকে বল্লঃ তাহলে আমি কি করব ?
প্যাঁচা বল্লঃ
দেখো আমার অনেক বয়েস হয়েছে । তাই আমার
অভিজ্ঞতা বেশী । তোমাকে একটা কাজ
যদি দেই করতে পারবে ?
কুটুস বললঃ আমার
যদি ভালো হয় নিশ্চয়ই করবো ।
প্যাঁচা তখন তাকে একটা চিকন সুই আর সুতো দিয়ে বলল তুমি কি
সুইয়ের ভেতর এ সুতোটা পরাতে পারবে। কুটুস ভাবলো এ আর এমন কি কাজ সে তাড়াহুড়ো করে
সুতোটা সুই এ লাগাতে গেলো। কিন্তু যতবারি লাগাতে যায় সে কোন ভাবেই পারছিলনা । অনেক অনেক বার চেষ্টা করে না পেরে তার খুব রাগ হলো, সে ছুড়ে ফেলে দিলো সুতো আর সুঁই । তার আবার কান্না পেল।
তখন প্যাঁচা
তাকে বলল - দেখো তুমি খুব
তাড়াহুড়ো কর কোন কাজে আর সে জন্য তোমার ভুল হয়। আর এতে তুমি রেগে যাও তাই তুমি এমন
কিছু করে যাতে তোমার উপর সবাই বিরক্ত হয় বা মজা পায় ।
কুটুস তখন একটু
ভাবলো, তারপর প্যাচাকে বলল - তাহলে আমার কি করা উচিত ?
প্যাঁচা তখন বলল তুমি ঠান্ডা মাথায় সুতো আর সুঁইটা হাতে নাও
তারপর সুঁই এর ফুটো টা দেখে খুব সাবধানে আস্তে করে সুতোটা পরিয়ে দাও । দেখবে খুব সহজ লাগবে। তাড়াহুড়ো করলে পারবেনা এবং তোমার রাগ
হলে আর কিছুতেই হবেনা ।
কুটুস তখন প্যাঁচার কথা শুনে আবার সুঁই সুতো হাতে নিয়ে ঠান্ডা
মাথায় চেষ্টা করল । খুব ভালোমত
মনযোগ দিয়ে সে চেষ্টা করল আর আশ্চর্য্য হয়ে দেখলো সে একবারেই এ কাজটা করতে পেরেছে
যা আগে অনেকবার চেষ্টা করেও পারেনি । সাথে সাথেই সে
বুঝতে পারলো যে রেগে গেলে কিছুই হবেনা, সব কিছু করতে
হবে শান্তভাবে চিন্তা করে ।
তখন প্যাঁচা তাকে বললঃ তুমি কি এবার বুঝতে পেরেছো কেন তোমার
দুরবস্থা হয়েছে ?
কুটুস তখন প্যাচাকে ধন্যবাদ দিয়ে বলল-আমি এবার বুঝতে পেরেছি । এখন আর আমার অসুবিধা হবেনা । আমি রাগ না করে সব ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করব ।
কুটুস তখন প্যাঁচার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তার বাড়ী চলে গেল আর
মনে মনে বার বার বলল আজকে থেকে আমি আর রাগ করবোনা,
তাড়াহুড়া করবোনা। সেদিন রাতে সে যখন সে পড়তে বসেছে তখন তার ভাই বোন সেই মুটুস
আর পুটুস আবার তাকে জালাতে এলো। এসে তাকে নানা কথা বলল, তাকে নিয়ে মজা করল কিন্তু কুটুস কোন
কথা বললোনা । যদিও মনে মনে
তার খুব রাগ হচ্ছিলো কিন্তু সে ধিরে ধিরে মন কে বাগে আনলো আর মনে মনে বলল আমি আর
কখোনই রাগ করবোনা। বরং সে তাদের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে একটা হাসি দিল । আর যায় কোথায় কুটুসের এ আচরন দেখে মুটুস আর পুটুসের খুব রাগ
হলো । তারা যে মজার জন্য এসেছিল তা না হওয়ায়
তারাই আজ রেগে মেগে কুটুস কে মারতে এলো । ঠিক সে সময়ে
কুটুসের মা আসলেন সেই ঘরে আর দেখে ফেললেন পুটুস আর মুটুস কিভাবে কুটুস সোনা কে
জালাচ্ছে। ব্যাস এতদিন যে শাস্তি কুটুস পেত সেই শাস্তি বরাদ্দ হলো মুটুস আর
পুটুসের জন্য আর মা কুটুসকে অনেক আদর করলেন। এমনি করে স্কুলেও যারা কুটুসকে জালাতে
এলো বরং তারাই শাস্তি পেলো । কুটুসের আর কোন
সমস্যা থাকলোনা ।
কুটুস খুব করে
সেই প্যাঁচাকে মনে মনে ধন্যবাদ দিলো এবং সারা জীবন এই শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে অনেক
বড় হলো ।